হরপ্পা সভ্যতার পতনের কারণগুলি আলােচনা করাে। হরপ্পা সভ্যতার নগরজীবনের ওপর একটি টীকা লেখাে।

সূচনা: আনুমানিক ১৭৫০ খ্রি.পূ. নাগাদ হরপ্পা সভ্যতার অবলুপ্তির সূচনা ঘটে এবং পরবর্তী ১০০ বা ১৫০ বছরের মধ্যে সমগ্র হরপ্পা সভ্যতার সম্পূর্ণ অবলুপ্তি ঘটে। এই অবলুপ্তির প্রকৃত কারণ নিয়ে মতভেদ থাকলেও অধিকাংশ ঐতিহাসিক এই সভ্যতার পতনের সুনির্দিষ্ট কিছু কারণের ওপর জোর দিয়েছেন।


হরপ্পার সভ্যতার পতনের কারণসমূহ

[1] ভূপ্রকৃতির পরিবর্তন: একদা সিন্ধু অঞ্চলে প্রচুর বৃষ্টিপাত হত। কিন্তু ভূপ্রকৃতির পরিবর্তনের ফলে ক্রমে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে যায়। ফলে সিন্ধু অঞ্চলে মরুভূমির সূচনা ঘটে। ভূস্তরের নীচের জল ক্রমশ নিঃশেষ হয়ে পড়লে কৃষি-উৎপাদন অত্যন্ত কমে যায় এবং খাদ্যাভাব তীব্রতর হয়।


[2] ভূমিকম্প: গবেষণা থেকে জানা গেছে যে, সিন্ধু উপত্যকার নিকটবর্তী অঞ্চলে ভূমিকম্পের উৎসস্থল ছিল। খননকার্যের ফলে প্রাপ্ত, সৎকারের নমুনা না থাকা ক্ষতবিক্ষত নরকঙ্কালগুলি থেকে এই ধারণা করা হয় যে, ভূমিকম্পের ফলে এই সভ্যতার বিনাশ ঘটে।


[3] বন্যা: অনেকের মতে বন্যা ও প্লাবন সিন্ধু সভ্যতার বিনাশ ঘটিয়েছিল। সিল্ধুবাসীরা নদীতে বাঁধ দিয়ে চাষাবাদ করত। এর ফলে সিন্ধু নদের জল অবরুদ্ধ হয়ে পলি জমে নদীগর্ভের উচ্চতা বৃদ্ধি পায়। ফলে প্রতি বর্ষাতেই নদীর জল দু- কূল ছাপিয়ে নগরগুলিকে প্লাবিত করে| এম. আর. সাহানির মতে, প্লাবন সিন্ধু সংস্কৃতিকে ভাসিয়ে দেয়।


[4] সিন্ধু নদের গতিপথ পরিবর্তন: সিন্ধু নদের গতিপথ পরিবর্তনের ফলে মহেনজোদারাের বাণিজ্যিক গুরুত্ব নষ্ট হয়। পাশাপাশি তীব্র জলাভাবে এই অঞ্চলের কৃষিব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। শুধুমাত্র সিন্ধু নদ নয়, শতদ্রু ও যমুনা নদীও গতিপথ পরিবর্তন করায় সমগ্র সভ্যতাটি অবলুপ্তির পথে এগিয়ে যায়।


[5] রক্ষণশীলতা: হরপ্পা, মহেনজোদারাের ক্রমিক অবক্ষয়ের আর-একটি কারণ ছিল স্থবিরতা। জীবনযাত্রার কোনাে ক্ষেত্রেই উন্নত রীতির প্রয়ােগ ঘটাতে নাগরিকরা আগ্রহী ছিল না। এই রক্ষণশীল মনােভাব তাদের জনজীবনকে পঙ্গু করে তুলেছিল।


[6] বনাঞ্চল ধ্বংস: সিন্ধুবাসী গৃহ নির্মাণের প্রয়ােজনীয় ইট‌ পােড়ানাের জন্য তারা যথেচ্ছভাবে বনজঙ্গল ধ্বংস করে। ফলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ দ্রুত কমে যায়। প্রত্নতত্ত্ববিদ প্রজেল- এর মতে, বনাঞ্চল ধ্বংসের সঙ্গে সঙ্গে বন্যজন্তুর সংখ্যাও হ্রাস পায়। অথচ একটি সভ্যতার টিকে থাকার জন্য এগুলি ছিল অপরিহার্য।


[7] অন্তর্বিপ্লব বা গৃহযুদ্ধ: সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংসের কারণ হিসেবে অধিকাংশ পণ্ডিত সংঘাত ও রক্তপাতকে নির্দিষ্ট করেছেন|তবে এই সংঘাত ও রক্তপাত কেন ঘটেছিল সে-বিষয়ে দ্বিমত আছে। কারও মতে, অন্তর্বিপ্লব বা গৃহযুদ্ধ থেকেই এই রক্তপাত ঘটেছে।


[8] অভিনিস্ক্রমণ: কোনাে কোনাে ঐতিহাসিকের মতে প্রাকৃতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক প্রভৃতি কারণে সিন্ধুর অধিবাসীরা একসময় তাদের মাতৃভূমি ত্যাগ করে। তাই বলা যায় সিন্ধু উপত্যকার বাসিন্দারা আরও উন্নত জীবন ও নিরাপত্তার আশায় অভিনিক্রমণ (Exodus) করলে হরপ্পা সভ্যতা জনশূন্য হয়ে পড়ে।


[9] বহিরাক্রমণ: অনেকে ধারণা বহিরাগত শত্রুর আক্রমণকে, প্রধানত বৈদিক আর্যদের আক্রমণকে হরপ্পার পতনের জন্য দায়ী করেছেন৷ ধবংসন্ভূপে আবিষ্কৃত মৃতদেহের কঙ্কালে ভারী বস্তুর আঘাতের চিহ্ন প্রাপ্তি এবং আর্যদের ভারী অস্ত্রের ব্যবহারের সপক্ষে ঐতিহাসিকদের মত যুক্তিটিকে গ্রহণযােগ্য করেছে। পাশাপাশি বৈদিক দেবতা ইন্দ্রকে পুরন্দর বা নগর ধ্বংসকারী উপাধি প্রদান আর্যদের দ্বারা হরপ্পা সভ্যতা ধ্বংসের যুক্তিটিকে আরও জোরালো করেছে।


সাম্প্রতিক গবেষণা: সিন্ধু বা হরপ্পা সভ্যতা কীভাবে ধ্বংস হল তা নিয়ে আজও গবেষণা চলছে। অধুনা উপগ্রহের মাধ্যমে ভূত্বকের ছবি তুলে এই সভ্যতার বিলুপ্তির প্রকৃত কারণ সম্বন্ধে অনুসন্ধান চলছে। ব্রিটিশ বিশেষজ্ঞ বৈনই পৈসার-এর মতে, সিন্ধু উপত্যকা অঞ্চলে মহাজাগতিক বিস্ফোরণে অথবা ধুমকেতুর ধাক্কায় জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটেছিল।


হরপ্পা সভ্যতার নগরজীবন


[1] পরিকল্পিত নগর প্রতিষ্ঠা: হরপ্পা সভ্যতায় এক সুপরিকল্পিত ও উন্নত নগর গড়ে ওঠে। সেখানকার অধিকাংশ রাস্তাই সরল ও সমান্তরাল ছিল। রাস্তাগুলি ছিল ৯ থেকে ৩৪ ফুট পর্যন্ত চওড়া। রাস্তার ধারে ছিল বাঁধানাে ফুটপাত, বাড়ির নোংরা জল বের করার জন্য ছিল পয়ঃপ্রণালী, রাস্তার ধারে ল্যাম্পপােস্টও অবস্থিত ছিল। আগুনে পােড়ানাে ইট দিয়ে তৈরি বহুতল বিশিষ্ট অনেক ঘরবাড়ির অবশিষ্টাংশও পাওয়া গেছে এই সভ্যতায়। মহেঞ্জোদারােতে একটি স্নানাগার এবং হরপ্লায় একটি শস্যাগার পাওয়া গেছে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের মাধ্যমে।


[2] নগরজীবনের সমাজ: হরপ্পা সভ্যতায় সামাজিক বিভাজন ছিল বিদ্যমান। বাসিন্দারা নাগরিক জীবনের সঙ্গে মানানসই সুন্দর পােশাক ও অলঙ্কার ব্যবহার করত। নাচ, গান, শিকার প্রভৃতি ছিল নাগরিক জীবনের প্রধান বিনােদন মাধ্যম।


[3] নগরজীবনের অর্থনীতি: এই সভ্যতার বহু মানুষ শহুরে পেশা, যেমন-শিল্পকর্ম, বাণিজ্য প্রভৃতির সঙ্গে যুক্ত ছিল। তবে কৃষি এবং পশুপালনের সঙ্গেও বহু মানুষ যুক্ত ছিল।


[4] নগরজীবনের রাজনীতি: হরপ্পার নগরজীবন সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালিত করার উদ্দেশ্যে এখানকার নাগরিকগণ কেন্দ্রীভূত নগর বা পৌরপ্রশাসন গড়ে তুলেছিলেন বলে ঐতিহাসিকগণ মনে করেন।


[5] নগরজীবনের ধর্মীয় বিশ্বাস: হরপ্পা সভ্যতার নাগরিকরা মূর্তিপূজা করত এবং বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তির আরধনা করত বলে ঐতিহাসিকগণ মনে করেন। তখন মাতৃমূর্তির পূজা জনপ্রিয় ছিল।


মেহেরগড় সভ্যতার পরিচয় দাও।


মেহেরগড়বাসীর জীবিকা কী ছিল? মেহেরগড় সভ্যতার ধ্বংসের কারণগুলি কী ছিল?


হরপ্পা সভ্যতার নগর পরিকল্পনার বিবরণ দাও।


প্রবন্ধ লেখাে : হরপ্পা সভ্যতা


হরপ্পা সভ্যতার অধিবাসীদের সামাজিক জীবনের পরিচয় দাও।হরপ্পা সভ্যতার অধিবাসীদের সামাজিক জীবনের পরিচয় দাও।


হরপ্পা সভ্যতার অধিবাসীদের অর্থনৈতিক জীবনের পরিচয় দাও।


হরপ্পা সভ্যতার অধিবাসীদের ধর্মীয় জীবনের পরিচয় দাও।