পদকর্তা হিসাবে চণ্ডীদাসের কৃতিত্ব বিচার কর।

চৈতন্যজীবনীকার উল্লেখ করেছেন যে মহাপ্রভু চণ্ডীদাস বিদ্যাপতি রায়ের নাটক-গীতি শ্রদ্ধার সঙ্গে শ্রবণ করতেন। এদের মধ্যে বিদ্যাপতির পদ এবং রায় রামানন্দের নাটক বাঙলা ভাষায় রচিত হয়নি। ফলতঃ চণ্ডীদাসই একমাত্র বাঙালী কবি যার পদাবলী মহাপ্রভুর আস্বাদ ধন্য।


বাঙলা সাহিত্যে চৈতন্য-আস্বাদিত চণ্ডীদাসের পদ নিয়ে মহা সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। শ্ৰীকৃষ্ণকীর্তন-রচয়িতা বড়ু চণ্ডীদাস চৈতন্য-পূর্ব যুগেই বর্তমান ছিলেন- মােটামুটিভাবে এই সিদ্ধান্ত সর্ধজনমান্যতা লাভ করেছে। কিন্তু চৈতন্যদেব যে গ্রাম্য, কুরুচিকর এবং ঐশ্বর্যরসের পােষক নাটগীতি শ্রীকৃষ্ণকীর্তন মুগ্ধচিত্তে শ্রবণ করতেন, এ কথা বিশ্বাস করে ওঠা কষ্টকর। অতএব, অপর একটি সিদ্ধান্ত এই– চৈতন্য-পূর্ব যুগে অথবা তার সমকালেই অপর এক পদকর্তার অস্তিত্বকে স্বীকার করে নিতে হয়। আবার চণ্ডীদাস নামাঙ্কিত এমন অনেক পদ পাওয়া যায়, যাতে চৈতন্যোত্তর যুগের লক্ষণ সুস্পষ্টভাবেই বর্তমান এবং এদের কাব্যোকর্ষ এমন অনুল্লেখ্য যে এগুলি চৈতন্যদেব দ্বারা আস্বাদিত হাতােএ কথা মেনে নেওয়া অসম্ভব। এই তৃতীয় চণ্ডীদাস ছাড়াও অপর একজন চতুর্থ চণ্ডীদাসকেও অবশ্য স্বীকার করে নিতে হয়, যিনি সহজিয়া রসের পদগুলি রচনা করেছেন। এখন এই সমস্ত চণ্ডীদাসের পদ নামসাদৃশ্য-হেতু এমনভাবে মিশে গেছে যে এদের পৃথক করা বােধ হয় আর সম্ভবপর নয়।


চণ্ডীদাস সমস্যা-সৃষ্টির পূর্বে যে চণ্ডীদাস-নামাঙ্কিত পদগুলি বাঙালীর মন কেড়ে নিয়েছিল, সেই পরমস্বাদু পদগুলিকেই ‘বৈষ্ণবমহাজনপদ' নামে অভিহিত করা হয়। এইসব পদের ভণিতায় 'দ্বিজ' এবং 'দীন' আছে, আবার নিরুপাধিক (অর্থাৎ, দ্বিজ, দীন, বড়ু ইত্যাদি উপাধিহীন) পদও রয়েছে। এই জাতীয় চণ্ডীদাস-নামাঙ্কিত শ্রেষ্ঠ পদগুলিকেই আলােচনার উদ্দেশ্যে গ্রহণ করা হলাে।


চণ্ডীদাসের ব্যক্তি-পরিচয় ঘন কুঞ্চটিকায় আচ্ছন্ন। এক বা একাধিক চণ্ডীদাস 'বাসুলী-পূজক' ছিলেন। চণ্ডীদাসের জন্মস্থান ছিল বীরভূম জেলার নানুর অথবা বাঁকুড়া জেলার ছাতনা। তবে খুবই সম্ভব এই দুই স্থানেই দুইজন চণ্ডীদাস জন্মগ্রহণ করেন। চণ্ডীদাস পরিচয়’ নামক এক অর্বাচীন পুথিতে চণ্ডীদাসের যে কাহিনী বর্ণিত হয়েছে, বিশ্বাসযােগ্যতার অভাবে তার প্রামাণিকতা অস্বীকৃত হওয়ায় বস্তুতঃ চণ্ডীদাসের কোন পরিচয়ই আর জানবার উপায় নেই।


চৈতন্য-পূর্ব যুগে রাধাকৃষ্ণলীলা-বিষয়ে যারা পদ রচনা করেছেন, তাঁরা নিজেরাই যেন সেই লীলারস আস্বাদনের জন্য শ্রীমতী রাধার সঙ্গে একাত্মতা বােধ করেছিলেন। চৈতন্যোত্তরকালে এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটায় পদকর্তারা চৈতন্যদেবের অন্তরালে দাড়িয়ে সেই লীলার স্বাদ গ্রহণ করেন। এই বিচারে, চণ্ডীদাস-নামাঙ্কিত উৎকৃষ্ট পদগুলি সবই চৈতন্য-পূর্ব যুগেই রচিত হয়েছিল বলে বিশ্বাস করতে হয়। চণ্ডীদাসের এই ভাবতন্ময়তা এবং একাত্মতাবােধই যে তার কাব্যের শ্রেষ্ঠ গুণ এবং বহিরঙ্গে অসম্পূর্ণতা সত্ত্বেও যে কেন চণ্ডীদাস বাঙালীর এমন আপনজন বলে গণ্য হতেন, চণ্ডীদাস পদাবলীর সম্পাদক নীলরতন মুখােপাধ্যায়ের আলােচনা থেকেই তা বােঝা যায়। তিনি লিখেছেনঃ "চণ্ডীদাস রাধাকৃষ্ণের প্রেমে একেবারে জমিয়া গিয়াছিলেন। যােগীর ন্যায় মানসক্ষেত্রে রাধার লীলা প্রত্যক্ষ করিতেন। যাহা দেখিতেছেন, তাহাই গাইতেন। কল্পনার কথা নয় যে, সাজাইয়া গুছাইয়া তােমার মনে চমক লাগাইতে হইবে। চণ্ডীদাস কৃত্রিমতা জানতেন না। খাঁটি জিনিষ যেমন পাইলেন, জানিলেন, লােকে লউক আর না লউক সেদিকে তাহার ভূক্ষেপ ছিল না। তাই তাহার কবিতা সরল ও অলঙ্কারবিহীন। বর্ণনীয় বিষয় হইতে মনকে দুরে না আনিলে তার উপায় খোঁজা হয় না। সুতরাং বিষয়ে তন্ময়তা জন্মিলে উপমা প্রভৃতির দিকে লক্ষ্য থাকে না।" বস্তুতঃ কাব্যের সৌন্দর্য বলতে এটিকেও বােঝায়। কাব্যের অনলঙ্কৃত সৌন্দর্য সরাসরি পাঠকমনকে স্পর্শ করবে এবং কবিতে ও পাঠকে একটা সাহিত্যবােধের সৃষ্টি করবে। তাই রাধাভাবে তন্ময় চণ্ডীদাস যখন আকুল কণ্ঠে বলে ওঠেন, 'সই, কে বা শুনাইল শ্যাম নাম তখন সঙ্গে সঙ্গে পাঠকের মনেও সাড়া জাগে। এই শ্যাম নাম বিরহ-ব্যাকুল পাঠকদের কানের ভিতর দিয়ে মরমে প্রবেশ করে তাদের হৃদয়কেও আকুল করে তােলে।


বাঙলা সাহিত্যের পুরােধা ঐতিহাসিক ডঃ দীনেশচন্দ্র সেন যেন চণ্ডীদাসের মর্মে প্রবেশ কা'রে কবিজনােচিতভাবেই সেই মর্ম ব্যাখ্যা করেছেন- 'চণ্ডীদাসের বাণী সহজ সরল ও সুন্দর। বিদ্যাপতির পূর্বরাগের ক্ষণে ক্ষণে নয়ন কোন অনুসরই। ক্ষণে ক্ষণে বসনধূলি তনু ভরই।'- প্রভৃতি বর্ণনায় ঈষদুদভিন্নযৌবনা রাধিকার রূপ উছলিয়া পড়িতেছে, কিন্তু সেই পূর্বরাগের অবস্থা চিত্রিত করিয়া চণ্ডীদাস যে ধ্যানপরায়ণা রাধিকার মূর্তিটি দেখাইয়াছেন, তাহার সাশ্রুনেত্র আমাদিগকে স্বর্গীয় প্রেমের স্বপ্ন দেখাইয়া অনুসরণ করে। এবং চৈতন্যপ্রভুর দুটি সজল চক্ষুর কথা স্মরণ করাইয়া দেয়। সেই মূর্তি ভাষার পুষ্পপল্লবের বহু উর্দ্ধে নির্মল অধ্যাত্মরাজ্য স্পর্শ করিয়া অমর হইয়া রহিয়াছে। সেই স্থানে সাহিত্যিক সৌন্দর্যের আড়ম্বর নাই। কিন্তু তাহা প্রেমের নিজস্ব স্থান। এখানে শব্দের ঐশ্বর্য অপেক্ষা শব্দের অল্পতেই ইঙ্গিতে বেশি কার্যকরী হয়। প্রকৃত প্রেমিক বড় স্বল্পভাষা এখানে উচ্চভাবের শােভা অবগতির জন্যই যেন ভাষার তনু ত্যাগ করে এবং বাহ্য সৌন্দর্যের বাহুল্য না থাকিলেও মন্ত্রপুত কোটি হৃদয়ের অন্তঃপুর উদঘাটিত করিয়া দেয়।


বস্তুতঃ চণ্ডীদাসের রচনায় চেষ্টাকৃত কবিত্ব প্রকাশের কোন প্রয়াসই দেখা যায় না। অধ্যাপক ডঃ সত্রাজিৎ গােস্বামী বলেছেন "চণ্ডীদাসের কবিতাও যেন তার রাধিকার মতােই যেমত যােগিনী পারা'; অকৃত্রিমতায় ও তন্ময়তায় চণ্ডীদাস-পদাবলীও বাহ্য অলংকারহীন, কিন্তু আদিগন্ত সমুদ্রের মতই গভীর।" যেখানে তিনি অলঙ্কার ব্যবহার করেছেন, সেগুলিও দৈনন্দিন জীবন থেকেই আহৃত, যেমন—'শঙ্খ বণিকের করাত যেমন আসিতে যাইতে কাটে', কিংবা 'কানুর পীরিতি চন্দনের রীতি ঘষিতে সৌরভময়।' চণ্ডীদাসের পদাবলীতে রূপকের আড়ালে একটা আধ্যাত্মিক জগৎ লুকিয়ে আছে—ভক্তের নিকট সেই জগতের মাধুরী অপরিসীম। কিন্তু যারা ঐ রসের পিপাসু নন, তারাও চণ্ডীদাসের কাব্য থেকে বঞ্চিত হন না। কারণ চণ্ডীদাসের কাব্যের এমন একটা সার্বজনীন ও সার্বভৌম আবেদন রয়েছে, যা দেশ কালকে অতিক্রম করে যে-কোন রসপিপাসু পাঠকের মনেই অনির্বচনীয় আনন্দ সৃষ্টি করতে পারে। এইখানেই চণ্ডীদাসের বিশেষত্ব, এইটিই তার শ্রেষ্ঠত্বের কারণ।


রাধাকৃষ্ণের বিচিত্র প্রেমলীলাকে অবলম্বন করে চণ্ডীদাস ঐ লীলাপর্যায়ের বিভিন্ন দিককেই প্রস্ফুটিত করতে চেষ্টা করেছেন। সর্বত্র যে তিনি অসাধারণ সাফল্য-অর্জনে সক্ষম হয়েছেন, তা নয়, কিন্তু কোন কোন ক্ষেত্রে তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী।


শ্ৰীমতী রাধিকার পূর্বরাগ বর্ণনায় চণ্ডীদাস এক নােতুন দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছেন। কবি বিদ্যাপতি এবং অপর সকলেই পূর্বরাগের পদে শ্রীমতীর লীলাচপল রূপটিই ফুটিয়ে তুলেছেন,‌ কিন্তু চণ্ডীদাস পূর্বরাগের পদেও রাধার মনে বিরহ বেদনার অব্যক্ত আকুতিকেই রূপায়িত করে তুলেছেন। প্রেমের এই প্রারম্ভিক লগ্ন থেকেই চণ্ডীদাসের রাধিকা প্রেমের বিষামৃত-পানে যন্ত্রণাদীর্ণা। অন্তরধনে ধনী রাধিকা তাে কৃষ্ণসমর্পিত প্রাণা, তিনি তাে সমস্তই কৃষ্ণে সমর্পণ করে বসে আছেন। কাজেই দেহসৌন্দর্যে তাকে মুগ্ধ করবার ভাবনা তার কল্পনায় আসে না। শ্রীকৃষ্ণের নাম শােনামাত্র যিনি বিবশা হায়ে পড়েন, কৃষ্ণনাম জপ করতে করতে তিনি অবশচিত্তা, শ্যাম-সদৃশ মেঘের মধ্যেই তিনি কৃষ্ণ দর্শনের আনন্দ লাভ করেন, সেই যৌবনে-যােগিনী শ্রীমতী রাধিকার মনে পূর্বরাগ সঞ্চারিত হলেও তার প্রকাশ যে অপর সকলের মতাে হবে না—এটাইতাে স্বাভাবিক; কারণ এ রাধিকার স্রষ্টা ভাবের কবি চণ্ডীদাস নিজে রাধার সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছে বলে কবির নিজস্ব অনুভূতি রাধায় সংক্রামিত করেছেন।


চণ্ডীদাস পূর্বরাগ অপেক্ষাও অধিকতর কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন আক্ষেপানুরাগ পর্যায়ের পদ-রচনায়। এখানে কবির তথা রাধার ভাবতন্ময়তা আরও গাঢ়, আরও স্পষ্ট। আক্ষেপানুরাগের আর যে সব বড় কবি আছে, তাদের রাধিকা অহংকে ত্যাগ করতে পারেন নি, তাই সেই আক্ষেপের সঙ্গে অনুযােগও বর্তমান। কিন্তু চণ্ডীদাসের রাধারমণে কোনাে অনুযােগ নেই, তিনি যে আপনার সর্বস্ব বিলুপ্ত করে দিয়েছেন। জনৈক সমালােচক তাই বলেছেন, "চণ্ডীদাসের সর্বস্ব আক্ষেপানুরাগ।"


বিরহের পদ চণ্ডীদাস খুব বেশি রচনা করেননি, কারণ পূর্বরাগ থেকেই তাে তার বিরহের শুরু। বিদগ্ধ সমালােচকের ভাষায় - "পূর্বরাগ হইতে চণ্ডীদাসের বিরহ শুরু হইয়াছে, আপেক্ষানুরাগে তাহারই বৃদ্ধি, পর্যায়ের পর পর্যায়ে অগ্রসর হইয়া চণ্ডীদাস ভাবসম্মিলনের আনন্দমুহূর্তে বিচ্ছেদের অস্তিমতম বেদনাকে প্রকাশ করিয়াছিলেন। এমনভাবে প্রকাশ কর- বোধ করি আর কোন বৈষ্ণব কবির দ্বারা সম্ভব নয়


বহুদিন পরে বঁধুয়া এলে।

দেখা না হইত পরাণ গেলে ॥

দুখিনীর দিন দুখেতে গেল।

মথুরা নগরে ছিলে তাে ভাল ॥


করুণ! মর্মস্পর্শী! কোনাে বিশেষণই এই চারি পংক্তির অনুভূতিকে প্রকাশ করিতে পারিবে না।"


চণ্ডীদাস তাঁর কাব্যকৃতির চরমসীমায় আরােহণ করেছেন ভাবসম্মেলনের পদগুলিতে। এই পদগুলিতে আরও আন্তরিকতা, আরও সুস্পষ্টতার পরিচয় পাওয়া যায়। জীবনভাের রাধিকা কৃষ্ণ সন্ধানেই কাটিয়েছেন, কৃষ্ণ তাে তাঁর জীবনে জ্বালাই শুধু বাড়িয়েছেন। তৎসত্ত্বেও যখন রাধিকা বলেন, 'জীবনে মরণে জনমে প্রাণনাথ হৈও তুমি’ তখন আর বিস্মিত না হয়ে উপায় থাকে না। রাধা প্রেম কামনাবাসনাশ্রিত মর্ত্যলােক থেকে বহু উর্ধ্বে এক অধ্যাত্মলােকে বিচরণ করে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। 'শতেক বরষ পরে বঁধুয়া মিলাল ঘরে’—এই শতবর্ষের ব্যবধানও যার চিত্তে একটুখানি মালিন্য স্পর্শ করতে পারেনি, সেই রাধচিত্ত যে যুগ যুগ ধরে বিরহিণী-প্রাণে অমৃতবারি সিঞ্চন করবে তাতেই বা বিস্ময়ের কি আছে। বস্তুত, এই কারণেই বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যে চণ্ডীদাস কৃত রাধার আত্মসমর্পণের পদগুলি অমূল্য বলে বিবেচিত হয়।


চণ্ডীদাসের নামে প্রচলিত বহু কবিতাই অপর কোন কোন কবির কবিতায়ও পাওয়া যায়। এদের মধ্যে বিশেষভাবে 'ঘরের বাহিরে দণ্ডে শতবার', আমার বঁধুয়া আন বাড়ি যায়', 'সজনি ও ধনী কে কহ বটে, 'কাহারে কহিব মনের বেদনা প্রভৃতি পদগুলির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। তবে এগুলি এখনও মতান্তর-রূপেই গৃহীত হয়ে থাকে, কোনটাই স্থির সিদ্ধান্ত নয়।