“অবশ্য এ-কথা মানতে হবে যে, সমস্যাই শুধু ঈশ্বর গুপ্তকে উত্তেজিত করে, সেইটুকুই তাঁর কৃতিত্ব। তিনি মুখ ফিরিয়ে কাব্যসাধনা করেননি এইটাই বড়ো কথা।”—এই উক্তির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো।

ঈশ্বর গুপ্ত ছিলেন যুগসন্ধির কবি। পুরাতন ও নতুন যুগের সন্ধিস্থলে ঈশ্বরচন্দ্রের আবির্ভাব। এইজন্য অনেক সমালোচক তাঁকে গ্রীক দেবতা 'জেনাস'-এর সঙ্গে তুলনা করেছেন। ঈশ্বরচন্দ্রকেও বাংলা সাহিত্যের 'জেনাস' বলা যায়। তিনি বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন আধুনিক যুগের সন্ধিস্থলে দাঁড়াইয়া দুইটি যুগকে একসূত্রে গ্রথিত করিয়া আছেন। তাদের এক মুখ প্রাচীন অতীতে, আর এক মুখ অনাগত ভবিষ্যতে। তাই তাঁদের কৃতিত্বে একদিকে যেমন পুরাতন ধারার অনুবর্তন আছে, অন্যদিকে তেমনি নতুন ধারার ইঙ্গিতও আছে।”


ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের কবিতার বৈশিষ্ট্য তাঁর বস্তুনিষ্ঠা ও সমাজসচেতনতা। সমাজের আচার-অনাচার, নানা সংস্কার ও কুসংস্কার, সুব্যবস্থা ও কুব্যবস্থার প্রত্যেকটি ঘটনা তাঁর কবিমনকে নাড়া দিয়েছে। “ঈশ্বরচন্দ্রের কবিতায় সমাজই মুখ্য।” সমালোচকের এই মূল্যায়ন দেখে জানা যায়, সমাজসমস্যাকে ঈশ্বর গুপ্ত গুরুত্ব দিয়েছেন, কারণ তার কবিতা মন্ময় কবিতা নয়। মন্ময় কবিতায় কবির মনোভাব থেকে সমুখ নানা ভাবতরঙ্গ।


ঈশ্বরচন্দ্র রক্ষণশীল কবি ছিলেন, তাঁর 'ছদ্ম-মিশনারী' কবিতায় এই মনের পরিচয় পরিস্ফুট হয়েছে। ইংরেজ মিশনারীদের প্রতি তাঁর ব্যঙ্গ ও শ্লেষ তীব্র : ‘বাক্যের কুহক-যোগে ঈষ্টমন্ত্রে ছেড়ে/যুবতীর বুক চিরে পতি লয়ে কেড়ে।” উনিশ শতকের পূর্ব থেকে ধর্মযাজকরা প্রচারকার্যের জোরে এদেশের মানুষের মনে নানা সমস্যার সৃষ্টি করে। যার ফলে ঈশ্বর গুপ্ত উপদেশ দিয়েছেন–“ওখানে জুজুর ভয়ে যেয়ো না রে বাছা।” এই আত্মরক্ষামূলক মনোভাব তাঁর যুগসন্ধির অবস্থান থেকে এসেছে।


‘দ্বিতীয় যুদ্ধ’ কবিতায় শিখদের বিরুদ্ধে ইংরাজদের পক্ষ অবলম্বন করে যুদ্ধ করবার জন্য তিনি ভারতবাসীকে উৎসাহিত করেছেন। ব্রিটিশের জয়ে উল্লাসিত হবার জন্য তিনি উৎসাহিত করেছেন :

‘ভারতের প্রিয় পুত্র হিন্দু সমুদয় 

মুক্ত মুখে বল সবে ব্রিটিশের জয়।'


এইভাবে একদিকে তিনি 'ব্রিটিশের জয়' ঘোষণা করেছেন। এতে মনে হয়, রাজনৈতিকভাবে তিনি ব্রিটিশ শক্তিকে স্বীকার করেছেন। এতেই বোঝা যায়, তাঁর মন পুরাতনপন্থী হলেও নতুনের প্রতি উদাসীন ছিল না। উনিশ শতকের নানা সামাজিক সমস্যা কবি-মনে আন্দোলন তুলেছে। তার মধ্যে বিধবা-বিবাহ, স্ত্রী শিক্ষার প্রসারে সমাজে বিকৃতি ও প্রাচীন সনাতন স্ত্রী-ধর্ম লোপ পাবার আশঙ্কা, বাঙালির সাহেবিয়ানা, অনুকরণপ্রিয় দেশীয় আচার প্রথা ও গুরু পুরোহিতের প্রতি উন্নাসিকতা, দেশে ব্যাপকভাবে গোহত্যা, সেই হেতু দ্বন্দ্বের অভাব, বাঙালিদের প্রতি সাহেবদের উপেক্ষা, ইয়ংবেঙ্গলের কর্ম ও আচরণের ফলে যুগসমাজে নানা সমস্যা—এই সব সমস্যাই ঈশ্বর গুপ্তকে উত্তেজিত করেছিল, তাঁকে উদ্বেলিত করেছিল। তিনি সামাজিক মানুষ, সংবেদনশীল কবি। তাই সমাজের তৎকালীন জ্বলন্ত সমস্যাকে তিনি উপেক্ষা করেননি। তার দিকে মুখ ফিরিয়ে থাকেন নি। ঈশ্বরচন্দ্রের কবিতায় ঊনবিংশ শতাব্দীর সমাজ-সমস্যাই দর্পণের মতো প্রতিবিম্বিত হয়েছে। বাঙালি যুগসমাজ আচারভ্রষ্ট হয়ে গেছে বলে কবি তাদের ভর্ৎসনা করেছেন।


এইসব সমস্যা ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তকে চিন্তিত করেছে। তাঁর কবিমানস নানা সমস্যার চিত্রকে তুলে ধরেছে। সমাজের নানামুখী দিক তাঁকে বিরক্ত করেছে। এদিকে সমাজের ভবিষ্যৎ ছবি তাঁকে সান্ত্বনা দেয় নাঃ

‘লক্ষ্মী মেয়ে যারা ছিল,

তারাই এখন চড়বে ঘোড়া!

ঠাটঠমকে চালাক চতুর

সভ্য হবে থোড়া, থোড়া।

আর কি এরা এমন ক'রে 

সাজ সেঁজুতির ব্রত নেবে?

আর কি এরা আদর করে 

পিড়ি পেতে অন্ন দেবে? 

পর্দা তুলে' ঘোমটা খুলে 

সেজেগুজে সভায় যাবে। 

আপন হাতে হাঁকিয়ে' বর্গী 

গড়ের মাঠের হাওয়া খাবে।'


ঈশ্বর গুপ্তের ছিল প্রাকৃত মনোবৃত্তি। তাই সমাজের কোন সমস্যার দিকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার মানসিকতা তাঁর ছিল না। যদিও সামাজিক সঙ্কটে তিনি ঐতিহ্যের 'চেনা পথ'-ই নিয়েছিলেন। কারণ “দেশজ রীতি বা কনভেনশনেই তাঁর কবিত্বের শক্তি।” দেশজ ধারার কবি হলেও তিনি সমসাময়িক সামাজিক সমস্যা ও রাজনৈতিক প্রেক্ষিতকে অস্বীকার করেননি।


ঈশ্বর গুপ্ত সমাজ-জিজ্ঞাসা, সমাজ-সংকটকে তাঁর কাব্যে ফুটিয়ে তুলেছেন, কিন্তু সমাধানের পথ তাঁর কাছে ছিল অপ্রত্যাশিত। তাই তাঁর কাব্যে শুধু সমস্যার চিত্র সমাধানের কোন চিহ্ন নেই।