নাগরিকত্ব | নাগরিক ও বিদেশির মধ্যে বৈসাদৃশ্য | নাগরিকত্ব অর্জনের পদ্ধতি

নাগরিকত্ব

প্রাচীন গ্রিস ও রােমের নগররাষ্ট্রগুলিতে যাঁরা রাষ্ট্র পরিচালনার কাজকর্মে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতেন, তাদেরই একসময় নাগরিক আখ্যা দেওয়া হত। সেই যুগে শুধুমাত্র অভিজাত পুরুষরা নাগরিক অভিধায় ভূষিত হতেন৷ ক্রীতদাস, মহিলা ও শ্রমিকরা রাষ্ট্র পরিচালনার কাজে অংশ নিতে না পারায় নাগরিক হতে পারতেন। না। যুগের পরিবর্তনের ফলে নাগরিকত্ব সম্পর্কিত আধুনিক ধারণার বিকাশ ঘটেছে। বর্তমানে কোনাে রাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাসকারী ও রাষ্ট্রের উদ্দেশ্যে আনুগত্য প্রদর্শনকারী সমস্ত ব্যক্তিকে নাগরিকরূপে অভিহিত করা হয়।


নাগরিকরা রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করার বিনিময়ে রাষ্ট্রপ্রদত্ত কিছু সুযােগসুবিধা ভােগ করে থাকেন। ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য এসব সুযােগসুবিধা একান্তভাবে অপরিহার্য। এগুলিকে অধিকার বলে।


আধুনিক রাষ্ট্রে নাগরিকরা ছাড়াও অন্য ধরনের আরও মানুষও থাকে, এদের বলা হয় বিদেশি বিদেশি আর নাগরিকদের মধ্যে রাষ্ট্রপ্রদত্ত অধিকার ভােগের নিরিখে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। একজন বিদেশির ব্যক্তিগত অধিকার, সামাজিক অধিকার এমনকি অর্থনৈতিক অধিকার ভােগের ছাড়পত্র থাকতে পারে, কিন্তু তার কোনােভাবেই রাজনৈতিক অধিকার ভােগের এক্তিয়ার থাকে না।


নাগরিকদের রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃতির বিষয়টিকে সাধারণভাবে নাগরিকত্ব বলা হয়। এই নাগরিকত্ব অর্জন ও বিলােপের পদ্ধতি সব দেশের ক্ষেত্রে সমান নয়। তবে জন্মসূত্রে ও অনুমােদনসূত্রে নাগরিকত্ব অর্জনের বিষয়টি মােটামুটিভাবে সব দেশেই দেখা যায়।


কোনো কোনাে দেশে অনুমােদনসূত্রে নাগরিকত্ব পাওয়া ব্যক্তিরা রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ পদে আসীন হতে পারেন না। দৃষ্টান্ত হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথা বলা যেতে পারে। নাগরিকত্ব বিলােপের ক্ষেত্রেও বিভিন্ন দেশের নিয়ম বিভিন্ন রকমের। যেমন, আমাদের দেশে দ্বৈত নাগরিকত্বের নিয়ম চালু নেই। এই কারণে কোনাে ভারতীয় নাগরিক একই সময়ে ভারত ও অন্য কোনাে রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব গ্রহণ করতে পারে না। তা ছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতাে এখানে রাজ্যগুলির জন্য আলাদা নাগরিকত্বের ব্যবস্থা রাখা হয়নি।


নাগরিকত্বের সংজ্ঞা


[1] প্রাচীন ধারণা: 'নাগরিক' শব্দের সাধারণ অর্থ হল নগরবাসী। প্রাচীন গ্রিসের নগররাষ্ট্রে বসবাসকারী জনগণের মধ্যে শুধুমাত্র যারা রাষ্ট্র পরিচালনার কাজকর্মে সক্রিয়ভাবে অংশ নিত তাদের নাগরিক বলা হত। অ্যারিস্টটলের বক্তব্য হল, ন্যায় প্রশাসনে যিনি অংশগ্রহণ করেন। এবং যিনি প্রশাসনিক পদের অধিকারী, তাঁকে নাগরিক বলা যায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, সে যুগে ক্রীতদাস, শ্রমিক ও মহিলাদের রাষ্ট্রীয় কাজে অংশ নিতে দেওয়া হত না বলে তারা নাগরিক হিসেবে গণ্য হত না। আধুনিক যুগে 'নাগরিক' শব্দটি এরকম সংকীর্ণ অর্থে ব্যবহার করা হয় না।


[2] আধুনিক সংজ্ঞা: বর্তমানে কোনাে রাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাসকারী ও রাষ্ট্রের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য প্রদর্শনকারী সব ব্যক্তিকে নাগরিকরূপে অভিহিত করা হয়।


নাগরিক ও বিদেশির মধ্যে বৈসাদৃশ্য


আধুনিক রাষ্ট্রে বসবাসকারী ব্যক্তিদের প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করা হয়— [1] নাগরিক ও [2] বিদেশি। নাগরিক বলতে কোনাে রাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাসকারী ও সেই রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনকারী ব্যক্তিকে বােঝায়। আবার বিদেশি বলতে সেই ব্যক্তিকে বােঝায় যিনি বিশেষ কোনাে কাজের জন্য নিজের রাষ্ট্র ছেড়ে অন্য কোনাে রাষ্ট্রে সাময়িকভাবে বসবাস করেন। নাগরিক ও বিদেশির মধ্যে মৌলিক বৈসাদৃশ্য যেসব ক্ষেত্রে প্রকটভাবে দেখা যায় সেগুলি একটি সারণিতে উল্লেখ করা হল।


নাগরিক

  • একজন নাগরিক রাষ্ট্রের স্থায়ী বাসিন্দা।

  • একজন নাগরিক তাঁর রাষ্ট্রের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য প্রদর্শন করেন।

  • নাগরিক তার রাষ্ট্রে ব্যক্তিগত, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক-সহ যাবতীয় অধিকার ভােগ করে থাকেন।

  • রাষ্ট্র তার নাগরিকের কাছে সমস্তরকম কর্তব্যপালন ও পূর্ণ আনুগত্য দাবি করে।

  • একজন নাগরিকের জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা রক্ষা করা রাষ্ট্রের প্রধান কর্তব্য।

  • রাষ্ট্র তার যে-কোনাে নাগরিককে কোনাে পুরুতর অপরাধের জন্য দেশের আইন অনুযায়ী চূড়ান্ত শান্তি অর্থাৎ মৃত্যুদণ্ড দিতে পারে।

  • কোনাে নাগরিককে গুপ্তচরবৃত্তি বা অসদাচরণের অপরাধে রাষ্ট্র বহিষ্কার করতে পারে না।

  • জরুরিকালীন পরিস্থিতি ছাড়া অন্যসময়ে নাগরিকদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করা হয় না।


বিদেশি

  • একজন বিদেশি অস্থায়ীভাবে কিছুকালের জন্য কোনাে রাষ্ট্রে বসবাস করেন মাত্র।

  • একজন বিদেশির সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য আংশিক।

  • একজন বিদেশিকে কোনােভাবেই রাজনৈতিক অধিকার দেওয়া হয় না।

  • একজন বিদেশির কাছে রাষ্ট্র সেই ধরনের কর্তব্য ও আনুগত্য দাবি করতে পারে না।

  • কোনাে বিদেশি যখন আশ্রয়দাতা রাষ্ট্রের সীমানা অতিক্রম করে, তখন তার প্রতি আর কোনােরকম কর্তব্য রাষ্ট্রের থাকে না।

  • সাধারণত কোনাে বিদেশিকে গুরুতর অপরাধেও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যায় না।

  • কোনাে বিদেশির বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তি বা অসদাচরণের কোনাে অভিযােগ প্রমাণিত হলে রাষ্ট্র তাকে চব্বিশ ঘণ্টা বা আটচল্লিশ ঘণ্টার মেয়াদে বহিষ্কারের আদেশ দিতে পারে।

  • যুদ্ধের সময় অথবা স্বাভাবিক সময়েও রাষ্ট্র চাইলে যে-কোনাে বিদেশির গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করে আদেশ জারি করতে পারে


নাগরিকত্ব অর্জনের পদ্ধতি


নাগরিকত্ব অর্জনের দুটি পদ্ধতি রয়েছে। প্রথমটি হল জন্মসূত্রে বা স্বাভাবিকভাবে প্রাপ্ত নাগরিকত্ব, দ্বিতীয়টি হল অনুমোদনসূত্রে বা কৃত্রিমভাবে প্রাপ্ত নাগরিকত্ব।


জন্মসূত্রে প্রাপ্ত নাগরিকত্ব: জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব অর্জনের দুটি প্রধান নীতি রয়েছে। সেগুলি হল— (i) রক্তের সম্পর্ক নীতি এবং (ii) জন্মস্থান সম্পর্কিত নীতি।


  • রক্তের সম্পর্ক নীতি: এই নীতি অনুসারে, একটি শিশু যে রাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ করুক না কেন শিশুটির পিতা-মাতা যে দেশের নাগরিক, শিশুটি উত্তরাধিকারসূত্রে সেই দেশের নাগরিকত্ব লাভ করবে। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, সুইডেনের কোনাে দম্পতির সন্তান যদি ব্রিটেনে জন্মগ্রহণ করে রক্তের সম্পর্ক নীতি অনুযায়ী সেই শিশুটি সুইডেনের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি পাবে।


  • জন্মস্থান সম্পর্কিত নীতি: এই নীতি অনুসারে, একটি শিশু যে রাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ করে সেই রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব লাভ করে। এক্ষেত্রে পিতা-মাতা যদি অন্য দেশের নাগরিক হন তাতে কিছু যায় আসে না, নাগরিকত্ব নির্ধারণে শিশুর জন্মস্থানই প্রধান বিবেচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কোনাে ভারতীয় দম্পতির সন্তান ব্রিটেনে ভূমিষ্ঠ হলে সে ব্রিটিশ নাগরিকত্ব পাবে।


অনুমােদনসূত্রে প্রাপ্ত নাগরিকত্ব: নাগরিকত্ব অর্জনের স্বাভাবিক উপায় ছাড়াও কৃত্রিম উপায় রয়েছে। বিদেশি রাষ্ট্রের কোনাে নাগরিক অন্য রাষ্ট্রের কাছে নাগরিকত্বের আবেদন জানালে সেই রাষ্ট্র যদি তা মঞ্জুর করে তাহলে তাকে অনুমােদনসূত্রে প্রাপ্ত নাগরিকত্ব বলা হয়। এই অনুমােদন দুপ্রকারের—(i) ব্যক্তিগত অনুমােদন এবং (ii) সমষ্টিগত অনুমােদন।


  • ব্যক্তিগত অনুমােদন: ব্যক্তিগত অনুমােদনসূত্রে নাগরিকত্ব সংকীর্ণ ও ব্যাপক দুটি অর্থেই হতে পারে। সংকীর্ণ অর্থে অনুমােদনসূত্রে নাগরিকত্ব লাভ করতে হলে আবেদনকারী ব্যক্তিকে রাষ্ট্র কর্তৃক আরােপিত নির্দিষ্ট কিছু শর্ত পালন করতে হয়। এই শর্তগুলি পূরণ করা হলে রাষ্ট্র সংশ্লিষ্ট আবেদনকারীর অনুমােদনসিদ্ধ নাগরিকত্ব মঞ্জুর করে থাকে। ব্যাপক অর্থে 'অনুমােদনসিদ্ধ নাগরিক হতে গেলে রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক অনুমােদনের দরকার হয় না। যেসব কারণে ব্যাপক অর্থে অনুমােদনসিদ্ধ নাগরিকত্ব লাভ করা যায়, সেগুলি হল

    • অন্য কোনাে রাষ্ট্রের সেনাবাহিনীতে যােগ দেওয়া,

    • কোনাে বিদেশি নাগরিককে বিবাহ করা,

    • অন্য কোনাে রাষ্ট্রে সরকারি চাকরি গ্রহণ করা,

    • অন্য কোনাে রাষ্ট্রে স্থায়ী সম্পত্তি ক্রয় করা,

    • অন্য রাষ্ট্রের কাছে রাজনৈতিক আশ্রয় লাভ করা ইত্যাদি।


  • সমষ্টিগত অনুমােদন: অনুমােদনসূত্রে নাগরিকত্ব লাভের আরেকটি স্বীকৃত পদ্ধতি হল সমষ্টিগত অনুমােদন। এই পদ্ধতি অনুযায়ী কোনাে একটি দেশ বা অঞ্চল অন্য রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হলে সংশ্লিষ্ট দেশ বা অঞ্চলের অধিবাসীরা ওই রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব লাভ করে। যেমন, গােয়া, দমন ও দিউ এবং পরবর্তীকালে সিকিম ভারতের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায়, এইসব অঞ্চলের অধিবাসীরা সমষ্টিগতভাবে ভারতের নাগরিকত্ব অর্জন করে। অনুমােদনসূত্রে নাগরিকত্ব দু-ধরনের হতে পারে—

    • আংশিক নাগরিকত্ব,

    • পূর্ণ নাগরিকত্ব।


অনুমােদনসিদ্ধ নাগরিকদের যখন প্রয়ােজনীয় অধিকারগুলি দেওয়ার পর কয়েকটি বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ অধিকার থেকে রাষ্ট্র তাদের বঞ্চিত রাখে, তখন তাকে আংশিক নাগরিকত্ব বলা হয়। পূর্ণ নাগরিকত্ব বলতে বোঝায় সেই নাগরিকত্ব যা অনুমােদনসূত্রে অর্জিত হলেও স্বাভাবিক নাগরিকত্বের মতােই। এক্ষেত্রে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভৃতি যাবতীয় অধিকার ভােগের সুযােগ পাওয়া যায়। এমনকি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার পথেও কোনাে অন্তরায় থাকে না।


ভারতীয় সংবিধানে উল্লিখিত নাগরিকত্ব অর্জন সম্পর্কিত নিয়ম


ভারতীয় সংবিধান কার্যকর হওয়ার সময় নিম্ন পর্যায়ভুক্ত ব্যক্তিদের ভারতীয় নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়

  • [1] যে ভারতীয় ভূখণ্ডে জন্মগ্রহণ করেছে এবং ভারতে বসবাস করেছে।
  • [2] যে ভারতে বসবাস করছে এবং যার পিতা-মাতার একজন ভারতীয় ভূখণ্ডে জন্মগ্রহণ করেছে।
  • [3] যে নিজে অথবা তার পিতা ও মাতার কেউই ভারতে জন্মগ্রহণ করেনি, অথচ সংবিধান কার্যকর হওয়ার পাঁচ বছর আগে থেকে ভারতে বসবাস করছে।


ভারতীয় নাগরিকত্ব অর্জনের বিধি


[1] জন্মসূত্র সম্পর্কিত সূত্র: ভারতীয় সংসদ প্রণীত ১৯৫৫ সালের ভারতীয় নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি বা তার পরবর্তী সময়ে যারা ভারতে জন্মগ্রহণ করেছেন তাঁরা ভারতীয় নাগরিক হিসেবে স্বীকৃত হবেন।


[2] রক্তের সম্পর্ক সূত্র: ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি বা তার পরে ভারতীয় নাগরিকদের যেসব সন্তানসন্ততি বিদেশে জন্মগ্রহণ করেছে, তারা সবাই রক্তের সম্পর্ক সূত্রে ভারতের নাগরিকত্ব লাভ করবে।


[3] নথিভুক্তিকরণ সূত্র: ভারতীয় নাগরিকত্বের জন্য কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র দপ্তরে আবেদনক্রমে নথিভুক্তিকরণের মাধ্যমে যাঁরা নাগরিকত্ব লাভের যােগ্য বলে বিবেচিত হতে পারেন, তাঁরা হলেন

  • (i) বিদেশে বসবাসকারী অনাবাসী ভারতীয়, 

  • (ii) ভারতীয় নাগরিককে বিবাহ করেছেন এমন বিদেশি মহিলা বা তাঁর অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তান, 

  • (iii) কমনওয়েলথ গােষ্ঠীভুক্ত দেশগুলির নাগরিক।


[4] দেশীয়করণ সূত্র: বিদেশি নাগরিকরা ভারত সরকারের নির্ধারিত শর্তপূরণসাপেক্ষে আবেদন করলে দেশীয়করণের মাধ্যমে ভারতীয় নাগরিকত্ব লাভ করতে পারেন।


[5] ভারতভুক্তির সূত্র: কোনাে ভূখণ্ড যদি ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়, তাহলে ওই ভূখণ্ডের সমস্ত অধিবাসী ভারতভুক্তির সূত্রে ভারতীয় নাগরিকরূপে গণ্য হবে। এইভাবে পুদুচেরি (পণ্ডিচেরি), গােয়া, দমন ও দিউ-সহ সিকিমের অধিবাসীরা ভারতীয় নাগরিকত্ব লাভ করেছেন।


ভারতীয় নাগরিকত্ব বিলােপের বিধি


যেসব কারণে ভারতীয় নাগরিকত্বের বিলােপ ঘটে, তা হল—[1] অন্য দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ, [2] দ্বৈত নাগরিকত্ব গ্রহণ, [3] অন্যান্য কারণ।


সুনাগরিকের ধারণা


গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার মূল উপাদান হল জনগণ। এই কারণে গণতন্ত্রকে জনগণের শাসন বলে অভিহিত করা হয়। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সাফল্যের প্রধান শর্ত হল সুনাগরিকত্ব। সাধারণভাবে নাগরিকদের মধ্যে যাঁরা বিশেষ কয়েকটি উৎকৃষ্ট গুণের অধিকারী, তাদের সুনাগরিক বলা হয়। লর্ড ব্রাইস সুনাগরিকের তিনটি প্রধান গুণের কথা উল্লেখ করেছেন। সেগুলি হল

  • [1] বুদ্ধিমত্তা (Intelligence), 

  • [2] আত্মসংযম (Self-control), 

  • [3] বিবেক (Conscience)। 


বার্নস এগুলি ছাড়া আরও দুটি গুণের কথা উল্লেখ করেছেন। সেগুলি হল—দেশপ্রেম এবং স্বাধীনচেতা মনােভাব। অধ্যাপক হ্যারল্ড ল্যাস্কির অভিমত হল, সুনাগরিক নিজের কল্যাণের সঙ্গে বৃহত্তর সমাজের কল্যাণের কথা ভাবেন। তাঁর মতে, সুনাগরিক হবেন বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন এবং কার্যক্ষেত্রে যথাযথ বিচারবুদ্ধি প্রয়ােগের যােগ্যতাও তার থাকবে।


সুনাগরিকত্নের প্রতিবন্ধকতা


সুনাগরিকত্বের প্রধান অন্তরায়গুলি হল[1] নির্লিপ্ততা, [2] স্বার্থপরতা, [3] দলীয় সংকীর্ণতা, [4] অজ্ঞতা, [5] গণমাধ্যমের নিরপেক্ষতার অভাব।


সুনাগরিকত্নের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণের উপায়


আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার সাফল্য নির্ভর করে সেই রাষ্ট্র কীভাবে নাগরিকদের দায়িত্ব ও কর্তব্যবােধে উদ্বুদ্ধ করে তাদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলছে তার ওপর। সুতরাং, গণতন্ত্রের সাফল্যের স্বার্থে সুনাগরিকত্বের ক্ষেত্রে অন্তরায়গুলি দূর করা প্রয়ােজন। সুনাগরিকত্বের পথের প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণের উপায়গুলি হল


[1] শাসনতান্ত্রিক প্রতিবিধান: এ প্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ কিছু শাসনতান্ত্রিক প্রতিবিধানের উল্লেখ করা যায়। যেমন—

  • (i) বাধ্যতামূলক ভােটদান, 

  • (ii) প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ, 

  • (iii) সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব, 

  • (iv) আইনি ব্যবস্থার প্রবর্তন, 

  • (v)স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা।


[2] নৈতিক প্রতিবিধান: নাগরিকদের নৈতিক উৎকর্ষ সাধিত হলে তাঁদের রাজনৈতিক চেতনার মাত্রা বৃদ্ধি পাবে এবং তারা দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে নিজেদের যথাযােগ্য ভূমিকা পালন করতে পারবেন।


[3] মার্কসবাদীদের অভিমত: মার্কসীয় চিন্তাবিদরা শােষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন।


নাগরিকের বিভিন্ন কর্তব্য


নিজের ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য অধিকার ভােগের বিনিময়ে নাগরিকদের যেসব দায়দায়িত্ব পালন করতে হয়, সেগুলিকে কর্তব্য বলা হয়। অধিকার ভােগের শর্ত হল কর্তব্যপালন| কর্তব্যপালন ছাড়া অধিকার ভােগ করা যায় না। অনেকে মনে করেন, সমষ্টিগত কল্যাপসাধনের জন্য নাগরিকদের যেসব দায়দায়িত্ব পালন করতে হয় তাই হল কর্তব্য। সাধারণত নাগরিক কর্তব্যকে প্রকৃতি অনুযায়ী দুটি ভাগে ভাগ করা যায়—একটি হল নৈতিক কর্তব্য এবং অন্যটি হল আইনগত কর্তব্য। নৈতিক কর্তব্যের সঙ্গে নীতিবােধ জড়িত থাকে। নৈতিক কর্তব্য অবহেলা করলে রাষ্ট্রের কিছু করার থাকে না। অন্যদিকে, আইনগত কর্তব্যের সঙ্গে আইনের অনুমােদন জড়িয়ে থাকে। তাই আইনগত কর্তব্য অবহেলা করলে রাষ্ট্রের শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে।


সামাজিক অধিকার, ব্যক্তিগত অধিকার এবং আইনগত অধিকার ভােগের নিরিখে নাগরিকদের কর্তব্যকে সামাজিক কর্তব্য, ব্যক্তিগত কর্তব্য এবং আইনগত কর্তব্য—এই তিনভাগে ভাগ করা হয়। এ ছাড়া রয়েছে

  • [1] আনুগত্য, 

  • [2] আইনের প্রতি মান্যতা, 

  • [3] কর প্রদান, 

  • [4] ভােটাধিকারের যথাযথ প্রয়ােগ, 

  • [5] অন্যান্য কর্তব্য।


নাগরিক ও বিদেশির মধ্যে সাদৃশ্য


আধুনিক রাষ্ট্রে বসবাসকারী ব্যক্তিদের মূলত দুটি ভাগে ভাগ করা হয়

  • [1] নাগরিক এবং 

  • [2] বিদেশি কোনাে রাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাসকারী ও সেই রাষ্ট্রের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য প্রদর্শনকারী ব্যক্তিকে নাগরিক বলা হয়।


অন্যদিকে, কোনাে ব্যক্তি যখন বিশেষ কোনাে কাজের জন্য নিজের রাষ্ট্র ছেড়ে বাইরের কোনাে রাষ্ট্রে সাময়িকভাবে বসবাস করেন তখন সেই রাষ্ট্রের কাছে তিনি 'বিদেশি হিসেবে পরিগণিত হন। নাগরিক ও বিদেশির মধ্যে যেসব ক্ষেত্রে সাদৃশ্য দেখা যায় সেগুলি হল


[1] আইনগত আনুগত্য প্রদর্শন: নাগরিক ও বিদেশি উভয়কেই, তাঁরা যে রাষ্ট্রে বসবাস করেন সেই রাষ্ট্রের আইনকানুন মেনে চলতে হয়।রাষ্ট্রীয় আইন অমান্য করলে একজন নাগরিকের মতাে একজন বিদেশিকেও শাস্তি পেতে হয়।


[2] অধিকার ভােগ: নাগরিক ও বিদেশি উভয়েই সমানভাবে সামাজিক অধিকার ও অর্থনৈতিক অধিকার ভােগ করে থাকেন। জীবনের অধিকার, ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার, ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার ইত্যাদি ক্ষেত্রে উভয়ের মধ্যে কোনােরকম ফারাক করা হয় না।


[3] কর প্রদান: কর প্রদানের ক্ষেত্রেও নাগরিক ও বিদেশির মধ্যে সাদৃশ্য রয়েছে। বাজার থেকে কোনাে জিনিস কিনলে একজন নাগরিকের মতাে একজন বিদেশিকেও পরােক্ষ কর দিতে হয়।


রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে সামাজিক চুক্তি মতবাদ আলােচনা করাে। রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত সামাজিক চুক্তি মতবাদের সমালােচনা ও প্রবক্তা


 হবস, লক এবং রুশাের তত্ত্বের তুলনামূলক আলােচনা করাে।


হবস, লক, রুশো কীভাবে প্রাকৃতিক অবস্থাকে বর্ণনা করেছেন?


রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে বিবর্তনবাদী তত্ত্ব ব্যাখ্যা করাে।


রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কিত তত্ত্বগুলির সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা করাে।


জাতি, জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতা


আধুনিক রাজনীতির মৌলিক ধারণাসমূহ