রাষ্ট্রের সংজ্ঞা দাও। রাষ্ট্রের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি ব্যাখ্যা করাে।

রাষ্ট্রের সংজ্ঞা

রাষ্ট্র হল রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কেন্দ্রীয় বিষয়|রাষ্ট্রকে কেন্দ্র করেই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শুরু ও শেষ। কিন্তু রাষ্ট্রের সঠিক সংজ্ঞা সম্পর্কে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা একমত হতে পারেননি। বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে রাষ্ট্রের সংজ্ঞা দিয়েছেন


[1] রাষ্ট্রের সাবেকি সংজ্ঞা: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক অ্যারিস্টটলের মতে, রাষ্ট্র হল স্বাবলম্বী ও পূর্ণাঙ্গ জীবনযাপনের উদ্দেশ্যে সংগঠিত কয়েকটি পরিবার ও গ্রামের সমষ্টি। প্রাচীন গ্রিসের নগররাষ্ট্রের পটভূমিকায় অ্যারিস্টটলের দেওয়া এই সংজ্ঞা বর্তমান যুগের আধুনিক রাষ্ট্রের পক্ষে প্রযােজ্য নয়। এই যুগে 'স্বাবলম্বী' ও 'পূর্ণাঙ্গ' রাষ্ট্রের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না।


[2] রাষ্ট্রের আইনগত সংজ্ঞা: প্রখ্যাত আইনবিদ হলের মতে, রাষ্ট্র হল এমন এক জনসমাজ যা নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসাধনের জন্য স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত এবং বহিঃশক্তির নিয়ন্ত্রণ থেকে সর্বতােভাবে মুক্ত। ওপেনহাইমের অভিমত হল, যখন কোনাে নির্দিষ্ট একটি ভূখণ্ডে কোনাে সংগঠিত জনসমষ্টি সার্বভৌম সরকার প্রতিষ্ঠা করে, তখন রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। আবার, প্রাক্তন মার্কিন রাষ্ট্রপতি উইলসনের মতে, কোনাে নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে আইন প্রতিষ্ঠার জন্য সংগঠিত জনসমষ্টি হল রাষ্ট্র।


[3] রাষ্ট্রের আদর্শবাদী সংজ্ঞা: কান্ট ও হেগেল উভয়ই রাষ্ট্রকে এক সর্বাত্মক ও ঐশ্বরিক কর্তৃত্বসম্পন্ন অতিমানবীয় নৈতিক প্রতিষ্ঠানরূপে অভিহিত করেছেন। হেগেলের রচনায় রাষ্ট্রকে পৃথিবীতে ঈশ্বরের পদচারণা বলে বর্ণনা করা হয়েছে।


[4] রাষ্ট্রের আধুনিক সংজ্ঞা: আধুনিক আচরণবাদী চিন্তাবিদরা রাষ্ট্রের প্রচলিত সংজ্ঞাগুলি মেনে নিতে চাননি। এমনকি তাঁরা 'রাষ্ট্র' শব্দটির পরিবর্তে রাজনৈতিক ব্যবস্থা পরিভাষাটি প্রয়ােগের পক্ষপাতী। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বার্জেস ও ব্লুন্টসলির মতে, একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে রাজনৈতিক দিক থেকে সংগঠিত জনসমষ্টি হল রাষ্ট্র।


[5] রাষ্ট্রের মার্কসবাদী সংজ্ঞা: মার্কসবাদীরা রাষ্ট্রের সংজ্ঞা নির্দেশ করতে গিয়ে বলেছেন যে, রাষ্ট্র হল শ্রেণিশােষণের এক হাতিয়ার ; এক শ্রেণি কর্তৃক অন্য শ্রেণির ওপর প্রভুত্ব বজায় রাখার প্রতিষ্ঠান| শ্রেণিবিভক্ত সমাজে শ্রেণিস্বার্থ সংরক্ষণের একটি রাজনৈতিক হাতিয়ার হল রাষ্ট্র।


[6] রাষ্ট্রের গার্নারের সংজ্ঞা: গার্নারের মতে, রাষ্ট্র হল সাধারণভাবে বৃহৎ এক জনসমাজ যা নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে স্থায়ীভাবে বসবাস করে, যা বহিঃশক্তির নিয়ন্ত্রণ থেকে সম্পূর্ণ বা প্রায় মুক্ত এবং যার একটি সুসংগঠিত সরকার রয়েছে ও সেই সরকারের প্রতি অধিকাংশ জনগণ স্বাভাবিক আনুগত্য প্রদর্শন করে।


রাষ্ট্রের অপরিহার্য উপাদান বা বৈশিষ্ট্য


রাষ্ট্র সম্পর্কে গার্নারের দেওয়া সংজ্ঞা থেকেই রাষ্ট্রের চারটি অপরিহার্য উপাদান বা বৈশিষ্ট্যের সন্ধান পাওয়া যায়। সেগুলি হল一 [1] জনসমষ্টি, [2] নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, [3] সরকার ও [4] সার্বভৌমত্ব।


[1] জনসমষ্টি: রাষ্ট্রের মৌল উপাদান হল জনসমষ্টি। জনগণের কল্যাণের জন্যই রাষ্ট্র গঠিত হয়। তাই জনগণকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রের কথা ভাবা যায় না। আধুনিক রাষ্ট্রে জনসমষ্টিকে সাধারণত তিন ভাগে ভাগ করা যায়

  • (i) নাগরিক,
  • (ii) বিদেশি ও
  • (iii) প্রজা।

যাঁরা রাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন, রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন এবং আইনসম্মতভাবে রাষ্ট্রপ্রদত্ত যাবতীয় সুযােগসুবিধা এবং অধিকার ভােগ করে থাকেন তাদের নাগরিক বলা হয়। অন্যদিকে, রাষ্ট্রের মধ্যে যেসব ভিনদেশি নাগরিক সাময়িকভাবে বসবাস করেন তাদের বিদেশি আখ্যা দেওয়া হয়। এ ছাড়া বিদেশি শাসনের অধীনে বসবাসকারী জনগণকে বলা হয় প্রজা। যেমন, ১৯৪৭-এর ১৫ আগস্টের আগে ভারতবাসীরা ছিল ব্রিটিশদের প্রজা।


[2] নির্দিষ্ট ভূখণ্ড: নির্দিষ্ট ভূখণ্ড হল রাষ্ট্রের দ্বিতীয় অপরিহার্য উপাদান। জনসমষ্টির বসবাসের জন্য একটি ভৌগােলিক সীমানাবিশিষ্ট নির্দিষ্ট ভূখণ্ড থাকা প্রয়ােজন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, কোনাে জনসমষ্টি যতক্ষণ না কোনাে নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের অধিকারী হয় ততক্ষণ পর্যন্ত তা রাষ্ট্রের মর্যাদা লাভ করে না। নির্দিষ্ট ভূখন্ড বলতে রাষ্ট্রের অধীনস্থ স্থলভাগ, জলভাগ ও বায়ুমণ্ডলকে বােঝায়। কাজেই রাষ্ট্রের নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের সীমানার মধ্যে নদনদী, পাহাড়-পর্বত, অরণ্য, আকাশসীমা, সমুদ্র, উপকূল ইত্যাদি সবকিছুই অন্তর্ভুক্ত।


[3] সরকার: রাষ্ট্র সম্পূর্ণভাবে একটি তাত্ত্বিক ধারণা। বিমূর্ত রাষ্ট্রের বাস্তব রূপ হল সরকার। কার্যক্ষেত্রে রাষ্ট্র বলতে আমরা সরকারকেই বুঝি। অধ্যাপক গার্নারের মতে, রাষ্ট্রের প্রতিনিধি বা যন্ত্র হল সরকার। রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বপালনকারীদেরই সাধারণভাবে সরকার বলা হয়। সরকারের বিভিন্ন রূপ আছে, যেমন—

  • গণতান্ত্রিক, 

  • সমাজতান্ত্রিক, 

  • একনায়কতান্ত্রিক, 

  • এককেন্দ্রিক ও যুক্তরাষ্ট্রীয়, 

  • রাষ্ট্রপতি-শাসিত ও মন্ত্রীপরিষদ-চালিত ইত্যাদি।


[4] সার্বভৌমত্ব: অধ্যাপক গেটেলের মতে, সার্বভৌমত্ব হল আধুনিক রাষ্ট্রের ভিত্তি। অনেকে মনে করেন, রাষ্ট্রের মস্তিষ্ক যদি সরকার হয়, তবে তার প্রাণ হল সার্বভৌমত্ব। কারণ জনসমষ্টি, নির্দিষ্ট ভূখণ্ড এবং সরকার থাকা সত্ত্বেও যদি কোনাে প্রতিষ্ঠানের সার্বভৌমত্ব না থাকে তবে তাক কোনােমতেই রাষ্ট্র আখ্যা দেওয়া যায় না। সার্বভৌমত্ব দুধরনের—


  • (i) অভ্যন্তরীণ: অভ্যন্তরীণ সার্বভৌমত্ব বলতে অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের চরম ক্ষমতাকে বােঝায়, অর্থাৎ রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে কোনাে ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, এমনকি সরকার নিজেও রাষ্ট্রীয় আইনের উর্ধ্বে নয়।


  • (ii) বাহ্যিক: রাষ্ট্রের বাহ্যিক সার্বভৌমত্ব বলতে বােঝায় যে, বহিঃশক্তির সমস্ত রকম নিয়ন্ত্রণ থেকে রাষ্ট্র মুক্ত, অর্থাৎ এই সার্বভৌমত্বের শক্তিতে কোনাে স্বাধীন রাষ্ট্র বিদেশি রাষ্ট্রের নির্দেশে পরিচালিত হয় না।


রাষ্ট্রের অন্যান্য বৈশিষ্ট্য


উপর্যুক্ত চারটি অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য ছাড়াও রাষ্ট্রের আরও তিনটি অপ্রধান বৈশিষ্ট্য রয়েছে। সেগুলি হল一

  • [1] স্থায়িত্ব,
  • [2] আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও
  • [3] জাতীয়তাবাদ।

[1] স্থায়িত্ব: যে রাষ্ট্রের কোনাে স্থায়িত্ব নেই, তাকে রাষ্ট্র বলা যায় না। সরকারের অস্তিত্ব ক্ষণস্থায়ী, আজ যে সরকার ক্ষমতায় আছে, কাল তা নাও থাকতে পারে। কিন্তু রাষ্ট্র চিরস্থায়ী, তার একটি সুষ্ঠু ধারাবাহিকতা আছে। অবশ্য মার্কসবাদীরা রাষ্ট্রকে চিরস্থায়ী বলে মেনে নিতে চাননি।


[2] আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি: রাষ্ট্রের আর-একটি বৈশিষ্ট্য হল আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রের স্বীকৃতি না পেলে কোনাে রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রকৃত অর্থে রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচিত হয় না।


[3] জাতীয়তাবাদ: কোনাে কোনাে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রাষ্ট্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে জাতীয়তাবাদের কথা বলে থাকেন। তাদের মতে, জাতীয়তাবাদের আদর্শে গভীরভাবে উদ্বুদ্ধ না হলে কোনাে জনসমষ্টি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনে সফল হতে পারে না। অবশ্য রাষ্ট্রভেদে জাতীয়তাবাদী চেতনা বিকাশের ধারা স্বতন্ত্র হতে বাধ্য।


১৯৪৮ সালে আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রবিজ্ঞান সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাব অনুযায়ী রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়গুলি কী? আলোচ্য বিষয়রূপে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিবর্তনের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।


আচরণবাদের বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করাে।


রাজনীতির অর্থ নিরূপণ করাে | রাজনীতি বলতে কী বােঝায়?


রাষ্ট্রবিজ্ঞানের রাষ্ট্রকেন্দ্রিক ও রাষ্ট্রনিরপেক্ষ সংজ্ঞাগুলি আলােচনা করাে।


রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞা দাও। রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে কেন 'প্রগতিশীল বিজ্ঞান' হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে?


রাষ্ট্রবিজ্ঞান কি বিজ্ঞান? রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে বিজ্ঞান বলার পক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তি | রাষ্ট্রবিজ্ঞান কি বিজ্ঞান পদবাচ্য? আলােচনা করাে।


রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলােচনা ক্ষেত্রের পরিধি বিশ্লেষণ করাে | রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রকৃতি ও বিষয়বস্তুর পরিধি সম্পর্কে আলােচনা করাে।