'কৃষিসমস্যা ও আমরা' প্রবন্ধে লেখক কৃষিসমস্যার উৎস সন্ধানে কোন কোন তথ্যের উল্লেখ করেছেন? লেখকের চিন্তানুসারে এই মত বিশ্লেষণ করো।

কৃষিসম্পদই জাতির প্রধান সম্পদ। কৃষি ও কৃষকের অবস্থার ওপর জাতির অর্থনৈতিক উন্নতি নির্ভর করে। কৃষির সঙ্গে শিল্পের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। কৃষি উন্নত না হলে শিল্প উন্নত হয় না। কিন্তু কোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পরিকল্পনা ব্যবস্থা এমনই হয় যে, বিনিয়োগের হার শিল্পকে সমৃদ্ধ করলেও কৃষিকে সমৃদ্ধ করে না। বিনিয়োগের ত্রুটি থেকেই এই অসাম্য দেখা দেয়। ভারসাম্যের এই অভাব কৃষিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে চলেছে। লেখক আলোচ্য প্রবন্ধে কৃষিসমস্যার যে করুণ চিত্র পরিবেশন করেছেন, তা থেকে কৃষিসমস্যার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক সাধারণ মানুষকে তুলে ধরবে।


ধনবিজ্ঞানের সূত্রে আছে, বিনিয়োগের হারের সঙ্গে আর্থিক প্রগতির অঙ্গাঙ্গি সম্পর্ক। বিনিয়োগের পরিমাণ বেশি বলেই চিন-জাপান-সোভিয়েট ইউনিয়নের আর্থিক প্রগতি উন্নততর। বিনিয়োগের অঙ্ক কম বলেই আমাদের অর্থনৈতিক প্রগতির হার কম। কিন্তু এর পরের কথা হচ্ছে, বিনিয়োগ দিয়ে যদি ব্যয়ের নির্বাচনী দিকটা যথাযথ না হয়, তাহলে যদি তা ইস্পাত-যন্ত্রপাতি-সড়ক-বন্দর-বিদ্যুৎ-সেচনে ব্যয়িত হয়, নিত্যপ্রয়োজনীয় চাহিদা মিটিয়ে যদি তা নিঃশেষ হয়, তাহলে প্রগতি ক্ষুণ্ন হয়। এ ব্যাপারে সোভিয়েট পরিকল্পনা একটা নতুন সূত্র এনে দিয়েছিল। বিনিয়াগের হার যত ইচ্ছা বাড়িয়ে যাও, উৎপাদন উপকরণ ক্রয়ার্থে নিয়োগ করো। কিন্তু ভোগ্যপণ্য কিনে বিনিয়োগ নষ্ট কোরো না। প্রথম দিকে অশনে-বসনে যথেষ্ট ব্যয় না করে, তা প্রয়োজনীয় উৎপাদন বৃদ্ধিতে ব্যয় করো, তাহলে আখেরে লাভ হবে। সোভিয়েট ইউনিয়নের এই আদর্শের হয়তো সমসাময়িক কারণও ছিল, কিন্তু বিনিয়োগ সম্পর্কে এই কৃচ্ছতা করে শিল্প-উৎপাদনে ফল পেলেও কৃষিক্ষেত্রে তারা ভুল করেছিল। কৃষি-বিনিয়োগ নিয়ে বিশেষ মনোযোগ দেয় নি। কৃষিকর্মের মোড় ফেরাবার জন্য প্রধানত জোর দেওয়া হয়েছিল বিদ্যুৎ সরবরাহ ও ট্রাক্টর নির্মাণের ওপর। কিন্তু রাষ্ট্র সার তৈরি বা উন্নত বীজ শস্য সংগ্রহে অবহেলা করেছে। এর ফলে কৃষি উৎপাদন কমেছে। এর থেকে শিক্ষা নিয়েছে চিন। চিনের সঙ্গে ভারতবর্ষের অব্যবস্থার সাদৃশ্য আছে যথেষ্ট। কৃষিক্ষেত্রে সমস্যাও স্বতন্ত্র।


কৃষিকর্ম দেশ জুড়ে ব্যাপ্ত হয়, হাজার হাজার পল্লিগ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। একই গ্রামে হয়তো দু-তিনশো কৃষিজীবী থাকে। তারা মনের দিক দিয়ে এক, কিন্তু ইচ্ছার দিক থেকে এক নয়। কৃষকদের সকলকে একমন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করতে হবে, প্রত্যেকটি গ্রামের সঙ্গে যোগাযোগ না রাখলে চেতনার অখন্ডতা আসবে না। এছাড়া কৃষিজমি সম্পর্কে কৃষকদের এক ধরনের ব্যক্তিগত দুর্বলতা থাকে। সোভিয়েট দেশ এই জায়গাটায় ভুল করেছিল। তারা ভেবেছিল জমিদারি প্রথা যেহেতু উচ্ছেদ হয়েছে, চাষিরা সোৎসাহে ফসল বাড়াবার চেষ্টা করবে। কিন্তু ভূমিসত্ত্ব সম্পর্কে চাষিদের দুর্বলতা থাকে। জমিদারি উচ্ছেদ করে সেই দুর্বলতা শেষ হবে না। চাষিদের মনের সায় কৃষিক্ষেত্রে উন্নত উৎপাদনের এক প্রধান শর্ত। এই দিকটা মানসিক। কৃষকের এই “মন বোঝা, মন-পাওয়ার সমস্যা” কেবল সোভিয়েত দেশে নয়, চিনে বা ভারতেও এটা প্রধান সমস্যা। কৃষির উৎপাদনের জন্য কৃষকদের সঙ্গে প্রয়োজীয় হার্দ্য-বিনিময় যে কত প্রয়োজন, তা সোভিয়েত, চিন ও ভারতের কর্তৃপক্ষ বুঝেছে। চিনে কৃষি-বিনিয়োগ বেড়েছে, হাল-লাঙল-কাস্তে, খুরপি প্রভৃতি ক্রয় ব্যাপারে প্রচুর উৎসাহে-মনোযোগ এবং আলাপ-আলোচনা চলেছে। কৃষি উৎপাদন প্রণালীর প্রয়োজন, উদ্ভাবন এবং সমস্যাকে কেন্দ্র করে নানা আলোচনা ও বিনিয়োগ হওয়ার ফলে ‘ভারী শিল্প'র ওপর গুরুত্ব কমে আসে। সোভিয়েট দেশ থেকে একথা শেখা গেছে যে যন্ত্রপাতির ক্ষেত্রে বিনিয়োগ বাড়িয়ে গেলেই আর্থিক প্রগতি সহজ হবে না।


চিনের কৃষিসমস্যা ও কৃষকদের সমস্যা থেকে ভারতবর্ষকেও শিখতে হবে। “কারণ আমাদের আর্থিক অবস্থার প্রতিস্ব খুঁজতে হলে বাইরের পৃথিবীতে চিন ছাড়া অন্য কোনো দেশে নেই। “চিনে কৃষিভূমির বিস্তার, সাতলক্ষ গ্রামের চল্লিশ কোটি কৃষকদের বশংবদ করে রাখতে পারলে তবেই কৃষিতে উন্নতি সম্ভব।” চিনের সমস্যাও আমাদের মতো “একমাত্র চিনেই আমাদের মতো পুঞ্জ পুঞ্জ সমস্যা।” এই সমস্যাগুলি যথাক্রমে এইরকম (১) শিল্পে বিদ্যুৎ পরিবহনের অভাব, (২) কৃষিক্ষেত্রে জরাজীর্ণতা, (৩) জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার। ভারতবর্ষেও একই সমস্যা হল পাঁচ লক্ষ গ্রামের পঁয়ত্রিশ কোটি কৃষকের। এইখানেই সমস্যার মূল কেন্দ্র।


১৯৫১ সাল থেকে দেশে আর্থিক পরিকল্পনা শুরু হয়েছে। কিন্তু এই বারো-তেরো বছরে কৃষির ব্যাপারে ভারতবর্ষ অনগ্রসর। গত দু-তিন বছরে কৃষির উৎপাদন আদৌ বাড়েনি। সর্বসাকুল্যে কৃষি-উৎপাদন হয়তো ১৯৫১-র তুলনায় তিরিশ গুণ বেড়েছে। কিন্তু এদিকে জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার অনুযায়ী কৃষকের সংখ্যা বেড়েছে অনেক বেশি হারে। কৃষকের গড় উৎপাদনের সূচক আসলে কমেছে। উৎপাদন বেড়েছিল প্রণালীগত উৎকর্ষ থেকে নয়, আবাদি জমির পরিমাণ বাড়িয়ে। স্বাধীনতার পর এদেশের খাদ্যশস্যের ঘাটতি ছিল চাহিদার শতকরা পাঁচ ভাগ। তারপর অনেক ব্যয় অধ্যবসায় বা আন্দোলন হয়েছে। কিন্তু ঘাটতির আনুপাতিক অঙ্ক একই আছে। ঘাটতির জন্য আমাদের বিদেশের ওপর নির্ভর করতে হয়। বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানি করতে হয়। আপাতত খাদ্যশস্য ও অন্যান্য কৃষিজাত দ্রব্য অন্যের সাহায্যে আহরণ করতে পারছি। কিন্তু লেখক এক্ষেত্রে একটা সতর্কবাণী করেছেন। এই আর্থিক সাহায্য সাময়িক, হয়তো পরদেশিদের মহানুভবতায় একদিন না একদিন মন্দস্রোত আসবে, স্তিমিত হবে সহানুভূতি, এদেশের কৃষি-প্রগতি অন্ধকারে হারিয়ে যাবে। এই ভয়াবহ দিন যাতে না আসে, তার জন্য পূর্ব প্রস্তুতি প্রয়োজন, “উৎপাদনে উচ্চকিত বিপ্লব” না ঘটাতে পারলে, “সহানুভূতির ঘড়াও শূন্যে ঠেকবে।" লেখক কৃষি-উন্নতির মন্দা হার সম্পর্কে হতাশ হয়ে বলেছেন, “আমরা যে তালে এগোচ্ছি, তাতে মাঝে মাঝে আশঙ্কা হয় শেষের সেদিন ভয়ংকর"। আসলে কৃষিপণ্যে উদ্বৃত্ত আমাদের কাম্য। সেই উদ্বৃত্ত না এলে শিল্প ব্যাহত হবে। বৈদেশিক মুদ্রার অনটন দেখা দেবে। দেশে সত্তর ভাগ কৃষক, তাদের অবস্থান ফেরালে শিল্পজাত পণ্য কেনবার সংগতি চাই। এর জন্য প্রয়োজন কৃষির প্রসার।


রাষ্ট্র কৃষিসমস্যা নিবারণে চেষ্টার ত্রুটি করছে না। সেচের জল বাড়িয়ে, শস্যের উচিত মূল্য বজায় রেখে, উন্নত বীজশস্য এবং উৎকৃষ্ট সার পৌঁছাবার হাজার প্রয়াস অব্যাহত রেখে রাষ্ট্র তার কর্তব্য পালন করছে। কিন্তু কৃষিতে ব্যাপ্তি হচ্ছে না কেন? এর জন্য প্রয়োজন আত্মবিশ্লেষণ, সমস্যা-সমীক্ষা। এই প্রশ্নের উত্তরে লেখকের সিদ্ধান্ত এই যে “গ্রামোন্নয়নের গঠন প্রণালীতে কোথায় নিশ্চয় ফাঁক আছে।" গ্রামোন্নয়নের জন্য যে টাকা বরাদ্দ হচ্ছে, তা কিন্তু আসল প্রয়োজন সিদ্ধ করেনি। অর্ধপথে তারা লক্ষভ্রষ্ট হয়েছে। আমাদের পরিসমাজে এখনও নানা স্তর ও শ্রেণি, নানা উপস্তর। তাই অসাম্যও বিদ্যমান। তার ফলে রাষ্ট্র কৃষি ও কৃষকের জন্য যে অনুদান পাঠাচ্ছে, তা উচ্চবিত্ত কৃষকের হাতে পড়ছে, মহাজনদের হাতে আসছে। কিন্তু প্রকৃত কৃষকদের করায়ত্ত হচ্ছে না। কৃষিক্ষেত্রে ধনবণ্টনের এই অসাম্যই কৃষিসমস্যার মূলকেন্দ্র। এদেশের এক-চতুর্থাংশ কৃষিজীবীর কোনো চাষের জমি নেই। আরেক চতুর্থাংশের জমির পরিমাণ গড় প্রতি চার-পাঁচ বিঘের বেশি নয়। এদিকে নানাধরনের ভূমিসংস্কার হয়েছে। তা সত্ত্বেও কৃষিভূমির অর্ধেকের বেশি উচ্চবিত্ত চাষিদের আয়ত্তে। “সরকারি প্রসাদে সবচেয়ে সুবিধে হয়েছে এই শাঁসালো মহাজনদের” সাধারণ মজুরচাষি বা ভাগচাষিদের ভাগ্যে ছিটেফোঁটাও এমন কিছু পড়ে নি যাতে তাদের মনে হতাশা আসে। পরিশ্রমের বেলায় এই সব দরিদ্র, ভূমিহীন কৃষক, কিন্তু লভ্যাংশের বেলায় মহাজন জোতদাররা। এর ফলে তাদের মনপ্রাণ উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। তিক্ততা দেখা দেয়, ফলে উৎপাদনে কোনো ‘incentive' বা উৎসাহ আসে না। মূল্যবান রাসায়নিক সার কালোবাজার ঘুরে অপাত্রে এসে পড়ে, দক্ষ কৃষকদের হাতে এসে পড়ে না। তার ফলে উৎপাদনের প্রাচুর্য ব্যাহত হয়। পণ্যমূল্য বেঁধে দিয়ে সরকার কৃষকদের কষ্ট নিরসনের চেষ্টা করেন। কিন্তু এতে বিশেষ কিছু লাভ হয় না, কারণ ভাগচাষি বা কৃষিমজুররা মহাজনদের কাছ থেকেই খাদ্যশস্য কিনতে বাধ্য হন, চড়াদামে ক্ষুধার অন্ন কিনতে হয়। এ সব থেকেই বোঝা যায় অধিকাংশ কৃষক অভাবে-ক্লিষ্ট, অনটনে জীর্ণ। তাদের মধ্যে উৎসাহের অভাব দেখা দেয়। ফলে উৎপাদনে মন্দাভাব দেখা দেয়। অসন্তুষ্ট ও ক্ষুব্ধ কৃষকদের অসন্তোষের ভিত্তিতে নতুন পৃথিবী গড়া যাবে না। কৃষিসমস্যার উৎসসন্ধান না করতে পারলে গণতন্ত্রের জাগরণে যে ব্রত উদযাপিত হতে চলেছে, তা ব্যর্থ হতে বাধ্য।