আধুনিক রাজনীতির মৌলিক ধারণাসমূহ

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলােচনায় আইন, স্বাধীনতা, সাম্য ও ন্যায়বিচারের ধারণা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সুদূর অতীতে গ্রিসের নগররাষ্ট্রগুলিতে সফিস্ট চিন্তানায়করা, রােমের স্টোয়িক দার্শনিকরা, প্লেটো ও অ্যারিস্টটল প্রমুখ এই সম্পর্কে তাদের মূল্যবান মতামত প্রকাশ করেন। পরবর্তীকালে উদারনীতিবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা, মার্কসীয় তাত্ত্বিকেরা এবং সাম্প্রতিককালে নয়া উদারনীতিবাদীরা আলােচ্য বিষয়গুলির উন্নততর ব্যাখ্যা দিয়েছেন।


প্রসঙ্গত বলা যায়, আইন, স্বাধীনতা, সাম্য ও ন্যায়বিচার পরস্পরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত। আইন শুধুমাত্র রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত, ঘােষিত ও প্রযুক্ত হলেই চলবে না, তাকে ন্যায়সম্মত ও যুক্তিসংগত হতে হবে। সাম্য ছাড়া যেমন স্বাধীনতা অর্থহীন, তেমনি স্বাধীনতা ছাড়া সাম্যও নিরর্থক হয়ে পড়ে। প্রাচীন গ্রিসে এবং রােমে যখন দাসব্যবস্থার প্রচলন ছিল তখন সব মানুষকে সমান ভাবা হত না। সেসময়ে সাম্যের চেয়ে স্বাধীনতার স্থান ছিল অনেক ওপরে৷ বস্তুতপক্ষে আমেরিকার স্বাধীনতার ঘােষণাপত্রে (১৭৭৬) এবং ফ্রান্সের মানবাধিকার সংক্রান্ত ঘােষণায় (১৭৮৯) সর্বপ্রথম সাম্য ও স্বাধীনতার সমন্বয়চিন্তা বাস্তবরূপ লাভ করে।


গণতন্ত্র একটি প্রাচীন ধারণা| গ্রিসের এথেন্সে 'গণতন্ত্র' কথাটি প্রচলিত ছিল। ভারতের প্রাচীন ধর্মগ্রন্থগুলিতেও গণতান্ত্রিক আদর্শের সন্ধান পাওয়া যায়। তবে ইউরােপের নবজাগরণের ফলে মধ্যযুগের শেষভাগে গণতান্ত্রিক আদর্শ ব্যাপ্তি লাভ করে। রুশাের সাধারণ ইচ্ছার তত্ত্ব, বেন্থামের হিতবাদ, মিলের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ, গ্রিনের প্রতিরােধের তত্ত্ব, অ্যাডাম স্মিথের অবাধ বাণিজ্যনীতি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগের ধারণা উদারনৈতিক গণতন্ত্রকে সমৃদ্ধ করে।


তত্ত্বগত দিক থেকে গণতন্ত্রের সম্পূর্ণ বিপরীত শাসনব্যবস্থা একনায়কতন্ত্র। একনায়কতন্ত্রের ভিত্তি রচনায় যেসব দার্শনিক বিশেষ ইন্ধন জুগিয়েছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হলেন জার্মান দার্শনিক হেগেল, নিটুসে এবং ট্রিটসকে। একনায়কতন্ত্রের মূল ভিত্তি রাষ্ট্রীয় শক্তি বা পশুবল| একনায়কতন্ত্রে রাষ্ট্র প্রধান, জনগণ অপ্রধান। প্রাচীন রােমে নিরাে ও জুলিয়াস সিজারের রাজত্বে, ফ্রান্সে নেপােলিয়নের আমলে, ইতালিতে কাউন্ট ক্যাভুর এবং বিংশ শতাব্দীতে জার্মানিতে হিটলার, ইতালিতে মুসােলিনি ও স্পেনে ফ্রাঙ্কোর শাসনকালে একনায়কতন্ত্রের উদ্ভব ঘটে।


আইনের অর্থ

ব্যাপক এবং সংকীর্ণ—উভয় অর্থেই আইন কথাটির ব্যবহার প্রচলিত আছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে আইনের সংজ্ঞা দিয়েছেন। জন অস্টিনের মতে, আইন হল অধস্তনের প্রতি ঊর্ধ্বতন রাষ্ট্রনৈতিক কর্তৃত্বের আদেশমাত্র। বিশ্লেষণপন্থী লেখক হল্যান্ডের মতে, সার্বভৌম রাষ্ট্রনৈতিক কর্তৃত্ব দ্বারা প্রযুক্ত মানুষের বাহ্যিক আচরণ নিয়ন্ত্রণকারী সাধারণ নিয়মই আইন। স্যাভিনি, হেনরি মেইন, মেইটল্যন্ডি ক্লার্ক প্রমুখ ঐতিহাসিক মতবাদে বিশ্বাসী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে সমাজে প্রচলিত রীতিনীতি, প্রথা ইত্যাদি সাধারণভাবে আইনের মর্যাদা লাভ করে। তাই সব আইনকে সার্বভৌম শক্তির আদেশ বলে অভিহিত করা যুক্তিযুক্ত নয়। বার্কারের অভিমত হল, আইন শুধুমাত্র রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত, ঘােষিত এবং প্রযুক্ত হলেই চলবে না, তাকে ন্যায়সম্মত ও যুক্তিসংগত হতে হবে। মার্কসীয় মতবাদ অনুযায়ী, আইন রাষ্ট্রপ্রকৃতির সঙ্গে অভিন্নভাবে জড়িত। আইন শাসকশ্রেণির ইচ্ছাকে প্রতিফলিত করে।


আইনের প্রকৃতি


আইনের প্রকৃতি সম্পর্কিত মতবাদপুলি হল- [1] দার্শনিক মতবাদ, [2] বিশ্লেষণমূলক মতবাদ, [3] ঐতিহাসিক মতবাদ, [4] তুলনামূলক মতবাদ [5] সমাজবিজ্ঞানমূলক মতবাদ এবং [6] মার্কসীয় মতবাদ।


স্বাভাবিক বা প্রাকৃতিক আইন


আইনের আলােচনায় স্বাভাবিক বা প্রাকৃতিক আইন একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে। স্বাভাবিক আইন মানুষের তৈরি নয়, রাষ্ট্র কর্তৃক সৃষ্ট বা সংরক্ষিতও নয়, স্বাভাবিক আইন সামাজিক প্রয়ােজন থেকে নিজেই গড়ে ওঠে। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক প্লেটো ও অ্যারিস্টটলের রচনায় এর প্রথম উল্লেখ দেখা যায়।


স্টোয়িক দর্শনে স্বাভাবিক আইনের তত্ত্বটি আরও স্পষ্ট রূপ নেয়। স্টোয়িকদের মতে, স্বাভাবিক আইন মান্য, কেননা তা মুক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। বোঁদা, হবস, লক্, রুশাে প্রমুখ দার্শনিকরা ছিলেন স্বাভাবিক আইনের সমর্থক।


আন্তর্জাতিক আইন


আধুনিক জাতীয় রাষ্ট্রগুলি অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে পরস্পর নির্ভরশীল। কিছু নিয়মকানুনের মাধ্যমে এই পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারিত হয়, এগুলিই আন্তর্জাতিক আইন নামে অভিহিত। লরেন্সের মতে, সাধারণভাবে যেসব নিয়মকানুনের দ্বারা সভ্য রাষ্ট্রগুলির পারস্পরিক ব্যবহার নিয়ন্ত্রিত হয় সেগুলিকে আন্তর্জাতিক আইন বলে।


আন্তর্জাতিক আইনের অর্থ ও প্রকৃতি


অস্টিন, হল্যান্ড প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আন্তর্জাতিক আইনকে আইন পদবাচ্য বলে স্বীকার করেননি। অন্যদিকে, হেনরি মেইন, স্যাভিনি প্রমুখ আন্তর্জাতিক আইনকে আইন পদবাচ্য মনে করেন।


[1] আইন পদবাচ্য নয়: আন্তর্জাতিক আইনকে আইন পদবাচ্য মনে না করার পক্ষে কারণগুলি হল- (i) সার্বভৌম কর্তৃপক্ষের অনস্তিত্ব, (ii) সুনির্দিষ্ট উৎসের অভাব (ii) বৈধতা আংশিক ও অসম্পূর্ণ, (iii) জাতীয় আইনের তুলনায় গুরুত্বহীন, (iv) আইনের ব্যাখ্যাকর্তা হিসেবে বিচার বিভাগের অনস্তিত্ব।


[2] আইন পদবাচ্য: ওপেনহাইমার, গোলক, কেলসেন, লরেন্স প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আন্তর্জাতিক আইনকে আইনের স্বীকৃতি দেওয়ার পক্ষে যে যুক্তিগুলি দিয়েছেন—(i) সদস্যরাষ্ট্রের স্বীকৃতিনির্ভর রাষ্ট্রগুলির পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারণে আন্তর্জাতিক আইন প্রয়ােজন। (ii) উৎসগত দিক থেকে অভিন্ন, (iii) সমস্ত রাষ্ট্রের আনুগত্য, (iv) আইন লঙ্ঘনের দোহাই যুক্তিহীন, (v) বিশ্বজনমতের সমর্থন।


জাতীয় আইন ও আন্তর্জাতিক অইিনের মধ্যে পার্থক্য


আন্তর্জাতিক আইন ও জাতীয় আইনের মধ্যে মৌলিক ও প্রকৃতিগত কয়েকটি পার্থক্য রয়েছে-


জাতীয় আইন


  • জাতীয় আইন বলতে বােঝায় সেই আইন যা রাষ্ট্র কর্তৃক সৃষ্ট ও স্বীকৃত।

  • জাতীয় আইনের সুনির্দিষ্ট প্রকৃতি লক্ষ করা যায়।

  • জাতীয় আইনের উৎস হল জাতীয় রাষ্ট্র বা জাতীয় রাষ্ট্রের আইনসভা।

  • রাষ্ট্রে জাতীয় আইন বলবৎ হওয়ার ক্ষেত্রে কোনাে বাধা থাকে না।

  • জাতীয় আইন জাতীয় রাষ্ট্রের সার্বভৌম কর্তৃপক্ষের আদেশ হিসেবে বলবৎ হয়।

  • জাতীয় আইনভঙ্গকারীকে শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা রাষ্ট্রের হাতে রয়েছে।


আন্তর্জাতিক আইন


  • আন্তর্জাতিক আইন হল কিছু আন্তর্জাতিক প্রথা, রীতিনীতি ও নিয়মকানুনের সমষ্টি। পারস্পরিক সম্পর্ক রচনার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রগুলি এগুলির বাধ্যতা মেনে চলে।

  • আন্তর্জাতিক আইন সুনির্দিষ্ট নয়।

  • আন্তর্জাতিক আইনের ক্ষেত্রে কোনাে আন্তর্জাতিক আইনসভা দেখা যায় না।

  • আন্তর্জাতিক আইনের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, আন্তর্জাতিক আইন সরাসরি বলবৎ হয় না।

  • আন্তর্জাতিক আইনের ক্ষেত্রে কোনাে সার্বভৌম কর্তৃপক্ষের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না।

  • আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলার ব্যাপারে রাষ্ট্রগুলির কোনাে বাধ্যবাধকতা নেই।


স্বাধীনতার সংজ্ঞা


স্বাধীনতা বা Liberty' শব্দটি লাতিন শব্দ 'Liber' থেকে গৃহীত হয়েছে। 'Liber' শব্দের অর্থ হল স্বাধীনতা। সাধারণভাবে স্বাধীনতা বলতে নিজের ইচ্ছামতাে কাজ করার অবাধ অধিকারকে বােঝালেও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে বস্তুত অবাধ, অনিয়ন্ত্রিত ও সীমাহীন স্বাধীনতা হল স্বেচ্ছাচারিতার নামান্তরমাত্র।


স্বাধীনতার প্রকৃতি


রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলােচনায় স্বাধীনতার প্রকৃতিকে তিনটি দিক থেকে বিশ্লেষণ করা হয়ে থাকে।


[1] নেতিবাচক স্বাধীনতা: নেতিবাচক স্বাধীনতার প্রবক্তা হলেন জেরেমি বেন্থাম, অ্যাডাম স্মিথ, জন স্টুয়ার্ট মিল, হার্বাট স্পেনসার, হবস, লক্ প্রমুখ। এ ছাড়া রয়েছেন বারলিন, হায়েক ও নােজিকের মতাে একালের নয়া উদারনীতিবাদী তাত্ত্বিকরা৷


[2] ইতিবাচক স্বাধীনতা: স্বাধীনতার ইতিবাচক প্রকৃতির বিশ্লেষণকারীদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হলেন হেগেল, গ্রিন, হবহাউস, ল্যাঙ্কি, বার্কার প্রমুখ।


[3] মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে স্বাধীনতা: স্বাধীনতার নেতিবাচক, অর্থাৎ ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদী ধারণার বিরােধিতা করে মার্কসীয় মতবাদে বলা হয়, সমস্ত রকম আর্থিক শােষণের অবসান না ঘটলে মানুষের সামাজিক মুক্তি ঘটা সম্ভব নয়। একমাত্র পুঁজিবাদী শােষণব্যবস্থার অবসান ঘটলেই প্রকৃত স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা সম্ভব।


আইন ও স্বাধীনতার সম্পর্ক


বার্কার প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর মতে, স্বাধীনতার পরিবেশ রাষ্ট্রীয় প্রচেষ্টা ছাড়া গড়ে ওঠে না। নাগরিকরা যে স্বাধীনতা ভােগ করে, রাষ্ট্র তা আইনের মাধ্যমে কার্যকর করে। অবশ্য রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের নেতিবাচক ভূমিকার কথাও জন স্টুয়ার্ট মিল, স্পেনসার, ব্রাইস প্রমুখ উল্লেখ করেছেন। ব্রাইসের অভিমত হল, আইন এবং স্বাধীনতার মধ্যে যে কোনাে একটিকে প্রাধান্য দিলে অন্যটি সংকুচিত হবে। বার্কারের বক্তব্য হল, স্বাধীনতার উৎস হল আইন।


স্বাধীনতার রক্ষাকবচ


আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে স্বাধীনতার সংরক্ষণে বিভিন্ন রক্ষাকবচের ব্যবস্থা করা হয়। এগুলি হল- [1] সংবিধানে লিপিবদ্ধ মৌলিক অধিকার, [2] ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ, [3] আইনের অনুশাসন, [4] দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থা, [S] প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক পদ্ধতি, [6] ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ, [7] সদাজাগ্রত জনমত, [8] স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা।


সাম্যের সংজ্ঞা


সাধারণভাবে সাম্য বলতে সব মানুষের সমতাকে বােঝায়। কিন্তু, রাষ্ট্রবিজ্ঞানে 'সাম্য বা 'Equality' কথাটি এই অর্থে ব্যবহৃত হয় না। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সাম্য বলতে সব মানুষের ব্যক্তিত্ববিকাশের উপযােগী যাবতীয় সুযােগসুবিধার সমতাকে বােঝায়৷


সাম্যের প্রকৃতি


অধ্যাপক হ্যারল্ড ল্যাস্কি সাম্যের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তার দুটি মূল বৈশিষ্ট্যের কথা তুলে ধরেছেন- [1] সাম্য হল বিশেষ সুযােগসুবিধার অনুপস্থিতি, [2] সাম্য বলতে সকলের জন্য পর্যাপ্ত সুযােগসুবিধা সুনিশ্চিত করাকে বােঝায়।


মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে সাম্য: মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে, ধনবৈষম্যমূলক ও শ্রেণিবিভক্ত সমাজে প্রকৃত সাম্যের অস্তিত্ব কখনােই সম্ভব নয়। ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিলোপ না ঘটলে সাম্য প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। লেনিনের মতে, এক শ্রেণির দ্বারা অন্য শ্রেণিকে শোষণের সমস্ত রকম সম্ভাবনা যতক্ষণ না বিনষ্ট হচ্ছে ততক্ষপ কোনাে প্রকৃত বা বিশুদ্ধ সাম্য প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না।


সাম্যের ধরন বা প্রকারভেদ


বিভিন্ন ধরনের সাম্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল[1] স্বাভাবিক সাম্য, [2] সামাজিক সাম্য, [3] রাজনৈতিক সাম্য, [4] আইনগত সাম্য, [5] অর্থনৈতিক সাম্য এবং [6] আন্তর্জাতিক সাম্য।


উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় স্বাধীনতা ও সাম্যের প্রকৃতি


বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যবস্থায় স্বাধীনতা ও সাম্যের প্রকৃতির তারতম্য ঘটে।


[1] স্বাধীনতার প্রকৃতি: উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও চিন্তার স্বাধীনতাকে দুটি মূলনীতিরূপে গ্রহণ করা হয়। স্বাধীনতার ওপর সবরকম সরকারি বিধিনিষেধ ও নিয়ন্ত্রণ নিষিদ্ধ থাকে।


[2] সাম্যের প্রকৃতি: উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় স্বাধীনতার মতাে সামাজিক ও রাজনৈতিক সাম্যের আদর্শ প্রতিষ্ঠার কথা ঘােষণা করা হয়।


বিভিন্ন সমাজব্যবস্থায় সাম্যের প্রকৃতি


বিভিন্ন সমাজব্যবস্থায় সাম্যের প্রকৃতিকে এইভাবে ব্যাখ্যা করা যায়-


[1] আদিম সাম্যবাদী সমাজে সাম্য: আদিম সাম্যবাদী সমাজের সাম্যও সেই সমাজের অর্থনীতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হত।


[2] দাস সমাজে সাম্য: দাস সমাজে ব্যক্তিগত সম্পত্তির উদ্ভব হয়। যাদের হাতে সম্পত্তির মালিকানা কেন্দ্রীভূত হয় তারা দাস মালিক হিসেবে পরিগণিত হয়।


[3] সামন্ত সমাজে সাম্য: সামন্ত সমাজে যাবতীয় আইন সামন্তপ্রভুদের স্বার্থরক্ষার জন্য প্রণীত হয়।


[4] ধনতান্ত্রিক সমাজে সাম্য: ধনতান্ত্রিক সমাজে সামাজিক ও রাজনৈতিক সাম্যকে স্বীকার করা হয়।


[5] সমাজতান্ত্রিক সমাজে সাম্য: সমাজতান্ত্রিক সমাজে সাম্যের ধারণা ঠিক ধনতান্ত্রিক সমাজের বিপরীত। এরূপ সমাজে অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠার ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়।


ন্যায়বিচারের প্রকৃতি


রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, ন্যায়বিচারের মাধ্যমে কোনাে সমাজের ভালাে বা মন্দ বােঝা যায়। যেসব দৃষ্টিকোণ থেকে ন্যায়বিচারের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করা হয়ে থাকে, সেগুলি হল- [1] সাবেকি উদারনৈতিক দৃষ্টিকোণ, [2] নয়া উদারনৈতিক দৃষ্টিকোণ এবং [3] মার্কসীয় দৃষ্টিকোণ।


ন্যায়বিচারের বিভিন্ন রূপ


প্রাচীন গ্রিসে দার্শনিকদের রচনায় প্রথম ন্যায়বিচারের ধারণার সন্ধান পাওয়া যায়। প্লেটোর The Republic গ্রন্থে ন্যায়বিচারের উল্লেখ রয়েছে। ন্যায়বিচারের রূপকে ক্ষেত্র অনুযায়ী চার ভাগে ভাগ করা হয়-[1] সামাজিক, [2] রাজনৈতিক, [3] অর্থনৈতিক এবং [4] আইনগত ন্যায়বিচার।


[1] সামাজিক ন্যায়বিচার: সামাজিক ন্যায়ের ধারণা অনুসারে, জনগণের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণসাধনের উদ্দেশ্যে একটি ন্যায়সংগত সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়।


[2] রাজনৈতিক ন্যায়বিচার: সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের মানবাধিকার সংক্রান্ত ঘােষণায় (১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দ) রাজনৈতিক ন্যায় ও সাম্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সাধারণভাবে রাজনৈতিক ন্যায় বলতে দেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় জনগণের সার্বিক অংশগ্রহণকে বােঝায়।


[3] অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার: অর্থনৈতিক ন্যায় ছাড়া সামাজিক ন্যায়প্রতিষ্ঠা অর্থহীন। উদারনীতিবিদরা অর্থনৈতিক ন্যায় বলতে রাষ্ট্র কর্তৃক জনকল্যাণমূলক কার্যক্রম রূপায়ণ, গতিশীল করব্যবস্থার মাধ্যমে ধনবৈষম্য হ্রাস, উন্মুক্ত বাজার অর্থনীতি, অবাধ প্রতিযােগিতা প্রভৃতিকে বুঝিয়েছেন। অন্যদিকে, মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে, অর্থনৈতিক ন্যায় বলতে সমস্ত রকম ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও মালিকানার বিলােপ ঘটিয়ে উৎপাদনের উপকরণের ওপর সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠাকে বােঝায়।


[4] আইনগত ন্যায়বিচার: আইনগত ন্যায়ের ধারণা অনুসারে, দেশের জন্য যুক্তিসংগত আইন প্রণয়নের প্রয়ােজন।


আইনের উৎস


রাষ্ট্রের মতাে আইনও ঐতিহাসিক বিবর্তনের ফল। বিশিষ্ট আইনবিদ হল্যান্ড-এর মতে, আইনের মুখ্য উৎসগুলি হল—প্রথা, ধর্ম, বিচারালয়ের রায়, ন্যায়বিচার, বিজ্ঞানসম্মত আলােচনা ও আইনসভা প্রণীত আইন।


সাম্য ও ন্যায়ের সম্পর্ক


সাম্য ও ন্যায়ের সম্পর্ক একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সাম্য প্রতিষ্ঠার একটি অন্যতম শর্ত হল ন্যায়বিচার ন্যায়নীতিতে এ কথা বলা হয় যে, সব মানুষ সমান।


গণতন্ত্রের সংজ্ঞা


মার্কিন রাষ্ট্রপতি আব্রাহাম লিংকনের মতে গণতন্ত্র হল জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য জনগণের শাসন (Government of the people, by the people and for the people) । সুইজি ও অন্যান্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর মতে, লিংকনের দেওয়া সংজ্ঞা অনুসারে জনগণের শাসন বলতে বােঝায় যে, জনগণ হল সমগ্র শাসনব্যবস্থার মূল উৎস এবং জনগণ ও সরকার পরস্পর বিচ্ছিন্ন নয়। অন্যদিকে, জনগণের দ্বারা শাসন বলতে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে পরিচালিত শাসনব্যবস্থাকে বােঝায়। জনগণের জন্য শাসনের অর্থ হল গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা আপামর জনগণের কল্যাণের জন্য কাজ করবে।


গণতন্ত্রের অর্থ


প্রাচীন গ্রিসে খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে ‘গণতন্ত্র' শব্দটির প্রথম প্রয়ােগ ঘটে। 'ডিমােস এবং 'ক্রেটোস-দুটি গ্রিক শব্দ নিয়ে 'ডেমােক্রেসি' শব্দের সৃষ্টি হয়। ডিমােস শব্দটির অর্থ ‘জনগণ’ আর ‘ক্ৰেটোস’ শব্দটির অর্থ কর্তৃত্ব বা শাসন। এককথায়, গণতন্ত্র শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হল জনগণের শাসন।


সাধারণভাবে ‘গণতন্ত্র’ শব্দটি সংকীর্ণ’ ও 'ব্যাপক' উভয় অর্থেই ব্যবহৃত হয়। ব্যাপক অর্থে গণতন্ত্র বলতে এমন এক আদর্শ সমাজব্যবস্থাকে বােঝায় যেখানে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিটি ক্ষেত্রেই সমতা প্রতিষ্ঠা লাভ করে। অন্যদিকে, সংকীর্ণ অর্থে গণতন্ত্র বলতে বােঝায়, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বা গণতান্ত্রিক সরকার।


মার্কসবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা মনে করেন যে, সমাজব্যবস্থায় ধনবৈষম্য বিরাজ করছে সেখানে কখনও প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। ল্যাঙ্কির বক্তব্য হল, অর্থনৈতিক গণতন্ত্র ব্যতীত রাজনৈতিক গণতন্ত্র অর্থহীন।


গণতন্ত্রের প্রকারভেদ


গঠনগত বা পরিচালনগত দিক থেকে সাধারণভাবে গণতন্ত্রকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। সেগুলি হল- [1] প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র এবং [2] পরােক্ষ গণতন্ত্র। তা ছাড়া তত্বগত বা শ্রেণিগত দিক থেকেও গণতন্ত্রকে [3] উদারনৈতিক গণতন্ত্র এবং [4] সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র—এই দু-ভাগে ভাগ করা যায়।


[1] প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র: যে শাসনব্যবস্থায় জনগণ সরাসরি এবং সক্রিয়ভাবে শাসনকার্য পরিচালনায় অংশগ্রহণ করে তাকে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র বলে।


  • প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণসমূহ: পরােক্ষ বা প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রে কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার সংস্থান রাখা হয়েছে। সেই পদ্ধতিগুলি হল- 

    • গণভােট, 

    • গণ উদ্যোগ, 

    • গণ-অভিমত, 

    • পদচ্যুতি।


  • প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের গুণাগুণ: প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের যেমন কিছু গুণ বা সুবিধা রয়েছে, তেমনি বেশ কিছু দোষ বা অসুবিধা রয়েছে।


দোষ বা অসুবিধা:

  • জনবহুল রাষ্ট্র পক্ষে অকার্যকরী,

  • রাজনৈতিক জ্ঞানের অভাবে ব্যর্থতা,

  • সুষ্ঠুভাবে আইন প্রণয়ন অসম্ভব,

  • জরুরি অবস্থায় অকার্যকর

  • গণতান্ত্রিক আদর্শের পরিপন্থী

  • জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্বশীলতা হ্রাস।


গুণ বা সুবিধা:

  • রাজনৈতিক চেতনা বৃদ্ধি,

  • জনস্বার্থবিরােধী পদক্ষেপ প্রতিরােধ,

  • গণতান্ত্রিক নীতির বাস্তবায়নে সহায়তা,

  • জনস্বার্থ রক্ষা,

  • স্বৈরাচার রােধ।


[2] পরােক্ষ বা প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র: পরােক্ষ বা প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র বলতে সেই গণতন্ত্রকে বােঝায় যেখানে জনগণ তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে দেশশাসনের কাজে অংশগ্রহণ করে।


  • পরােক্ষ বা প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র বৈশিষ্ট্য: পরােক্ষ বা প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের উল্লেখযােগ্য বৈশিষ্ট্যগুলি হল-

    • জনগণের পরােক্ষ অংশগ্রহণ,

    • রাষ্ট্রপতি-শাসিত অথবা মন্ত্রীপরিষদ-চালিত শাসনব্যবস্থা,

    • সংখ্যাগরিষ্ঠের সরকার,

    • প্রাপ্তবয়স্কদের ভােটাধিকার,

    • জনগণের কাছে দায়বদ্ধতা,

    • একাধিক দলের উপস্থিতি,

    • গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রপব্যবস্থা


[3] উদারনৈতিক গণতন্ত্র: শাসনব্যবস্থায় জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণ, রাজনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠা, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যাবসাবাণিজ্যের অবাধ স্বাধীনতা, ব্যক্তির মর্যাদা ও স্বাধীনতার অধিকারের গুরুত্ব, সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠা, আইনের অনুশাসন প্রতিষ্ঠা, অর্থনৈতিক স্বাধীনতার স্বীকৃতি, নির্বাচন ও নির্বাচিত হওয়ার অধিকার প্রভৃতি নীতি রূপায়ণ এই প্রকার গণতন্ত্রের লক্ষ্য।


[4] সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র: মার্কসবাদ ও লেনিনবাদের ওপর ভিত্তি করে সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের উদ্ভব ঘটে। একে 'বৈপ্লবিক গণতন্ত্র' বা 'প্রকৃত গণতন্ত্র' নামেও অভিহিত হয়।


গণতন্ত্রের গুণ-দোষ বিচার


[1] গণতন্ত্রের সুবিধা বা গুণ: গণতন্ত্রের যেসব সুবিধা বা গুণের কথা বলা হয়, তার মধ্যে উল্লেখযােগ্য হল-

  • (i) সার্বভৌমত্বের বাস্তবায়ন,

  • (ii) স্বাভাবিক অধিকারের তত্ত্বের রূপায়ণ,

  • (iii) আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা,

  • (iv) সর্বাধিক ব্যক্তির সর্বাধিক কল্যাণ,

  • (v) স্বাধীন এবং নিরপেক্ষ বিচার বিভাগের উপস্থিতি,

  • (vi) সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার নীতি অনুসরণ,

  • (vii) ন্যায় ও সত্যের প্রতিষ্ঠা,

  • (viii) মানুষের মর্যাদা,

  • (ix) ব্যক্তিত্বের সর্বাঙ্গীণ বিকাশ,

  • (x) রাজনৈতিক চেতনার বৃদ্ধি,

  • (xi) স্বৈরাচারের সম্ভাবনা হ্রাস,

  • (xii) বিপ্লবের শঙ্কা হ্রাস।


[2] গণতন্ত্রের অসুবিধা বা দোষ: গণতন্ত্রের অসুবিধার দিকগুলি হল-

  • (i) দরিদ্র, অজ্ঞ ও অযােগ্যদের শাসনব্যবস্থা,

  • (ii) উৎকর্ষের পরিবর্তে সংখ্যার প্রাধান্য,

  • (iii) সরকারের স্থায়িত্বহীনতা,

  • (iv) রক্ষণশীল শাসনব্যবস্থা,

  • (v) দলীয় স্বার্থের প্রাধান্য,

  • (vi) ব্যাকুল,

  • (vii) আমলাতন্ত্রের প্রাধান্য,

  • (vii) সংখ্যালঘুর স্বার্থকে উপেক্ষা,

  • (ix) জরুরি অবস্থায় অনুপযুক্ত।


একনায়কতন্ত্রের সংজ্ঞা


নিউম্যানের দেওয়া সংজ্ঞা অনুযায়ী, দেশের সমগ্র প্রশাসন এক বা একাধিক ব্যক্তি দখল করে অপ্রতিহত স্বৈরাচারী ক্ষমতা প্রয়ােগ করলে তাকে একনায়কতন্ত্র বলা হয়। অস্টিন রেনির মতে, একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় প্রশাসনের চূড়ান্ত ক্ষমতা এক বা একাধিক ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত থাকে। ফোর্ডের অভিমত অনুসারে, একনায়কতন্ত্র হল রাষ্ট্রপ্রধান কর্তৃক বিধিবহির্ভূত ক্ষমতার অধিগ্রহণ।


বস্তুত যে শাসনব্যবস্থায় যাবতীয় সরকারি ক্ষমতা কোনাে ব্যক্তি বা ব্যক্তিসমষ্টির হাতে থাকে তাকে একনায়কতন্ত্র অ্যাখ্যা দেওয়া হয়।


বিভিন্ন প্রকারের একনায়কতন্ত্র


একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার প্রধানত তিনটি রূপ দেখা যায়। সেগুলি হল- [1] ব্যক্তিগত একনায়কতন্ত্র, [2] দলগত একনায়কতন্ত্র এবং [3] সামরিক একনায়কতন্ত্র।


একনায়কতন্ত্রের গুণ-দোষ


গণতন্ত্রের সম্পূর্ণ বিপরীত শাসনব্যবস্থা হল একনায়কতন্ত্র এর গুণ ও দোষপুলি নিম্নরূপ-


[1] একনায়কতন্ত্রের গুণ: একনায়কতন্ত্রের যেসব গুণ বা সুবিধার কথা বলা হয়, তার মধ্যে নিম্নলিখিত উল্লেখযোগ্য-

  • (i) দলীয় প্রথার কুফলমুক্ত,

  • (ii) সরকারের স্থায়িত্ব,

  • (iii) জরুরি অবস্থার উপযােগী,

  • (iv) জাতীয় সংহতি ও দেশপ্রেমের পক্ষে অনুকূল,

  • (v) স্বচ্ছ ও সুদক্ষ প্রশাসনের উপস্থিতি,

  • (vi) কর্মসূচির দ্রুত রূপায়ণ,

  • (vii) দ্রুত আইন প্রণয়ন,

  • (vii) অর্থের অপচয় রােধ।


[2] একনায়কতন্ত্রের দোষ: একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থারও কিছু অসুবিধা বা তুটি রয়েছে। সংক্ষেপে সেগুলি এইরকম—

  • (i) ন্যায় ও সত্যের বিরােধী,

  • (ii) ব্যক্তিস্বাধীনতার বিরোধী,

  • (iii) স্বায়ত্তশাসনে বাধা,

  • (iv) ব্যক্তিসত্তার বিরােধী,

  • (v) যুদ্ধবাদের পৃষ্ঠপােষক,

  • (vi) নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী,

  • (vii) রাজনৈতিক চেতনা বিকাশের পরিপন্থী,

  • (viii) সন্ত্রাস সৃষ্টিকারী,

  • (ix) মানবতার অভিশাপ।


একনায়কতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য


একনায়কতন্ত্রের কয়েকটি উল্লেখযােগ্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে। সেগুলি হল-

  • [1] সর্বশক্তিমান রাষ্ট্র,

  • [2] এক দল, এক রাষ্ট্র, একনায়ক,

  • [3] বিরােধী জনমতের অস্তিত্বহীনতা,

  • [4] সাম্রাজ্যবাদ ও যুদ্ধবাদের জন্মদাতা,

  • [5] মিথ্যার প্রচারক,

  • [6] ব্যক্তিস্বাধীনতার বিরােধী,

  • [7] গুপ্তচর বাহিনীর উপস্থিতি,

  • [8] প্রহসনমূলক বিচার ব্যবস্থা,

  • [9] রাষ্ট্র ও সরকারের অভিন্নতা,

  • [10] সরকারি আইন ও নীতির কঠোরতা।


গণতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্রের মধ্যে পার্থক্য


রাজনৈতিক আদর্শ হিসেবে গণতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্র দুটি বিপরীতধর্মী আদর্শ। এই কারণে গণতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্রের মধ্যে মৌলিক প্রভেদ রয়েছে।


গণতন্ত্র


  • ব্রিটিশ উদারনৈতিক মানবতাবাদী ও হিতবাদী দর্শন হল গণতন্ত্রের তত্ত্বগত উৎস।

  • গণতন্ত্রে জনগণের সার্বভৌমত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত।

  • গণতন্ত্রে রাষ্ট্র ব্যক্তির জন্য।

  • গণতান্ত্রিক শাসনকে জনগণের শাসন বলে অভিহিত করা হয়।

  • গণতন্ত্রের ভিত্তি হল শাসিতের সম্মতি।

  • স্বায়ত্তশাসন গণতন্ত্রের মূলনীতি।

  • গণতন্ত্রে ব্যক্তিস্বাধীনতা একটি প্রধান স্বীকৃত উপাদান।

  • গণতন্ত্র প্রকৃত জাতীয়তা বাদের পৃষ্ঠপােষক এবং বিশ্বশান্তির আদর্শে বিশ্বাসী।

  • গণতান্ত্রিক সরকার জনগণের মতামতের ওপর নির্ভরশীল।

  • স্ত্রী-পুরুষ, জাতিধর্মবর্ণ নির্বিশেষে জনগণের মধ্যে কোনােকরম বৈষম্য করা হয় না।


একনায়কতন্ত্র


  • জার্মান আদর্শবাদী দার্শনিক হেগেলের চরম রাষ্ট্রবাদী দর্শন হল একনায়কতন্ত্রের প্রধান উৎস।

  • একনায়কতন্ত্রে জনগণের মতামতের কোনাে মূল্য নেই।

  • একনায়কতন্ত্রে ব্যক্তি রাষ্ট্রের জন্য।

  • একনায়কতান্ত্রিক শাসন হল একজন ব্যক্তি বা একটি বিশেষ দল বা একটি বিশেষ শ্রেণির শাসন।

  • একনায়কতন্ত্রের ভিত্তি হল পশুশক্তি।

  • একনায়কতন্ত্রে স্বায়ত্তশাসন সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষিত।

  • একনায়কতন্ত্রে ব্যক্তি স্বাধীনতা কোনােভাবেই স্বীকৃত নয়।

  • একনায়কতন্ত্র উগ্র জাতীয়তাবাদের জন্ম দেয় যা বিশ্বশান্তির পরিপন্থী।

  • একনায়কতন্ত্রে এক দলীয় শাসনের অধীনে রাষ্ট্রব্যবস্থা অনেক মজবুত ও স্থিতিশীল।

  • একনায়কতন্ত্রে সর্বস্তরে বৈষম্য প্রকট।


গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ


রাষ্ট্রচিন্তায় আদর্শ শাসনব্যবস্থা হিসেবে গণতন্ত্রের স্থান সবার ওপরে।


[1] গণতন্ত্রের সংকট: রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, বিংশ শতাব্দীতে গণতান্ত্রিক ধ্যানধারণার পূর্ণ বিকাশ ঘটে। আধুনিক যুগকে এই কারণে গণতন্ত্রের যুগ বলে অভিহিত করা হয়। অবশ্য বিংশ শতাব্দীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে গণতন্ত্র এক ভয়ংকর সংকটের মুখােমুখি হলে জার্মানি ও ইতালির দুই রাষ্ট্রনায়ক যথাক্রমে হিটলার ও মুসােলিনি গণতান্ত্রিক আদর্শকে ধ্বংস করার জন্য নাৎসিবাদী ও ফ্যাসিবাদী একনায়কতন্ত্র প্রবর্তন করেন।


[2] গণতন্ত্রের অপূর্ণতা: অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠিত না হওয়ায় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রচলিত রাজনৈতিক ও সামাজিক সাম্য অর্থহীন হয়ে পড়েছে। রাষ্ট্রীয় সম্পদ এখানে মুষ্টিমেয় ধনী ব্যক্তির করায়ত্ত।


[3] গণতন্ত্রের বিকল্প গণতন্ত্রই: জনগণের শাসন হিসেবে গণতন্ত্রের কি কোনাে বিকল্প আছে তা নিয়ে যথেষ্ট বিরােধ আছে। অনেকে বলেন গণতন্ত্রের প্রতি বিশ্বাস হারানাে জনগণের প্রতি বিশ্বাস হারানাের সমার্থক।


[4] গণতন্ত্রের অগ্রগতি: বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রে রাষ্ট্রীয় কাজকর্মে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণের প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। নাগরিক বা পুর সমাজের (Civil Society) কাজকর্ম বেড়ে চলেছে। গণতান্ত্রিক অধিকার সংরক্ষণে নাগরিক সচেতনতা অধিকতর মাত্রায় সম্প্রসারিত হচ্ছে।


[5] তৃতীয় বিশ্বে গণতন্ত্র: উন্নত দুনিয়ার গণতান্ত্রিক দেশগুলির সমস্যা এবং উন্নয়নশীল দুনিয়ার গণতান্ত্রিক দেশগুলির সমস্যা এক নয়। বিশ্বের প্রাচীনতম গণতান্ত্রিক দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতবর্ষের গণতান্ত্রিক পরিবেশকে এক করা যায় না। তবুও এ কথা বলা যায় যে, জনগণের ন্যায্য দাবি আদায়ে গণ- আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণে গণতান্ত্রিক পরিবেশের কোনাে বিকল্প নেই।


রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত বলপ্রয়ােগ মতবাদ আলােচনা করাে। রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত বলপ্রয়ােগ মতবাদের সমালােচনা


রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে সামাজিক চুক্তি মতবাদ আলােচনা করাে। রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত সামাজিক চুক্তি মতবাদের সমালােচনা ও প্রবক্তা


 হবস, লক এবং রুশাের তত্ত্বের তুলনামূলক আলােচনা করাে।


হবস, লক, রুশো কীভাবে প্রাকৃতিক অবস্থাকে বর্ণনা করেছেন?


রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে বিবর্তনবাদী তত্ত্ব ব্যাখ্যা করাে।


রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কিত তত্ত্বগুলির সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা করাে।


জাতি, জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতা