“আমাদের আর্থিক অবস্থার প্রতিস্ব খুঁজতে হলে বাইরের পৃথিবীতে চিন ছাড়া অন্য কোনো দেশই নাই।”—এই উক্তির আলোকে ভারত-চিন কৃষিসমস্যার আলোচনা করো।

চিনদেশের সঙ্গে ভারতের কৃষিসমস্যার সাদৃশ্য বেশি। এই সাদৃশ্য সোভিয়েট রাশিয়া বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল বা অন্য কোনো দেশের সঙ্গে নেই। চিনদেশের কৃষিসমস্যা ভারতের মতো। এই সমস্যা ‘পুঞ্জ পুঞ্জ সমস্যা'। শিল্প-বিদ্যুৎ পরিবহণের অভাব, কৃষিক্ষেত্রে জরাজীর্ণতা, জনসংখ্যাবৃদ্ধির বর্ধমান হার -এসবই ভারতের মতো চিনেও বর্তমান। চিনের সঙ্গে ভারতের কৃষিসমস্যার মিল হল পাঁচলক্ষ গ্রামে ছড়ানো পঁয়ত্রিশ কোটি কৃষকের মানসিক সহযোগিতার প্রশ্ন। এঁদের সকলকে বুঝতে হবে, “কৃষি উৎপাদন স্রোতস্বিনী না হলে আমাদেরও মুক্তির আশা পরাহত।”—এই সতর্কবাণী কৃষকদের মনে যে চেতনার বিদ্যুৎ সৃষ্টি করেছে, তাই উৎপাদনের পক্ষে সর্বাপেক্ষা সহায়ক শক্তি।


ভারতবর্ষে আর্থিক পরিকল্পনা ১৯৫১ সাল থেকে শুরু হয়েছে। কিন্তু এই বারো-তেরো বছরে কৃষির ব্যাপারে ভারতীয়রা তেমন অগ্রসর হতে পারেনি। গত দু-তিন বছরে কৃষি উৎপাদন আদৌ বাড়েনি। ১৯৫১ সালের তুলনায় কৃষি-উৎপাদন হয়তো শতকরা তিরিশ ভাগ বেড়েছে। কিন্তু ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপে তার উপযোগিতা খুব একটা আশাব্যঞ্জক নয়। কৃষিপ্রণালীর উৎকর্ষ নয়, কেবলমাত্র আবাদি জমির পরিমাণ বাড়িয়ে শস্যসম্ভার বাড়ানো হয়েছে। স্বাধীনতার পর ভারতে খাদ্যশস্যের ঘাটতি ছিল চাহিদার শতকরা পাঁচ ভাগ পরিমাণ। তারপর অনেক আন্দোলন হয়েছে। অনেক অর্থব্যয়, পরিকল্পনা ও অধ্যাবসায় সত্ত্বেও ঘাটতির অঙ্ক একইরকম আছে। তার ফলে এখনও প্রতি বছর বিদেশ থেকে তিরিশ-চল্লিশ লক্ষ টনের মতো খাদ্যশস্য আমদানি করতে হয়। এখন হয়তো এ ব্যাপারে বিশেষ অসুবিধা হবে না, কিন্তু পরদেশি উদারতার যদি পরিবর্তন হয়, তাহলে দেশের পক্ষে সমূহ বিপদ। কৃষি-উৎপাদনে উচ্চকিত বিপ্লব না ঘটলে সমস্যা দুঃসাধ্য হয়ে উঠবে। বাড়তি কৃষিজমিও অবশিষ্ট থাকবে না, যাতে আবাদ করে সংকট ত্রাণ হবে। এই সতর্কবাণী লেখক করেছেন তাঁর অননুকরণীয় ভাষায় “আমরা যে তালে এগোচ্ছি তাতে মাঝে মাঝে আশঙ্কা হয় শেষের সেদিন ভয়ংকর খুব বেশি দূরে নেই।” এখনও পর্যন্ত জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের সঙ্গে কৃষি-উৎপাদনের প্রসারের হার কোনোক্রমে পাল্লা দিতে পেরেছে। কিন্তু তাতে আত্মতুষ্টির অবকাশ কম। কৃষিপণ্যে উদ্বৃত্ত আমাদের কাম্য। এই উদ্বৃত্তের অভাবে শিক্ষা শিথিল, দুর্বল হবে। বৈদেশিক মুদ্রার অনটন বাড়বে। এ-সবের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে “আশ্বাসের ঋতু” কে টেনে এনে হাজির করা যাবে না যার ওপর দাঁড়িয়ে আমরা আমাদের প্রগতির বিজয়-পতাকা তুলে ধরতে পারব। দেশের শতকরা সত্তরভাগ কৃষিজীবী এখনও কৃষি থেকে জীবিকার অন্ন সংগ্রহ করেন। সুতরাং কৃষির অবস্থা, চাষবাসের হাল না ফিরলে তাদের অবস্থাও বদল হবে না। এদের উন্নতি হলে তবেই শিল্পে উদ্দামগতি আসবে। শিল্পজাত পণ্যের ক্রয় করার জন্য প্রয়োজনীয় সংগতি চাই। এই সংগতি আসবে কৃষিক্ষেত্রের উৎপাদন থেকে। এই কারণে কৃষির উন্নতি প্রয়োজন। কৃষিক্ষেত্রের উদ্বৃত্ত থেকে তাদের খাদ্য আসবে। এই উদ্বৃত্ত থেকে মেটাবে কাঁচামালের চাহিদা।


ভারতের কৃষিব্যবস্থায় নৈরাশ্য নেমে এসেছে। সোনার কাঠি-রুপোর কাঠি এই কৃষিসম্পদ। কিন্তু এই সোনার কাঠি রুপোর কাঠি ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাই পরিকল্পনার ব্যর্থতাও বার-বার ঘটছে। এইজন্যই উদ্‌বেগ। উদ্‌বেগ থেকে আসে আত্মবিশ্লেষণ। আত্মবিশ্লেষণের পথে গেলেই তবে কৃষিসমস্যার মূল ব্যাপারটা প্রণিধান করা যাবে। অবশ্য একথা সত্য যে রাষ্ট্রের তরফ থেকে গত বারো-তেরো বছরে অন্তত তিনহাজার কোটি টাকা কৃষিসম্প্রসারণে বিনিয়োগ করা হয়েছে। এই বিনিয়োগ এসেছে অ-কৃষিজীবীদের কাছ থেকে। কোনোরকম কর চাপানো হয়নি। ভূমিসংস্কার অল্পস্বল্প হয়েছে। কিন্তু তাতে বড়ো বড়ো রাজামহারাজার হয়তো অসুবিধে হয়েছে, কিন্তু ভূস্বামীদের অসুবিধে হয়নি। রাষ্ট্র কিন্তু নানা ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। যেমন, সেচের জল বাড়ানো, উন্নত বীজশস্য সংগ্রহ, উৎকৃষ্ট সার পৌঁছানো এসব হরেকরকম ব্যবস্থা করা হয়েছে, তবু কৃষিতে ব্যাপ্তি হচ্ছে না কেন?


লেখক মনে করেন, আমাদের কৃষিসমস্যার মূলে কোথাও ফাঁকি আছে। গ্রামোন্নয়ন গঠন প্রণালীতে হয়তো কোনো অবহেলা প্রবেশ করেছে। এমন অস্বাভাবিক নয় যে, প্রাপ্ত সাহায্য বা অনুদান সব অর্ধপথে লক্ষভ্রষ্ট হচ্ছে। তৃতীয় যে শক্তির হাতে গিয়ে এসব অনুদান পড়ছে তারা হয়তো গ্রামের মহাজন বা উচ্চবিত্ত ব্যক্তি। গ্রাম-সমাজে এখনও শ্রেণিবিন্যাস বহুবিধ। নানা অসাম্য দিয়ে ঘেরা এই গ্রামসমাজ। শ্রেণিভেদে ও বর্ণভেদে-চিহ্নিত এই সমাজে এখনও দুর্নীতি ও অনাচার যথেষ্ট পরিমাণে আছে। সমাজতন্ত্রের ধুয়ো যেমন উঠছে, তেমনি বিত্তবানদের সমৃদ্ধ করার সুযোগ সমপরিমাণে বাড়ছে। গ্রামাঞ্চলে ধনীপক্ষই প্রবল। এই কারণ রাষ্ট্রীয় কল্যাণবিস্তার শুভফল নীচুতলায় ছড়াতে পারছে না। এর ফলে পুষ্ট হচ্ছে গ্রামের মহাজন ও উচ্চবিত্ত চাষি। নীচুতলার কৃষক সম্প্রদায় ‘যে তিমিরে সেই তিমিরেই'। তাদের মনে হতাশা বাড়ছে, পরিশ্রমের সঙ্গে সঙ্গে তাদের মনে অতৃপ্তি বাড়ছে। এই অতৃপ্তি ও অসন্তোষ নিয়ে কখনও উৎপাদনকর্মের মতো মহৎ যজ্ঞে অংশগ্রহণ করা যায় না। এর ফলে গ্রামজীবনে হতাশা নেমে এসেছে। অধিকাংশ কৃষকের অভাব-অসন্তোষের ভিত্তিতে নতুন পৃথিবী গড়া যাবে না। সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার মানুষের প্রগতি কৃষকের মুক্তির ওপর নির্ভরশীল। ভারতের মতো অনুন্নত দেশের পক্ষেও এই একই শিক্ষা। “অধিকাংশ কৃষকের অভাব-অসন্তোষের ভিত্তিতে নতুন পৃথিবী গড়া সম্ভব নয়। উৎপাদনে উদ্দাম বন্যার ঢল এ অবস্থায় নামবার নয়। গণতন্ত্রের ছায়ায় যে মস্ত পরীক্ষা আমাদের দেশে চলছে তাকে সফল করতে হলে তাই ভিন্নগতিতে কৃষিসমস্যার উৎসের সন্ধানে যেতে হবে। নিরপেক্ষ তুলাদণ্ড নিয়ে বিচার করে দেখতে হবে কোথায় স্খলন-পতন ঘটেছে। কোথায় কোন ধরনের উন্নতি সম্ভব।" কৃষিসমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে ভারত চিনের পথে যদি অগ্রসর হয়, তবেই হয়তো মুক্তি, এই বিশ্বাস লেখকের আন্তরিক।