জাতি, জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতা

রাজনৈতিক তত্ত্বের আলােচনায় জাতীয় জনসমাজ, জাতি এবং রাষ্ট্র সম্পর্কিত ধারণা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ব্যুৎপত্তিগতভাবে জাতীয় জনসমাজ (Nationality) ও জাতি (Nation) র মধ্যে বিশেষ পার্থক্য না থাকলেও, রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে এই দুটির অর্থ নিয়ে মতভেদ আছে। অনেকে জাতি ও রাষ্ট্রকে অভিন্ন মনে করলেও জাতীয় জনসমাজ, জাতি ও রাষ্ট্রের মধ্যে প্রকৃতিগত স্বাতন্ত্র্য রয়েছে।


অধ্যাপক টমাস হিল গ্রিনের মতাে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা রাষ্ট্র বা জাতির মধ্যে কোন ভেদরেখা টানতে চাননি। তাঁরা রাষ্ট্রকে রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত কোনাে জাতি বা জনসমষ্টি বলে আখ্যা দিয়েছেন। পণ্ডিতদের মতে, রাষ্ট্র একটি রাজনৈতিক ধারণা। অন্যদিকে, জাতি হল এক ভাবগত উপলদ্ধি বিশেষ৷ অবশ্য জাতি ও রাষ্ট্র একে অপরের পরিপূরক বলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা রায় দিয়েছেন৷ এই কারণে রাষ্ট্রকে জাতীয় রাষ্ট্র বলা হয়।


জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার-সম্পর্কিত তত্ত্ব বহুকাল আগে এক জাতি, এক রাষ্ট্র নীতিকে তুলে ধরে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা এই তত্ত্বের পক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তি দেখিয়েছেন। ইউরােপে নবজাগরণ ও ধর্মসংস্কার আন্দোলনের ফলশ্রুতিস্বরূপ জাতীয়তাবাদের উৎপত্তি ঘটে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এর বিকৃত রূপ প্রকাশ পেলে বিশ্বের চিন্তানায়করা বিকল্প হিসেবে তুলে ধরেন আন্তর্জাতিকতাবাদকে।


জাতীয় জনসমাজ

জাতীয় জনসমাজ (Nationality) হল জনসমাজ (People) ও জাতির (Nation) মধ্যবর্তী পর্যায়। সাধারণভাবে বলা যায়, যখন কোনাে জনসমাজ রাজনৈতিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে অন্যান্য জনসমাজ থেকে নিজেদের সম্পূর্ণ আলাদা বলে ভাবতে থাকে, তখন সেই জনসমাজ জাতীয় জনসমাজে পরিণত হয়।


জন স্টুয়ার্ট মিল রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন জনসমাজকে জাতীয় জনসমাজ আখ্যা দিয়েছেন। লর্ড ব্রাইসের মতে, জাতীয় জনসমাজ বলতে এমন এক জনসমাজকে বােঝায় যারা শতাব্দীব্যাপী ভাষা, সাহিত্য, ধ্যানধারণা, রীতিনীতি ও ঐতিহ্যের বন্ধনে দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ এবং যারা অনুরূপভাবে আবদ্ধ অন্য কোনাে জনসমাজ থেকে নিজেদের স্বতন্ত্র বলে মনে করে থাকে। ম্যাকাইভার জাতীয় জনসমাজ বলতে সম্প্রদায়ের সামাজিক ঐক্যবােধকে বুঝিয়েছেন। কোকার মনে করেন, জাতীয় জনসমাজ হল প্রধানত অতীত ইতিহাসের অভিজ্ঞতা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ফলাফল।


জাতীয় জনসমাজের মূল উপাদান


রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা জাতীয় জনসমাজ গঠনের উপাদানগুলিকে দুটি ভাগে ভাগ করেছেন।


[1] বাহ্যিক বা বস্তুগত উপাদান: এগুলি হল—ভৌগােলিক একতা, বংশগত ঐক্য, ভাষাগত ঐক্য, ধর্মগত ঐক্য, রাষ্ট্রনৈতিক ঐক্য এবং অর্থনৈতিক সমস্বার্থ।


[2] ভাবগত উপাদান: জাতীয় জনসমাজ গঠনের ক্ষেত্রে শুধু বাহ্যিক বা বস্তুগত উপাদানই যথেষ্ট নয়, ভাবগত ঐক্যও অপরিহার্য। জাতীয় জনসমাজ গঠনে ভাবগত উপাদানই হল মূল ঐক্যবিধানকারী শক্তি (cementing factor)। ফরাসি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রেনার মতে, জাতীয় জনসমাজ-সম্পর্কিত ধারণা হল প্রধানত একটি ভাবগত ধারণা। কোনাে জনসমাজ যখন ভাবে যে তাদের সুখ-দুঃখ, ব্যথা-বেদনা, আশা-আকাঙ্ক্ষা, গৌরব-গ্লানি সব এক, তখন সেই জনসমাজের চেতনায় জাতীয়তাবােধের সঞ্চার ঘটে।


জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার


[1] সূত্রপাত: ১৭৭২ সালে পােল্যান্ডের বিভক্তিকরণের ঘটনাকে ভিত্তি করেই জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণ-সম্পর্কিত আলোচনার সূত্রপাত ঘটে।


[2] অর্থ ও ব্যাখ্যা: প্রত্যেক জাতির স্বাধীন ও স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠন করার অধিকারকে বলা হয় আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার। আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার তত্ত্বের মূলভিত্তি হল এক জাতি, এক রাষ্ট্র নীতি। এই নীতি অনুসারে প্রতিটি রাষ্ট্র হবে জাতিভিত্তিক। এক-একটি জাতিকে নিয়ে গঠিত হবে এক-একটি রাষ্ট্র। কোনাে রাষ্ট্র যদি পাঁচটি জাতিকে নিয়ে গঠিত হয়ে থাকে তাহলে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার নীতি অনুসারে ওই রাষ্ট্রকে ভেঙে পাঁচটি আলাদা আলাদা রাষ্ট্র তৈরি করতে হবে।


[3] মিলের মত: এই তত্ত্বের অন্যতম প্রবক্তা জন স্টুয়ার্ট মিলের বক্তব্য হল, জাতীয় জনসমাজের সীমানা রাষ্ট্রের সীমানার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া বাঞ্ছনীয়।


[4] লেনিনের মত: লেনিনের মত, বিদেশি শাসন থেকে মুক্তি ও স্বাধীন সরকার গঠন বা অত্যাচারী শাসকের হাত থেকে রাজনৈতিক মুক্তি হল আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার।


জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের পক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তি


জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের পক্ষে যুক্তিগুলি হল— [1] সংখ্যালঘু সমস্যার সমাধানে সহায়ক, [2] গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পক্ষে উপযুক্ত, [3] জাতীয় গুণাবলির বিকাশে সহায়ক, [4] বিশ্বসভ্যতার বিকাশে সহায়ক, [5] নৈতিক মানদণ্ডে সমর্থনযােগ্য, [6] জাতিগত সংঘাতের সম্ভাবনা হ্রাস [7] রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের সঙ্গে ব্যক্তিস্বাধীনতার সমন্বয়সাধন।


সমালােচকরা এই তত্ত্বের বিপক্ষে যে যুক্তিগুলি দিয়েছেন— [1] অখণ্ডতার পরিপন্থী, [2] অবাস্তব, [3] উন্নত সভ্যতা ও সংস্কৃতির পরিপন্থী, [4] উদ্বাস্তু সমস্যার সৃষ্টিকারী, [5] সংখ্যালঘু সমস্যার সমাধানে সহায়ক নয়, [6] অগণতান্ত্রিক, [7] বৈরী মনােভাবের জন্মদাতা, [8] ইতিহাসের পশ্চাদ্গতির সূচক।


জাতীয়তাবাদের অর্থ


জাতীয়তাবাদ হল এমন এক মতাদর্শ যা জাতির আত্মপ্রতিষ্ঠার দাবিকে বাস্তবায়িত করতে সাহায্য করে। কোনাে জনসমাজের মধ্যে বংশ, ধর্ম, ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি প্রভৃতি নানা কারণে যখন গভীর একাত্মবােধের সৃষ্টি হয় এবং এই একাত্মবােধের জন্য জনসমাজের প্রত্যেকে যখন নিজেকে সুখ-দুঃখ, ন্যায়-অন্যায়, মান-অপমানের সমান অংশীদার বলে মনে করে তখন জাতীয়তাবোধের জন্ম হয়। দেশপ্রেম এই জাতীয়তাবােধের সঙ্গে মিলিত হয়ে জাতীয়তাবাদের সৃষ্টি করে। বার্নসের মতে, ইউরােপের নবজাগরণ ও সংস্কার আন্দোলনের সময়ে জাতীয়তাবাদের ধারণার উৎপত্তি ঘটে।


[1] বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর অভিমত: বার্ট্রান্ড রাসেলের মতে, জাতীয়তাবাদ হল এমন এক সাদৃশ্য ও ঐক্যের অনুভূতি যা পরস্পরকে ভালােবাসতে শেখায় ("Nationalism is a sentiment of similarity and solidarity")। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী লয়েড জাতীয়তাবাদকে আধুনিক বিশ্বের ধর্ম বলে বর্ণনা করেছেন। লেনিন নিপীড়নকারী শাসকশ্রেণির বিরুদ্ধে শােষিত ও নির্যাতিত জাতির গণতান্ত্রিক আন্দোলন হিসেবে জাতীয়তাবাদকে দেখেছেন।


[2] বিকাশ: জাতীয়তাবাদের ধারণা ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের সময় পূর্ণতা লাভ করে। ১৭৮৯ সালের ১ অক্টোবর ফরাসি সরকারের মৌলিক আদর্শ ঘােষণা করে বলা হয়, "জাতি হল সমস্ত ক্ষমতার উৎস। জাতীয়তাবাদের প্রভাবে জার্মানি, ইতালি, স্পেন ও রাশিয়ায় প্রতিরােধ সংগ্রাম গড়ে ওঠে। ১৮০৭ সালে দার্শনিক ফিকটে জাতির উদ্দেশ্যে এক ঘােষণায় মানুষকে দেশপ্রেমের অগ্নিশিখায় উদ্দীপ্ত করে হাসিমুখে জাতির জন্য আত্মবলিদানের আহ্বান জানান।


[3] জাতীয়তাবাদের বৈশিষ্ট্য: জাতীয়তাবাদের উল্লেখযােগ্য বৈশিষ্ট্যগুলি হল- (i) ঐতিহাসিক ও পরিবর্তনশীল প্রকৃতি, (ii) বিবিধ রূপে প্রকাশিত, (iii) ভাবগত ঐক্যের সহায়ক, (iv) রাষ্ট্রের মুখ্য উপাদান, (v) গণসার্বভৌমিকতার আদর্শ স্বীকৃত, (vi) নেতিবাচক ও ইতিবাচক দিকের অস্তিত্ব, (vii) মুক্তির দিশারি, (vii) ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতীক, (ix) জাত্যাভিমানের প্রতীক এবং (x) আন্তর্জাতিক সম্প্রীতির সহায়ক।


জাতীয়তাবাদদের বিভিন্নতা: আদর্শ ও বিকৃত জাতীয়তাবাদ


আদর্শ জাতীয়তাবাদের মূল কথা, "নিজে বাঁচো এবং অপরকে বাঁচতে দাও।” আদর্শ জাতীয়তাবাদ আন্তর্জাতিকতার পরিপূরক। অপরদিকে, আদর্শ বা প্রকৃত জাতীয়তাবাদ কখনাে কখনাে আদর্শভ্রষ্ট হয়ে সংকীর্ণ ও উগ্র জাতীয়তাবাদে পরিণত হলে তা বিকৃত জাতীয়তাবাদে রূপ নেয়।


তৃতীয় বিশ্বের জাতীয়তাবাদ


তৃতীয় বিশ্ব নামটি প্রথম ব্যবহৃত হয়েছিল ১৯৫২ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশগুলিকে এক সঙ্গে তৃতীয় বিশ্ব আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। প্রথম বিশ্ব অর্থাৎ উন্নত ধনতান্ত্রিক দেশগুলি এবং দ্বিতীয় বিশ্ব, অর্থাৎ সমাজতান্ত্রিক দেশগুলি থেকে এদের পৃথক করার জন্যই এই নামকরণ করা হয়। রাজনৈতিক ধারণা হিসেবে ইউরোপের জাতীয়তাবাদ ও তৃতীয় বিশ্বের জাতীয়তাবাদের মধ্যে মৌলিক কোনাে পার্থক্য নাই। তবে তৃতীয় বিশ্বের জাতীয়তাবাদের কতকগুলি বৈশিষ্ট্য আছে। যথা- [1] সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী, [2] ধর্মীয় প্রভাব, [3] গােষ্ঠীগত ভেদাভেদ, [4] ভাষাগত বিভেদ, [5] জাতিগত বিভেদ, [6] আবেগ প্রবণ, [7] শিক্ষার অভাব, [8] নির্দিষ্ট লক্ষ্যের অভাব।


আন্তর্জাতিকতাবাদের অর্থ


বৃহত্তর বিশ্বসমাজ গঠনের উদ্দেশ্যে নিবেদিত এক আদর্শের নাম হল আন্তর্জাতিকতাবাদ। বিশ্বমানবতা, বিশ্বশান্তি এবং বিশ্বভ্রাতৃত্বের নীতি হল আন্তর্জাতিকতার প্রধান উপাদান। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী গােল্ডস্মিথের অভিমত অনুসারে, আন্তর্জাতিকতাবাদ হল এমন একটি ধারণা যা একজন ব্যক্তিকে শুধুমাত্র তার নিজের দেশের নয়, সমগ্র পৃথিবীর নাগরিক হিসেবে গণ্য করে।


বিগত শতাব্দীতে পরপর দুটি বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বের মনীষীদের চিন্তায় জাতীয় রাষ্ট্র তথা জাতীয়তাবাদের বিকল্প হিসেবে বিশ্বরাষ্র তথা আন্তর্জাতিকতাবাদের ধারণাটি প্রাধান্য পায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় উগ্র জাতীয়তাবাদ যেভাবে মানবজাতিকে এক সর্বাত্মক ধ্বংসের পথে ঠেলে দেয়, তা থেকে মুক্তির পথ হিসেবে আন্তর্জাতিকতাবাদের জন্ম হয়।


আন্তর্জাতিকতাবাদের বৈশিষ্ট্য


আন্তর্জাতিকতাবাদের কয়েকটি উল্লেখযােগ্য বৈশিষ্ট্য হল- [1] বিশ্বশান্তি ও মানবসভ্যতার সংরক্ষক, [2] পারস্পরিক রাষ্ট্রীয় সহযােগিতার পৃষ্ঠপােষক, [3] সাম্রাজ্যবাদবিরোধী, [4] বিশ্বসমৃদ্ধির সহায়ক, [5] জাতিবৈরিতার অবসানের পক্ষপাতী, [6] মানবসভ্যতার বিকাশে সহায়ক, [7] সংকীর্ণ বা বিকৃত জাতীয়তাবাদের বিরােধী।


জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদের মধ্যে সম্পর্ক


জিমার্ন, ম্যাৎসিনি, রাসেল প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মনে করেন জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদ একে অপরের পরিপূরক। আবার ল্যাস্কি, গার্নার, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ জাতীয়তাবাদকে আন্তর্জাতিকতার পরিপন্থী বলে মনে করেন। জাতীয়তাবাদ হল একটি জনসমাজের গভীর স্বাতন্ত্র্যবােধের প্রকাশ। জাতীয়তাবাদ এমন এক মানসিকতা যা প্রত্যেক জাতীয় জনসমাজকে তাদের নিজস্ব সত্তা সম্পর্কে সজাগ হতে সাহায্য করে। অন্যদিকে, আন্তর্জাতিকতা এক মহান আদর্শে অনুপ্রাণিত মানসিক অনুভূতি। বিভিন্ন জাতির স্বাতবােধ বিসর্জন না দিয়ে এক বিশ্বসমাজ গড়ে তােলাই এর মুখ্য উদ্দেশ্য। বস্তুতপক্ষে, মানবসভ্যতার যথার্থ বিকাশের জন্য জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদের সুষ্ঠু সমন্বয়সাধন অত্যন্ত জরুরি।


জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ধারণা


জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ধারণা ছিল সম্পূর্ণ নিজস্ব। তাঁর জাতীয়তাবাদী ভাবনা একদিকে যেমন স্বদেশি চেতনার সীমিত গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, অন্যদিকে তেমনই ইউরােপীয় জাতীয়তাবােধের অহমিকার দ্বারাও প্রভাবিত ছিল না। জাতীয়তাবাদ বিষয়টিকে রবীন্দ্রনাথ বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে দেখতে চেয়েছিলেন যেখানে কোনােরকম সংকীর্ণতার স্থান নেই।


[1] ইউরােপীয় জাতীয়তাবাদের সমালােচনা: রবীন্দ্রনাথ তাঁর ন্যাশনালিজম (Nationalism) গ্রন্থে জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে নিজের মৌলিক চিন্তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেন। ১৯১৬-১৭ সালে জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণের সময় বিভিন্ন জায়গায় তিনি যেসব বক্তৃতা দেন, সেগুলি নিয়েই তার ন্যাশনালিজম গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ জাতীয়তাবাদ, বিশেষত ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদের তীব্র সমালােচনা করেন।


[2] পাশ্চাত্য সভ্যতা ও জাতীয়তাবাদ: রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন যে, ইউরােপ তথা পশ্চিমের যন্ত্রনির্ভর সভ্যতার মূল চালিকাশক্তি হল জাতীয়তাবাদ। পাশ্চাত্য সভ্যতার জাতীয়তাবাদ সমগ্র মানবজাতি এবং সমগ্র মানবসভ্যতার পক্ষে এক ভয়াবহ বিপদ।


[3] জাতি ও জাতীয়তাবাদ: রবীন্দ্রনাথ তাঁর শিক্ষার মিলন প্রবন্ধে এ কথা স্পষ্টভাবে বলেছেন যে, জাতি (nation) গঠিত হয়েছে সত্যের জোরে কিন্তু জাতীয়তাবাদ (Nationalism) সত্য নয়। জাতীয়তাবাদ এমন এক ধরনের দুর্বুদ্ধিসম্পন্ন মানসিকতা যেখানে দেশের আত্মস্তরিতা প্রকাশ পায়।


[4] জাতির চেয়ে মানুষ বড়াে: মানবতাবাদী রবীন্দ্রনাথের কাছে জাতির চেয়ে মানুষই ছিল বড়াে। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন যে, জাতীয়তাবাদের প্রভাবে মানুষের মধ্যে যে বিচ্ছিন্নতার সৃষ্টি হয়, তাতে মনুষ্যত্বের অবক্ষয় ঘটে।


[5] ভারতীয় জাতীয়তাবাদ: রবীন্দ্রনাথ সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন, পশ্চিমি জাতীয়তাবাদ—পশ্চিমি সভ্যতার এই পথ কখনােই ভারতবর্ষের পথ হতে পারে না| এক্ষেত্রে কাম্য হল এক বিশ্বজনীন মানবিক আদর্শ যা আধ্যাত্মিক ঐক্যে উদ্বুদ্ধ।


জাতি


লাতিন 'Natio' শব্দ থেকে আসা ইংরেজি 'Nation' শব্দটির বাংলা প্রতিশব্দ কী হওয়া উচিত তা নিয়ে মতবিরোধ থাকলেও, শব্দটি বাংলায় জাতি প্রতিশব্দের রূপ পেয়েছে। কিন্তু বাংলায় জাতপাত, বর্ণভেদ, ধর্ম, কুল ইত্যাদি বােঝাতে জাতি শব্দের প্রচলন রয়েছে।


বস্তুতপক্ষে 'জাতি' হল সাধারণভাবে 'জনসমাজ'-এর একটি চূড়ান্ত বিকশিত রূপ। জনসমাজের মধ্যে এক গভীর স্বাতন্ত্র্যবােধ দেখা দিলে জাতীয় জনসমাজের উদ্ভব ঘটে। লর্ড ব্রাইসের মতে, জাতি বলতে বােঝায় রাষ্ট্রনৈতিকভাবে সংগঠিত এমন এক জনসমাজকে, যা বহিঃশাসন থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত অথবা মুক্ত হওয়ার জন্য সচেষ্ট। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হায়েসের মতে, একটি ঐক্যবদ্ধ জাতীয় জনসমাজ স্বাধীনতা ও সার্বভৌমিকতা অর্জন করলে জাতি হিসেবে পরিগণিত হয়।


জাতি ও রাষ্ট্রের মধ্যে পার্থক্য


অনেক সময় জাতি ও রাষ্ট্রের ধারণাকে অভিন্ন বলে মনে করলেও উভয়ের মধ্যে কয়েকটি মৌল প্রভেদ রয়েছে-


জাতি

  • রাজনৈতিক চেতনাযুক্ত ঐক্যবদ্ধ জাতীয় জনসমাজ নিয়ে জাতি গড়ে ওঠে।

  • জাতির হাতে কোনাে সার্বভৌম ক্ষমতা থাকে না।

  • জাতি গঠনের পক্ষে একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ড অপরিহার্য উপাদান নয়।

  • জাতি একটি ভাবগত ধারণা মাত্র।

  • জাতির ভিত্তিতে রাষ্ট্রের শ্রেণিবিভাজন সম্ভব। কিন্তু জাতির নিজের ক্ষেত্রে এই বিভাজন সম্ভব নয়।


রাষ্ট্র

  • রাষ্ট্রগঠনের জন্য নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, সরকার ও সার্বভৌমিকতা প্রভৃতি উপাদান একান্তভাবে প্রয়ােজন।

  • রাষ্ট্র এক চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী, যা সার্বভৌম ক্ষমতারূপে পরিচিত।

  • রাষ্ট্রের একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ড অবশ্যই থাকা দরকার।

  • রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, রাষ্ট্র হল একটি আইনগত ধারণা।

  • রাষ্ট্র একজাতিভিত্তিক বা বছুজাতিভিত্তিক উভয়প্রকারই হতে পারে।


জাতি ও রাষ্ট্রের মধ্যে প্রভেদ থাকা সত্ত্বেও এই দুটি একে অপরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করে।


জাতীয় জনসমাজ ও জাতির মধ্যে পার্থক্য


জাতীয় জনসমাজ (Nationality) ও জাতিকে (Nation) অনেক সময় অভিন্ন মনে করা হয়। গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে জাতি ও জাতীয় জনসমাজের মধ্যে সূক্ষ্ম প্রকৃতিগত পার্থক্য দেখতে পাওয়া যায়।


রাজনৈতিক চেতনাগত পার্থক্য


জে এইচ রােজ জাতীয় জনসমাজকে জনসমাজ ও জাতির মধ্যবর্তী পর্যায় হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন জাতীয় জনসমাজ যখন বাইরের শাসন থেকে মুক্ত হয়ে বা মুক্তি পেতে সচেষ্ট হয়ে স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠনের জন্য জাতীয়তাবােধে উদ্বুদ্ধ হয় তখনই তা জাতি হয়ে ওঠে। জাতি হল জাতীয় জনসমাজের রাজনৈতিক রূপ। লর্ড ব্রাইস বহিঃশাসন থেকে মুক্ত বা মুক্তিকামী জাতীয় জনসমাজকে জাতি আখ্যা দিয়েছেন।


জাতীয়তাবাদের পক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তি


প্রকৃত জাতীয়তাবাদের পক্ষে যুক্তিগুলি হল—[1] মহান আদর্শ, [2] গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সহায়ক, [3] সম্প্রীতির প্রতীক, [4] মানবসভ্যতার বিকাশে সহায়ক [5] স্থায়িত্ব ও শান্তির সহায়ক, [6] যুদ্ধের সম্ভাবনা হ্রাসকারী, [7] আন্তর্জাতিকতাবাদের সােপান।


হায়েসের মতে, উগ্র জাতীয়তাবাদ চরম অন্যায় ও অকল্যাণের প্রধান উৎস। রবীন্দ্রনাথ একে মানবসভ্যতার শত্রুরূপে আখ্যা দেন। এর বিপক্ষে যুক্তিগুলি হল[1] সাম্রাজ্যবাদের জনক, [2] জাতিবিদ্বেষের জনক, [3] সুস্থ সংস্কৃতির পরিপন্থী, [4] গণতন্ত্র হত্যাকারী, [5] সাংস্কৃতিক স্থবিরতার জন্মদাতা, [6] বিশ্বশান্তির বিরােধী, [7] আন্তর্জাতিকতার বিরােধী।


একটি জাতি হিসেবে ভারত


ভারতীয় জনগণের মধ্যে নানা বিষয়ে অনৈক্য বা বৈচিত্র্যকে জাতিত্ব অর্জনের পক্ষে অসুবিধাজনক বলে উল্লেখ করা হয়। সমজাতীয় ভাষা ও সংস্কৃতির কোনােটাই ভারতে নেই। বরং ভারত একটি বহু ভাষাভাষী ও মিশ্র সংস্কৃতির দেশ। এই বিষয়ে অবশ্য ভিন্নমতও রয়েছে। বলা হয়, জাতি গঠনের ক্ষেত্রে ভাষা বা সংস্কৃতিগত বৈচিত্র্য বাধা হতে পারে না। জাতি গঠনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল ঐতিহাসিক উপাদান ও রাজনৈতিক ঐক্যবােধ। একই ভৌগােলিক অঞ্চলে বসবাসকারী ঐক্যবদ্ধ জনসমষ্টি একই রাজনৈতিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হলে, তা জাতিতে পরিণত হয়।


জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদের মধ্যে পার্থক্য


জাতীয়তাবাদ


  • মধ্যযুগে ইউরােপের নবজাগরণ ও সংস্কার আন্দোলনের ফলে জাতীয়তাবাদের উৎপত্তি ঘটে।

  • জাতীয়তাবােধের সঙ্গে দেশপ্রেম মিলিত হলে জাতীয়তাবাদ সৃষ্টি হয়।

  • জাতীয়তাবাদ জাতীয় রাষ্ট্র গঠনের আদর্শকে সামনে বিশ্ব রেখে কাজ করে।

  • জাতীয়তাবাদের মূলভিত্তি হল স্বদেশপ্রীতি।

  • জাতীয়তাবাদ নিজের জাতি সম্পর্কে এক শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা প্রচার করে জাতিগত স্বাতন্ত্র গড়ে তােলে।


আন্তর্জাতিকতাবাদ


  • আন্তর্জাতিকতাবাদ ধারণাটির উৎপত্তি অপেক্ষাকৃত আধুনিককালের ঘটনা।

  • আন্তর্জাতিকতাবাদ হল এমন এক বিশেষ মানসিক অনুভূতি যা এক বিশ্ব, এক রাষ্ট্রগঠনে বিশ্বাসী।

  • আন্তর্জাতিকতাবাদ বিশ্বরাষ্ট্র গঠনের মাধ্যমে এক বিশ্বসমাজ গড়ে তুলতে চায়।

  • আন্তর্জাতিকতাবাদের মূলভিত্তি হল বিশ্বপ্রীতি।

  • আন্তর্জাতিকতাবাদ জাতিগত স্বাতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে বিশ্বশান্তি ও বিশ্বভ্রাতৃত্বের আদর্শ প্রচার করে, বিশ্বসমাজ ও বিশ্বমানবসভ্যতা গড়ে তােলার লক্ষ্যে কাজ করে।


আন্তর্জাতিকতার গুরুত্ব


আন্তর্জাতিকতার গুরুত্ব নানান দিক থেকে অনুধাবন করা যায়, যেমন- [1] বিশ্বশান্তি ও মানবসভ্যতার সংরক্ষক, [2] বিশ্বসমৃদ্ধির সহায়ক, [3] পারস্পরিক সহযােগিতার প্রসারক, [4] জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নতির সহায়ক, [5] উপনিবেশবাদ এবং নয়া উপনিবেশবাদের গতিরােধকারী।


জাতিগত বিন্যাসে রাষ্ট্র


জাতিগত বিন্যাসে রাষ্ট্র দুরকমের—[1] একজাতিক রাষ্ট্র, যেমন—পাকিস্তান; [2] বহুজাতিক রাষ্ট্র, যেমন—ভারত।

জাতি রাষ্ট্রের ধারণা


রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বার্নসের মতে, জাতি-রাষ্ট্রের ধারণা ফরাসি বিপ্লবের (১৭৮৯) মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ইউরােপ ও আমেরিকার বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। তার ফলশ্রুতিস্বরূপ স্বাধীন জাতি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। পরবর্তীকালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর এক জাতি, এক রাষ্ট্র তত্ত্বের প্রভাবে জাতি ও রাষ্ট্রের মধ্যে বিভেদরেখা মুছে যেতে শুরু করে।রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা জাতি-রাষ্ট্রের কোনাে নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নির্ধারণ করেননি। সাধারণভাবে জাতি-রাষ্ট্র বলতে জাতি বা জাতীয় জনসমাজের ভিত্তিতে গঠিত কোনাে রাষ্ট্রকে বােঝায়। আধুনিক যুগে জাতি-রাষ্ট্রের ধারণা তত প্রাসঙ্গিক নয়। কারণ আধুনিক যুগে একটি রাষ্ট্রের মধ্যে একাধিক জাতির অস্তিত্ব থাকা সম্ভব। পৃথিবীতে এমন বহু রাষ্ট্র রয়েছে যেগুলি বহুজাতি-অধ্যুষিত রাষ্ট্র। দৃষ্টান্তস্বরূপ, ভারতবর্ষের কথা উল্লেখ করা যায়।


সম্মিলিত জাতিপুঞ্জকে রাষ্ট্র বলা যায় কি । রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কিত ঐশ্বরিক মতবাদটি সমালােচনা-সহ আলােচনা করাে।


রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত বলপ্রয়ােগ মতবাদ আলােচনা করাে। রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত বলপ্রয়ােগ মতবাদের সমালােচনা


রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে সামাজিক চুক্তি মতবাদ আলােচনা করাে। রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত সামাজিক চুক্তি মতবাদের সমালােচনা ও প্রবক্তা


 হবস, লক এবং রুশাের তত্ত্বের তুলনামূলক আলােচনা করাে।


হবস, লক, রুশো কীভাবে প্রাকৃতিক অবস্থাকে বর্ণনা করেছেন?


রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে বিবর্তনবাদী তত্ত্ব ব্যাখ্যা করাে।


রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কিত তত্ত্বগুলির সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা করাে।