সাম্রাজ্যবাদের উদ্দেশ্যগুলি লেখাে।

সূচনা: বিশেষ কয়েকটি উদ্দেশ্যপূরণের লক্ষ্যে কোনাে একটি দেশ। অপর দেশে সাম্রাজ্যবাদ কায়েম করে। আর্থিক সুবিধালাভ, জাতীয়তাবাদের সম্প্রসারণ, জাতীয় শক্তিবৃদ্ধি, জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষা, জনসংখ্যার সংকুলান ও ধর্ম-সভ্যতার আদর্শ প্রচার ছিল সাম্রাজ্যবাদের উদ্দেশ্যসমূহ।


সাম্রাজ্যবাদের উদ্দেশ্যসমূহ

[1] অর্থনৈতিক সুবিধালাভ: ইংল্যান্ড ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, পাের্তুগাল, স্পেন প্রভৃতি নৌশক্তিতে শক্তিশালী দেশগুলিও বাণিজ্যিক লক্ষ্য নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অভিযান চালায় এবং ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য গড়ে তােলে। আরও পরবর্তী সময়ে ইংল্যান্ড সহ ইউরােপের বেশ কয়েকটি দেশে শিল্পবিপ্লব ঘটলে কাঁচামাল আমদানি ও উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী বিক্রয়ের লক্ষ্যে উপনিবেশের প্রয়ােজনীয়তা বাড়ে। এই প্রয়ােজনীয়তা মেটানাের লক্ষ্যে ইউরােপের শিল্পোন্নত দেশগুলি সাম্রাজ্যবাদ কায়েমের লক্ষ্যে সক্রিয় হয়ে ওঠে।


[2] জাতীয়তাবাদের সম্প্রসারণ: সাম্রাজ্যবাদের অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হল জাতীয়তাবাদের সম্প্রসারণ। একটি দেশ নিজের দেশের পতাকা অন্য দেশে উড়িয়ে, নিজের দেশের ভাষাসংস্কৃতি অন্য দেশের অধিবাসীদের ওপরে চাপিয়ে দিয়ে এক আত্মতুষ্টি লাভ করে থাকে। এই ধরনের মনােভাব থেকেই অনেকে নিজেদেরকে শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে মনে করে থাকে। অনেক সময় কোনাে দেশের রাজা বা শাসক নিজেদের শৌর্যবীর্যের প্রমাণ রাখার জন্য সুবিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলতেন।


[3] জাতীয় শক্তিবৃদ্ধি: বিশ্বরাজনীতিতে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা বা দেশবাসীর নানা চাহিদা মেটানাের লক্ষ্যে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি জাতীয় শক্তিবৃদ্ধির চেষ্টা করে। নিজ নিজ ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য থেকে কাঁচামাল ও সম্পদ জোগাড় করে একটি ক্ষুদ্র দেশ কীভাবে বিশ্বের এক অন্যতম রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হতে পারে ফলে ব্রিটেন তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ফলে ব্রিটেন এবং ফ্রান্স world power হিসেবে মর্যাদা লাভ করে। পরবর্তীকালে জার্মানিও বিশ্বরাজনীতিতে স্বতন্ত্র স্থান লাভের লক্ষ্যে জাতীয় শক্তিবৃদ্ধির চেষ্টা চালায়।


[4] জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষা: জাতীয় নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে আসলে সাম্রাজ্যবাদকেই সুদৃঢ় করার চেষ্টা চালানাে হয়। যেমন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জাতীয় নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে ফ্রান্স রাইন নদী পর্যন্ত সমগ্র ভূখণ্ডের ওপর নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার দাবি জানায়। একই অজুহাতে জাপান দূরপ্রাচ্যে নিজের আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও লাতিন আমেরিকার অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করে দেশের নিরাপত্তার কথা প্রচার করে রাশিয়া লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, এস্তোনিয়া এবং ফিনল্যান্ডের কিছুটা অঞ্চল দখল করে নেয়। ব্রিটেন তার ব্রিটিশ জিব্রাল্টার, মাল্টা, সাইপ্রাস, এডেন ইত্যাদি অঞ্চল নিজের দখলে করে নেয়।


[5] জনসংখ্যার সংকুলান: শিল্পবিপ্লবের পরবর্তীকালে ইউরােপে বিপুল জনসংখ্যার চাপ সামলানাের লক্ষ্যে জনবহুল রাষ্ট্রগুলি অনেক সময় সাম্রাজ্যবাদের প্রসার ঘটাতে সচেষ্ট হয়। উনিশ শতকে ইউরােপের প্রায় সমস্ত দেশেই কমবেশি জনসংখ্যার বিস্তার ঘটে। এই বর্ধিত জনসংখ্যার পুনর্বাসন ও সংকুলানের লক্ষ্যে এবং কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে এশিয়া, আফ্রিকা এবং অস্ট্রেলিয়ার বেশকিছু অঞ্চলে ইউরােপীয় উপনিবেশ গড়ে ওঠে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে জার্মান রাষ্ট্রনায়ক অ্যাডলফ হিটলার পূর্ব ইউরোপে জার্মান রাষ্ট্রশক্তির সম্প্রসারণের লক্ষ্যে সচেষ্ট হন। জার্মানি ছাড়াও জাপান, ইটালি-সহ বেশ কয়েকটি দেশ এই একই অজুহাত দেখিয়ে নিজ নিজ সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটায়।


[6] ধর্ম ও সভ্যতার আদর্শ প্রচার: সুপ্রাচীন অতীত থেকেই পাের্তুগাল, স্পেন, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড প্রভৃতি দেশের খ্রিস্টান মিশনারিগণ। এশিয়া, আফ্রিকা এবং আমেরিকার বিভিন্ন দেশে গিয়ে খ্রিস্টধর্মের প্রচার করেন। স্পেন ও পাের্তুগালের হাজার হাজার জেসুইট এবং অন্যান্য খ্রিস্টান পুরােহিতগণ খ্রিস্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে লাতিন আমেরিকার বহু অজানা দেশে পাড়ি দেয়। সপ্তদশ শতকে উত্তর আমেরিকাতে মূলত প্রােটেস্ট্যান্ট ধর্মীয় নেতাদের প্রচেষ্টার জন্যই ব্রিটিশ উপনিবেশ গড়ে উঠেছিল। শুধুমাত্র ধর্মযাজকরাই নন, রাজনৈতিক নেতৃবর্গও ধর্ম ও সভ্যতা প্রচারকে হাতিয়ার করে সাম্রাজ্যবাদী নীতি অনুসরণ করেন।


উপসংহার: ইউরােপের কিছু সাম্রাজ্যবাদী চিন্তাবিদ মনে করেন এশিয়া ও আফ্রিকার অনুন্নত, অন্ধকারাচ্ছন্ন মানুষদের প্রতি ইউরােপীয়দের কিছু দায়বদ্ধতা আছে। যেমন, স্পেনকে পরাজিত করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ফিলিপিনস অধিকার করে নিলে (১৮৯৮ খ্রি.) মার্কিন রাষ্ট্রপতি ম্যাককিনলে খ্রিস্টধর্ম ও মানবতার স্বার্থে তাতে সমর্থন জানান।