যে দেশে বহু ধর্ম বহু ভাষা' প্রবন্ধে অন্নদাশঙ্কর রাষ্ট্রভাষারূপে ইংরেজির সমর্থনে যে সমস্ত যুক্তি উত্থাপন করেছেন, তার ওপর আলোকপাত করো।

ইংরেজাধীন ভারতের রাষ্ট্রভাষা ছিল ইংরেজি। বহুভাষী দেশ এই বিদেশি ভাষার সূত্রেই এক অভিন্ন ঐক্যসূত্রে বাঁধা পড়েছিল। সেদিন হয়তো পরাধীন জাতিরূপে ইংরেজির দায় ভারতবাসীকে বাধ্য হয়ে গ্রহণ করতে হয়েছিল, কিন্তু কালক্রমে অভ্যস্ততাহেতু ইংরেজিই আমাদের শিক্ষা-দীক্ষা ও ভাব প্রকাশের মাধ্যম-রূপে একমাত্র অবলম্বন হয়ে দাঁড়াল। তারপর ইংরেজ চলে গেল, স্বাধীন ভারতে রাষ্ট্রভাষা এক সমস্যারূপে দেখা দিল। ভারতবর্ষে অন্তত ১৪-১৫টি প্রধান ভাষা রয়েছে। ভারতের নিজস্ব এমন কোনো প্রচলিত ভাষা নেই, যা সর্বজনের নিকট গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারে। এর মধ্যে অন্যতম ভাষা হিন্দি, যা’ সর্বাধিক লোকের মাতৃভাষা এবং ততোধিক লোকের নিকট বোধগম্য। অতএব ইংরেজির উত্তরাধিকারের দাবিদার হলো হিন্দি, কিন্তু অহিন্দিভাষীরা এর বিরোধিতায় এগিয়ে এল কারণ হিন্দি অনেকের নিকটই দুর্বোধ্য। কিন্তু এমন কোন ভাষাও নেই যা’ অপর সকলের নিকট গ্রহণীয় হতে পারে। এই ক্ষেত্রে মুশকিল আসান হতে পারে যদি গ্রহণ করা যায় ইংরেজিকে, যা এতদিন ধরে সরকারি ভাষারূপে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কিন্তু হিন্দিও তার দাবিতে অনড়। অতএব ভাষার প্রশ্নে গণপরিষদে ভোট নেওয়া হলো, তাতে মাত্র এক ভোটের ব্যবধানে হিন্দির বিজয় ঘোষিত হয় এবং ভারতের রাষ্ট্রভাষারূপে হিন্দিকেই সংবিধানে স্থান দেওয়া হয়। যেহেতু হিন্দিতে অনেকের আপত্তি রয়েছে এবং দেশের শাসনতন্ত্র হিন্দিতে তখনই চালানো সম্ভবপর নয়, এই বিবেচনার আপাত ব্যবস্থা হিসেবে মাত্র ১৫ বৎসরের জন্য ইংরেজিকেও হিন্দির পাশে রাখা হলো। স্থির হল, ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে বিষয়টি নিয়ে পুনর্বিবেচনা করা হবে। এই অবস্থায় ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে অন্নদাশঙ্কর রায় আলোচ্য প্রবন্ধটি রচনা করেন এবং বহু যুক্তি-তর্কের অবতারণা করে অভিমত প্রকাশ করেন যে, ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দের পরেও অনির্দিষ্ট কালের জন্য অথবা অন্তত আগামী ৫০ বৎসরের জন্য ইংরেজিকে হিন্দির পাশে সহচর সরকারি ভাষা-রূপে স্থান দান করা হোক।


ভারতের প্রতিটি ভাষাভাষী নাগরিকের প্রতি যথার্থ সুবিচার করতে হলে এবং শাসন-কর্তৃপক্ষের প্রকৃত ন্যায়নীতিবোধের পরিচয় দিতে হলে ভারতের প্রধান ১৪-১৫টি ভাষাকেই রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দান করা সংগত হত। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে অবস্থাটা অতীব জটিল, হয়তো বা অসাধ্য হয়ে দাঁড়াত। এইজন্যই এর বিকল্পরূপে এমন একটি ভাষার প্রয়োজন যা সকলের পক্ষে সমানভাবে গ্রহণীয় (ভারতে তেমন ভাষা অবশ্য একটিই ছিল, সেটি সংস্কৃত। কিন্তু আলোচনামূলে কেন যে এটির উল্লেখ করা হল না, তার কারণ বোঝা যায় না।)। দীর্ঘকাল ইংরেজি ভাষাই আমাদের এই অভাব পূরণ করে এসেছে, অতএব সমস্যার সমাধান কল্পে এর দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া আর গত্যন্তর নেই। এমনকি হিন্দিরই পরিবর্তে ইংরেজিই অধিকতর গ্রহণযোগ্য, জাতীয়তার খাতিরেই হিন্দিকে স্থান দিতে হয়েছে। এখন, কেন একটি বিদেশিই শুধু নয়, বিজেতার ভাষাকেই আমাদের রাষ্ট্রভাষা রূপে গ্রহণ করব, তার কিছু কিছু কারণ প্রদর্শন প্রয়োজন।


এতকাল ধরে ইংরেজি শুধু সরকারি ভাষারূপে নয়, শিক্ষার মাধ্যম, প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা মাধ্যম-রূপে চলে এসেছে বলে দায়ে পড়েই হোক আর চাপে পড়েই হোক, ইংরেজিকে আমরা মেনে নিয়েছি। শুধু মেনে নিয়েছি বলাটাই যথেষ্ট নয়, দীর্ঘকালের অভ্যস্ততায় এবং ইংরেজির গুণপনায় তাতে আকৃষ্ট হয়ে তাকে আপনও করে নিয়েছি। তাই এখন, স্বাধীন ভারতেও প্রায় সর্বত্র ইংরেজি আবশ্যিক ভাষারূপে গণ্য হচ্ছে, যেখানে তা হয়নি, সেখানে মানুষ স্বেচ্ছায় ইংরেজি পড়ছে। পক্ষান্তরে দেশীয় টোল মাদ্রাসা প্রায় উঠেই যাচ্ছে।


রাষ্ট্রভাষা হিন্দি থাকলেও এবং ইংরেজি তার সহচর হয়ে থাকলেও উচ্চশিক্ষা ও প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় ইংরেজিই হতে পারে একমাত্র মাধ্যম, এমনকি হিন্দিভাষীকেও ইংরেজিতেই পরীক্ষা দিতে হবে। নতুবা হিন্দিভাষীরা পরীক্ষা দেবে নিজের মাতৃভাষায়, অপর ভাষীরা ভিন্ন ভাষায়। তাতে অসম প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে হবে তাদের। হিন্দি ভাষীরা এইক্ষেত্রে এক কদম এগিয়ে থাকবে। এতে অবশ্যই ন্যায়-নীতিবোধের মর্যাদা রক্ষিত হবে না।


হিন্দির পাশাপাশি ইংরেজি যদি না থাকে তবে হিন্দি অপরের ওপর আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা চালাবে। ফলে দেশে ফ্যাসিস্ততন্ত্র কায়েম হবে এবং এর বিরুদ্ধে ভিন্নভাষীরা রুখে দাঁড়ালে দেশ আর অখন্ড থাকবে না। আর আমরা হাজার বছরের ইতিহাস থেকে এই শিক্ষাই লাভ করেছি যে, দেশ খণ্ড-বিখণ্ড হলে তার স্বাধীনতা বজায় থাকে না।


সত্য বটে, ইংরেজি একটি বিদেশী ভাষা কিন্তু এটি যে একটি আন্তর্জাতিক ভাষা—এই সত্যও তো গোপন করা যায় না। আর ইংরেজি বিদেশি বলেই বা পরিত্যাজ্য হবে কেন? আমরা এ যুগে তো বিদেশি ভাবধারাতেই মানুষ হয়েছি, একালের সভ্যতা-সংস্কৃতির যাবতীয় উপাদান, সবই তো বিদেশির দান। তাদের বহু শব্দও তো আমরা আত্মস্থ করেছি। শুধুমাত্র বিদেশি বলেই কি আমরা এই সমস্ত কিছুকেই আজ বিসর্জন দিয়ে আবার অরণ্য সভ্যতার যুগে ফিরে যেতে পারব? বরং রাষ্ট্রভাষা না হলেও যে আমরা ইংরেজিকে ত্যাগ করতে পারিনে, এইটিই হল বাস্তব ঘটনা। পারিনে এই কারণে আমাদের ভাষা-সাহিত্যের মান নির্ধারণ করতে, তার গতিপথ ঠিক রাখতে ইংরেজির সহায়তা আমাদের একান্ত আবশ্যক বলেই।