১৮৭০ থেকে ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালকে বিশ্বের ইতিহাসে সাম্রাজ্যবাদের যুগ হিসেবে উল্লেখ করা কতখানি যুক্তিযুক্ত তা আলােচনা করাে।

১৮৭০ থেকে ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের সাম্রাজ্যবাদের যুগ

সূচনা: উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে শিল্পে উন্নত ইউরােপীয় দেশগুলি নিজেদের শিল্পপণ্য বিক্রয় এবং কাঁচামাল জোগাড়ের লক্ষ্যে উপনিবেশ দখলের উদ্দেশ্যে অন্যান্য দেশের সাথে প্রতিযােগীতায়। নামে। বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির মধ্যে সংঘাত লক্ষ্য করে ঐতিহাসিক ডেভিড টমসন, ১৮৭০ থেকে ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের সময়কালকে সাম্রাজ্যবাদের যুগ বলে উল্লেখ করেন।


সাম্রাজ্যবাদী সংঘাত: এই পর্বে (১৮৭০-১৯১৪ খ্রি.) ইউরােপের বিভিন্ন দেশগুলির মধ্যে সাম্রাজ্যবাদী সংঘাত বাধে।


  • ফ্রান্স ও প্রাশিয়ার মধ্যে সেডানের যুদ্ধ (১ সেপ্টেম্বর, ১৮৭০ খ্রি.) বেধেছিল। এর ফলে ফ্রান্সে দ্বিতীয় সাম্রাজ্যের পতন ঘটে, জার্মানির ঐক্য সম্পূর্ণ হয় এবং সেডানের যুদ্ধের পর ইউরােপীয় রাজনীতির ভারকেন্দ্র প্যারিস থেকে বার্লিনে স্থানান্তরিত হয়।


  • রুশ মদতে স্লাভরা স্বাধীনতার লক্ষ্যে তুরস্কের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তােলে যা প্যান স্লাভ আন্দোলন (Pan-slav movemant) বা সর্বস্লাভবাদ নামে পরিচিত। পরবর্তীকালে সান স্টিফানাের সন্ধি (৩ মার্চ, ১৮৭৮ খ্রি.) ও বার্লিন সন্ধির (১৩ জুলাই, ১৮৭৮ খ্রি.) দ্বারা বলকান সংকটের সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হলেও সংকটের রেশ থেকে যায়।


  • বলকান সংকটে রাশিয়া সর্বপ্রথম হস্তক্ষেপ করে নিজের প্রভাব প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়। এদিকে বলকান অঞ্চলে রুশ প্রভাব বাড়লে ইংল্যান্ড, অস্ট্রিয়া ও ফ্রান্স বাণিজ্যিক স্বার্থ ও সামাজিক অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্নে শঙ্কিত হয়ে পড়ে। সার্বিয়া, গ্রিস, বুলগেরিয়া ও মন্টেনেগ্রো এই চারটি রাজ্য একজোট হয়ে বলকান লিগ গঠন করে। বলকান লিগ খ্রিস্টান প্রজাদের ওপর তুর্কি অত্যাচার বন্ধের দাবি জানায়। কিন্তু তুরস্ক বলকান লিগের এই দাবি অগ্রাহ্য করলে শুরু হয় প্রথম বলকান যুদ্ধ (৮ অক্টোবর, ১৯১২ খ্রি. ৩০ মে, ১৯১৩ খ্রি.) এদিকে ম্যাসিডােনিয়া অঞ্চলে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠাকে কেন্দ্র করে সার্বিয়া ও বুলগেরিয়ার মধ্যে দ্বন্দ্ব বাধলে শুরু হয় দ্বিতীয় বলকান যুদ্ধ (২৯ জুন—১০ আগস্ট, ১৯১৩ খ্রি.) যুদ্ধকে কেন্দ্র করে অস্ট্রিয়া ও সার্বিয়ার মধ্যে চরম উত্তেজনামূলক সম্পর্ক তৈরি হয়। পরবর্তীকালে সেরাজেভাে হত্যাকান্ড (২৮ জুন, ১৯১৪ খ্রি.) ঘটলে শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (২৮ জুলাই, ১৯১৪ খ্রি.১১ নভেম্বর, ১৯১৮ খ্রি.)।


  • গ্রিস-তুরস্কের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করলেও গ্রিক ভাষাভাষী কয়েকটি অঞ্চল তুরস্কের শাসনাধীনে রয়ে গিয়েছিল। এই অঞ্চলগুলির মধ্যে ভূমধ্যসাগরস্থ ক্রিট দ্বীপের বাসিন্দারা স্বেচ্ছায় গ্রিসের সঙ্গে নিজেদেরকে যুক্ত করার কথা ঘােষণা করে। এই ঘােষণার পর গ্রিক সেনারা ক্রিট দ্বীপে প্রবেশ করে। তুর্কি সেনারা তাদের বাধা দিতে গেলে শুরু হয় গ্রিস-তুরস্ক যুদ্ধ, যাতে গ্রিস হেরে যায়।


  • তুরস্কে এনভার পাশার নেতৃত্বে তরুণ তুর্কি আন্দোলনের সূচনা ঘটেছিল (১৯০৮ খ্রি.)। এই আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল বিদেশি শক্তির প্রভাব থেকে তুরস্ককে মুক্ত রাখা।


যুক্তি


[1] বিখ্যাত ইংরেজ অর্থনীতিবীদ জে এ হবসন ও পরে লেনিন বলেন—১৮৭০ খ্রিস্টাব্দের পরবর্তী কয়েক দশকে শিল্পসমৃদ্ধ পশ্চিম ও মধ্য ইউরােপীয় দেশগুলিতে নতুন আর্থিক শক্তি বলা যায় ধনতন্ত্রের বিকাশ ঘটে।


[2] পাশাপাশি উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়কাল পর্যন্ত ইউরােপের সব জায়গায় ঔপনিবেশিক শক্তিগুলির বিরুদ্ধে জাতীয় নীতি ও জাতীয় জনমত গড়ে ওঠে। উনিশ শতকের শেষের দিক থেকে শিল্পবিপ্লবজাত অতিরিক্ত পুঁজি বিনিয়ােগ করার জন্য শিল্পোন্নত দেশগুলি এশিয়া ও আফ্রিকাকে বেছে নেয়। এর দুটি মূল কারণ ছিল—প্রথমটি হল, এই মহাদেশ দুটিতে কাঁচামালের প্রাচুর্য আর দ্বিতীয়টি ছিল সস্তা মজুর। এইভাবে এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চল দখল করতে গিয়ে ইউরােপীয় শক্তিগুলি নিজেদের মধ্যে সাম্রাজ্যবাদের সংঘাতে লিপ্ত হয়।


[3] অর্থনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থের সঙ্গে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণের লক্ষ্যে এগােলে ইউরােপীয় দেশগুলি সাম্রাজ্যবাদী শক্তিতে পরিণত হয়।


[4] নিজ নিজ দেশের মর্যাদা বাড়ানাের জন্য ইউরােপীয় দেশগুলি উপনিবেশ বিস্তারে এগিয়ে আসে। জার্মানি ও ইটালি এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা নেয়। এই দুই দেশের উগ্রজাতীয়তাবাদী আদর্শ ইউরােপের অন্যান্য দেশগুলির মধ্যে ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য বিস্তারের প্রতিযােগীতাকে তীব্র করে। ইউরােপ জুড়ে স্বদেশপ্রীতি সাম্রাজ্যগঠন প্রীতির রূপ নেয়। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে সাম্রাজ্যবাদ মূলত এই যুগের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠে।


[5] সামরিক কারণে ইউরােপীয় দেশগুলি বিশেষত জার্মানি ও ইটালি সাম্রাজ্যবাদের স্বপক্ষে যুক্তি দেখাতে শুরু করে। ফ্রান্সের মতাে দেশও যুক্তি দেখিয়ে বলে অনুন্নত দেশের অধিবাসীদের উপযুক্ত সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদেরকে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির সামরিক প্রয়ােজন মেটানাে উচিত।


[6] ইংরেজ লেখক রুডইয়ার্ড কিপলিং নিজ দেশেবাসীকে বিশ্বের অনুন্নত জাতিগুলির দায়দায়িত্ব গ্রহণের আহ্বান জানান। ফরাসি লেখক জুলি ফেরি বলেন উন্নত জাতিগুলির কর্তব্য হল পিছিয়ে পড়া জাতিগুলিকে সভ্য করে তােলা। লন্ডন মিশনারি সােসাইটির সদস্য ডেভিড লিভিংস্টোন, ফরাসি ধর্মপ্রচারক কার্ডিনাল লেভিগেরি প্রমুখ বিশ্বের অনুন্নত জাতিগুলির মধ্যে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের মধ্যে দিয়ে নিজ নিজ দেশের সাম্রাজ্যবাদ স্থাপনের পথকে মসৃণ করেন।


উপসংহার: ১৮৭০ থেকে ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়কালের মধ্যে ইউরােপীয় দেশগুলি যে সাম্রাজ্য বিস্তারের লড়াই শুরু করে তার দুই মূল ক্ষেত্র ছিল আফ্রিকা ও এশিয়া মহাদেশ। সাম্রাজ্যবাদের সুবাদে এই দুই মহাদেশ ছাড়াও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে দ্রুত ইউরােপীয় দেশগুলির প্রতিষ্ঠা ঘটে। ইংল্যান্ড-ফ্রান্স, জার্মানি ইটালির পাশাপাশি রাশিয়া ও আমেরিকার মতাে দেশগুলিও সাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্বে মত্ত হয়ে ওঠে।