“অনেকগুলি প্রবন্ধে বঙ্কিমচন্দ্র জীবনকে একটা প্রবল, সর্বব্যাপী, হাস্যকর অথচ গভীর অর্থপূর্ণ কল্পনার ভিতর দিয়া দেখিয়াছেন; সেই কল্পনার দ্বারা বিকৃত ও রূপান্তরিত হইয়া জীবনের সমস্ত প্রচেষ্টা ও উদ্দেশ্য এক ব্যর্থ উদ্ভট খেয়ালের সূত্রে গ্রথিত বলিয়া প্রতিভাত হইয়াছে।”—বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কমলাকান্তের দপ্তরে’, ‘পতঙ্গ’ প্রবন্ধটি সম্পর্কে এই মন্তব্যটির যৌক্তিকতা বিচার করো।

বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কমলাকান্তের দপ্তর’-এর অন্তর্ভুক্ত ‘পতঙ্গ’ শীর্ষক রচনায় মানুষের জীবন সম্পর্কিত এক তত্ত্বভাবনা আপাত হাস্যকর অথচ গভীর অর্থপূর্ণ কল্পনায় উপস্থাপিত হয়েছে। কমলাকান্ত নসীরাম বাবুর বৈঠকখানায় সান্ধ্য আসরে দলাদলির প্রসঙ্গে চটে গিয়ে আফিমের মাত্রা চড়িয়ে দেয়, তার প্রসাদে সেজের আলোর চারপাশে পরিভ্রমণরত একটি পতঙ্গের কথা শুনতে পায়। নিজেদের স্বভাবধর্মের দুনির্বার প্রেরণায়ই পতঙ্গরা অগ্নিশিখার রূপে মুগ্ধ হয়ে তাতে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণ বিসর্জন করে আসছে আবহমানকাল। এই পতঙ্গ সেজের বাতির কাচের আবরণের ধাক্কা খেয়ে তাতে আত্মাহুতি দিতে পারছে না বলে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়ে বলে, পুড়ে মরতে তাদের চিরকালের অধিকার, পতঙ্গজাতিরূপে তারা পূর্বাপর আলোয় পুড়ে‌ আসছে। অগ্নিশিখা রূপময়, সে পোড়াতেই জন্মগ্রহণ করেছে, আর পুড়ে মরার জন্যই পতঙ্গদের জন্ম। হিন্দুর মেয়ের সঙ্গে তাদের অনেক পার্থক্য। তারা আশা-ভরসা থাকতে কখনও পুড়ে মরতে চায় না, আগে বিধবা হয়, তবে পুড়ে মরতে বসে। শুধু পতঙ্গরাই সকল সময়ে প্রাণবিসর্জনে ইচ্ছুক।


আফিমের প্রসাদে সেজের বাতির চারদিকে পরিভ্রমণরত আলোর উদ্দেশে পতঙ্গের এই ভাষণের কল্পনা নিঃসন্দেহে হাস্যকর। কিন্তু এই হাস্যকর কল্পনার মধ্য দিয়েই বঙ্কিমচন্দ্র মানব জীবনের করুণ নিষ্ফলতা প্রদর্শন করেছেন। নেশাখোর কমলাকান্তের কল্পনায় সমগ্র মানব জাতি বিকৃত ও রূপান্তরিত হয়ে পতঙ্গরূপে প্রতিভাত হয়েছে। সকল মানুষেরই এক একটি বহ্নি আছে, সকলেই মনে করে, সেই বহ্নিতে পুড়ে মরার অধিকার তাদের আছে, কেউ মরে, কেউ কাচে অর্থাৎ কোনো না কোনো বাধা বা পিছুটানের জন্য মরতে পারে না। জ্ঞান, ঐশ্বর্য, মান, রূপ, ধর্ম, ইন্দ্রিয়—এসবই তো অগ্নিশিখার মতো মানুষকে আকর্ষণ করে, তাদের আকণ্ঠ তৃষ্ণায় সমস্ত জীবন ধরে দগ্ধ হয়ে তারা মৃত্যুবরণ করে। সংসার যেমন বহ্নিময়, তেমনি কাচময়, অর্থাৎ তার চারধারে আবরণ আছে, অনেকেই সেই আবরণে ঠেকে গিয়ে রক্ষা পায়। যদি সমস্ত ধর্মবিদ চৈতন্যদেবের মতো ধর্ম মানস-প্রত্যক্ষে দেখতে পেত, তবে এই পৃথিবীতে কেউ আর বেঁচে থাকত না। অনেকে জ্ঞান-বহ্নির আবরণ কাচে ঠেকে রক্ষা পায়, কিন্তু সক্রেটিস ও গ্যালিলিও তাতে পুড়ে মরলেন। মহাভারতে মান-বহ্নিতে দুর্যোধনকে, 'প্যারাডাইস লস্টে’ জ্ঞান-বহ্নিতে আদম ও ইভকে, ‘অ্যান্টনি অ্যান্ড ক্লিওপেট্রায় ভোগ-বহ্নিতে অ্যান্টনি ও ক্লিওপেট্রাকে, 'রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট' রূপ-বহ্নিতে রোমিও ও জুলিয়েটকে এবং 'ওথেলো' নাটকে ঈর্ষা-বহ্নিতে ওথেলোকে পুড়ে মরতে দেখি।


মানুষের জ্ঞান, অর্থ, রূপ, মান প্রভৃতির তীব্র আকাঙ্ক্ষায় চঞ্চল হয়, তাদের লাভ করার উদ্দেশ্যে প্রয়াসী হয়, এইসব কাম্যবস্তু কি, সঠিকভাবে জানেও না; শুধু তাদের কামনায় অস্থির ও উদ্ভ্রান্ত হয়ে নিজের জীবন শেষ করে। ঈশ্বর, ধর্ম, স্নেহ, জ্ঞান প্রভৃতির স্বরূপ কী, কেউ জানে না। কাব্য, ধর্ম, দর্শন ও বিজ্ঞান তার ব্যাখ্যা দিতে পারেনি। সুতরাং এইসব কাম্যবস্তুকে কেন্দ্র করে মানুষের সমস্ত প্রচেষ্টা ও উদ্দেশ্য শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ ও উদ্ভট খেয়াল বলেই মনে হয়। ‘পতঙ্গ’ প্রবন্ধটি এইভাবে বিশ্লেষণ করে দেখলে বঙ্কিমচন্দ্র জীবনকে যে একটা প্রবল, সর্বব্যাপী, হাস্যকর অথচ গভীর অর্থপূর্ণ কল্পনার ভেতর দিয়ে দেখেছেন, সেই কল্পনার দ্বারা বিকৃত ও রূপান্তরিত হয়ে জীবনের সমস্ত প্রচেষ্টা ও উদ্দেশ্য এক ব্যর্থ উদ্ভট খেয়ালের সূত্রে প্রথিত বলে প্রতিভাত হয়েছে, সমালোচকের এই মন্তব্য যুক্তিপূর্ণ বলেই বোধ হয়। অগ্নিশিখার রূপে মুগ্ধ হয়ে পতঙ্গের তীব্র চঞ্চলতা এবং তাতে আত্মাহুতি দান—এই রূপক-কল্পনায় মানুষের জীবনের বিভিন্ন কাম্যবস্তু লাভের উদ্দেশ্য ও প্রচেষ্টা ব্যর্থ ও উদ্ভট খেয়ালের সূত্রে গাঁথা ছাড়া আর কিছু মনে হয় না।