ভারতের সংসদীয় ব্যবস্থার প্রকৃতি ব্যাখ্যা করাে | ভারতে সংসদীয় ব্যবস্থার স্বরূপ বর্ণনা করাে।

ভারতের সংসদীয় ব্যবস্থার/শাসনব্যবস্থার প্রকৃতি/স্বরূপ

গ্রেট ব্রিটেনের সংসদীয় শাসনব্যবস্থাকে বিশ্বের যে দেশগুলি অনুসরণ করেছে তার মধ্যে ভারত অন্যতম। ভারতের সংবিধান পর্যালােচনা করলে দেখা যায় যে, ভারতের শাসনব্যবস্থাকে সংসদীয় বা মন্ত্রীপরিষদ চালিত শাসনব্যবস্থারূপে অভিহিত করার পক্ষে যথেষ্ট কারণ রয়েছে। সেই কারণগুলি হল一


[1] নিয়মতান্ত্রিক রাষ্ট্রপ্রধানের উপস্থিতি: সংসদীয় শাসনব্যবস্থার একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হল নিয়মতান্ত্রিক বা নামসর্বস্ব রাষ্ট্রপ্রধানের উপস্থিতি। তত্ত্বগতভাবে নিয়মতান্ত্রিক রাষ্ট্রপ্রধান রাষ্ট্রের প্রধান হলেও কার্যত তিনি মন্ত্রীসভার পরামর্শ অনুসারে শাসনকার্য পরিচালনা করেন। তাঁর নামে শাসনকার্য পরিচালিত হলেও মন্ত্রীসভা হল দেশের প্রকৃত শাসক। ভারতে রাষ্ট্রপ্রধানরূপে রাষ্ট্রপতি এই ধরনের নিয়মতান্ত্রিক শাসকের ভূমিকাই পালন করেন।


[2] ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতি বর্জিত: সংসদীয় শাসনব্যবস্থার পাঠভূমি গ্রেট ব্রিটেনের মতাে ভারতেও ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতি স্বীকৃত হয়নি। সংসদীয় শাসনব্যবস্থার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হল আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগের পরস্পর নির্ভরশীল ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। এই ধরনের শাসনব্যবস্থায় আইনসভায় যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সেই দলের নেতা বা নেত্রীরা মন্ত্রীসভা গঠন করে দেশ শাসন করেন। আবার বিচার বিভাগের দায়িত্বে যেসব বিচারপতিরা থাকেন তাদের নিয়ােগতালিকা মন্ত্রীসভা অনুমোদন করে। সংসদীয় ব্যবস্থার এই বৈশিষ্ট্য ভারতে পুরােপুরি অনুসৃত হয়েছে।


[3] মন্ত্রীসভা গঠনে আইনসভার ভূমিকা: সংসদীয় সরকারের একটি অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য হল মন্ত্রীসভা গঠন করার ব্যাপারে আইনসভার নিম্নকক্ষের কার্যকরী ভূমিকা। ভারতে কেন্দ্রীয় আইনসভার নিম্নকক্ষ লােকসভায় যে দল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে, রাষ্ট্রপতি সেই দলের নেতা বা নেত্রীকে সরকার গঠনের জন্য আহ্বান জানান।


[4] বিরােধী দলের গুরুত্ব: সংসদীয় বা মন্ত্রীসভা-চালিত সরকারের একটি মুখ্য বৈশিষ্ট্য হল শক্তিশালী বিরােধী দলের উপস্থিতি। সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরােধী দল না থাকলে গণতন্ত্র ব্যাহত হয়। বিরােধী দলই সরকারকে যথাযথভাবে দেশ শাসন করতে বাধ্য করে। বিরােধী দল কর্তৃক ক্ষমতাসীন সরকারের সমালোচনা সংসদীয় গণতন্ত্রের একটি স্তম্ভম্বরূপ। ভারতে সংসদীয় ব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল শক্তিশালী বিরােধী দলের উপস্থিতি।


[5] মন্ত্রীসভার দায়বদ্ধতা: সংসদ বা আইনসভার নিম্নকক্ষের কাছে মন্ত্রীসভার দায়বদ্ধতা ভারতের সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় পূর্ণভাবে অনুসৃত হয়েছে। ভারতীয় আইনসভার নিম্নকক্ষ লােকসভার কাছে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা তার যাবতীয় কাজকর্মের জন্য দায়বদ্ধ থাকে। মন্ত্রীসভার এই দায়িত্বকে যৌথ দায়িত্ব বলা হয়। এই কারণে লােকসভায় কোনাে মন্ত্রীর বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব গৃহীত হলে সমগ্র মন্ত্রীসভা পদত্যাগে বাধ্য হয়।


[6] অঙ্গরাজ্যে সংসদীয় ব্যবস্থার প্রচলন: সংসদীয় শাসনব্যবস্থার অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য অনুসরণ করে ভারতের অঙ্গরাজ্যগুলিতেও সংসদীয় শাসনব্যবস্থা প্রচলিত হয়েছে রাজ্যগুলিতে নিয়মতান্ত্রিক প্রধানের ভূমিকা পালন করেন রাজ্যপাল। রাজ্যের শাসনকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে রাজ্যপাল রাজ্যমন্ত্রীসভার পরামর্শ অনুযায়ী চালিত হন। অন্যদিকে, রাজ্যমন্ত্রীসভা আবার রাজ্য-আইনসভার কাছে যাবতীয় কাজকর্মের জন্য দায়বদ্ধ থাকে। আইনসভার আস্থা হারালে মন্ত্রীসভা পদত্যাগে বাধ্য হয়।


[7] প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্ব: সংসদীয় শাসনব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্ব। ব্রিটিশ সংসদীয় ব্যবস্থার বিশেষজ্ঞরা প্রধানমন্ত্রীকে মন্ত্রীসভার সমপর্যায়ভুক্ত সহকর্মীদের মধ্যে অগ্রগণ্য (First among the equals) বলে অভিহিত করেছেন। ভারতেও অনুরূপ ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে। ভারতের সংসদীয় ব্যবস্থায় সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল বা জোটের নেতা বা নেত্রী হিসেবে প্রধানমন্ত্রী সরকারের নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন।


[8] সিদ্ধান্তের গােপনীয়তা: মন্ত্রীসভার সিদ্ধান্তের গোপনীয়তা রক্ষা সংসদীয় শাসনব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। ব্রিটিশ সংসদীয় ব্যবস্থায় মন্ত্রীসভার বৈঠকের কার্যবিবরণী গােপন দলিল হিসেবে সংরক্ষণ করা হয়। ভারতীয় সংসদীয় ব্যবস্থাতেও মন্ত্রীসভার সিদ্ধান্তের গােপনীয়তা রক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে।


[9] আইন বিভাগের কাজকর্ম নিয়ন্ত্রণ: সংসদীয় শাসনব্যবস্থার রীতি অনুসরণ করে ভারতে আইন বিভাগ তথা সংসদের (আইনসভা) ওপর শাসন বিভাগ বা মন্ত্রীসভার আধিপত্য বজায় রয়েছে। আইন প্রণয়নের ব্যাপারে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা পার্লামেন্ট বা সংসদে এবং রাজ্য মন্ত্রীসভা অঙ্গরাজ্যগুলির আইনসভায় মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে।


উপসংহার: সমালােচকরা মনে করেন, ভারতে সংসদীয় শাসনব্যবস্থার সঙ্গে রাষ্ট্রপতি-শাসিত সরকারের কিছু বৈশিষ্ট্যের সমন্বয় ঘটেছে। তাই তাঁরা ভারতকে পূর্ণাঙ্গ সংসদীয় শাসনব্যবস্থার দেশ বলে অভিহিত করতে চাননি। যুক্তি হিসেবে সমালােচকরা রাষ্ট্রপতিকে পুরােপুরি নামসর্বস্ব শাসক বলে মেনে নিতে রাজি নন। রাজ্যে শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা জারির বিষয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার দেওয়া পরামর্শ রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রত্যাখ্যানের ঘটনা, ত্রিশঙ্কু লােকসভায় একক বৃহত্তম দল বা জোটের নেতাকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা গঠনের আহ্বান জানানাে, কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার বিলে স্বাক্ষর না দিয়ে বিলটিকে পুনর্বার বিবেচনার জন্য ফেরত পাঠানাে ইত্যাদি দৃষ্টান্তের কথা তারা তুলে ধরেন। পাশাপাশি বর্তমানে ভারতীয় সংসদের সার্বভৌমত্ব কার্যত মন্ত্রীসভার সার্বভৌমত্বে পরিণত হয়েছে বলেও তাঁরা মনে করেন। পরিশেষে বলা যায়, জুটিবিচ্যুতি সত্ত্বেও ভারতীয় শাসনব্যবস্থা সংসদীয় শাসনব্যবস্থার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ।


কেন সংবিধানে ভারতকে 'যুক্তরাষ্ট্র' না বলে 'রাজ্যসমূহের ইউনিয়ন’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে? ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের গতিপ্রকৃতির সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও।


রাষ্ট্রপতি-শাসিত শাসনব্যবস্থা কাকে বলে? রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যগুলি আলােচনা করাে।


রাষ্ট্রপতি-শাসিত সরকারের গুণ-দোষ বা সুবিধা-অসুবিধা বিশ্লেষণ করাে।


সংসদীয় বা মন্ত্রীপরিষদ-চালিত শাসনব্যবস্থার সংজ্ঞা দাও। সংসদীয় শাসনব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যগুলি আলােচনা করাে।


সংসদীয় সরকারের গুণ-দোষ বা সুবিধা-অসুবিধাগুলি ব্যাখ্যা করাে।


সংসদীয় শাসনব্যবস্থার সাফল্যের শর্তগুলি আলােচনা করাে।


মন্ত্রীসভা-চালিত এবং রাষ্ট্রপতি-শাসিত সরকারের মধ্যে পার্থক্য | রাষ্ট্রপতি-শাসিত ও সংসদীয় শাসনব্যবস্থার মধ্যে পার্থক্য লেখাে।