“যে দেশে বহু ধর্ম বহু ভাষা” প্রবন্ধে বহুধর্মী এবং বহুভাষী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রধর্ম এবং রাষ্ট্রভাষা বিষয়ে লেখক অন্নদাশঙ্করের নীতিগত অভিমত কী, এবং কী কী দৃষ্টান্ত সাহায্যে তা সমর্থন করেছেন বুঝিয়ে লেখো।

“যে দেশে বহু ধর্ম বহু ভাষা” প্রবন্ধে বহু ভাষা ও সম্প্রদায়ে বিভক্ত ভারতের ভাষাসমস্যা সমাধানে ও সংহতি বিধানে প্রাবন্ধিক যে পথ-নির্দেশ দিয়েছেন তার সংক্ষিপ্ত আলোচনা করে তোমার মতামত ব্যক্ত করো।


লেখক অন্নদাশঙ্কর রায় একজন আই. সি. এস. ও উচ্চপদস্থ রাজপুরুষ ছিলেন। তিনি যথানির্ধারিত সময়ের পূর্বেই অবসর গ্রহণ করে শিক্ষা-সংস্কৃতি, বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা প্রভৃতি বিষয়ে এবং সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করেন। স্বাধীনতার পরে ভারতীয় সংবিধানে হিন্দি ভাষাকেই শুধু সরকারি ভাষার স্বীকৃতি দান করা হয় এবং আপাতত ব্যবস্থা হিসেবে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত ইংরেজিকে তার পাশে রাখা হয়েছে। অনুরূপ অবস্থায় ১৯৬২ সালে লেখক আলোচ্য প্রবন্ধটি রচনা করেন তখন তাঁর মাথায় ছিল আসন্ন বিপদের দুশ্চিন্তা। তারপরও ত্রিশ বৎসর কাল অতিক্রান্ত হয়েছে। স্থিতাবস্থা অর্থাৎ তৎকালীন অবস্থা এখনও বর্তমান। কাজেই একালের সামনেও বিপদের খাঁড়া ঝুলছে। অতএব প্রবন্ধটির প্রাসঙ্গিকতা এখনো পূর্ববৎ বজায় রয়েছে।


পৃথিবীর বহু রাষ্ট্রের জনগণ একধর্মসম্প্রদায়ভুক্ত কিংবা সমভাষাভাষী। তাদের নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু অনেক দেশ আছে যেখানে একাধিক প্রধান ধর্মমত এবং একাধিক প্রধান ভাষা প্রচলিত। সেই সমস্ত ক্ষেত্রে ধর্ম ও ভাষা বিষয়ক নীতি নির্ধারণে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব যদি যথাযথ ন্যায়নীতিবোধ এবং সুবিবেচনার পরিচয় দিতে না পারে, তাহলেই সমূহ বিপদের সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে। মনীষী প্রাবন্ধিক অন্নদাশঙ্কর রায় আলোচ্য ‘যে দেশে বহু ধর্ম বহু ভাষা' প্রবন্ধে বহুধর্মী ও বহুভাষী রাষ্ট্রের ইতিকর্তব্য বিষয়ে যুক্তি ও দৃষ্টান্তসহ স্বীয় অভিমত জ্ঞাপন করেছেন।


যে দেশে বহু ধর্মমত প্রচলিত, সে দেশের মূলনীতি কী হবে, এ বিষয়ে বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন প্রকার মনোভাব গ্রহণ করে এবং অবশ্যই তদনুযায়ী ফলও তাকে ভোগ করতে হয়। পাকিস্তান বহুধর্মী রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও অধিকাংশের ইচ্ছানুযায়ী নিজেকে ইসলামি রাষ্ট্র বলে ঘোষণা করেছে। ভারতও বহুধর্মী রাষ্ট্র কিন্তু ভারত অনুরূপ বিষয়ে ভিন্নপথ অবলম্বন করেছে। এখানে সব ধর্মকেই সমান মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। কোনো একটি বিশেষ ধর্মকে রাষ্ট্রধর্মের মর্যাদা দান করলে, অপর সকল ধর্মের প্রতি অবিচার করা হবে—এই যুক্তিতে ভারত সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু-নির্বিচারে সকল ধর্মের প্রতি সমদৃষ্টি রেখে নিজেকে সেকুলার বা ধর্মনিরপেক্ষ বলে ঘোষণা করে।


পার্শ্ববর্তী দেশ বার্মা অনুরূপ যুক্তি গ্রহণ করেও শেষ পর্যন্ত দুর্বুদ্ধিবশত উ নু এবং তাঁর দল রাষ্ট্রশক্তি হাতে পেয়েই বার্মাকে বৌদ্ধরাষ্ট্ররূপে ঘোষণা করেন। অধিকাংশের ইচ্ছায় এই কর্ম সাধিত হলেও এর ফল শুভ হল না। কোনো কোনো পার্বত্য জাতির পক্ষ থেকে আংশিক স্বাতন্ত্র্যের দাবি । প্রধান সেনাপতি রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব গ্রহণ করে গণতন্ত্র ধ্বংস করে দেন এখন আর সেটি বৌদ্ধ রাষ্ট্র নয়। পাকিস্তান ইসলামি রাষ্ট্র-রূপে বর্তমান থাকলেও সেখানেও গণতন্ত্র পর্যুদস্ত হয়েছে। কারণ গণতন্ত্র তো শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠের ইচ্ছাসাপেক্ষ নয়, সংখ্যালঘুদেরও সেখানে সমর্থন থাকা চাই। ইসলামি রাষ্ট্রে সংখ্যালঘুরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকের অধিক মর্যাদা পেতে পারে না। সেখানে চলে একনায়কত্ব এবং তার ফল ভোগ করতে হয় সংখ্যাগুরুদেরও। যারা পরের অধিকারকে স্বীকৃতি দেয় না, নিজের ওপর কর্তৃত্ব করবার অধিকারও তাদের থাকে না।


ভারত ধর্মনিরপেক্ষতাকে মেনে নিয়েছিল বলেই পাকিস্তান এবং বার্মার মতো দুর্দশাকে এড়িয়ে যেতে পেরেছে। ধর্মনিরপেক্ষতার মনোভাব যত বাড়বে গণতন্ত্রও তত দৃঢ় হবে। কারও কারও ইচ্ছামতো, ভারত যদি কখনও হিন্দুরাষ্ট্র হয়, তবে তা ফ্যাসিস্ত শাসনে পরিণত হবে এবং ভারতের অবস্থাও হবে পাকিস্তান এবং বার্মার মতো।


সাম্প্রতিক কালে ভারতে ভাষাবিষয়ক নীতির প্রশ্ন বেশ প্রবলভাবেই দেখা দিয়েছে। এ বিষয়টিও এক এক দেশ একভাবে গ্রহণ করেছে। ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে বেলজিয়াম বলে যে স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হয়, তার রাষ্ট্রভাষারূপে স্বীকৃত হয় ফরাসি ভাষা, কিন্তু দশ বৎসরের মধ্যেই স্থানীয় ফ্লেমিশরাও ভাষার দাবিতে আন্দোলন শুরু করে, তার ফলে ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে এই ফ্লেমিশ ভাষাকেও ফরাসির সঙ্গে রাষ্ট্রভাষা রূপে স্বীকৃতি দান করা হয়। ফলে এখন সেখানে দুটি ভাষাই সরকারি ভাষা-রূপে চলছে। সুইজারল্যান্ড ইউরোপের অপর একটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্র। ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দের শাসনতন্ত্রে সেখানে জার্মান, ফরাসি এবং ইতালিয়ান্—তিনটি ভাষাকেই জাতীয় ভাষা-রূপে স্বীকার করে নেওয়া হয়। এ ছাড়া সেখানে আবার জেলা স্তরে দুটি ভাষারও অস্তিত্ব আছে। আবার ইংরেজি ভাষাও তথায় বহুল প্রচলিত। তারা একাধিক ভাষাতেই অভ্যস্ত।


একটা দেশের রাষ্ট্রভাষা হবে একটাই, ইউরোপে এই অভিমত অত্যন্ত ব্যাপকভাবে প্রচলিত থাকায় পূর্ব ইউরোপের অনেক স্থানেই এ নিয়ে সংখ্যালঘুদের নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছে। ভারতে ধর্মের ব্যাপারে যাঁরা উদারনীতি গ্রহণ করেছেন, তাঁদেরও অনেকে মনে করেন, রাষ্ট্রভাষা একটি হওয়াই সংগত। বিশাল ভারতবর্ষে বস্তুত চৌদ্দ-পনেরোটি প্রধান ভাষা থাকলেও ইংরেজ আমলে ইংরেজিই ছিল একমাত্র সরকারি ভাষা। রাষ্ট্রভাষার এই একত্ব একটি সংস্কার মাত্র, এটি স্বতঃসিদ্ধ নয়। অধিকাংশের ভোটে নয়, সকলের সম্মতিতে, সুবিধা-বিচারে এবং ন্যায়বোধের বিচারে ভাষার প্রশ্নটি মীমাংসিত হওয়া প্রয়োজন। শুধুমাত্র হিন্দি রাষ্ট্রভাষা থাকলে অহিন্দিভাষীদের ন্যায়বোধ তাতে চরিতার্থ হয় না। পূর্বোক্ত প্রধান সবক-টি ভাষাকেই রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়া সম্ভবপর হলেই যথার্থ সুবিচার হতো, কিন্তু তাকে বাস্তবে রূপায়িত করা হয়তো বর্তমান অবস্থায় অসাধ্য বিবেচিত হবে। সেই অবস্থায় হিন্দি থাক, কিন্তু তার সঙ্গে সমস্ত অহিন্দিভাষীদের দ্বারা স্বীকৃত অপর একটি ভাষাও যুক্ত হওয়া আবশ্যক। সেটি যদি কোনো ভারতীয় ভাষা হয়, তবে তা' অহিন্দিভাষীরাই ঠিক করবেন। কিন্তু আপাত-ব্যবস্থা হিসাবে অন্তত আগামী পঞ্চাশ বৎসর পর্যন্ত ইংরেজিই হিন্দির সহচর রাষ্ট্রভাষারূপে স্বীকৃতি লাভ করুক। একবিংশ শতকে রাষ্ট্রভাষা কী হবে—সেটা তৎকালিক পরিবেশে তখনকার জনগণই স্থির করবেন। —মনীষী অন্নদাশঙ্কর ‘যে দেশে বহু ধর্ম বহু ভাষা' প্রবন্ধে এই অভিমত প্রকাশ করেন।