ভারতের সংবিধান প্রণয়নের সংক্ষিপ্ত রূপরেখা বিশ্লেষণ করে।

ভারতের সংবিধান প্রণয়নের সংক্ষিপ্ত রূপরেখা

ভারতের সংবিধান প্রণয়নের বিষয়টি তাৎপর্যপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনারূপে চিহ্নিত হয়ে আছে। স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস পর্যলােচনা করলে দেখা যায় ভারতীয়দের রাজনৈতিক ভাগ্য স্বয়ং ভারতীয়রা নির্ধারণ করবে এ দাবি বহু আগে ১৯২২ সালে গান্ধিজির স্বরাজ-এর মাধ্যমে উত্থাপিত হয়।


জাতীয় কংগ্রেসের দাবি: ভারতীয় স্ট্যাটিউটরি কমিশন (Indian Statutory Commission) এবং গােল টেবিল বৈঠক (Round Table Conference) ব্যর্থ হওয়ার পর ভারতের জনগণ কর্তৃক রচিত এক সংবিধানের দাবি জোরদার হয়ে ওঠে। ১৯৩৫ সালে জাতীয় কংগ্রেস এই দাবি জানায়। ১৯৩৮ সালে পণ্ডিত নেহরু এই অভিমত প্রকাশ করেন যে, প্রাপ্তবয়স্কের ভােটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচিত সংবিধান সভা বা গণপরিষদ কর্তৃক বাইরের হস্তক্ষেপ ছাড়াই স্বাধীন ভারতের সংবিধান রচনা করতে হবে।


গণপরিষদ গঠন: ১৯৩৯ সালে কংগ্রেসের কার্যকরী সমিতির অধিবেশনে স্বাধীন ভারতের সংবিধান রচনার দাবি পুনরায় উত্থাপন করা হয়। এসবের ফলশ্রুতিস্বরূপ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে স্বাধীন ভারতের সংবিধান রচনার জন্য ব্রিটিশ শাসকরা ১৯৪৬ সালের মে মাসে ক্যাবিনেট মিশন প্রেরণ করে। ক্যাবিনেট মিশন অবিভক্ত ভারতের সংবিধান রচনার জন্য একটি গণপরিষদ বা সংবিধান সভা গঠনের প্রস্তাব অনুমােদন করে। ব্রিটিশ শাসকদের পরিকল্পনা অনুসারে ১৯৪৬ সালের জুলাই মাসে অবিভক্ত ভারতের প্রাদেশিক আইনসভার সদস্যদের ভােটে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গণপরিষদ (Constituent Assembly) গঠন করা হয়।


গণপরিষদের উদ্দেশ্য: গণপরিষদের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্যের কথা ঘােষণা করে নেহরু এই অভিমত প্রকাশ করেছিলেন যে, গণপরিষদের প্রধান কাজ হবে একটি নতুন সংবিধানের মাধ্যমে ভারতবর্ষকে স্বাধীন করা।


সংবিধান রচনার পাঁচটি মৌলিক বিষয় বস্তুত পাঁচটি মৌলিক স্বতঃসিদ্ধ বিষয়কে সামনে রেখে ভারতীয় গণপরিষদে সংবিধান রচনার কাজ হাতে নেওয়া হয়। এগুলি হল-

  • (i) যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা (Federalism) 

  • (ii) ধর্মনিরপেক্ষতা (Secularism) 

  • (iii) গণতান্ত্রিক সমাজবাদ (Democratic Socialism) 

  • (iv) সংসদীয় শাসনব্যবস্থা (Parliamen tary Government) এবং 

  • (v) বিচার বিভাগীয় সমীক্ষা বা পর্যালোচনা (Judicial Review)I


গণপরিষদের অধিবেশন: ১৯৪৬ সালের ৯ ডিসেম্বর থেকে ২৩ ডিসেম্বর গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এই অধিবেশনে ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ গণপরিষদের স্থায়ী সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন।


গণপরিষদের দ্বিতীয় অধিবেশন বসে ১৯৪৭ সালের ২১ জানুয়ারি থেকে ২৬ জানুয়ারি পর্যন্ত। এই অধিবেশনে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়| গণপরিষদের তৃতীয় অধিবেশনে (১৯৪৭ সালের ২২ এপ্রিল থেকে ২ মে) কেন্দ্রীয় সংবিধান সম্পর্কিত কমিটি এবং প্রাদেশিক সংবিধান সম্পর্কিত কমিটি গঠিত হয়। গণপরিষদের চতুর্থ অধিবেশনে (১৪ জুলাই থেকে ৩১ জুলাই) কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সংবিধান সম্পর্কিত কমিটির রিপাের্ট নিয়ে আলােচনা করা হয়।


খসড়া কমিটি গঠন: ইতিমধ্যে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ভারত বিভক্ত ও স্বাধীন হয়। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট মধ্যরাত্রে গণপরিষদের এক বিশেষ অধিবেশন বসে| এই অধিবেশন ১৯৪৭ সালের ২৯ আগস্ট পর্যন্ত স্থায়ী হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, এই পঞ্চম অধিবেশনের সময় থেকে ভারতীয় গণপরিষদ (Constituent Assembly of India) একটি সার্বভৌম ক্ষমতাসম্পন্ন পরিষদের মর্যাদা লাভ করে। এই অধিবেশনে বিভিন্ন কমিটির রিপাের্টের ভিত্তিতে স্বাধীন ভারতের খসড়া সংবিধান (Draft Constitution) প্রণয়নের জন্য একটি খসড়া কমিটি (Drafting Committee) গঠন করা হয়। ড বি আর আম্বেদকরকে এই কমিটির সভাপতি নিযুক্ত করা হয়। কমিটির অন্যান্য সদস্যরা ছিলেন এন গােপালস্বামী আয়েঙ্গার, আহ্লাদী কৃষ়স্বামী আয়ার, কে এম মুন্সি, সৈয়দ মহম্মদ শাহেদুল্লাহ, ডি পি খৈতান এবং বি এল মিত্র।


সংবিধান রচনার উপাদান: খসড়া কমিটি বিশ্বের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলির সংবিধানসমূহ থেকে উৎকৃষ্ট উপাদানগুলি সংগ্রহ করে ভারতীয় সংবিধানকে সমৃদ্ধ করেছেন। গ্রেট ব্রিটেনের সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, আইনসভার দ্বিপরিষদীয় গঠনকাঠামাে, মার্কিন সংবিধানের সাংবিধানিক প্রাধান্য, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, আদালতে বলবৎযােগ্য মৌলিক অধিকার, আয়ারল্যান্ডের সংবিধানের নির্দেশমূলক নীতিসমূহ, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার সংবিধানের কেন্দ্র-রাজ্য ক্ষমতা বিভাজন ইত্যাদির কথা এক্ষেত্রে দৃষ্টান্তস্বরূপ উল্লেখ করা যায়। এ ছাড়া ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে (Indian Council Act 1935) কেন্দ্র, রাজ্য ও যুগ্ম-তালিকার প্রবর্তন, শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা, রাষ্ট্রপতির শাসন প্রভৃতির কথাও বিশেষভাবে উল্লেখ্য। সর্বোপরি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের আদর্শ ও মূল্যবােধ, গ্রাম পঞ্চায়েত ব্যবস্থা, অস্পৃশ্যতা নিষিদ্ধকরণ, ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পের উন্নতিবিধান সম্পর্কে গান্ধিজির চিন্তাভাবনা ইত্যাদি গণপরিষদের খসড়া কমিটিকে সংবিধান প্রণয়নে প্রভাবিত করে।


সংবিধান প্রণয়ন: ১৯৪৭ সালের ৪ নভেম্বর খসড়া সংবিধান রচনার কাজ শুরু হয় এবং ১৯৪৮ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তা গণপরিষদের কাছে পেশ করা হয়। এরপর খসড়া সংবিধানটি (৩১৫টি ধারা ও ১৩টি তপশিল সহ) জনগণের কাছে প্রচারের ব্যবস্থা করা হয় এবং জনগণকে আলােচনা ও সংশােধনী পেশের সুযােগ দেওয়া হয়। খসড়া সংবিধানটির ওপর মােট ৭,৩৬৫টি সংশােধনী গণপরিষদে আলােচিত হয়। পরবর্তীকালে চূড়ান্তভাবে সংবিধানে ৩৯৫টি ধারা এবং ৮টি তপশিল অনুমােদিত হয়। পরিশেষে ১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর গণপরিষদে ভারতের সংবিধান গৃহীত হয়। সভাপতি ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ এতে স্বাক্ষর করেন। এর রচনার কাজ শেষ করতে মােট ২ বছর ১১ মাস ১৮ দিন সময় লাগে।


১৯৫০ সালের ২৪ জানুয়ারি গণপরিষদের সর্বশেষ অধিবেশনে ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন| ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি স্বাধীন ভারতের সংবিধান কার্যকরী হয়।


মূল্যায়ন: ভারতের সংবিধান প্রণয়নের প্রক্রিয়ার মূল্যায়ন করতে গিয়ে সমালােচকরা গণপরিষদের গণচরিত্রের ঘাটতির কথা তুলে ধরেছেন। তাদের মতে, যেহেতু প্রাপ্তবয়স্কের ভােটাধিকারের ভিত্তিতে গণপরিষদ নির্বাচিত হয়নি, তাই এতে জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেনি। গণপরিষদে উচ্চবিত্ত এবং সামন্ততন্ত্রের প্রতিনিধিত্ব বেশি থাকায় সাধারণ মানুষের চিন্তাধারা ও আশা-আকাঙ্ক্ষা কোনাে মর্যাদা পায়নি বলে অনেকে মনে করেন। এ ছাড়া সংবিধানটিকে গণভােটে যাচাই করার জন্য কোনাে গণভােটের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি বলে একে সমালােচকরা জনগণের সংবিধান আখ্যা দিতে চাননি। গণপরিষদে কংগ্রেসের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব বাস্তবে গণপরিষদকে কংগ্রেস পরিষদে রূপান্তরিত করেছিল বলে কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন।


উপসংহার: পরিশেষে বলা যায়, সমকালীন পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে উপরি-উক্ত সমালােচনা পুরােপুরি গ্রহণযােগ্য নয়। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে মাত্র তিন বছরের মধ্যে বিশ্বের বৃহত্তম লিখিত সংবিধান প্রণয়ন করে, সারা দেশকে একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় গণতান্ত্রিক সংসদীয় শাসনব্যবস্থার স্থায়ী রাজনৈতিক কাঠামাে উপহার দিয়ে, সংবিধান প্রণেতারা এক অমূল্য অবদান রেখে গেছেন।


সংবিধান কাকে বলে? সংবিধানের শ্রেণিবিভাজন করাে।


লিখিত সংবিধান কাকে বলে? লিখিত সংবিধানের সুবিধা ও অসুবিধা ব্যাখ্যা করাে।


অলিখিত সংবিধান এবং তার সুবিধা ও অসুবিধা | অলিখিত সংবিধানের গুণ ও দোষ | অলিখিত সংবিধান কী?


লিখিত ও অলিখিত সংবিধানের মধ্যে পার্থক্য ব্যাখ্যা করাে।


সুপরিবর্তনীয় সংবিধান বলতে কী বােঝ? সুপরিবর্তনীয় সংবিধানের সুবিধা ও অসুবিধাগুলি আলােচনা করাে।


দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধানের সুবিধা ও অসুবিধাগুলি | দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধানের গুণাগুণ | দুম্পরিবর্তনীয় সংবিধান কাকে বলে? 


সুপরিবর্তনীয় ও দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধানের মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করাে।