বৈষ্ণব আলংকারিকদের রসতত্ত্বের পরিচয় দাও। তাঁদের মতে শ্রেষ্ঠ রস কোনটি এবং কেন? পাঠ্য পদ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে শ্রেষ্ঠ রসটির বিষয়ে অলোচনা করো।

বৈষ্ণব আলংকারিকদের রসতত্ত্ব


বৈষ্ণব দর্শন শাস্ত্রে বৈশ্ববীয় পদাবলী মানেই রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা। গৌড়ীর বৈষ্ণব দর্শমৈ গৌড় বা বঙ্গদেশের অধিবাসী শ্রীচৈতন্যদেব নিজের জীবন-দৃষ্টান্ত দিয়ে ধর্মদর্শনের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সাধারণ অলংকার শাস্ত্রে ‘রতি, হাস, শোক, ক্রোধ, উৎসাহ, ভয়, জুগুপ্সা ও বিস্ময়' এই আট প্রকার রসের নির্দেশ থাকলেও বৈব আলংকারিকরা এই তত্ত্বকে পরিহার করে একটি ভিন্ন মাত্রা সংযোজন করেছেন। কারণ, জনসাধারণের দৈনন্দিন জীবনের আচার আচরণ ভাব ভঙ্গীকে গভীরভাবে অনুধাবন করার পর যে বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়, তার উপর নির্ভর করে উক্ত আটশ্রেণির ভাব বা রসের সন্ধান দিয়েছেন, কিন্তু বৈষ্ণব শাস্ত্রে কৃষ্ণই মুখ্য, তাঁকেই কেন্দ্র করে ভক্ত ও পূজারীগণ যুগে যুগে আবর্তিত হয়ে চলেছে। কাজেই সাধারণ মানুষের সঙ্গে কৃষ্ণানুরক্তির তুলনা চলেনা। তবে উভয়ের মধ্যে, একটিই সাদৃশ্য রতি ; ভাবযা শ্রেষ্ঠ। কিন্তু বৈশ্ববদের প্রিয়বস্তু ‘ভগবান। সেই ভগবান–‘কৃষ্ণ’ ফলে তাদের যে রতি তা হল ‘কৃষ্ণ রতি'। সাহিত্য দর্পণকার বিশ্বনাথ কবিরাজ এই রতির স্বরূপ উদ্ঘাটনে বলেছেন— প্রিয়বস্তুর প্রতি মানবমনের সহজ অনুরাগই রতি। কৃষ্ণের প্রতি ‘ভক্তি' ভাবই মুখ্য হয়ে উঠেছে।


‘ভক্তি রসামৃত সিন্ধু’তে রূপ গোস্বামী ভক্তি সম্বন্ধে যে তথ্য প্রদান করেছেন তা হল— “শ্রবণ কীর্তন স্মরণ ইত্যাদি দ্বারা রতি স্থায়ীভাব কৃষ্ণরতি বিভাব-অনুভাব সাত্ত্বিকভাব ব্যভিচারী ভাবের দ্বারা ভক্তহৃদয়ে আস্বাদ্য অবস্থায় আনীত হইলে তাহা ভক্তিরস হইয়া যায়।”এই ভক্তিরস পাঁচ প্রকার। যথা—শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য ও মধুর।


(১) শান্ত রস : যেখানে ভক্ত ভগবানরূপে কৃষ্ণকে কল্পনা করে নিয়ে আরাধনা করতে থাকেন, অর্থাৎ কৃষ্ণকে সবৈশ্বর্যশালী নিত্যবস্তুরূপে জেনে ভক্ত তার বিষয় বাসনা ত্যাগ করে একান্ত নিষ্ঠাভরে নিজেকে কৃষ্ণের পায়ে সমর্পন করে থাকেন সেখানেই সৃষ্টি হয় শান্তরসের। এই শান্তরসের স্থায়ীভাব হল 'শম' নামক রতি। এই পর্বের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন রূপে বিদ্যাপতির ‘প্রার্থনা পর্যায়ের পদখানি গুরুত্ব রাখে—

কত চতুরানন মরি মরি যাওয়ত ন তুয়া আদিঅব সানা।

তোহে জননি পুন তোহে সমায়ত সাগর লহরী সমানা।।"


(২) হাস্য রস : ভক্ত নিজেই ভৃত্য সেজে ভগবান কৃষ্ণকে প্রভুরূপে মেনে নিয়ে তাকে সেবার মধ্য দিয়ে এই রসের স্ফুরণ ঘটায়। ভগবান এখানে ঐশ্বর্যশালী। আর ভক্ত—দীনমাত্র। এরসের স্থায়ীভাব হল 'সেবা' নামক রতি। এর মধ্যে শাস্তরসের মত কৃথ্বনিষ্ঠা থাকলেও আর ও একটা ভাবসংযোজিত হল সেবা, এই সেবার দ্বারা ভক্ত ভগবানের মধ্যে একপ্রকার মমত্ব জেগে ওঠে। মীরার ভজনে পাই- ‘চাকর রাখোজী', দিয়া কার অনুচর (নরোওম দাস)।


(৩) সখ্য রস : ‘বিশ্বাসময় সমপ্রণাত'ই এখানে মুখ্য। ভগবানকে সখারূপে কল্পনা করে ভক্তের যে সঙ্গদান তার মধ্য দিয়েই নিষ্পন্ন হয় সখ্যরসের। শাস্তের কৃষ্ণনিষ্ঠা, দাস্যের সেবার সঙ্গে এই পর্বে আরও একটি ভাব যুক্ত হল—'সমপ্রাণতা'। তবে এক্ষেত্রে ভক্তই শুধু সেবক নয় অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মাঝে মধ্যে ভগবানও সেবক সাজেন। এই রসের স্থায়ীভাবে ‘বিপলম্ভ' নামক রতি।


(৪) বাৎসল্য রস : পাল্য-পালক সম্পর্কের মধ্যে ভক্ত এবং ভগবান এখানে আবদ্ধ। ভগবানকে সন্তানরূপে কল্পনা করে ভক্ত মাতা বা পিতা সেজে তাকে পালন করেন। অর্থাৎ  এই রসের স্থায়ীভাব হল ‘বাৎসল্য’ নামক রতি। এখানে অপত্যস্নেহ লক্ষ করা যায় এ প্রসঙ্গে যাদবেন্দ্রর একটি বিখ্যাত পদ—“আমার শপতি লাগে/না ধাইও ধেনুর আগে পরাণের পরাণ নীলমণি।"


(৫) মধুর রস : ভগবান এখানে কান্ত, ভক্ত কান্তা। স্বামীর প্রিয়রূপে ভগবানকে বরণ করে ভক্ত হৃদয়ে যে রসের স্ফুরণ ঘটে তার নামই মধুর রস। শান্ত দাস্য সখ্য, বাৎসল্যের সঙ্গে মধুর রসের কান্ত ভাব সংযোজিত হয়ে বৈষ্ণব সাহিত্যকে শ্রেষ্ঠ রস সাহিত্য রূপে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। এই মধুর রসের স্থায়ী ভাব হল ‘মধুরা’ নামে রতি। “শান্ত দাস্য-সখ্য বাৎসল্যের গুণ মধুরেতে বৈসে'—'চৈতন্য চরিতামৃত' কাব্যের এ উক্তিতে প্রমাণিত হয় বৈব সাহিত্যে এটিই উত্তম রস। এর পর আর কোনও রসের সন্ধান মেলেনি, তাই এই মধুর সর্বশ্রেষ্ঠ।


তবে বৈশ্বব শাস্ত্রকাররা এই ‘মধুর’ রতির তিনটি প্রকার ভেদ দেখিয়েছেন—সাধারণী, সমঞ্জসা ও সমর্থা। কৃষ্ণকে স্বামীরূপে কল্পনা করে ভক্ত হৃদয়ে যে কান্তা ভাব জাগরিত হয় তার মূল নিদর্শন-মধুর রস। কৃষ্ণের রূপ লাবণ্যে মুগ্ধ হয়ে তার সঙ্গলাভে ইন্দ্রিয় সুখ অনুভব করার মধ্যদিয়ে যে রতি ভক্ত হৃদয়ে উৎসারিত তাকে ‘সাধারণ’ রতি রূপে আখ্যা দেওয়া হয়। মথুরায় কুব্জার মধ্যে এই সাধারণী রতিই দৃষ্ট হয়। কৃষ্ণের রূপগুণ শ্রবণের পর তাঁর সঙ্গে পরিণয় বন্ধনে আবন্ধু হয়ে সঙ্গ সুখ উপলব্ধি করার মধ্যদিয়ে যে রতি ভক্ত হৃদয়ে হয় তার নাম ‘সমঞ্জসা’। দরজায় রুক্মিণী-সত্য-ভামার রতি হল সমঞ্জুসারতি। আর সমাজ সংসার সমস্ত মিথ্যা প্রমাণ করে, স্বতঃসিদ্ধ কৃষ্ণরতি ভক্ত হৃদয়ে উত্থিত হয়ে কেবলমাত্র ভগবানের তৃপ্তি সাধনের পক্ষে পর্যবসিত হয়, এবং এরদ্বারা ভগবান একেবারে ভক্তের বশীভূত হলে তবেই ‘সমর্থা’ রতিরূপে চিহ্নিত হয় ।। বৃন্দাবনে ললিতা বিশাখা-শ্রীরাধার রতি হল ‘সমর্থা'। এঁরাই হলেন কৃষ্ণের নিত্য প্রিয়া। বিশেষ করে—“ইহার মধ্যে রাধার প্রেম-সাধ্য শিরমণি”। সমগ্র বৈষ্ণব সাহিত্যে পরকীয়া নায়িকারূপে রাধিকা বিরাজ করলেও তাঁর প্রেম সর্বশ্রেষ্ঠ রূপে প্রতিভাত হয়ে উঠেছে।


পরিশেষে বলতে হয়, বৈব রসশাস্ত্রে, পঞ্চরসের অনুসন্ধান শাস্ত্রকারগণ দিয়ে থাকলেও মধুর রসের আবেদন শাশ্বত চিরন্তন। ভক্ত সাধক পদকারদের রচনায় মাঝে মধ্যে অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে শান্ত, দাস্য সখ্য, বাৎসল্য রসের ফল্গুধারা প্রবাহিত হলে মধুর রসকেই উপজীব্য করে। বিখ্যাত পদকাররা তাদের কাব্য সমুদ্রে সস্তরণ করেছেন, তাঁরা জানতেন, ভগবানকে যদি সত্যিকারের প্রিয়রূপে না দেখা যায় তাহলে ভক্ত ও ভগবানের মধ্যেকার দূরত্ব কোনও দিনই ঘুচবার নয়। তাই বোধহয় রবি ঠাকুরের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে—“দেবতারে প্রিয় করি প্রিয়রে দেবতা।" এই মহিমার স্ফূরণ ঘটবে ত্যাগ, তিতিক্ষা, সেবাধর্মের মধ্য দিয়ে, সেখানে জাগতিক সকল সুখই পরিত্যজ্য, ভগবানকে প্রিয়রূপে সেবা করাই মুখ্য—যা মধুর রসের মূলকথা।