বাংলা নাট্য-সাহিত্যের ইতিহাসে রামনারায়ণ তর্করত্নের দান এবং অবদান | বাংলা নাটকে রামনারায়ণ তর্করত্নের কৃতিত্ব, স্থান ও ভূমিকা

বাংলা নাট্য-সাহিত্যের ইতিহাসে রামনারায়ণ তর্করত্নের স্থান এবং অবদান

আধুনিক বাংলা নাটকের পুরােধাপুরুষ 'অপূর্ববস্তু-নিমাণক্ষম' প্রতিভার অধিকারী মধুসূদনের আবির্ভাবের পূর্বে যে কয়েকজন বাঙালী নাট্যকার নবযুগের নবনাট্যধারার নান্দীপাঠ শুরু করেছিলেন, রামনারায়ণ তর্করত্ন (১৮২২-১৮৮৬) তাদের মধ্যে অন্যতম। নব্য শিক্ষিত বাঙালী হিসাবে তার অত্যধিক নাট্যপ্রীতি তৎকালে তাকে 'নাটুকে রামনারায়ণ' নামে পরিচিত তথা যশস্বী করে তুলেছিল। পুরাতনপন্থী বা সংস্কৃতপন্থী এই ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের রচিত নাটক ও প্রহসনগুলির সাহিত্য মূল্য সবিশেষ না থাকলেও বাস্তবতা ও স্বচ্ছন্দ সরসতার জন্য তিনি জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলেন।


উনবিংশ শতকে পাশ্চাত্ত্য সভ্যতার প্রদীপ্ত আলােকে বঙ্গ সমাজের বহুকাল পােষিত কুৎসিত ব্যাধিগুলির নগ্নরূপ প্রকাশিত হয়ে পড়েছিল। ঊনবিংশ শতকে তাই বহু মনীষীকেই সমাজ-সংস্কার আন্দোলনে ব্রতী হতে লক্ষ্য করা যায়। এই ভাবসংঘর্ষের তরঙ্গাঘাত বাংলা সাহিত্যকেও অনিবার্যভাবে প্রভাবিত করেছিল। স্বভাবতই শিক্ষিত বাঙালীর মধ্যে পাশ্চাত্ত্য প্রভাবপুষ্ট নবীন প্রজন্মেরই জয় হয়েছিল ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, টেকচাঁদ ঠাকুর, কালীপ্রসন্ন সিংহ প্রমুখের গদ্যসাহিত্যে সেই সংস্কার-প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যাবে। বাংলা নাট্যসাহিত্যে এই নব্যভাবের প্রবাহ ধরা পড়েছিল রামনারায়ণ তর্করত্ন, উমেশচন্দ্র মিত্র, মনােমােহন বসু, মধুসূদন দত্ত, দীনবন্ধু মিত্র প্রমুখের রচনায়। বাংলা নাটকের ইতিহাস-প্রণেতা শ্রদ্ধেয় অর্জিত কুমার ঘােষ বাংলা নাটকের ক্ষেত্রে রামনারায়ণের স্থান প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন— 'নাট্যক্ষেত্রে সংস্কারের মুদ্গর লইয়া অবতীর্ণ হইলেন রামনারায়ণ তর্করত্ন। রামনারায়ণের জন্ম ও মানসিক চর্যা প্রাচীনপন্থী ব্রাহ্মণ-পন্ডিত সমাজে, অথচ এই সমাজের বিরুদ্ধেই তিনি মুদ্রার হানিলেন।'


সামাজিক সমস্যা নিয়ে তিনিই সর্বপ্রথম নাটক লিখতে আরম্ভ করেন, এবং নিজে একজন সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত হলেও তার মতের উদারতা আমাদের মনে বিস্ময় উদ্রেক করে। তাঁর নাটকে একদিকে যেমন উপমা-অনুপ্রাসবহুল সংস্কৃত শব্দের আধিক্য আছে, অন্যদিকে আবার ছড়া, প্রবচন ও গ্রাম্য কথােপকথনের মধ্য দিয়ে দেশের নিজস্ব রসধারাও স্ফুর্তি লাভ করেছে। রামনারায়ণের সামাজিক সমস্যামূলক নাটকগুলি খুব প্রভাব বিস্তার করেছিল, এবং পরে সেগুলি একাধিক নাট্যকারের দ্বারা অনুসৃত হয়েছিল।


রামনারায়ণ সামাজিক নাটক, পৌরাণিক নাটক, প্রহসন ইত্যাদি বিভিন্ন প্রকার নাট্যরচনা করেছেন বটে, কিন্তু তার শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয় পাওয়া গেছে হস্যরসের ক্ষেত্রে অর্থাৎ প্রহসনে। সামাজিক সমস্যার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ ছিল এবং এই সমস্যার বাস্তব রূপ দেখাতেই তিনি সফলকাম হয়েছিলেন। কান্নার ভারী অস্ত্র অপেক্ষা হাসির হাল্কা শাস্ত্রই তার অধিক প্রিয়। এদিক দিয়ে তিনি দীনবন্ধুর সমধর্মী ছিলেন।


'কুলীনকুলসর্বস্ব' (১৮৫৪) তার প্রথম নাটক, বাংলা সাহিত্যের আদি সামাজিক নাটক বলা যেতে পারে। 'কুলীনকুলসর্বস্ব'-এ কৌলিন্য প্রথার দোষ ও অসঙ্গতি হাস্যরসাত্মক দৃশ্যাবলীর মধ্য দিয়ে দেখিয়ে তার নিন্দা করা হয়েছে। এক কন্যাদায়গ্রস্ত ভদ্রলােক চার কন্যার যথেষ্ট বয়স হওয়া সত্ত্বেও তাদের বিবাহ দিতে সক্ষম হন নি। অবশেষে এক কুরুপ বৃদ্ধের সঙ্গে কন্যাদের বিবাহ দিতে বাধ্য হলেন। এই হচ্ছে নাটকের বর্ণিত বিষয়। লেখক বিজ্ঞাপনে বলেছেন— 'পুরাকালে বল্লাল ভূপাল, আবহমান প্রচলিত জাতি মর্যাদা মধ্যে স্বকপােলকল্পিত কুলমর্যাদা প্রচার করিয়া যান, তৎপ্রথায় অধুনা বঙ্গস্থলী যেরূপ দূরবস্থাগ্রস্ত হইয়াছে তদ্বিষয়ে কোন প্রস্তাব লিখিতে আমি নিতান্ত অভিলাষী ছিলাম..'


নাটকের মধ্যে গুরুগম্ভীর শব্দাড়ম্বরের পাশে সরস ও লঘু ভাষার চাপল্য স্থান পেয়েছে। পুরুষ ও স্ত্রী চরিত্রের ভাষার মধ্যেই এই ব্যবধান সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। হয়ত সংস্কৃত নাটক অনুসরণ করেই তিনি এই ব্যবধান সৃষ্টি করেছিলেন। পুরুষদের কথা যেমন আড়ষ্ট, নারীদের কথা তেমনি সহজ ও স্বাভাবিক হয়েছে। রামনারায়ণ একদিকে সংস্কৃত কবিতা এবং অন্যদিকে ছড়া ও প্রবচনের সমাবেশ করেছেন। ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গলের প্রভাব ভাষা ও ভাবের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। নাটকের মধ্যে নানা বিচিত্র চরিত্র বর্ণিত হয়েছে। চরিত্রগুলির নাম বিশেষ কৌতুকপূর্ণ-অনৃতাচার্য, অধর্মবুচি, বিবাহবণিক, উদরপরায়ণ, বিবাহবাতুল, অভব্যচন্দ্র ইত্যাদি। ঘটক, পুরােহিত, ঔদরিক, মূৰ্থ প্রভৃতিকে নিয়ে সরস ব্যঙ্গ করা হয়েছে।


রামনারায়ণের 'নবনাটক' বহুবিবাহের অনিষ্টকারিতা দেখানাের উদ্দেশ্যে লিখিত। নাটকে গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতি উপহার পত্রে লিখিত আছে, 'ইহা বহুবিবাহ প্রভৃতি বিবিধ কুপ্রথা নিবারণের নিমিত্ত সদুপদেশ সূত্র নিবদ্ধ।' নাটকটি জোড়াসাঁকো নাট্যশালার জন্য রচিত। এই নাটকটি রচনা করে নাট্যকার পুরস্কার লাভ করেন। নাটকটিতে বহুবিবাহের বিরুদ্ধে এত তত্ত্বকথা আছে যে, আধুনিক যুগে বার্নার্ড শ-এর কোনাে নাটকেও বােধ হয় তত তত্ত্বের কচকচি নেই। প্রকৃতপক্ষে গুরু বিষয় অপেক্ষা লঘু চুটকিতে রামনারায়ণের হাত ভাল খােলে। কৌতুক ও রসময়ী গােয়ালিনীর যে দৃশ্য তিনি দেখিয়েছেন তা বিলক্ষণ হাস্য-সরস হয়ে উঠেছে। বহুবিবাহ ছাড়াও নাটকের মধ্যে বৈধব্যবেদনা, স্তাবকতা-দোষ,ভাষা-সমস্যা ইত্যাদি বহুবিষয় আলােচিত হয়েছে। নাট্যকারের মুখপাত্র হলেন সুধীর। তার মুখ দিয়ে তিনি যাবতীয় তত্ত্বোপদেশ ব্যক্ত করেছেন। সেজন্য তাকে সপ্রাণ ব্যক্তি অপেক্ষা নিষ্প্রাণ সাবয়ব তত্ত্ব বলেই বােধ হয়।


প্রহসন রচনায় রামনারায়ণের পটুত্ব অবশ্য-স্বীকার্য। যে স্বচ্ছ ও লঘু সংলাপ এবং বাগবৈদগ্ধ্য প্রহসনের অনুকূল, সেগুলিতে ছিল তার দক্ষ অধিকার। 'যেমন কর্ম তেমনি ফল' প্রহসনখানি দুই অঙ্কে বিভক্ত। প্রথম অঙ্ক বর্ণনামূলক এবং ঘটনাহীন। প্রকৃত প্রহসনের ঘটনা দ্বিতীয় অন্কেই স্থাপিত। পরস্ত্রীর প্রতি অবৈধ আসক্তি এবং তার হাস্যকর শাস্তি নিয়েই প্রহসনটি রচিত। আলােচ্য কাহিনীর সঙ্গে দীনবন্ধুর 'নবীন তপস্বিনীর' কাহিনীর অনেকটা মিল আছে।


'চক্ষুদান' নামক ক্ষুদ্রাকায় প্রহসনখানি লাম্পট্যব্যাধির প্রতিকারের উদ্দেশ্য নিয়ে রচিত। স্বামী নিকুঞ্জবিহারী স্ত্রীর প্রতি অবহেলা করে অন্য নারীতে নিমগ্ন। স্ত্রী বসুমতী একদিন ছলনার আশ্রয় নিয়ে স্বামীর চিত্তে চৈতন্য উদ্রেক করতে সমর্থ হন। এটিই হচ্ছে চক্ষুদানের প্রতিপাদ্য বিষয়। তবে এ চক্ষুদান শুধু নিকুঞ্জবিহারীর নয়, এ চক্ষুদান বােধ হয় নাট্যকার দিতে চেয়েছেন তৎকালীন লাম্পট্য দুষ্ট সমাজকে। নিকুঞ্জবিহারীর শেষ কথাগুলি উল্লেখযােগ্য— 'বসুমতি, তুমি আজ কবল আমাকেই চক্ষুদান দিলে এমন নয়; সঙ্গে সঙ্গে অনেকেরই চক্ষুদান হলাে।'


‘উভয়সঙ্কট’ (১৮৬৯) ক্ষুদ্রাকার প্রহসন। কিন্তু এই প্রহসনের উৎকর্য ক্ষুদ্র নয়। এখানেও সপত্নী-সমস্যার সরস অবতারণা করা হয়েছে। তবে আলােচ্য প্রহসনের মধ্যে অহেতুক আতিশয্য এবং অবিশ্বাস্য নির্মমতা নেই। রহস্য মধুর ঘটনার মধ্য দিয়ে সমস্যাটির উপর পরিহাসস্নিগ্ধ আলােকপাত করা হয়েছে। এই জাতীয় প্রহসনে স্ত্রী-ভূমিকার প্রাধান্য থাকে এবং আলােচ্য প্রহসনেও তার কোন ব্যতিক্রম নেই। বড় বৌ, ছােট বৌ এবং গয়লানীতিনটি চরিত্রই বাস্তবধর্মিতায় উজ্জ্বল; দুই সতীনই কর্তাকে বিকৃত আদরযত্নের আতিশয্য দেখাতে গিয়ে যে রকম মজার সঙ্কট সৃষ্টি করেছে, সেই বিষয়টিই প্রহসনের মধ্যে কৌতুকরস সঞ্চার করেছে। কলহ তিক্ত, যত্ন পীড়িত বেচারা কর্তা শেষে যে উক্তি করেছেন তা বিলক্ষণ কৌতুকপ্রদ- 'অগাে মহাশয়েরা, আমার দুর্গতি আপনারা দেখছেন, আপনাদের মধ্যে আমার মত সৌভাগ্যশালী পুরুষ কেহ থাকেন, তিনি এমন সময় উপস্থিত হলে না জানি কি করেন, বােধ করি তাঁরও এইবুপ উভয় সঙ্কট।'


রামনারায়ণ কয়েকটি পৌরাণিক নাটকও রচনা করেছিলেন। 'রুক্মিণী হরণ' (১৮৭১)-এর কাহিনী রামনারায়ণ পুরাণ থেকে গ্রহণ করেছেন বটে, কিন্তু তিনি পুরাণের অনুবাদ করেন নি, অন্ধ অনুবর্তনও করেন নি। নাটকীয় প্রয়ােজনে নতুন চরিত্র-সৃষ্টি এবং কুশলী ঘটনা বিন্যাস করে তিনি পৌরাণিক বৃত্তান্তকে নাট্যরসােত্তীর্ণ করে তুলেছেন। প্রাচীন চরিত্রগুলি অলৌকিক রহস্য-মহিমার যবনিকা ছিন্ন করে লৌকিক বাস্তবরসে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। সংস্কৃত শব্দবর্জিত চলিত ভাষার মধ্যে স্বচ্ছন্দগতি সঞ্চারিত হয়েছে। সরল, লােভাতুর, তােতলা ব্রাহ্মণ ধনদাসের চরিত্রটি সহজে ভােলার নয়।


'কংসবধ' (১৮৭৫) নাটকে কংস কর্তৃক অক্রুরকে বৃন্দাবনে প্রেরণ থেকে নাটকের আরম্ভ এবং কংসবধ ও উগ্রসেনের পুনরায় সিংহাসন প্রাপ্তিতে নাটকের সমাপ্তি। সংলাপের দীর্ঘতা ও আধ্যাত্মিক উচ্ছাসের জন্য এই নাটকটি রামনারায়ণের অন্য নাটকের মত সরস হতে পারে নি। এছাড়া রামনারায়ণ ধর্ম বিজয় (১৮৭৫) নামে আর একখানি পৌরাণিক নাটকও রচনা করেছিলেন।


এছাড়াও রামনারায়ণ চারখানি সংস্কৃত নাটকের অনুবাদ করেছিলেন। সেগুলি হল যথাক্রমে- ‘বেণীসংহার’ (১৮৫৬), 'রত্নাবলী' (১৮৫৮), 'অভিজ্ঞান শকুন্তল' (১৮৬০) ও 'মালতী মাধব' (১৮৬৭)। এর মধ্যে নাট্যগত উৎকর্ষ না থাকলেও রত্নাবলী নাটকটির একটি ঐতিহাসিক উল্লেখযোেগ্যতা আছে। ১৮৫৮ খ্রীষ্টাব্দে পাইকপাড়ার জমিদারের বেলগাছিয়া রঙ্গমঞ্চে রত্নাবলীর অভিনয়ে আমন্ত্রিত হয়ে তৎকালীন প্রখ্যাত কবি মধুসূদন দত্ত বাংলা নাটক সম্পর্কে হতাশ হয়েছিলেন। প্রকারান্তরে রত্নাবলী নাটকই ছিল নাট্যকার মধুসূদনের আত্মপ্রকাশের কারণ। ১৮৫৯ খ্রীষ্টাব্দে 'শর্মিষ্ঠা' মধুসূদনের প্রথম নাটক। মধুসূদনের প্রতিভা স্পর্শেই বাংলা নাট্যসাহিত্য আধুনিকতার স্তরে উন্নীত হয়েছিল। তথাপি আধুনিক নাট্যধারার, বিশেষত প্রাক্-মধুসূদন পর্বে বাংলা নাট্যসাহিত্যের চর্চায় এবং বাংলা রঙ্গমঞ্চের শুশ্রুষায় রামনারায়ণ তর্করত্নের দান অনস্বীকার্য।