“তাঁদের পক্ষে অনিবার্য ছিল রবীন্দ্রনাথের অনুকরণ, এবং অসম্ভব ছিল রবীন্দ্রনাথের অনুকরণ।”—কাদের সম্বন্ধে উক্তিটি করা হয়েছে এবং ‘অনুকরণ’ কেন ‘অনিবার্য’ ও ‘অসম্ভব' ছিল, বুঝিয়ে বলো।

রবীন্দ্রকাব্য-বৈশিষ্ট্য এবং রবীন্দ্র-যুগের প্রথম পর্বের উত্তর-সাধকদের উপর রবীন্দ্র-প্রভাবের পরিণাম সম্বন্ধে আলোচনা করো।


রবীন্দ্র প্রতিভা যখন মধ্যগগনের দিকে এগিয়ে চলছে অর্থাৎ কালের হিসেবে যখন সেটা বিশ শতকের প্রথম দুই দশক, তখন বাংলাদেশে অনেক ‘স্বভাবকবি'র আবির্ভাব ঘটেছিল। এঁদের সহজাত কবিত্বশক্তি তো ছিলই, অধিকন্তু এঁদের মধ্যে কেউ কেউ ছিলেন একান্তভাবে হৃদয় নির্ভর প্রেরণায় বিশ্বাসী : এঁরা যেমন খুশি লিখে যান, হৃদয়ের সঙ্গে বুদ্ধিবৃত্তির যোগ থাকে না। তাঁদের আবেগকে শাসন করবার শক্তিও থাকে না, ফলত অসংযম-জনিত পতনের তিনি হন একজন উল্লেখ্য দৃষ্টান্ত। রবীন্দ্র-সমকালে এরূপ একজন স্বভাব-কবি ছিলেন গোবিন্দদাস—যিনি রবীন্দ্রনাথের অস্তিত্বটুকুও যেন অনুভব করেননি। এতটাই রবীন্দ্র-প্রভাব মুক্ত ছিলেন তিনি।


এই সময় কিছু কবিকিশোর দেখা দিয়েছিলেন যাঁরা আবেগ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা হারিয়ে ঐতিহাসিক কারণেই ‘স্বভাবকবি’ হয়ে উঠেছিলেন এবং এর জন্য দায়ী রবীন্দ্র-প্রভাব। রবীন্দ্র-প্রতিভার খর-মধ্যাহ্নে এই তরুণ কবিরা রবীন্দ্র-মণ্ডলে সংলগ্ন হয়ে আত্মবিসর্জন দিতে বাধ্য হন।


রবীন্দ্র-কাব্যের বৈশিষ্ট্য এই যে আরাম করে ভোগ করা যায় না। তার প্রভাব মনের শান্তিকে বিঘ্নিত করে। তিনি এত বড়ো যে, আমরা আমাদের সমগ্র অস্তিত্ব দিয়ে গ্রহণ করেও তার সবটুকু নিতে পারি নে, আমাদের মাপজোপের মধ্যে তিনি আসেন না, তিনি আমাদের সহাশক্তির সীমাকেও অতিক্রম করে যান। রবীন্দ্রনাথের আগে বাংলা সাহিত্যে পাওয়া গেছে দাশুরায়ের বাক্-চাতুর্য, রামপ্রসাদের কড়াপাকের ভক্তিরস, ঈশ্বর গুপ্তের কিছু সংবাদ-ধর্মী বস্তুবর্ণনা, বড় জোর মধুসুদনের তুর্যধ্বনি। এর পর রবীন্দ্রনাথের আবির্ভাবে এত অভিনবত্ব, বৈচিত্র্য, মাধুর্য এসে গেল যে তার প্রতিক্রিয়ায় বিস্মিত, বিচলিত, অভিভূত এমনকি বিব্রত বা ক্রুদ্ধও হওয়া সহজ ছিল, কিন্তু তাঁকে গ্রহণ করা, তাঁকে সহ্য করা সম্ভব ছিল না। ফলে একদিকে সমালোচকরা তাঁর নিন্দায় মুখর হয়ে উঠলেন। আর একদিকে তরুণ কবির দল প্রতিরোধহীন অবস্থায় তারই মধ্যে নিজেকে সমর্পণ করে দিয়ে আত্মবিলোপ ঘটালেন। রবীন্দ্রনাথকে গ্রহণ করা যে সহজ নয়, তার অপর প্রমাণ, তাঁর খ্যাতি ও বিপুল রচনার তুলনায় তাঁর পাঠকসংখ্যা খুবই কম; পক্ষান্তরে রবীন্দ্রনাথের স্বাদ গ্রহণ করে জনসাধারণ তাঁরই তরলিত আরামদায়ক সংস্করণে গদ্যে শরৎচন্দ্র এবং পদ্যে সত্যেন্দ্রনাথে।


রবীন্দ্র-প্রতিভার মধ্যাহ্নে অর্থাৎ বিশ শতকের প্রথম দশকে প্রায় সমস্ত বাঙালি শক্তিমান কবিই, যেমন যতীন্দ্রমোহন, করুণানিধান, কিরণধন, সত্যেন্দ্রনাথ প্রমুখ রবীন্দ্রনাথের অনুকরণে বাধ্য হয়েছিলেন কারণ এ ছাড়া তাঁদের উপায় ছিল না, কিন্তু কাজটি ছিল তাঁদের মধ্যে একান্ত অসাধ্য। এঁদের মধ্যে একমাত্র সত্যেন্দ্রনাথেরই ছিল কিছু নিজস্ব বৈশিষ্ট্য, যার সাহায্যে তাঁকে অন্য কবিদের থেকে পৃথক করা যেত, কিন্তু অপরদের মধ্যে কোন নিজস্বতা ছিল না। তাঁরা প্রত্যেকেই রবীন্দ্রনাথ দ্বারা আপ্লুত ছিলেন। তারা ছিলেন রবীন্দ্রনাথের বড় কাছাকাছি, বস্তুত রবি-মণ্ডলের অন্তর্ভুক্ত গ্রহদেরই মতো। রবির আলোকেই তাঁরা উদ্ভাসিত। তাঁদের প্রথম বাল্য, কৈশোর, যৌবনে ক্রমশ প্রকাশিত হয়ে চলছে রবীন্দ্রনাথের অনুপম কাব্যধারা—'সোনার তরী', 'চিত্রা', 'কথা ও কাহিনী' এবং পরে কখনও ‘কল্পনা', 'ক্ষণিকা', 'গীতাগুলি'—এদের আকর্ষণে না মজে উপায় ছিল না তাদের। যে সুরে মানুষের ঘুম ভাঙে, সেই সুরের মোহ তাদের মনে যে মায়াজাল সৃষ্টি করলো, তাদেরই স্বপ্নে এই কবিদের আত্মচেতনা বিলীন হয়ে গেল। তাঁরা গুরুদেবের কাব্যকলায় মারাত্মকরূপে প্রতারিত হলেন। তাঁরা ভাবলেন, রুনুঝুনু ছন্দ বাজলেই বুঝি রাবীন্দ্রিক স্পন্দন জাগে আর অতিশয় সরল লেখাতেই বুঝি স্রোতোস্বিনীর গতি আসে। তাঁদের সদিচ্ছার ত্রুটি ছিল না, কিন্তু বুদ্ধিবিভ্রম ঘটেছিল। তাই রবীন্দ্রনাথের ব্রত গ্রহণ করলেও সাধনার প্রয়োজনটুকু উপলব্ধি করলেন না। বাইরের রূপটাকেই চরম মনে করে ঐকান্তিকতার স্বরূপচিন্তায় অভিনিবিষ্ট হলেন না। রবীন্দ্রনাথের কাব্যকলার গভীরতর তাৎপর্য উপলব্ধি করতে না পেরে তাঁরা বহিরঙ্গ শোভাতেই এত মগ্ন হয়ে পড়লেন যে রবীন্দ্র-কাব্যের আপাত-সরলতাকেই চরম বলে গ্রহণ করে ভীষণভাবে প্রতারিত হলেন। রবীন্দ্রকাব্য আসলে জলধর্মী—উপর স্তরে তার আপাত সরল সমতলতা, কিন্তু যত গভীরে নিমজ্জিত হওয়া যায়, ততই স্রোতে প্রতিস্রোতে তা নিত্যমথিত, আবর্তিত। সেই আবর্তে পড়লে সেখান থেকে বেরিয়ে আসা প্রায় অসাধ্য ব্যাপার। আমাদের রবীন্দ্র-মণ্ডলে অবস্থিত কবিকুল রবীন্দ্রনাথকে ঘিরেই শুধু আবর্তিত হতে লাগলেন। রবীন্দ্রনাথে যে জঙ্গমতা ছিল, তা অনুকরণের সাধ্য তাঁদের ছিল না; পক্ষান্তরে রবীন্দ্রনাথ যা কখনও চাননি, সেই স্থবিরতাই হলো তাঁদের লভ্য। একই স্থানে তাঁরা ঘুরপাক খেয়েছেন, ফলে সেখানে যে ফেনোচ্ছ্বাস দেখা দিয়েছে, উত্তর-সাধক কবিদের কাব্যে তারই পূর্ণায়ত রূপ—ফেনিলতা, অসংবৃত উচ্ছ্বাস। বস্তুত স্বভাবকবির দুর্লক্ষণ হলো এইগুলিই যে তাঁরা শৈথিল্যকেই মনে করলেন স্বতঃস্ফূর্ততা আর ভাবালুতা, তন্দ্রালতাকে ধরে নিলেন তন্ময়তা বলে। এতৎসত্ত্বেও যে রবীন্দ্র সন্নিহিত এই কবিকুল ইতিহাসে শ্রদ্ধেয় হয়ে রইলেন তার কারণ এই—তাঁদের এই আত্মবিসর্জনের ফলেই পরবর্তী কবিকুল রবীন্দ্রপ্রভাব বিষয়ে সতর্ক হবার অবকাশ পেলেন।