‘ছিন্নপত্র’ নামকরণটি এই পত্রাবলির সংকলনের ক্ষেত্রে কতদূর যথার্থ হয়েছে আলোচনা করো।

রবীন্দ্রনাথের পত্রসংকলন গ্রন্থগুলির মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ ‘ছিন্নপত্র’। ১৩১৯ বঙ্গাব্দে প্রথম প্রকাশিত এই পত্র সংকলন রবীন্দ্রনাথের স্ব-সম্পাদিত। স্বভাবতই সংকলনের নামকরণও তাঁরই।


নিজ সাহিত্যকর্মের নামকরণের ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথ চিরকালই সতর্ক ভাবনার পরিচয় রেখেছেন। তাঁর আশৈশব রচিত এবং ক্রমান্বয়ে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থগুলির নামকরণ যে কতখানি সুপ্রযুক্ত হয়েছে, তা স্পষ্ট হয়। কবিমানসের ক্রমাগ্রগতির সঙ্গে কাব্যগ্রন্থগুলির নামকরণের সংগতি দেখে। 'সন্ধ্যাসঙ্গীত’ থেকে ‘প্রভাতসঙ্গীত' তো সন্ধ্যার ছায়াচ্ছন্নতা থেকে কবিমানসের প্রভাতআলোয় উদ্ভাসনই ইঙ্গিত করে। 'ছবি ও গান' এবং 'কড়ি ও কোমল'-ও তো নব যৌবনধর্মেরই দ্যোতক। আর যৌবনের মানস-সৌন্দর্যলোকে অবগাহনের কাব্যই তো ‘মানসী'। 'রক্তকরবী’ নাটকের নামকরণের ইতিহাসের মধ্যেও লুকিয়ে আছে রবীন্দ্রনাথের সতর্ক ভাবনার পরিচয়। ‘যক্ষপুরী' থেকে 'নন্দিনী', 'নন্দিনী' থেকে ‘রক্তকরবী'—এই নামপরিবর্তনের মধ্য দিয়ে নাটকের মর্মবস্তুতে পৌঁছোতে চেয়েছেন সুনির্দিষ্টভাবে। 'ছিন্নপত্র’ নামকরণের মধ্যেও নিশ্চিতভাবে এই পত্রধারার বৈশিষ্ট্যটিকে ধরতে চেয়েছেন বলে মনে হয়।


১৮৮৭ থেকে ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালে পূর্ববঙ্গের শিলাইদহ-সাজাদপুর-পতিসরে জমিদারি দেখাশোনার কাজে পরিভ্রমণকালে মুক্ত প্রকৃতির অপরিমিত সৌন্দর্য এবং পল্লিজীবনের উষ্ণ স্পর্শে বিমুগ্ধ রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রায় প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতা ও অনুভূতির কথা চিঠিতে জানিয়েছেন স্নেহাস্পদা ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরাকে। পরে রবীন্দ্রনাথের অনুরোধে ইন্দিরা দেবী ব্যক্তিগত অংশগুলি বর্জন করে চিঠিগুলি দুটি খাতায় নকল করে রবীন্দ্রনাথকে দেন। সেই খাতা দুটি থেকেই নির্বাচিত কিছু চিঠি রবীন্দ্রনাথ সম্পাদিত করে প্রকাশ করেন ‘ছিন্নপত্র' নামে ১৩১৯ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ মাসে। প্রকাশক হিসাবে নাম ছাপা ছিল 'শ্রীনগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, শিলাইদহ, নদীয়া'।


১৯১০ খ্রিস্টাব্দ থেকেই রবীন্দ্রনাথকে জীবনবৃত্তান্ত রচনায় প্রবৃত্ত হতে দেখি। ‘আত্মপরিচয়’-এর প্রথম পাণ্ডুলিপিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন— “আমার হাতে আমারই রচিত অনেকগুলি পুরাতন চিঠি ফিরিয়া আসিয়াছে বর্তমান প্রবন্ধে মাঝে মাঝে এই চিঠিগুলি হইতে কোনো কোনো অংশ উদ্ধৃত করিব।”


‘আত্মপরিচয় ’তে ‘ছিন্নপত্র’ থেকে উদ্ধৃত চিঠির অংশ আমরা দেখেছি। অর্থাৎ ১৯১০-এর পূর্বেই এই চিঠির কপিগুলি তাঁর হস্তগত হয়েছিল। যদিও চিঠিগুলি রবীন্দ্রনাথ ইন্দিরা দেবীর কাছে চেয়েছিলেন ১৮৯৫-তেই। ১৯১১-র মধ্যেই আত্মজীবনীমূলক ‘জীবনস্মৃতি' প্রকাশেরও উদ্যোগ দেখা যায়। ইতোমধ্যে অজিতকুমার চক্রবর্তী ‘রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থরচনার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের কিছু চিঠিপত্রের সাহায্য নেওয়ায় আত্মচরিত রচনার পাশাপাশি নিজের পত্রাবলি সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের আগ্রহ বাড়ে এবং ‘জীবনস্মৃতি’ ও ‘ছিন্নপত্র’ একযোগে প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ঢাকার অতুল লাইব্রেরির মাধ্যমে এই প্রকাশের সম্পর্কে একটি তারিখহীন পত্রে মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়কে লিখেছেন— “আমি ত সেই প্রকাশককে লিখে দিয়েছি।...আমি (জীবনস্মৃতির জন্য) ২৫০০ টাকা চাইব। আর যদি ওর সঙ্গে ‘ছিন্নপত্র’ (আমার চিঠি) জুড়ে দিই তাহলে ৩০০০ টাকা।”


এই চিঠিটি উল্লেখের উদ্দেশ্য এই যে, এ থেকে বোঝা যাবে ১৯১১-তেই পত্রসংকলনটির ‘ছিন্নপত্র নামকরণ হয়ে গেছে।


এই সময়কালেই রবীন্দ্রনাথের অন্যান্য পত্রগুলি সংগ্রহের কাজও শুরু হয় নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় ও রথীন্দ্রনাথের উৎসাহে। সেই চিঠিগুলি সংগ্রহেও বিস্তর বাধা উপস্থিত হচ্ছিল এবং অনেক ক্ষেত্রে চিঠিগুলির অসম্পূর্ণ-আংশিক নকল সংগৃহীত হচ্ছিল। ইন্দিরা দেবীর দেওয়া নকলের খাতাটিতেও চিঠিগুলি অসম্পূর্ণ। ইন্দিরা দেবী তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন— “(চিঠিগুলির) সাহিত্যিক অংশগুলি পারিবারিক অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে একটি খাতায় তারিখ সমেত লিখে রেখেছিলুম।” (রবীন্দ্রস্মৃতি)


পারিবারিক অংশগুলি বিচ্ছিন্ন করার ব্যাপারে মনে হয় রবীন্দ্রনাথেরও অনুমোদন ছিল। কেননা রবীন্দ্রনাথ ইন্দিরা দেবীকে লিখেছিলেন— “ওর মধ্যে যা কিছু আমার ব্যক্তিগত জীবন-সংক্রান্ত সেটা তেমন বহুমূল্য নয়।”


ফলে সংগ্রহ পর্বেই মূল চিঠিগুলির বেশ কিছু অংশ বিচ্ছিন্ন হয়। অতএব চিঠিগুলি ‘ছিন্ন’ তো বটেই। পারিবারিক ব্যক্তিগত অংশ বিচ্ছিন্ন করা ছাড়াও ইন্দিরা দেবী আরও কিছু বর্জন করেছেন। প্রথমত, চিঠিগুলির সম্বোধন ও আশীবচনসহ স্বাক্ষর অংশ নকল করা হয়নি। ব্যক্তিমানুষ ও পত্র প্রাপকের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক বুঝে নেবার পক্ষে এই অংশগুলির গুরুত্ব অনস্বীকার্য। মৃণালিনী দেবীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের দাম্পত্য সম্পর্কের মাধুর্যটি তো ধরা পড়ে যায় ‘ভাই ছুটি’ সম্বোধন থেকেই। এদিক থেকেও ‘ছিন্নপত্রে’র চিঠিগুলি নির্মমভাবে ছিন্ন। দ্বিতীয়ত, একটি চিঠি প্রাসঙ্গিক আরও বহু তুচ্ছ বিষয়, ঘটনা ও ব্যক্তিকেও উদ্ঘাটিত করার যে ক্ষমতা রাখে, সেই ইতিহাস মুল্যের দিক থেকেও চিঠিগুলিকে নির্মমভাবে খণ্ডিত করা হয়েছে। চিঠিগুলির মধ্যে যে অসংখ্য ব্যক্তিনাম নানা প্রসঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছিল, ইন্দিরা দেবী সেই নামগুলির আদ্যক্ষরমাত্র উদ্ধৃত করেছেন, তাও অনেকসময় ভুলভাবে। দৃষ্টান্ত—

“শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং পর্যন্ত ক্রমাগত স-র উচ্ছ্বাস উক্তি” (৯) 

“আজকের চিঠির মধ্যে এক জায়গায় অ-র গানের একটুখানি উল্লেখ আছে”। (৫৮)

“শনিবার মধ্যাহ্নে আহারাদি করে বলু, আমি, বি-বাবু..." (৭১) 

“সু-র কুঁড়েমিতে একটি মাধুর্য আছে।” (৭৬)–ইত্যাদি।


‘ছিন্নপত্র’-র ১৩২ ও ১৩৩ সংখ্যক চিঠিতে যে ‘শ'-এর কথা পাই, তিনি শিলাইদহ সদর-কাছারির বিশিষ্ট কর্মচারী শরৎচন্দ্র সরকার। কিন্তু খাতার নকলে ইন্দিরা দেবী এটিকে ভুলক্রমে ‘শৈ’ করেছিলেন, নামটি স্মরণে থাকায় সম্পাদনাকালে রবীন্দ্রনাথ সংশোধন করে ‘শ’ লেখেন। কিন্তু কার্যত স্বীকার করতেই হবে, সচেতনভাবে চিঠিগুলিকে ছিন্ন বা খণ্ডিত করতে গিয়ে চিঠিগুলির ঐতিহাসিক মূল্য ও অন্যান্য বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে।


‘ছিন্নপত্র’-তে সংকলিত চিঠিগুলি ছিন্ন করার দায় কেবলমাত্র ইন্দিরা দেবীর নয়, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথেরও ১৯১১-তে চিঠিগুলির প্রেস-কপি করার সময়েই তিনি এই পত্রগুচ্ছ খণ্ডে খণ্ডে প্রকাশের পরিকল্পনা করেন— “আমার মনে হয় চার খণ্ডে ভাগ করে ছাপলেই ভাল হবে। খণ্ডে খণ্ডে বেরলে একটা সুবিধা হবে এই যে পাঠকেরা ক্রমে ক্রমে পড়ার দরুণ রস পাবে বেশি।”


এই পরিকল্পনা কার্যকর না হলেও ইন্দিরা দেবীকে লেখা পত্রগুচ্ছের প্রথম প্রকাশকালে সব চিঠিগুলির মধ্য থেকে কয়েকটি চিঠিকেই মাত্র নির্বাচিত করা হয়। অন্যান্য পত্রাবলি সংগ্রহের কাজও এ সময় চলছিল; এমন সংগ্রহ থেকে শ্রীশচন্দ্র মজুমদারকে লেখা আটটি পত্রও এই গ্রন্থে সংকলিত হয়। রবীন্দ্রনাথও এই পত্রগুচ্ছ সম্পাদনাকালে বহু অংশ বর্জন করেন—“বহু চিঠিই রবীন্দ্রনাথ তখন গ্রন্থভুক্ত করেন নাই; অনেক চিঠির কোনো কোনো অংশ সাধারণের সমাদরযোগ্য নহে মনে করিয়া বর্জনও করেন।” [ছিন্নপত্র-র ১৯৬০ সংস্করণে ‘গ্রন্থপরিচয়’ অংশ]


শুধু তাই নয়, সম্পাদনাকালে রবীন্দ্রনাথ কোনো কোনো চিঠির অংশ বর্জন ছাড়াও একাধিক চিঠিকে কখনো কখনো সংযুক্ত করে একটি চিঠিতে রূপান্তরিত করেন। বিশ্বভারতী থেকে ১৯৬০ সালে ‘ছিন্নপত্র’র নতুন সংস্করণ প্রকাশের সময় এগুলিকে বিচ্ছিন্ন করা হয়। ৭ ডিসেম্বর '৯৪ ও ১১ ডিসেম্বর '৯৪-এর চিঠি দুটিকে প্রথম সংস্করণে যেমন একটি চিঠিতে রূপান্তরিত করা হয়েছিল, তেমনি ৯ ও ১০ জুলাই '৯৫-এর চিঠি দুটিকেও রবীন্দ্রনাথ একটি চিঠিরূপেই প্রকাশ করেন। ইন্দিরা দেবীর সম্পাদিত খাতাটিতে নকল করা চিঠিগুলিকেও রবীন্দ্রনাথ কেমন নির্মমভাবে ‘ছিন্ন করেছিলেন তার প্রমাণ মিলবে 'ছিন্নপত্র'র ১২৬ সংখ্যক চিঠির সঙ্গে ‘ছিন্নপত্রাবলী'র ১৬০ সংখ্যক চিঠিটি মিলিয়ে পড়লেই। কলকাতা থেকে ৭ অক্টোবর, ১৮৯৪তে লেখা চিঠিটি শুরু হয়েছিল—“আমিও জানি (বব্), তোকে আমি যে সব চিঠি লিখেছি...” ইত্যাদি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ প্রায় ১৪-১৫ লাইন বর্জন করে ‘ছিন্নপত্রে’ চিঠিটি শুরু করেন—“আমাদের সবচেয়ে যা শ্রেষ্ঠ প্রকাশ সে আমরা কাউকে নিজের ইচ্ছা অনুসারে দিতে পারি নে।”


অর্থাৎ মূল চিঠিগুলি যে প্রথমে ইন্দিরা দেবীর হাতে ‘ছিন্ন’-আকারেই উপস্থিত হয়েছে এবং নিজে সম্পাদনাকালেও সেগুলিকে সাধারণের সমাদরযোগ্য করে তুলতে নির্মমভাবে ‘ছিন্ন’ করেছেন, রবীন্দ্রনাথ সে ব্যাপারে নিশ্চিতভাবেই পূর্ণ-সচেতন ছিলেন। পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথের বর্জিত অংশগুলি এবং অন্যান্য চিঠিগুলি নিয়ে ‘ছিন্নপত্রাবলী' সংকলিত হবার সময়েও চিঠিগুলি অসম্পূর্ণই থেকে গেছে। ফলে রবীন্দ্রনাথ প্রদত্ত ‘ছিন্নপত্র’ নামটি এই পত্র সংকলনের চরিত্র বৈশিষ্ট্য নির্দেশক এবং যথেষ্ট ইঙ্গিতপূর্ণ বলেই নামটিকে যথার্থ ও সার্থক বলে মনে হয়।