দূরপ্রাচ্যে সাম্রাজ্যবাদ বিস্তারের বিবরণ দাও।

সূচনা: লাভজনক ব্যবসায় আকৃষ্ট হয়ে পাের্তুগিজ, ডাচ বা ওলন্দাজ, ইংরেজ, ফরাসি, দিনেমার প্রভৃতি ইউরােপীয় ঔপনিবেশিক জাতিপুলি এশিয়ার বিভিন্ন দেশে উপনিবেশ প্রতিষ্ঠায় অত্যন্ত সক্রিয় হয়ে ওঠে।


দূরপ্রাচ্যে সাম্রাজ্যবাদ বিস্তারের প্রাথমিক পর্যায়

[1] চিনে: চিনের বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ ইউরােপীয় বণিক জাতিগুলিকে প্রলুদ্ধ করে। ষােড়শ শতকে পাের্তুগিজ বণিক সম্প্রদায় দক্ষিণ চিনের ম্যাকাও বন্দরে প্রবেশ করে এবং সেখানে পাের্তুগিজ আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। পরবর্তী সময়ে একে একে স্পেনীয়, ওলন্দাজ, ইংরেজ ও ফরাসি বণিকগণ চিনের ম্যাকাও এবং ক্যান্টন বন্দরে বাণিজ্যিক অধিকার লাভ করে বিদেশি বণিকদের অনুপ্রবেশ রােধে ব্যর্থ হয়ে চিন সরকার তাদের ওপর নানা ধরনের বিধিনিষেধ আরােপ করে। প্রথম ইঙ্গ-চিন যুদ্ধ বা প্রথম অহিফেন যুদ্ধে (১৮৩৯-৪২ খ্রি.) ইংরেজদের কাছে মাঞ্চু শাসকরা হেরে যান এবং অপমানজনক নানকিং সন্ধি স্বাক্ষরে বাধ্য হন। এই সন্ধির শর্তানুযায়ী ইংরেজরা হংকং লাভ করে এবং চিনের ক্যান্টন-সহ ৫টি বন্দর ইউরােপীয় বাণিজ্যের জন্য খুলে দেওয়া হয়।


[2] জাপানে: উদীয়মান সূর্যের দেশ নামে পরিচিত জাপানও দীর্ঘদিন নিজেকে বাইরের জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে জাপানের প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্যের আকর্ষণে মার্কিন সেনাপতি কমােডাের ম্যাথু পেরি ৭টি যুদ্ধজাহাজ নিয়ে জাপানে প্রবেশ করেন (১৮৫৪ খ্রি.)। মার্কিন চাতুরীর কাছে হার মেনে জাপান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কানাগাওয়ার সন্ধি স্বাক্ষর করে। পরে একে একে ইংল্যান্ড, রাশিয়া, হল্যান্ড প্রভৃতি দেশ জাপানের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়। পরবর্তী সময়ে জাপানে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে। জাপান পূর্বে স্বাক্ষরিত যাবতীয় বৈষম্যমূলক চুক্তি বাতিল করে দেয়। ইউরােপীয় দেশগুলির সাম্রাজ্যবাদী ভাবনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে জাপান নিজেই সাম্রাজ্যবাদী দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।


দূরপ্রাচ্যে সাম্রাজ্যবাদ বিস্তারের পরবর্তী পর্যায়


[1] চিনে রাশিয়ার অনুপ্রবেশ: দূরপ্রাচ্যে জাপানের অগ্রগতি রােধ করে রাশিয়া মারিয়ার লিয়াও-টুং উপদ্বীপের দখল নেয়। শুধু তাই নয় রাশিয়া চিনের উত্তর সীমান্তবর্তী মঙ্গোলিয়ার আমুর উপত্যকা দখল করে এবং সেখানে ভাডিভােস্টক বন্দর স্থাপন করে। এই বন্দরকে রেলপথ দিয়ে সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরের সঙ্গে যােগ করা হয়। এ ছাড়াও লিয়াও-টুং উপদ্বীপের আর্থার বন্দরকে ট্রান্স সাইবেরীয় রেলপথের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়।


[2] চিনের খন্ডীকরণ: সাম্রাজ্যবাদের ফলে চিনকে ঘিরে রুশ-জাপান বিরােধ বাধে। ব্রিটেন এবং অন্যান্য বিরােধি শক্তিগুলিও চিনের ওপর ঝাপিয়ে পড়ে। জার্মানি কিয়াওচাও বন্দর দখলের পর শান্টুং প্রদেশেও নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে। ইংল্যান্ড ইয়াংশি উপত্যকায় নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। ফ্রান্স ইন্দোচিনের আনাম থেকে চিনের অভ্যন্তরভাগ পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের অধিকার পায়। তরমুজকে যেমন অনেকগুলি ফালি করে খাওয়া হয়, ইউরােপীয় শক্তিগুলি ঠিক তেমনভাবে চিনকে বিভিন্ন অংশে ভাগ করে এবং নিজ নিজ অধিকার প্রতিষ্ঠা করে।


[3] মুক্তদ্বার নীতি: মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব জন হে ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে তাঁর বিখ্যাত মুক্তদ্বার নীতি (Open Door Policy) চিনে প্রয়ােগ করার কথা ঘােষণা করেন। এই প্রস্তাব সংবলিত পত্র চিন দখলকারী রাষ্ট্রগুলির রাজধানী শহরে অর্থাৎ লন্ডন, প্যারিস, বার্লিন, সেন্ট পিটার্সবার্গ, রােম ও টোকিও-তে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। বলাবাহুল্য রাশিয়া ছাড়া চিনে বাণিজ্যে লিপ্ত অন্যান্য দেশগুলি এই মুক্তদ্বার নীতি গ্রহণ করে। চিনে বক্সার বিদ্রোহ (১৯০০ খ্রি.) শুরু হলে মাধঞ্চরিয়ার রেলপথ রক্ষার অজুহাতে রুশ সেনাদল চিনে। প্রবেশ করে এবং চিন সরকার সেই বিদ্রোহ দমনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এই সময় রাশিয়া সমস্ত মাঞ্চুরিয়া অঞ্চল দখল করে নেয়। তাই জাপান রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ (১৯০৪-০৫ খ্রি.) ঘােষণা করে। এই যুদ্ধে রাশিয়া পরাজিত হয় এবং জাপানের সঙ্গে পাের্টসমাউথের সন্ধি স্বাক্ষরে বাধ্য হয়। এই সন্ধির ফলে জাপান পুনরায় মাঞ্চুরিয়ার লিয়াওটুং উপদ্বীপ লাভ করে।


উপসংহার: পরবর্তীকালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন জাপান চিনে জার্মান উপনিবেশ শান্টুং দখল করে চিনের ওপর একুশ দফা দাবি পেশ করে (১৯১৫ খ্রি.)। এই দাবিগুলি চিন মেনে নেওয়ায় জাপান চিনে অতিরিক্ত বেশ কিছু সুযােগসুবিধা ভােগ করার সুযােগ পায়।


সাম্রাজ্যবাদের উদ্দেশ্যগুলি লেখাে।


সাম্রাজ্যবাদ বিকাশের বিভিন্ন স্তরগুলি সম্পর্কে লেখাে। ইউরােপের বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী দেশের ঔপনিবেশিক নীতি পর্যালােচনা করাে।


১৮৭০ থেকে ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালকে বিশ্বের ইতিহাসে সাম্রাজ্যবাদের যুগ হিসেবে উল্লেখ করা কতখানি যুক্তিযুক্ত তা আলােচনা করাে।