রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত বলপ্রয়ােগ মতবাদ আলােচনা করাে। রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত বলপ্রয়ােগ মতবাদের সমালােচনা

রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত বলপ্রয়োগ মতবাদ

রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কিত কল্পনাপ্রসূত মতবাদগুলির মধ্যে অন্যতম হল বলপ্রয়ােগ মতবাদ।


[1] মূল বক্তব্য: এই মতবাদের মূল বক্তব্য হল, রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়েছে শুধুমাত্র বলপ্রয়ােগের ভিত্তিতে। পশু বল বা বাহুবল হল রাষ্ট্রের মূলভিত্তি। প্রকৃতিগতভাবে সামাজিক জীব হিসেবে মানুষ কলহপ্রিয় ও ক্ষমতালােভী। ম্যাকিয়াভেলির মতে, মানুষ সম্বন্ধে সাধারণ ধারণা হল যে তারা অকৃতজ্ঞ, অস্থির, মিথুক, ভীরু ও ক্ষমতালােভী (This is to be asserted in gen eral of men that they are ungrateful, fickle, false, cowardly, covetous.)। তাই অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা করার জন্য এবং বৈদেশিক আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য রাষ্ট্রকে সর্বদা পুলিশ ও সামরিক বাহিনী প্রস্তুত রাখতে হয়। কাজেই বলপ্রয়োগ মতবাদ অনুযায়ী, রাষ্ট্রের অস্তিত্বের স্বার্থে শক্তি বা বলপ্রয়ােগ অপরিহার্য। গ্রিক দার্শনিক হেরাক্লিটাস ছিলেন বলপ্রয়ােগ মতবাদের প্রথম প্রবক্তা। এই মতবাদের অন্যান্য প্রবক্তাদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হলেন ম্যাকিয়াভেলি, হারবার্ট স্পেনসার, ডেভিড হিউম, ট্রিটস্কে, লিকক, ওপেনহাইমার, জেঙ্কস প্রমুখ।


[2] রাষ্ট্রের সৃষ্টি: মানবসভ্যতার ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, অতীতে মানবসমাজ ছিল বহু ক্ষুদ্র গােষ্ঠী, দল ও উপজাতিতে বিভক্ত। প্রথম অবস্থায় কোনাে শক্তিশালী ব্যক্তি দুর্বল ব্যক্তি বা দলের ওপর পাশবিক বলের সাহায্যে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে গােষ্ঠীর সৃষ্টি করে। পরবর্তীকালে গােষ্ঠী থেকে সৃষ্টি হয় উপজাতির পরে উপজাতিগুলির মধ্যে সংঘর্ষ দেখা দেয়। এইভাবে কোনাে শক্তিশালী উপজাতি যখন দুর্বল উপজাতিগুলির ওপর বলপ্রয়ােগের মাধ্যমে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়, তখন বিজয়ী উপজাতি তাদের দলপতিকে শাসনকর্তারূপে স্বীকৃতি দেয়। কালক্রমে দলপতির শাসনে এক-একটি এলাকায় রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয় এবং দলপতি নিজে রাজা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। এই কারণে ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ার মন্তব্য করেন, প্রথম যিনি রাজা হন, তিনি ছিলেন একজন সৌভাগ্যবান যােদ্ধা।


[3] রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত বলপ্রয়ােগ মতবাদের সমালােচনা:


রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে বলপ্রয়ােগ মতবাদটি বিভিন্ন দিক থেকে সমালােচিত হয়েছে।


  • একপেশে ধারণা: রাষ্ট্রের উৎপত্তির একমাত্র কারণ বলপ্রয়ােগ—এ কথা কখনােই স্বীকার করা যায় না। বলপ্রয়ােগ ছাড়াও রাষ্ট্রের উৎপত্তির আরও অনেক কারণ রয়েছে। তাই লিকক বলেছেন যে, রাষ্ট্রের উৎপত্তির অন্যতম কারণকে একমাত্র কারণ বলে মনে করে এই মতবাদ ভুল করেছে।


  • রাষ্ট্রের ভিত্তি হিসেবে জনগণের সম্মতি: সমালােচকদের মতে, শুধুমাত্র বলপ্রয়ােগের দ্বারা রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব টিকিয়ে রাখা যায় না। ব্রিটিশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী টি এইচ গ্রিনের মতে, জনগণের সম্মতি হল রাষ্ট্রের ভিত্তি, পাশবিক বল নয় (Will, not force, is the basis of the State)।


  • আনুগত্যের বিভ্রান্তিকর ব্যাখ্যা: রাষ্ট্রের প্রতি জনগণের আনুগত্যের প্রকৃত কারণ হল সরকারের বলপ্রয়ােগ বা ক্ষমতার ভয়-বলপ্রয়ােগ মতবাদ এ কথা প্রচার করে চরম বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। জনগণ শুধুমাত্র রাষ্ট্রশক্তির ভয়ে আইন মেনে চলে, এ কথা ঠিক নয়। আইনের যথার্থ উপযােগিতা বা প্রয়ােজনীয়তা বুঝেই তারা আইন মান্য করে থাকে।


  • স্বৈরাচারের সমর্থক: অভ্যন্তরীণ শান্তিশৃঙ্খলা ও প্রতিরক্ষার ব্যাপারে বলপ্রয়ােগ একান্ত অপরিহার্য—এই মতবাদ জনগণকে স্বাধীনতা ও নাগরিক অধিকারের মূল্যকে উপেক্ষা করে ক্ষমতাবান স্বৈরাচারী শাসকের কাছে নত থাকার শিক্ষা দেয়। 'জোর যার মুলুক তার' বা 'বীরভােগ্যা বসুন্ধরা' প্রভৃতি নীতিতে বিশ্বাস রেখে এই মতবাদ স্বৈরাচারিতাকেই আসলে সমর্থন করে।


  • নৈতিকতার বিরােধী: বল বা শক্তি প্রয়ােগের দ্বারা রাষ্ট্রের সৃষ্টি এবং তাকে সংরক্ষিত রাখার প্রয়াস নৈতিক দিক থেকে সমর্থনযােগ্য নয়। এই মতবাদে গণতন্ত্র, সাম্য, ব্যক্তিস্বাধীনতার পরিবর্তে স্বৈরাচারিতা, বাহুবল প্রভৃতি অনৈতিক বিষয়কে সমর্থন করা হয়।


  • হীন প্রবৃত্তিকে গুরুত্বদান: দয়ামায়া, স্নেহ, প্রেম, প্রীতি প্রভৃতি সদগুণের পরিবর্তে লােভ, হিংসা, স্বার্থপরতা প্রভৃতি হীন প্রবৃত্তিকে এই মতবাদ গুরুত্ব দিয়েছে।


  • সভ্যতার অগ্রগতির পরিপন্থী: বলপ্রয়ােগ মতবাদ সভ্যতার পশ্চাদ্গতি সূচিত করে। বিশ্বের মনীষীরা বহুকাল ধরেই মানবিকতাবাদ ও সাম্য-মৈত্রী স্বাধীনতার ভিত্তিতে বিশ্বশান্তির যে আদর্শের কথা প্রচার করে চলেছেন, বলপ্রয়ােগ মতবাদ তার পরিপন্থী।


  • অগণতান্ত্রিক: বলপ্রয়ােগ মতবাদ অনুসারে, রাষ্ট্রনায়করা জনগণের কাছে কোনােভাবেই দায়বদ্ধ থাকেন না। এই মতবাদে গণতান্ত্রিক আদর্শ ও মূল্যবােধকে কোনাে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি।


  • মানবিকতার পরিপন্থী: বলপ্রয়ােগ মতবাদে যেভাবে যােগ্যতমের উদ্বর্তন (Survival of the fittest) নীতিকে প্রচার করা হয়েছে তা মানবিক দিক থেকে কোনােভাবেই সমর্থনযােগ্য নয়। জীববিজ্ঞানের সূত্র অবলম্বন করে শুধুমাত্র বাহুবলের মাপকাঠিতে যােগ্যতমের বাঁচার অধিকার থাকবে, এই ধারণা হিংস্র জন্তুজানােয়ারের ক্ষেত্রে প্রযুক্ত হলেও মানুষের ক্ষেত্রে তা কখনােই প্রযােজ্য হতে পারে না।


  • সাম্রাজ্যবাদের সমর্থক: বলপ্রয়ােগ মতবাদ সাম্রাজ্যবাদ ও যুদ্ধবাদকে উৎসাহ দেয়| এই মতবাদের সমর্থক জার্মান আদর্শবাদী নিটুসে, ট্রিট্স্কে, বার্নহার্ডি প্রমুখের তত্ত্ব সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতার বীজ বপন করে।


উপসংহার: এই ধরনের বিরূপ সমালােচনা সত্ত্বেও বলপ্রয়ােগ মতবাদের ঐতিহাসিক তাৎপর্যকে উপেক্ষা করা যায় না।রাষ্ট্রের উৎপত্তির ক্ষেত্রে শক্তি বা বলপ্রয়ােগের যে অবদান ছিল, ইতিহাসবিদরা তা অস্বীকার করেননি। অন্যদিকে, রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বজায় রাখার স্বার্থে বলপ্রয়ােগ কতটা জরুরি তা সন্ত্রাসবাদ কবলিত আধুনিক বিশ্বের রাষ্ট্রগুলির দিকে তাকালে খুব সহজেই বুঝতে পারা যায়। রাষ্ট্রের উৎপত্তির প্রাথমিক পর্যায়ে মানুষকে রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলেছিল বলপ্রয়ােগ মতবাদ। সুতরাং, এই মতবাদ সম্পূর্ণ গুরুত্বহীন, এমন কথা মনে করার সংগত কোনাে কারণ নেই।


রাষ্ট্রবিজ্ঞান কি বিজ্ঞান? রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে বিজ্ঞান বলার পক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তি | রাষ্ট্রবিজ্ঞান কি বিজ্ঞান পদবাচ্য? আলােচনা করাে।


রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলােচনা ক্ষেত্রের পরিধি বিশ্লেষণ করাে | রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রকৃতি ও বিষয়বস্তুর পরিধি সম্পর্কে আলােচনা করাে।


রাষ্ট্রের সংজ্ঞা দাও।রাষ্ট্রের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি ব্যাখ্যা করাে।


রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে মূল পার্থক্যগুলি উল্লেখ করাে । রাষ্ট্র ও সমাজের পার্থক্য ব্যাখ্যা করাে।


সরকার কী? সার্বভৌমত্ব কী? বোঁদা প্রদত্ত সার্বভৌমিকতার সংজ্ঞা। সার্বভৌমিকতার দুটি বৈশিষ্ট্য। জনগণের সার্বভৌমিকতা।


রাষ্ট্র ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান বা সামাজিক সংগঠনের মধ্যে সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্যগুলি আলােচনা করাে।


সম্মিলিত জাতিপুঞ্জকে রাষ্ট্র বলা যায় কি । রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কিত ঐশ্বরিক মতবাদটি সমালােচনা-সহ আলােচনা করাে।