সাধক কমলাকান্ত ভট্টাচার্য শাক্ত পদরচনায় প্রতিভার স্বাক্ষর | শাক্ত পদাবলীর কবি কমলাকান্ত ভট্টাচার্যের কবিকৃতিত্ব

শাক্ত পদাবলীর কবি কমলাকান্ত ভট্টাচার্যের কবিকৃতিত্ব


অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতাব্দীতে যে বেশ কয়েকজন শাক্ত পদকার পদ রচনা করে শাক্ত গীতি সাহিত্য ও শাক্ত সাধনাকে জনপ্রিয় করেছিলেন তাতে সন্দেহ নেই। সর্বাতিশায়ী বৈবপ্রভাব, বিশেষত বৈষ্ণুব গুরুবাদ ও সহজিয়া বৈষ্ণবদের রহস্যময় রসের সাধনার প্রতিষেধক হিসাবেও অষ্টাদশ শতাব্দীর সাধারণ সমাজে ও অভিজাত সমাজে শাক্ত পদচর্চার বিশেষ বাহুল্য দেখা যায়। পূর্বে দেখেছি, ষোড়শ শতাব্দীতে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার জন্য উৎপীড়িত জনচিত্তে সর্বশক্তিময়ী মঙ্গলকাব্যের দেবীদের পরিকল্পনা হয়েছিল। তাঁদের মহিমা জ্ঞাপক পুরাণধর্মী কাহিনি-কাব্যও রচিত হয়েছিল। সেই উপদ্রুত রাজনৈতিক জীবনে দেবীর বরাভয় জনচিত্তকে সঙ্কট মুহূর্তে আত্মরক্ষা করতে প্রেরণা জুগিয়েছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রায় মাঝামাঝি হতে বাংলাদেশে আবার রাষ্ট্র সংকট মাথা তুলল। রাষ্ট্রের শোষণ যন্ত্রে ধনী দরিদ্র, রায়ত-জমিদার, প্রজা-ভূস্বামী সকলেই সমবেতভাবে পিষ্ট হতে থাকল। সেই বাস্তব যন্ত্রণা ভুলে মানসিক মুক্তির উদার আসনে শ্যামামায়ের স্নেহাঞ্চলে অসংখ্য ভক্তের দল মিলিত হলেন। এর মধ্যে একনিষ্ঠ ভক্ত এবং পদকার হিসাবে কমলাকান্তের নাম সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরণযোগ্য।


বাংলা শাক্ত পদসাহিত্যে যিনি কবি ও সাধক রামপ্রসাদের তুল্য গৌরব লাভ করেছিলেন, তিনি হলেন এই কমলাকান্ত ভট্টাচার্য (বন্দ্যোপাধ্যায়)। রামপ্রসাদের মতোই তাঁর জীবনকে কেন্দ্র করে নানা অলৌকিক গল্প প্র লিত হয়েছিল। সাধন মার্গেও তিনি রামপ্রসাদের মতো সিদ্ধি লাভ করেছিলেন। অবশ্য কবিরঞ্জনের অধিকতর জনপ্রিয়তার ফলে কমলাকান্তের খ্যাতি কিছু সংকুচিত হয়েছিল। যদিও তাঁর অনেক শাক্ত পদ কাব্যগুণে রামপ্রসাদ অপেক্ষা কোন দিক দিয়ে ন্যূন নয়। বর্ধমান রাজবংশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল বলে তাঁর তিরোধানের পর বর্ধমানের রাজের উদ্যোশে জীবনীসহ তাঁর সমগ্র পদাবলী মুদ্রিত হয়েছিল। ১৯২০ সালে কমলাকাস্তের জীবনীকার অতুলচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এর লেখায় কবির জন্মস্থান, জীবনকথা ও সাধন স্থান সম্বন্ধে যে তথ্য পাওয়া যায়, তাতেই সহজেই অনুমেয়, ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়-তৃতীয় দশক পর্যন্ত তিনি জীবিত ছিলেন। আবার জীবিতকালে মহাসাধক বলে তিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।


রামপ্রসাদের মতো কমলাকান্তের যে জনিপ্রয়তা তা মূলত তাঁর শাক্তপদাবলীর জন্যেই। বর্ধমান রাজবাটী-প্রকাশিত কমলাকান্তের পদাবলী সংগ্রহে মোট ২৬৯ টি পদছিল। তার মধ্যে ২৪৫টি ছিল শ্যাম বিষয়ক, ২৪টি বৈব ভাবাপন্ন রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক পদ। কবি যে প্রথম জীবনে বৈক্ষ্ণব ধর্মের অনুরক্ত ছিলেন তাঁর সাধকরঞ্জন গ্রন্থটি পাঠ করলে তা সহজেই অনুমান করা যায়। কবি এই বৈষ্ণুব ভাবের রসে অনেকগুলি বৈশব পদ রচনা করলেও অধিকাংশ বৈষ্ণব পদই কবিত্ব বর্জিত, শুধু গৌর চন্দ্রিকার পদে কিঞ্চিৎ প্রতিভার পরিচয় মেলে। যাইহোক, কমলাকান্তের ভণিতায় প্রায় তিনশত শাক্তপদ পাওয়া যায়, তার মধ্যে আগমনী ও বিজয়ার গান অতি উৎকৃষ্ট, তাতে মাতৃহৃদয়ে বেদনা আশা আকাঙ্ক্ষা কবি খুব সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলতে সমর্থ হয়েছেন। সাধক রাম প্রসাদ শাক্ত পদ রচনায় খ্যাতির শীর্ষ স্থানে অবস্থান করলেও কমলাকান্তের মতো আগমনী বিজয়ার পদ রচনায় সফল হননি।


প্রতিটি বাঙালি বৎসরে একবার দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে নানা আনন্দে মেতে ওঠেন। তাঁদের ধারণা, বৎসরে একবার ঘরের কন্যা উমা পিত্রালয়ে অর্থাৎ কৈলাস ভবনে আসেন, মাতা মেনকা শোক তাপ জর্জর চিত্তে কন্যা উমাকে কাছে পেয়ে চারদিনের জন্যে আনন্দের সাগরে নিমগ্ন হয়ে পড়েন। চারিদিকে হাসি আর খুশীর লহরী, পাড়া পড়শীরা ছুটে আসে কন্যা উমাকে দেখতে, বিয়ে হওয়ার পর উমা কেমন আছে, তা জানতে। তবে এ শুধু উমাকে কেন্দ্র করে একটি মাত্র কল্পিত চিত্র হয়েই থেমে থাকেনি। বাঙালির গার্হস্থ্য জীবনে বাবা মায়েরা যে সব কন্যাদের পাত্রস্থ করেছিলেন এই দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে শ্বশুর বাড়ী থেকে সেই সব কন্যাদের পিত্রালয়ে আনতে উন্মুখ হয়ে ওঠেন। সব মিলিয়ে দুর্গোৎসবকে কেন্দ্র করে বাঙালির প্রতি ঘরে ঘরে এই পূজার কয়দিন সুখের চিত্র বিরাজ করতে থাকে। তবে স্মরণ রাখতে হবে বৎসরান্তে ঘরে কন্যা উমা যে একবার পিত্রালয়ে আসে তার জন্য সারা বৎসর ধরে মাতা মেনকা কন্যার জন্য কম অনুতাপ সহ্য করেননি। মাতার এই তাপ জর্জর হৃদয়ের অভিব্যক্তির সন্ধান পদকার কমলাকান্ত খুব নিপুণ ও সুচারুভাবে তাঁর লেখনীর মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তুলতে সমর্থ হয়েছিলেন। আর এখানেই কমলাকান্তের শ্রেষ্ঠত্ব।

দীর্ঘ অদর্শনে কন্যার জন্য মাতার হৃদয় বড়ো ব্যাকুল। মেনকা স্বপ্নে উমাকে দেখে গিরিরাজকে বলেন—

আমি কি হেরিলাম নিশি স্বপনে।... 

এই এখনি শিয়রে ছিল  গৌরী আমার কোথায় গেল

হে, আধ আধ মা বলিয়ে বিধুবদনে।।


স্বপ্নে কন্যাকে দেখে মাতা বড়ো অস্থির হয়ে পড়েছেন। আর বিলম্ব নয় এখনি কৈলাস পতিকে বলে মেয়েকে ঘরে আনার ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু উদাসীন স্বামীর প্রতি অনুযোগ করে মেনকা বলেন—

কবে যাবে বল গিরিরাজ গৌরীত্ব আনিতে।

ব্যাকুল হইয়াছে প্রাণ উমারে দেখিতে হে।।


এ বাক্যে স্বামীকে একেবারে নীরবতা পালন করতে দেখে প্রায় আতকণ্ঠে মেনকা অভিযোগ হানে—

গৌরী দিয়ে দিগম্বরে   আনন্দে রয়েছো ঘরে

কি আছে অন্তরে তব বুঝিতে না পারে। 

কামিনী করিল বিধি    তেই হে তোমারে সাধি

নারীর জনম কেবল যন্ত্রণা সহিতে।”


এই ভর্ৎসনার পর পিতা হয়ে গিরিরাজ কি চুপ করে বসে থাকতে পারেন ? তাই তিনি অবিলম্বে কৈলাসে গিয়ে কন্যাকে এনে গিরিরাণীর কোলে অর্পণ করে বলেন—

“গিরিরাণী এই নাও তোমার উমারে

ধর ধর হরের জীবন ধন।।”


সহসা কন্যাকে সশরীরে চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করার পর মায়ের হৃদয়ের বাৎসল্যের বাঁধ ভেঙে গেল। দেবীকে কোলে নিয়ে মা মেনকা বলে ওঠেন—

“ভাল হল এলে তুমি    আর না পাঠাব আমি

বুঝি বিধি প্রসন্ন হৈল গো।”


কিন্তু উমাকে তিনি কয়দিনই বা ধরে রাখতে পারবেন? নবমী নিশি অবসান হলেই তো ভোলা মহেশ্বর এসে গৌরীকে আবার কৈলাসে নিয়ে যাবেন। তাই রাণী আকুল প্রার্থনা জানান—“ওরে নবমী নিশি, না হৈও রে অবসান।” কিন্তু সময় কারো জন্যে অপেক্ষা করে না, নবমী নিশিরও অবসান হয়। ভোলানাথের ডমরু বেজে ওঠে। তাছাড়া উমার তো থাকবার উপায় নেই। তাঁকে তো হিমাচল গৃহ আঁধার করে কৈলাসে যেতেই হবে। তাই মাতা মেনকার শুধু বিলাপই সম্বল হয়—

“ফিরে চাও গো উমা তোমার বিধুমুখ হেরি। 

অভাগিনী মায়েরে বধিয়া কোথা যাও গো ।”


এ সমস্ত থেকে বুঝতে বিলম্ব হয় না, শাক্ত পদ রচনায় কমলাকান্তের কৃতিত্ব কতখানি। তবে আগমনী বিজয়ার এই সব পদে বিশেষ কোন কাব্যগুণ না থাকলেও আন্তরিকতা অকৃত্রিম আবেগের জন্য এগুলি এখনো বাংলাদেশে জনপ্রিয়।


কমলাকান্তের কয়েকটি শ্যামা সঙ্গীত শাক্ত সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। তাঁর কোন কোন পদ কবিত্বের দিক দিয়ে রামপ্রসাদ অপেক্ষাও উৎকৃষ্ট। আবেগ, শিল্পরূপ তাত্ত্বিকতা প্রভৃতি গুণগুলিকে তিনি কয়েকটি পদে চমৎকার ভাবে ফুটিয়ে তুলতে সমর্থ হয়েছিলেন। যেমন—

  • (ক) সদানন্দময়ী কালী মহাকালের মনোমহিনী গো মা।

  • (খ) তাই শ্যামা রূপ ভালোবাসি, কালী মনোমহিনী এলোকেশী।

  • (গ) শুকনো তরু মঞ্জুরে না, ভয় লাগে মা ভাঙ্গে পাছে।


এসকল পদের সাধ্য সাধন গত গুঢ়ার্থ যাই হোক না কেন, কিন্তু পংক্তি কটির নিখুঁত ছন্দ, প্রতীক প্রভৃতি আন্তরিকতার সঙ্গে বর্ণিত হয়েছে। কিংবা,

  • (ক) আদর করে হূদে রাখ আদরিনী শ্যামা মাকে। 

  • (খ) আপনারে আপনি দেখ যেও না মন কারু ঘরে।

  • (গ) মন গরীবের কি দোষ আছে, তার কেন নিন্দা কর মিছে।


এই সমস্ত পদের মার্জিত সংযত ভাষাভঙ্গির মধ্য দিয়ে কবি যে সমস্ত তত্ত্বকথা বলেছেন, তার গূঢ় তাৎপর্য সাধকের কাছে পরম আদরের বস্তু, কিন্তু সাধারণ রসিক পাঠকের নিকট এর কাব্যমূল্য অল্প নয়।


তাই বলা যায়, বাংলা শাক্ত সাহিত্যে বহু সাধক, ভক্ত ও কবির আবির্ভাব হয়েছে, তাঁদের রচিত শ্যামাসঙ্গীতের সংখ্যাও নিতান্ত কম নয়। কিন্তু কমলাকান্ত এই বিপুল আয়তন পদসাহিত্যের মধ্যেও আপন স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করেছেন। রামপ্রসাদের কবিত্ব ও সাধকত্ব এক সূত্রে মিলে গিয়েছে, তাই তাঁর বাণী মূর্তি অনেক সময় নিরাভরণ চলতি গ্রাম জীবনেরই প্রতিচ্ছবি। কিন্তু কমলাকান্তের পদে সচেতন রচনা শক্তির মার্জিত বাকরীতি অধিকতর প্রাধান্য পেয়েছে। রামপ্রসাদের গান সুরের আশ্রয় না পেলে যেন দাঁড়াতে পারে না, কিন্তু কমলাকান্তের গানের অনেক স্থানে বিশুদ্ধ লিরিক রূপটি রক্ষিত হয়েছে— তাঁর পদ গান না করলেও চলে, শুধু পাঠে বা আবৃত্তিতে এর রস ধরা পড়ে। তাই সমালোচক ড. অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষায় বলতে হয় “ভবিষ্যতে বাঙালির মনোভঙ্গীর কোন উৎকট পরিবর্তন যদি না হয় তাহলে কমলাকান্ত যে স্বমহিমায় চিরদিন প্রতিষ্ঠিত থাকবেন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।”