রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কিত তত্ত্বগুলির সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা করাে।

রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কিত তত্ত্বসমূহ

রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতপার্থক্য থেকে জন্ম নিয়েছে বিভিন্ন মতবাদ। এগুলির মধ্যে উল্লেখযােগ্য হল- [1] জৈব মতবাদ, [2] ভাববাদ বা আদর্শবাদ, [3] সামাজিক চুক্তি মতবাদ, [4] মার্কসীয় মতবাদ, [5] উদারনৈতিক মতবাদ।


[1] জৈব মতবাদ: রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কিত প্রাচীন মতবাদগুলির মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হল জৈব মতবাদ। জীববিজ্ঞানের সূত্রের সাহায্যে এই মতবাদে রাষ্ট্রের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করা হয়।


মূল বক্তব্য: প্লেটো, অ্যারিস্টটল, সিসেরাে, মারসিগলিও প্রমুখ দার্শনিক সাদৃশ্যমূলক যুক্তির সাহায্যে রাষ্ট্রকে জীবদেহের সঙ্গে তুলনা করেছেন। একটি জীবদেহ যেভাবে বিভিন্ন জীবকোশের সমন্বয়ে গঠিত হয়, রাষ্ট্রও তেমনি অনেক ব্যক্তির সমন্বয়ে গঠিত হয়। জীবদেহের কোষগুলি যেমন একে অপরের ওপর এবং সামগ্রিকভাবে দেহের ওপর নির্ভরশীল, রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত নাগরিকরাও সেইভাবে রাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল। জীবদেহ থেকে অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে সেগুলি যেমন অকেজো হয়ে যায়, রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন ব্যক্তির অবস্থাও তাই হয়। জৈব মতবাদের দ্বিতীয় ধারার প্রবক্তা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ব্লুন্টসলি ও স্পেনসার মানবদেহের সঙ্গে রাষ্ট্রের কোনােরূপ পার্থক্য আছে বলে মানতে চাননি।


[2] ভাববাদ বা আদর্শবাদ: আদর্শবাদ হল রাষ্ট্রের প্রকৃতি বিষয়ক প্রাচীন মতবাদগুলির মধ্যে অন্যতম প্রাচীন গ্রিক রাষ্ট্র তত্ত্বের প্রবক্তা প্লেটো এবং অ্যারিস্টটলের রচনায় এই মতবাদের সন্ধান পাওয়া যায়। পরবর্তীকালে জার্মান দার্শনিক কান্ট, ফিকটে, হেগেল, ট্রিটস্কে, বার্নহার্ডি প্রমুখের দ্বারা এই মতবাদ পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হয়।


মূল বক্তব্য: আদর্শবাদ বা ভাববাদের মূল বক্তব্য হল ঈশ্বরের ক্ষমতার মতাে রাষ্ট্রের ক্ষমতাও অসীম, চরম, সর্বব্যাপী ও নির্ভুল। রাষ্ট্র হল পৃথিবীতে ঈশ্বরের পদচারণা। আদর্শবাদে ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের মধ্যে কোনাে দ্বন্দ্ব স্বীকার করা হয়নি। এই তত্ত্ব অনুসারে রাষ্ট্রের প্রতি দ্বিধাহীন আনুগত্য প্রদর্শনের মাধ্যমে ব্যক্তি তার স্বাধীনতা ভােগ করতে পারে। হেগেলের মতে, রাষ্ট্র ব্যতীত স্বাধীনতা অবাস্তব। রাষ্ট্রকে বাদ দিয়ে ব্যক্তি তার স্বতন্ত্র অস্তিত্বের কথা কল্পনা করতে পারে না।


[3] সামাজিক চুক্তি মতবাদ: রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে একটি তাৎপর্যপূর্ণ মতবাদ হল সামাজিক চুক্তি মতবাদ। এই তত্ত্বের প্রধান প্রবক্তারা হলেন ব্রিটিশ চিন্তাবিদ টমাস হবস, জন লক এবং ফরাসি দার্শনিক রুশো।


মূল বক্তব্য: সামাজিক চুক্তি মতবাদের মূল কথা হল মানুষ চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছে। রাষ্ট্র কোনাে ঐশ্বরিক প্রতিষ্ঠান নয়। ইংরেজ দার্শনিক টমাস হবস ১৬৫১ সালে তাঁর লেভিয়াথান গ্রন্থে এই অভিমত ব্যক্ত করেন যে, প্রাকৃতিক অবস্থায় মানুষের জীবন ছিল নিঃসঙ্গ, দরিদ্র, ঘৃণ্য, পাশবিক ও ক্ষণস্থায়ী। এই অরাজক অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আদিম মানুষ নিজেদের মধ্যে চুক্তি করে সমস্ত ক্ষমতা নিঃশর্তভাবে কোনাে একজন ব্যক্তি বা ব্যক্তিসংসদের হাতে অর্পণ করে। চুক্তি তত্ত্বের অন্যতম প্রবক্তা জন লক চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্র সৃষ্টির কথা মেনে নিলেও শাসকের নিঃশর্ত ক্ষমতাকে অনুমােদন করেননি। তাঁর মতে, শাসক যতক্ষণ পর্যন্ত চুক্তির শর্ত পালন করবেন ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি শাসনক্ষমতা ভােগ করার অধিকার পাবেন। চুক্তির শর্ত পালনে ব্যর্থ হলে জনগণ শাসককে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারবেন। অন্যদিকে ফরাসি দার্শনিক রুশাের মতে, কোনাে ব্যক্তি বা ব্যক্তিসংসদের সঙ্গে মানুষ চুক্তি করেনি। জনগণ নিজেদের মধ্যে এই চুক্তি সম্পাদন করে সার্বভৌম ক্ষমতা সাধারণ ইচ্ছা’র হাতে অর্পণ রছিল।


[4] মার্কসীয় মতবাদ: রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে মার্কসীয় মতবাদ হল এক বৈজ্ঞানিক মতবাদ। রাষ্ট্র সম্পর্কে মার্কস-এঙ্গেলসের চিন্তাধারা ও পরবর্তীকালে লেনিনের রচনা থেকে মার্কসীয় তত্ত্ব গড়ে উঠেছে।


মূল বক্তব্য: মার্কসীয় মতবাদ অনুসারে রাষ্ট্রের আবির্ভাব আকস্মিকভাবে ঘটেনি। সমাজে ব্যক্তিগত সম্পত্তির উদ্ভবের পর রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়। এই সময় সমাজ পরস্পরবিরােধী দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত হয়ে পড়ে। একদিকে সম্পত্তিবান শােষকশ্রেণি, অন্যদিকে সম্পত্তিহীন শােষিতশ্রেণি। এই নতুন অবস্থায় রাষ্ট্র নামক হাতিয়ারের সাহায্যে সমাজে প্রভুত্বকারী সংখ্যালঘু সম্পত্তিবান শ্রেণি তার বিরােধী সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্পত্তিহীন শ্রেণিকে শােষণ করে। এইভাবে দাস সমাজ, সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ও পুঁজিবাদী সমাজে রাষ্ট্র শ্রেণিশােষণের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। মার্কসের মতে, একমাত্র সমাজতান্ত্রিক সমাজে রাষ্ট্র প্রকৃতির আমূল পরিবর্তন ঘটে। বিপ্লবের ফলে পুঁজিবাদী বুর্জোয়া রাষ্ট্রের ধ্বংসের পরে যে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় তা শােষণহীন সমাজব্যবস্থা প্রবর্তন করে। সমাজতান্ত্রিক সমাজের পরবর্তী পর্যায়ে সাম্যবাদী সমাজে সমস্তরকম শ্রেণিশােষণের সমাপ্তি ঘটায় রাষ্ট্রের কোনাে প্রয়ােজন থাকবে না। স্বাভাবিকভাবেই রাষ্ট্রের বিলুপ্তি ঘটবে বলে মার্কসীয় তত্ত্বে দাবি করা হয়।


[5] উদারনৈতিক মতবাদ: রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কিত একটি গুরুত্বপূর্ণ মতবাদ হল উদারনৈতিক মতবাদ। সপ্তদশ শতাব্দীতে সামন্ততান্ত্রিক স্বৈরাচারী শাসন ও বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের মাধ্যমে ইংল্যান্ডে উদারনৈতিক তত্ত্বের উদ্ভব হয়।


মূল বক্তব্য: উদারনীতিবাদের মূল বক্তব্য হল, ব্যক্তির জন্যই রাষ্ট্র গঠিত হয়। তাই রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ব্যক্তির জন্য, ব্যক্তি রাষ্ট্রের জন্য নয়। এই মতবাদ রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে ব্যক্তিস্বাধীনতার নীতিকে প্রতিষ্ঠিত করে। উদারনীতিবাদের প্রধান প্রবক্তা জন লকের মতে, জনগণের সম্মতি হল রাষ্ট্রের মূলভিত্তি। রাষ্ট্রের অস্তিত্ব জনগণের কল্যাণসাধনের ওপর নির্ভরশীল। নয়া উদারনীতিবাদী তাত্ত্বিক রবার্ট নােজিকের মতে, রাষ্ট্র কোনাে ক্ষমতাকেন্দ্রিক বা স্বৈরী-প্রতিষ্ঠান নয়।রাষ্ট্র হল একটি ন্যূনতম রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা (Minimal State)-মাত্র। নিরাপত্তা রক্ষা, ন্যায়বিচার ও প্রতিরক্ষা ছাড়া রাষ্ট্রের আর কোনাে কাজ থাকতে পারে না।


উপসংহার: রাষ্ট্রনৈতিক চিন্তাধারায় মৌলিক মতপার্থক্য থাকলেও, আলােচ্য তত্ত্বগুলি রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে যে বক্তব্য উপস্থাপিত করেছে তার তাৎপর্য অপরিসীম।


রাষ্ট্র ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান বা সামাজিক সংগঠনের মধ্যে সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্যগুলি আলােচনা করাে।


সম্মিলিত জাতিপুঞ্জকে রাষ্ট্র বলা যায় কি । রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কিত ঐশ্বরিক মতবাদটি সমালােচনা-সহ আলােচনা করাে।


রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত বলপ্রয়ােগ মতবাদ আলােচনা করাে। রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত বলপ্রয়ােগ মতবাদের সমালােচনা


রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে সামাজিক চুক্তি মতবাদ আলােচনা করাে। রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত সামাজিক চুক্তি মতবাদের সমালােচনা ও প্রবক্তা


 হবস, লক এবং রুশাের তত্ত্বের তুলনামূলক আলােচনা করাে।


হবস, লক, রুশো কীভাবে প্রাকৃতিক অবস্থাকে বর্ণনা করেছেন?


রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে বিবর্তনবাদী তত্ত্ব ব্যাখ্যা করাে।