ভারতীয় সংবিধানের অপরিহার্য বৈশিষ্ট্যগুলি আলােচনা করাে | ভারতীয় সংবিধানের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি লেখাে।

ভারতীয় সংবিধানের প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ

পৃথিবীর সব দেশের সংবিধানেরই কিছু নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এই বৈশিষ্ট্যগুলি অনুধাবন করলে এক দেশের সংবিধানের সঙ্গে অন্য দেশের সংবিধানের পার্থক্য বুঝতে পারা যায়। ভারতের সংবিধানের প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি নীচে উল্লেখ করা হল一


[1] পৃথিবীর সর্ববৃহৎ লিখিত সংবিধান: ভারতীয় সংবিধানকে‌ বিশ্বের সর্ববৃহৎ লিখিত সংবিধান বলে আখ্যা দেওয়া হয়। ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি ভারতীয় সংবিধান যখন কার্যকর হয়, সেসময় ৩৯৫টি ধারা এবং ৮টি তপশিল নিয়ে ভারতীয় সংবিধান রচিত হয়েছিল। বিভিন্ন সময়ে সংবিধান সংশােধনের পর বর্তমানে ভারতীয় সংবিধানের সর্বমােট ধারা প্রায় ৪৫০ এবং তপশিলের সংখ্যা ১২ দাড়িয়েছে।


[2] যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা: ভারতীয় সংবিধানে যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে। ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রে একটি কেন্দ্রীয় সরকার এবং অনেকগুলি রাজ্য সরকারের মধ্যে শাসনক্ষমতা ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে ভারতের অঙ্গরাজ্যগুলির সংখ্যা হল ২৮। ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের শাসনক্ষমতা তিনটি তালিকায় বণ্টিত হয়েছে। এই তালিকা তিনটি হল যথাক্রমে কেন্দ্রীয় তালিকা, রাজ্য তালিকা ও যুগ্ম তালিকা। কেন্দ্রীয় তালিকায় ৯৭টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে, রাজ্য-তালিকায় ৬৩টি বিষয় রাজ্য সরকারগুলির হাতে এবং যুগ্ম-তালিকায় ৫২টি বিষয় যুগ্মভাবে কেন্দ্র ও রাজ্যের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে। উপরি-উক্ত তিনটি তালিকার বাইরে যে সকল অবশিষ্ট ক্ষমতা রয়েছে, সেগুলি কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে।


[3] সংবিধানের প্রাধান্য: ভারতীয় সংবিধানের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল এখানে সংবিধানের প্রাধান্য স্বীকৃত হয়েছে। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন হল সংবিধান। যাবতীয় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা এবং নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের উৎস হল সংবিধান। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারসমূহ, বিচার বিভাগ, আইন বিভাগ এবং দেশের সমস্ত প্রতিষ্ঠান ও নাগরিকবৃন্দ সবাইকে সংবিধানের অধীনে থেকে কাজকর্ম করতে হয়। এজন্য সংবিধান বিরােধী কোনাে আইন, আদেশ বা নির্দেশ জারি হলে সুপ্রিমকোর্টের তা বাতিল করার ক্ষমতা রয়েছে।


[4] সংবিধানের একটি প্রস্তাবনা: ভারতীয় সংবিধানের উল্লেখযােগ্য একটি বৈশিষ্ট্য হল সংবিধানের সঙ্গে একটি প্রস্তাবনার সংযুক্তি। প্রস্তাবনাকে সংবিধানের মুখবন্ধ বলা হয়। এতে সংবিধানের নৈতিক আদর্শ, দর্শন, মূল উদ্দেশ্য প্রভৃতি ব্যক্ত করা হয়েছে।


[5] সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র: সংবিধানের প্রস্তাবনায় ভারতকে একটি সার্বভৌম গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র বলে বর্ণনা করা হয়েছে। সার্বভৌম কথাটির তাৎপর্য হল ভারত অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক উভয় দিক থেকে চূড়ান্ত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধিকারী। ভারতে গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র রয়েছে। জনগণ নিজেরাই ভােট দিয়ে প্রতিনিধি নির্বাচন করে পরােক্ষভাবে সরকার গঠনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। এখানে কোনাে রাজতন্ত্র নেই। প্রস্তাবনায় আরও দুটি তাৎপর্যপূর্ণ শব্দ ১৯৭৬ সালের ৪২তম সংবিধান সংশােধনের মাধ্যমে সংযােজিত হয়। এই সংশােধন অনুসারে ভারতকে একটি সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তােলার কথা ঘােষিত হয়েছে।


[6] সুপরিবর্তনীয় ও দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধানের মিশ্রণ: ভারতের সংবিধান একইসঙ্গে সুপরিবর্তনীয় ও দুষ্পরিবর্তনীয় প্রকৃতির। ভারতীয় সংবিধান সংশােধনের ক্ষেত্রে তিনটি পদ্ধতি রয়েছে। সংবিধানের অন্তর্গত কতকগুলি বিষয়ের পরিবর্তন বা সংশোধন অত্যন্ত সরল প্রকৃতির। সাধারণ আইন পাসের পদ্ধতিতে পার্লামেন্টের উভয়কক্ষে সাধারণত সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থনে সংবিধান সংশোধন করা হয়। অন্যদিকে, সংবিধানের কিছু নির্দিষ্ট অংশের সংশােধনের ক্ষেত্রে পার্লামেন্টের দুটি কক্ষের মােট সদস্যের অর্ধেকের বেশি এবং ভােটদানকারী সদস্যের দুই তৃতীয়াংশের সমর্থনের প্রয়ােজন হয়। এ ছাড়া ভারতীয় সংবিধানে যে অংশটি দুষ্পরিবর্তনীয় প্রকৃতির, বিশেষ পদ্ধতি অনুযায়ী প্রথমে সংশােধনী প্রস্তাবটিকে পার্লামেন্টের উভয়কক্ষের মােট সদস্যদের অধিকাংশ এবং উপস্থিত ও ভােটদানকারী সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশ কর্তৃক সমর্থিত হতে হবে, এরপর প্রস্তাবটিকে অন্তত অর্ধেক রাজ্য আইনসভার অনুমােদন পেতে হবে।


[7] ব্রিটিশ শাসনকাঠামাের প্রভাব: ভারতীয় সংবিধানের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল ব্রিটিশ শাসনকাঠামাের প্রভাব। এই প্রসঙ্গে ১৯০৯, ১৯১৯ এবং ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের কথা উল্লেখ করা যায়। গণপরিষদের সদস্যবৃন্দ স্বাধীন ভারতের সংবিধান রচনার সময় ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের দ্বারা সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়েছিলেন।


[8] নাগরিকদের মৌলিক অধিকার ও মৌলিক কর্তব্য: ভারতীয় সংবিধানের একটি অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হল সংবিধানে নাগরিকদের জন্য মৌলিক অধিকার ও মৌলিক কর্তব্যের অন্তর্ভুক্তি। ভারতীয় সংবিধানে ১২-৩৫ ধারার মধ্যে ৬টি গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এগুলি হল


  • (i) সাম্যের অধিকার,

  • (ii) স্বাধীনতার অধিকার,

  • (iii) শােষণের বিরুদ্ধে অধিকার,

  • (iv) ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার,

  • (v) সংস্কৃতি ও শিক্ষাবিষয়ক অধিকার এবং

  • (vi) শাসনতান্ত্রিক প্রতিবিধানের অধিকার।


ভারতের মূল সংবিধানে কোনাে মৌলিক কর্তব্যের উল্লেখ ছিল না। পরবর্তীকালে ১৯৭৬ সালে ৪২তম সংবিধান সংশােধনের সাহায্যে সংবিধানের চতুর্থ অধ্যায়ে (Part IVA) নাগরিকদের ১০টি মৌলিক কর্তব্য পালনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। সম্প্রতি ২০০২ সালে ৮৬তম সংবিধান সংশােধনের মাধ্যমে ৫১(ক) ধারায় নতুন একটি কর্তব্য সংযােজিত হওয়ায় বর্তমানে মৌলিক কর্তব্যের সংখ্যা বেড়ে দাড়িয়েছে ১১।


[9] রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য নির্দেশমূলক নীতিসমূহ: আয়ারল্যান্ডের সংবিধানের অনুকরণে রাষ্ট্র পরিচালনার নির্দেশমূলক নীতিগুলি ভারতীয় সংবিধানের চতুর্থ অধ্যায়ে ৩৬ থেকে ৫১ ধারার মধ্যে লিপিবদ্ধ হয়েছে। এই নীতিগুলির মধ্যে উল্লেখযােগ্য হল কাজের অধিকার, বার্ধক্য ও বেকার অবস্থায় সরকারি সাহায্য পাওয়ার অধিকার, স্ত্রী-পুরুষ উভয়ের সমান কাজের জন্য সমান মজুরি পাওয়ার অধিকার, ১৪ বছর পর্যন্ত বালক বালিকাদের অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা প্রবর্তনের প্রয়াস গ্রহণ ইত্যাদি।


[10] সর্বজনীন ভােটাধিকার: পৃথিবীর মধ্যে সর্বৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হল ভারতবর্ষ। তাই ভারতের সংবিধানে সর্বজনীন ভােটাধিকারের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে ১৮ বছর বয়সি প্রতিটি ভারতীয় নাগরিকের ভােটদানের অধিকারকে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক অধিকাররূপে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।


[11] সংসদীয় বা মন্ত্রীসভা-শাসিত শাসনব্যবস্থা: ভারতীয় সংবিধানে সংসদীয় শাসনব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে। ব্রিটিশ সংবিধানের অনুকরণে গৃহীত এই ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের সর্বময় কর্তৃত্ব তত্ত্বগতভাবে রাষ্ট্রপতির হাতে থাকলেও কার্যত যাবতীয় ক্ষমতার অধিকারী হল সংসদ বা পার্লামেন্টের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতৃত্বাধীন মন্ত্রীসভা। মন্ত্রীসভাকে তার কাজকর্মের জন্য সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভার নিকট দায়বদ্ধ থাকতে হয়। লােকসভার আস্থা হারালে সমগ্র মন্ত্রীসভাকে পদত্যাগ করতে হয়। ভারতে অঙ্গরাজ্যগুলিতেও সংসদীয় শাসনব্যবস্থা চালু রয়েছে।


[12] স্বাধীন এবং নিরপেক্ষ বিচার বিভাগ: ভারতীয় সংবিধানের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার বিভাগের উপস্থিতি। স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার বিভাগ গড়ে তােলার জন্য সংবিধানে যেসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় লিপিবদ্ধ করা হয়েছে, সেগুলি হল—বিচার বিভাগের রায় নিয়ে কোনাে প্রশ্ন পার্লামেন্টে বা অন্য কোথাও তােলা যায় না, বিচারপতিদের গুরুতর কারণ ছাড়া পদচ্যুত করা যায় না, বিচারপতিদের নিয়ােগ, কার্যকাল ও সুযোগসুবিধাদির উল্লেখ ইত্যাদি।


লিখিত ও অলিখিত সংবিধানের মধ্যে পার্থক্য ব্যাখ্যা করাে।


সুপরিবর্তনীয় সংবিধান বলতে কী বােঝ? সুপরিবর্তনীয় সংবিধানের সুবিধা ও অসুবিধাগুলি আলােচনা করাে।


দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধানের সুবিধা ও অসুবিধাগুলি | দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধানের গুণাগুণ | দুম্পরিবর্তনীয় সংবিধান কাকে বলে? 


সুপরিবর্তনীয় ও দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধানের মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করাে।


ভারতের সংবিধান প্রণয়নের সংক্ষিপ্ত রূপরেখা বিশ্লেষণ করে।


ভারতীয় সংবিধানের দর্শন যেভাবে প্রস্তাবনায় প্রতিফলিত হয়েছে তা আলােচনা করাে।


ভারতীয় সংবিধানের মুখবন্ধ বা প্রস্তাবনার গুরুত্ব ও তাৎপর্য বিশ্লেষণ করাে।