কতকগুলি প্রবন্ধে প্রৌঢ়ত্বের মোহভঙ্গ, যৌবনের রঙিন নেশার অবসানের তীব্র অনুভূতিময় উপমার অজস্র প্রাচুর্য ও অপরূপ সুসংগতি ও গভীর ভাবের সুর-ঝংকারের সমন্বয়ে ইহারা পূর্বস্মৃতির আলোচনামূলক সাহিত্যের শীর্ষস্থানীয় হইয়াছে।—বঙ্কিমচন্দ্রের কমলাকান্তের দপ্তরের ‘একা’ প্রবন্ধটি সম্পর্কে এই মন্তব্যটি কতদুর প্রযোজ্য বিচার করো।

বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কমলাকান্তের দপ্তর’-এর কয়েকটি রচনায় প্রৌঢ়ত্বের মোহভঙ্গ, যৌবনের আশাস্বপ্নের রঙিন নেশার বিভোরতার অবসানের গাঢ় অনুভূতিময় বিশ্লেষণের পটভূমিতে বঙ্কিমের জীবনচিন্তা এক বিচিত্র, বর্ণময় রূপ লাভ করেছে। ‘একা’, ‘আমার মন’, ‘বুড়া বয়সের কথা’ এই জাতীয় পূর্বস্মৃতির আলোচনামূলক রচনার উদাহরণ। প্রৌঢ়ত্বের শেষ প্রান্তে উপনীত হবার পর যে পরিবর্তন মানুষকে তার এই চিরপরিচিত জগৎ থেকে তাকে দুর্ভেয় সম্পূর্ণরূপে অপরিচিত রহস্যময় শোকে নির্বাসিত করবে, তার প্রথম অনুভূতির এক বিষাদময় কুহেলিকা তার মনকে গ্রাস করে। যে সমাজ-সংসারের আনন্দপ্রবাহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, একাকীত্বের হিমশীতল দ্বীপে গণ্ডিবদ্ধ হবার ফলে গভীর বিষাদ ও নৈরাশ্যে তার হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে। ‘একা’ রচনায় আমরা কমলাকান্তের মাধ্যমে প্রৌঢ়ত্বের নিঃসঙ্গতার বিষাদবিচ্ছিন্ন জীবন ও মানসের যে চিত্র পাই সেটি সত্যই অতুলনীয়। বহুকালবিস্মৃত সুখস্বপ্নের স্মৃতির মতো এক পথচারীর সংগীত কমলাকান্ত শুনতে পায়, এই সংগীত তার এত মধুর লাগল কেন সেই প্রশ্ন তাকে ব্যাকুল করে তোলে। এই সংগীত যে অত্যন্ত সুন্দর এমন নয়, পথিক পথ দিয়ে আপন মনে গাইতে গাইতে যাচ্ছে। জ্যোৎস্নাময়ী রাত্রি দেখে তার মনের আনন্দ উচ্ছ্বলিত হয়ে উঠেছে। তার কণ্ঠ মধুর, মধুরকণ্ঠে এই মধুমাসে সে নিজের মনের সুখের মাধুর্য বিকীর্ণ করতে করতে যাচ্ছে। “তবে, বহুতন্ত্রীবিশিষ্ট বাদ্যের তন্ত্রীতে অঙ্গুলিস্পর্শের ন্যায়, ঐ গীতিধ্বনি আমার হৃদয়কে আলোড়িত করিল কেন?”—এই সুন্দর উপমায় কমলাকান্তের হৃদয় যে পূর্বস্মৃতির আলোড়নে উদ্বেল হয়ে উঠছে তার ইঙ্গিত দিয়ে সে পাঠকচিত্তকে পরবর্তী অংশের জন্য উন্মুখ করে তুলেছে। সেই প্রশ্নের কথা কমলাকান্তের আত্মানুসন্ধানের সূত্রে পাই প্রকৃতির সৌন্দর্য ও তার পটভূমিতে আনন্দোচ্ছল জনতার এই বর্ণাঢ্য চিত্র। “কেন, কে বলিবে? রাত্রি জ্যোৎস্নাময়ী—নদী-সৈকতে কৌমুদী হাসিতেছে। অর্ধাবৃতা সুন্দরীর নীল বসনের ন্যায় শীর্ণ-শরীরা নীল-সলিলা তরঙ্গিনী, সৈকতবেষ্টিত করিয়া চলিয়াছেন; রাজপথে, কেবল আনন্দ বালক, বালিকা, যুবক, যুবতী, প্রৌঢ়া, বৃদ্ধা, বিমলচন্দ্রকিরণে স্নাত হইয়া আনন্দ করিতেছে। আমিই কেবল নিরানন্দ – তাই, ঐ সংগীতে আমার হৃদয়যন্ত্র বাজিয়া উঠিল।” অর্ধবৃতা সুন্দরীর নীল বসনের উপমায় শীর্ণকায়া নীল-সলিলা নদীর সৌন্দর্যকে লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন, দিগন্তপ্পাবী জ্যোৎস্নায় রাজপথে বিভিন্ন বয়সের নারী পুরুষের আনন্দোৎসবের চিত্রটিও বর্ণসুষমাময়।


সৌন্দর্য ও আনন্দের এই বর্ণাঢ্য চিত্র উপস্থাপিত করার পর কমলাকান্তের একাকীত্ব এবং সেই আনন্দযজ্ঞে অংশ গ্রহণের আকুলতা রূপায়িত হয়েছে “আমি একা তাই এই সংগীতে আমার শরীর কণ্টকিত হইল। এই বহুজনাকীর্ণ নগরী মধ্যে এই আনন্দময়, অনন্ত জনস্রোতোমধ্যে, আমি একা। আমিও কেন ঐ অনন্ত জনস্রোতোমধ্যে মিশিয়া, এই বিশাল আনন্দতরঙ্গ-তাড়িত জলবুদ্বুদসমূহের মধ্যে আর একটি বুদ্বুদ না হই? বিন্দু বিন্দু বারি লইয়া সমুদ্র; আমি বারিবিন্দু এ সমুদ্রে মিশাই না কেন?" এখানে পর পর দুটি উপমা পাই, স্রোতের বুদ্বুদ ও সমুদ্রের বারিবিন্দু–কমলাকান্তের মনন, আবেগ ও কল্পনার তরঙ্গলীলায় এই উপমাগুলি ভেসে ভেসে তার নিঃসঙ্গতার বেদনা ও সমাজ সংসারের সঙ্গে নিবিড়, উষ্ণ আত্মীয়তার জীবনের চরিতার্থতা উপলব্ধির আকুলতাকে মর্মস্পর্শী করে তুলেছে। অতঃপর সে একাকীত্বের অভিশাপ সম্পর্কে পাঠকদের সচেতন করে তুলতে চেয়েছে : “তাহা জানি না—কেবল ইহাই জানি যে, আমি একা। কেহ একা থাকিও না। যদি অন্য কেহ তোমার প্রণয়ভাগী না হইল, তবে তোমার মনুষ্যজন্ম বৃথা। পুষ্প সুগন্ধি, কিন্তু যদি ঘ্রাণগ্রহণকর্তা না থাকিত, তবে পুষ্প সুগন্ধি হইত না—ঘ্রাণেন্দ্রিয় বিশিষ্ট না থাকিলে গন্ধ নাই। পুষ্প আপনার জন্য ফুটে না। পরের জন্য তোমার হৃদয় কুসুমকে প্রস্ফুটিত করিও।” এই অংশেও দুটি উপমা ব্যবহৃত হয়েছে, পুষ্প ও তার ঘ্রাণগ্রহণকর্তা মানুষ তাদের মধ্য দিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র পুষ্পের মতো পরের জন্য আত্মনিবেদনেই যে মানবজীবনের পরম সার্থকতা, সেই সত্যকে প্রকাশ করেছেন। একের পর এক উপমা গেঁথে লেখক যে রূপচিত্র গড়ে তুলেছেন সেটি সূর্যাস্তের করুণ রক্তরাগরেখার মতো প্রৌঢ়ত্বের নিঃসঙ্গতার বেদনায় অনুরঞ্জিত, বিষাদময়। আমরা আশার স্বপ্নে উদ্বেল যৌবন পার হয়ে প্রৌঢ়ত্বের মোহভঙ্গ, অবসাদ ও নিষ্ফলতাবোধের যন্ত্রণায় উপনীত কমলাকান্তের ভারাক্রান্ত হৃদয়ের দীর্ঘশ্বাস এই অংশগুলির চিত্রে বর্ণনা ও উপমায় অনুরণিত হতে শুনি।


একবার মাত্র শোনার পরই এ সংগীত তার কেন এত ভালো লাগল, তার কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে কমলাকান্ত বলেছে : “অনেকদিন আনন্দোখিত সংগীত শুনি নাই—অনেকদিন আনন্দানুভব করি নাই। যৌবনে, যখন পৃথিবী সুন্দরী ছিল, যখন প্রতি পুষ্পে সুগন্ধ পাইতাম, প্রতি পত্রমর্মরে মধুর শব্দ শুনিতাম, প্রতি নক্ষত্রে চিত্রা রোহিণীর শোভা দেখিতাম, প্রতি মনুষ্যমুখে সরলতা দেখিতাম, তখন আনন্দ ছিল। পৃথিবী, সংসার ও মানবচরিত্র এখনও তাই আছে, কিন্তু প্রৌঢ় কমলাকান্ত যৌবনকালের আনন্দ-বিস্ফারিত সেই হৃদয় হারিয়ে বসে আছে। তখন সংগীত শুনে তার আনন্দ হত, আজ পথচারীর সংগীত শুনে সেই আনন্দ তার মনে পড়ল, মুহূর্তের জন্য সে তার যৌবন ফিরে পেল, আবার তেমনিভাবে নিজের মানসজগতে সমবেত বন্ধুদের মধ্যে বসল, আবার সেই যৌবনসুলভ অকারণ উচ্চ হাসি হাসল, প্রৌঢ়ত্বের পরিণত বৈষয়িক বুদ্ধিতে নিষ্প্রয়োজনীয় বলে যে কথা এখন বলে না, কিন্তু সেই সময়ে যৌবনের চিত্তচাঞ্চল্যের জন্য বলত, আবার সেই কথাগুলো বলতে লাগল, আবার অকৃত্রিম হৃদয়ে পরের প্রেম অকৃত্রিম বলে মনে মনে গ্রহণ করল। কমলাকান্তের বর্তমান নিরানন্দ মানসের অভিজ্ঞতার পটভূমিতেই যৌবনের পূর্বস্মৃতির এই পর্যালোচনা এত বিষাদমণ্ডিত হয়ে উঠেছে : “তখন সংগীত ভাল লাগিত, — এখন লাগে না-চিত্তের যে প্রফুল্লতার জন্য ভাল লাগিত, সে প্রফুল্লতা নাই বলিয়া ভাল লাগে না। আমি মনের ভিতর মন লুকাইয়া সেই গত যৌবনসুখ চিন্তা করিতেছিলাম—সেই সময়ে এই পূর্বস্মৃতিসূচক সংগীত কর্ণে প্রবেশ করিল, তাই এই মধুর বোধ হইল।”


সেই প্রফুল্লতা সেই সুখ আর কেন নেই, সুখের সামগ্রী ত কমেনি, জীবনের পথ যতই অতিবাহিত করা হয়, মানুষ ততই সুখপ্রদ বস্তু সঞ্চয় করে, তবে বয়সে আনন্দ হ্রাস পায় কেন: “পৃথিবী আর তেমন সুন্দরী দেখা যায় না কেন? আকাশের তারা আর তেমন জ্বলে না কেন? আকাশের নীলিমায় আর সে উজ্জ্বলতা থাকে না কেন? যাহা তৃণপল্লবময় কুসুমসুবাসিত স্বচ্ছ কল্লোলিনী-শীকর-সিক্ত, বসন্তপবনবিধৃত বলিয়া বোধ হইত, এখন তাহা বালুকাময় মরুভূমি বলিয়া বোধ হয় কেন?” এই চিত্রগুলিতেও যে বয়সে মানুষের আনন্দ অনুভব করার ক্ষমতা সব থেকে সজীব ও পরিপূর্ণ থাকে, সেই যৌবনকালের স্মৃতিচারণের বেদনা-বিধুর প্রকাশ আমাদের হৃদয়কে গভীরভাবে স্পর্শ করে। যৌবনের আশারূপ সেই রঙিন কাঁচ নেই বলেই তার প্রৌঢ়ত্বের জীবন থেকে সব সৌন্দর্য ও আনন্দ তিরোহিত হয়েছে। নিজেই সেই প্রশ্নের উত্তর দেবার পর কমলাকান্ত পরিণত বয়সের অভিজ্ঞতা যে কত শুষ্ক, কঠোর নৈরাশ্যময় ও যন্ত্রণাদায়ক, এই অংশগুলির চিত্রপরম্পরায় নির্দেশিত করেছে : “এখন জানিয়াছি যে, এ অরণ্যে পথ নাই, এ প্রান্তরে জলাশয় নাই, এ নদীর পার নাই, এ সাগরে দ্বীপ নাই, এ অন্ধকারে নক্ষত্র নাই। এখন জানিয়াছি যে, কুসুমে কীট আছে, কোমল পল্লবে কণ্টক আছে, আকাশে মেঘ আছে, নদীতে আবর্ত আছে, ফলে বিষ আছে, উদ্যানে সৰ্প আছে, মনুষ্য-হৃদয়ে কেবল আত্মাদর আছে”। কিন্তু প্রৌঢ় বয়সের এই মোহভঙ্গে কমলাকান্ত জীবন সম্পর্কে নৈরাশ্যবাদী হয়ে পড়েনি, মানবপ্রীতিই তার কানে এখন সংসারসংগীত হয়ে উঠেছে, মানবজাতির ওপর তার যদি প্রীতি থাকে, তার সে আর অন্য সুখের প্রত্যাশী নয়—এই জীবন প্রত্যয়ের সূত্রেই ‘একা’র পূর্বস্মৃতির পর্যালোচনা বিভিন্ন উপমা, চিত্র ও বর্ণনা অপূর্ব সুসংগতি ও গভীর ভাবের সমন্বয়ে অনন্য রসোত্তীর্ণ রচনার ঐশ্বর্যে পরিণত হয়েছে। “কতকগুলি প্রবন্ধে প্রৌঢ়ত্বের মোহভঙ্গ, যৌবনের রঙিন নেশার অবসানের তীব্র অনুভূতিময় উপমার অজস্র প্রাচুর্য ও অপরূপ সুসঙ্গতি ও গভীর ভাবের সুরঝংকারের সমন্বয়ে ইহারা পূর্বস্মৃতির আলোচনামূলক সাহিত্যের শীর্ষস্থানীয় হইয়াছে”—এই মন্তব্যটি কমলাকান্তের দপ্তরের 'একা' রচনাটির প্রতি সম্পূর্ণভাবেই প্রযোজ্য।