'কমলাকান্তের দপ্তর’-এর ‘আমার মন' প্রবন্ধটির বক্তব্য বিষয় সংক্ষেপে বিবৃত করে নিবন্ধটির রচনাভঙ্গীর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনা করো।

সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আমার মন’ প্রবন্ধটির বিষয়বস্তুকে মোটামুটিভাবে চারটি ভাগে বিভক্ত করা যেতে পারে। প্রথমে কমলাকান্তের মন হারিয়ে যাওয়া নিয়ে তিনি কৌতুক করেছেন। এরপর সুখের মূল অন্বেষণ করতে গিয়ে পরসুখবর্ধনকেই স্থায়ী সুখের মূল বলে নির্দেশ করেছেন। তৃতীয় অংশে বর্তমানে এদেশে প্রদত্ত সুখের অভাব ও অর্থ বা বাহ্য-সম্পদের জন্য নিরতিশয় লালসার কথা বলে ক্ষোভ করেছেন। পরিশেষে তিনি আত্মসর্বস্বতা বিস্মৃত হয়ে পরের জন্য চিন্তা করতে উপদেশ দিয়েছেন। বস্তুতঃ প্রবন্ধটি লঘুভাবে শুরু হয়েছে; কিন্তু রসিকতায় প্রবৃত্ত হয়ে কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর বঙ্কিমচন্দ্র অকস্মাৎ গভীর সত্য দর্শনে প্রবৃত্ত হয়েছেন। এরপরেই স্বদেশের দিকে দৃষ্টিপাত করে আশাভঙ্গজনিত ক্ষোভ ও পরিশেষে দেশবাসীর নিকট সাগ্রহ অনুরোধ ব্যক্ত হয়েছে।


কমলাকান্ত একদিন অনুভব করে, তার মন কোথায় হারিয়ে গেছে। সে তার বিভিন্ন কাম্যবস্তুতে নিজের হারানো মনের সন্ধান করতে থাকে। সে অত্যন্ত ভোজনপ্রিয়, পাকশালায়, যেখানে পোলাও, কাবাব, কোফতা, ইলিস মাছের ঝোল, মাংসের কোরমা, লুচি, সন্দেশ ইত্যাদি লোভনীয় সুখাদ্য প্রস্তুত হয়, সেইখানে তার মন ভক্তিপ্রণত হয়ে থাকত। কিন্তু একজন বন্ধুর পরামর্শে সেখানেও কমলাকান্ত তার হারানো মনের সন্ধান পেল না। একজন বন্ধুর পরামর্শ মতো সে প্রসন্ন গোয়ালিনীর কাছে নিজের মনকে সন্ধান করে দেখল। প্রসন্নর সঙ্গে তার কিছু প্রণয় ছিল, কিন্তু সেটি শুধু গব্যরসাত্মক। প্রসন্ন তাকে যে দুধ দেয়, তা জলশূন্য ও দামেও সস্তা, সে কখনো কখনো তাকে ক্ষীর, সর, ননী ইত্যাদি বিনামূল্যে দিয়ে যায়। সে একদিন কমলাকান্তের দপ্তরে কিসের কাগজ জানতে চেয়েছিল, সে কি শুনবে, কমলাকান্ত জানতে চাইলে শুনতে রাজি হয়েছিল। সে প্রসন্নকে কয়েকটি রচনা পড়ে শুনিয়েছিল, সে শুনেছিল। শুধু তাই নয়, প্রসন্ন তার অনুরোধে আফিম পর্যন্ত ধরেছিল। এই সমস্ত গুণের জন্য কমলাকান্ত তার বশীভূত। কিন্তু সে প্রসন্নর কাছেও তার মনকে খুঁজে পেল না। কমলাকান্ত পথে বেরিয়ে কলসী কাঁখে নিয়ে এক যুবতীকে যেতে দেখল। তার প্রতি পদক্ষেপে রূপলাবণ্যের তরঙ্গকে উচ্ছ্বলিত হতে দেখে কমলাকান্তের মনে হল, এই যুবতীই তার মনকে চুরি করেছে। সে যুবতীর সঙ্গে সঙ্গে চলতে থাকে, তখন সে কেন তার সঙ্গ নিয়েছে, যুবতীটি জানতে চায়। কমলাকান্ত উত্তর দেয়, সে তার মন চুরি করেছে। যুবতী তখন তাকে কটূক্তি করে গালি দেয়। সেই শিক্ষা লাভের পর কমলাকান্ত মনের সন্ধানে আর রসিকতার চেষ্টা করে না। সে উপলব্ধি করে, সে কখনো কিছুতে তার মনকে বাঁধতে পারেনি, সেইজন্য কিছুতেই তার মন নেই। এই সংসারে মানুষেরা কী করতে আসে তা সে ঠিক বলতে পারে না, কিন্তু তার মনে হয়, তারা শুধু মন বাঁধা দিতেই আসে। কমলাকান্ত চিরকাল নিজেরই রইল, পরের হল না, সেইজন্যই পৃথিবীতে তার সুখ নেই। যারা স্বভাবগত বৈশিষ্ট্যে আত্মপ্রিয়, তারাও বিয়ে করে সংসারী হয়ে স্ত্রীপুত্রের কাছে আত্মসমর্পণ করে সুখী হয়। কমলাকান্ত অনেক অনুসন্ধানে দেখেছে, পরের জন্য আত্মবিসর্জন ছাড়া পৃথিবীতে স্থায়ী সুখের অন্য কোনো মূল বা ভিত্তি নেই। অর্থ, খ্যাতি ইত্যাদি ইন্দ্রিয়াদিলব্ধ সুখ স্থায়ী হয় না। এগুলি প্রথমবারে যে পরিমাণে সুখদায়ক হয়, দ্বিতীয় ও তৃতীয়বারে সেই সুখের পরিমাণ ক্রমাগত হ্রাস পায়, অভ্যাসে সুখ আর থাকে না। সুখ না থাকুক, তাদের অভাবে গুরুতর অতৃপ্তি দেখা দেয় এবং তৃপ্তিহীন আকাঙ্ক্ষায় যন্ত্রণা বৃদ্ধি হয়। পৃথিবীর যে সমস্ত বস্তু কাম্য বলে আবহমানকাল পরিচিত, তারা সবই অতৃপ্তিকর ও দুঃখের উৎস। খ্যাতির সঙ্গে নিন্দা, ইন্দ্রিয়সুখের সঙ্গে ব্যাধি, ঐশ্বর্যের সঙ্গে ক্ষতি ও মনোকষ্ট—প্রতিটি কাম্যবস্তুর সঙ্গে অতৃপ্তি ও দুঃখ জড়িত। বিদ্যা তৃপ্তিদায়ক নয়, শুধু অন্ধকার থেকে গাঢ়তর অন্ধকারে মানুষকে নিয়ে যায়। অর্থ বা খ্যাতি অর্জন করে সুখী হয়েছে, একথা কারো মুখেই শোনা যায় না। তার থেকে ঐশ্বর্য, সম্মান ইত্যাদির নিষ্ফলতার গুরুতর প্রমাণ আর কী হতে পারে।


তবু যে মানুষ মাত্রেই ধনমানাদির জন্য লালায়িত হয়ে তাদের জন্য প্রাণপাত করে, তা শুধু কুশিক্ষার প্রভাবে। বিদ্বান, বুদ্ধিমান, দার্শনিক, সংসারতত্ত্ববিদ প্রভৃতি নিজেদের জ্ঞান ও বুদ্ধি নিয়ে আস্ফালন করতে পারে, কিন্তু তাদের স্বীকার করতেই হবে যে পরসুখবর্ধন ছাড়া মানুষের অন্য সুখের ভিত্তি নেই। কমলাকান্ত মরে ছাই হবে, তার মান পর্যন্ত লুপ্ত হবে, কিন্তু সে মুক্তকণ্ঠে বলছে, একদিন মানুষমাত্রেই তার এই কথা বুঝবে যে মানুষের স্থায়ী সুখের আর কোন ভিত্তি নেই। এই কথাটি প্রাচীন, প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে বুদ্ধদেব এই কথা কতভাবে বলে গেছেন, তারপর শত সহস্র লোকশিক্ষক শতসহস্রবার এই শিক্ষা দিয়েছেন। কিন্তু মানুষ কিছুতেই আত্মকেন্দ্রিকতার মায়াজাল ছিন্ন করতে পারে না। আবার আমাদের দেশ ইংরেজ শাসনাধীন হবার পর ইংরেজি শাসন, ইংরেজি সভ্যতা ও ইংরেজি শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে বাহ্যসম্পদের প্রতি অনুরাগ এসে এ দেশকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বাহাসম্পদ ইংরেজ জাতির বড়ো প্রিয়। এটাই ইংরেজি সভ্যতার প্রধান লক্ষণ, বাণিজ্য বৃদ্ধিতে, রেলওয়ে, টেলিগ্রাফ প্রভৃতির স্থাপনে ইংরেজদের ভারতবর্ষের বাহাসম্পদ বৃদ্ধির পরিচয় জাজ্বল্যমান। আমরা তাতেই আকৃষ্ট হয়ে বাহ্যসম্পদকে ভালোবেসেছি, তার আরাধনায় আমাদের প্রাচীন আদর্শগুলিকে বিসর্জন দিয়েছি। কিন্তু কমলাকান্তের প্রশ্ন, এই রেলওয়ে-টেলিগ্রাফে তার কতটুকু মনের সুখ বাড়বে, তার এই হারানো মন এই বাহ্যসম্পদ খুঁজে এনে দিতে পারবে, কারো মনের অশান্তির আগুন নির্বাপিত করতে পারবে। ইংরেজি, বাঙলা সংবাদপত্র, সাময়িকপত্র, বক্তৃতা বিতর্ক— সবকিছুতেই এই বাহ্যসম্পদের প্রশস্তি শোনা যায়। বাহ্যসম্পদের পূজার জন্য আহ্বান প্রতিনিয়ত উচ্চারিত হচ্ছে, এ পূজার তাম্রশ্মশ্রুধারী ইংরেজ নামে ঋষিগণ পুরোহিত, অ্যাডাম স্মিথ পুরাণ এবং মিল তন্ত্র থেকে এ পুজার মন্ত্র পড়তে হয়; এই উৎসবে ইংরেজি সংবাদপত্রগুলি ঢাক ঢোল, বাংলা সংবাদপত্র কাঁসিদার, শিক্ষা ও উৎসাহ নৈবেদ্য এবং হৃদয় ছাগবলি।


এই বৈষয়িক সম্পদে ক'জন অভদ্র ভদ্র হয়েছে, ক'জন অশিষ্ট শিষ্ট, ক'জন অধার্মিক ধার্মিক, ক'জন অপবিত্র পবিত্র হয়েছে, তার পূজারীরা কী কমলাকান্তের এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে? তারা বলবে, এই উদর পূর্ণ তথা তার ক্ষুধা প্রতিদিন দূর করা চাই, যাতে সকলেরই উদর ভালো করে পূর্ণ হয়, তারা তারই জন্য সচেষ্ট। কিন্তু সেই কাজে তারা এত ব্যস্ত যে অন্য সব কথা ভুলে গেছে, মনের সুখ বৃদ্ধি তার থেকে স্বতন্ত্র; মানুষে মানুষে প্রীতি বৃদ্ধির কথা তাদের ভাবতে হবে। কমলাকান্ত শুধু নিজের উদর পূর্তিতেই ব্যস্ত থেকেছে, কখনো পরের জন্য ভাবেনি; সেইজন্য সংসারে তার সুখ নেই। পরের বোঝা কেন ঘাড়ে করবে একথা ভেবে সে সংসারী হয়নি। কিন্তু যারা বিবাহ করেছেন তারা যদি ভাবে, বিবাহ করেছে বলেই সুখ তাদের করতলগত, তবে তারা ভুল করবে। সংসারী হয়ে নিজের পরিবারকে ভালোবেসে তারা যদি সমগ্র মানবজাতিকে ভালোবাসতে না শেখে, তবে তাদের বিবাহ নিষ্ফল। বিবাহের মধ্য দিয়ে মানবচরিত্রের উৎকর্ষসাধন না হলে তার কোনো প্রয়োজন নেই।


‘কমলাকান্তের দপ্তর’-এর অন্যান্য প্রবন্ধের মতো আমার মন'ও রচনা-সাহিত্যের উদাহরণ। এখানে গতানুগতিক প্রবন্ধের তথ্যসমাবেশ, যুক্তিশৃঙ্খলাবদ্ধ বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে মানবপ্রীতিই যে মানুষের জীবনের সার্থকতার একমাত্র মানদণ্ড, এই সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করা হয়নি। রঙ্গরসিকতা, ভবঘুরে অর্ধোন্মাদ কমলাকান্তের বিচিত্র অনুভূতি ও মননের ছন্দে সেই সত্য সজীব মূর্তি লাভ করেছে। তার মন কোথায় হারিয়ে গেল, কোন কিছুতেই তার সুখ কেন নেই–কমলাকান্ত প্রথমে এই প্রশ্নের সূত্রে তার ভোজনপ্রিয়তা নিয়ে কৌতুক করেছে। “যেখানে ইলিস মৎস্য, সতৈল অভিষেকের পর ঝোলগঙ্গায় স্নান করিয়া, মৃণ্ময়, কাৎস্যময়, কাচময় বা রজতময় সিংহাসনে উপবেশন করেন, সেইখানেই আমার মন প্রণত হইয়া পড়িয়া থাকে, ভক্তিরসে অভিভূত হইয়া, সেই তীর্থস্থান আর ছাড়িতে চায় না" এই বিচিত্র কল্পনায় সুখাদ্যের প্রতি কমলাকান্তের আকর্ষণ আমাদের কাছে অত্যন্ত কৌতুকাবহ হয়ে ওঠে। নিজের হারানো মনের সন্ধানের সূত্রে প্রসন্ন গোয়ালিনীর সঙ্গে তার গব্যরসাত্মক প্রণয়ের বিবরণ কম কৌতুকাবহ নয়। “প্রসন্নের গুণের কথা আর অধিক কি বলিব—সে আমার অনুরোধে আফিম ধরিয়াছিল”—কমলাকান্তের এই গুণগ্রাহিতার কৌতুকরসে আমাদের মন সিঞ্চিত হয়। পথাচারিণী একটি যুবতীর কাছে তার হারানো মনের সন্ধান, সে কেন তার সঙ্গ নিয়েছে, তার এই প্রশ্নের উত্তরে সে তার মন চুরি করেছে, কমলাকান্তের সেই উত্তরদানের পর যুবতীর এই প্রতিক্রিয়া—“যুবতী কটূক্তি করিয়া গালি দিল; বলিল, ‘চুরি করি নাই। তোমার ভগিনী আমাকে যাচাই করিতে দিয়াছিল। দর কষিয়া আমি ফিরিয়া দিয়েছি'—রঙ্গরসে অত্যন্ত উপভোগ্য হয়ে ওঠে।


এইভাবে কৌতুকরসে রচনাটির মূল ভাববস্তুর উপস্থাপনার পর কমলাকান্ত মননশীলতার গাম্ভীর্যে ও আবেগের স্পন্দনে এই সত্য উচ্চারণ করে, “আমি অনেক অনুসন্ধান করিয়া দেখিতেছি, পরের জন্য আত্মবিসর্জন ভিন্ন পৃথিবীতে স্থায়ী সুখের অন্য কোন মূল্য নাই।” ইংরেজ রাজত্ব ইংরেজদের আদর্শে এদেশের শিক্ষিত সম্প্রদায় বাহ্যসম্পদসাধনাকেই তাদের জীবনের মূলমন্ত্র করে তুলেছিল, কমলাকান্ত এই অংশে তাদের সেই মানসিকতাকে কঠিন বিদ্রূপের ধিক্কার দেয় : “মন! মন আবার কি? টাকা ছাড়া মন কি? টাকা ছাড়া আমাদের মন নাই; টাকশাল আমাদের মন ভাঙ্গে গড়ে। টাকাই বাহাসম্পদ। হর হর বম্ বম্। বাহ্যসম্পদের পূজা কর। এ পূজার তাম্রশ্মশ্রুধারী ইংরেজ নামে ঋষিগণ পুরোহিত; এডাম স্মিথ পুরাণ এবং মিল তন্ত্র হইতে এ পূজার মন্ত্র পড়িতে হয়; এ উৎসবে ইংরেজি সংবাদপত্র সকল ঢাকঢোল, বাঙ্গালা সম্বাদ-পত্র কাসিদার; শিক্ষা এবং উৎসাহ ইহাতে নৈবেদ্য, এবং হৃদয় ইহাতে ছাগবলি"। এইভাবেই রঙ্গব্যঙ্গ, মননশীলতা ও বিদ্রূপ প্রভৃতির সুরসমন্বয়ে, কমলাকান্তের তথা লেখকের মনন ও আবেগের মধ্য দিয়ে মানবপ্রীতিই মানুষের জীবনের একমাত্র সার্থকতা, এই সত্য সৃজনমূলক সাহিত্যের হৃদয়স্পর্শী রূপ পেয়েছে।