“তুমি কি? তা আমি জানি না—আমি জানি না— কেবল জানি যে, তুমি আমার বাসনার বস্তু— আমার জাগ্রতের ধ্যান-নিদ্রায় স্বপ্ন—জীবনের আশ-মরণের আশ্রয়। তোমাকে কখন জানিতে পারিব না।—জানিতে চাহিও না – যে দিন জানিব, সেই দিন আমার সুখ যাইবে। কাম্য বস্তুর স্বরূপ জানিলে কাহার সুখ থাকে?” – আলোর উদ্দেশে পতঙ্গের এই উক্তিতে কমলাকান্তের দপ্তরের ‘পতঙ্গ’ শীর্ষক প্রবন্ধটির মর্মার্থ যেভাবে প্রকাশিত হয়েছে, বিশ্লেষণ করে দেখাও।

রাত্রিতে নসীরাম বাবুর বৈঠকখানায় সেজ জ্বলছে। কমলাকান্ত পাশে মোসায়েবের মতো উপবিষ্ট। বাবু দলাদলির গল্প বলছেন, আর কমলাকান্ত আফিম চড়িয়ে ঝিমোচ্ছে। দলাদলির প্রসঙ্গে চটে গিয়ে সে আফিমের মাত্রা বেশি করে ফেলেছে। সেই অবস্থায় কমলাকান্ত দেখতে পায়, একটা পতঙ্গ এসে চো-ও-বোঁ ও-ও শব্দ করে ফানুসের চারপাশে ঘুরছে। সে হঠাৎ দিব্যকর্ণ প্রাপ্ত হয়ে আফিমের প্রসাদে পতঙ্গের কথা শুনতে পেল। পতঙ্গ বলছিল, তারা পতঙ্গজাতি, পূর্বাপর আলোয় পুড়ে মরে আসছে, তাদের পুড়ে মরার জন্মগত অধিকার আছে। সেকালে আলো যখন পেতলের পিলসুজের ওপর মেটে প্রদীপ শোভা পেত, তারা স্বচ্ছন্দে পুড়ে মরত। কিন্তু এখন সেজের ভেতর আলো আশ্রয় গ্রহণ করায় তারা প্রবেশ করার পথ না পেয়ে তার চারদিকে ঘুরে বেড়ায়, পুড়ে মরতে পারে না। আলো রূপময়, দগ্ধ করার জন্যই তার জন্ম, সে পতঙ্গ, পুড়ে মরার জন্যই জন্মগ্রহণ করেছে। পতঙ্গ উড়ে চলে যাবার পর নসীরাম বাবু তার নাম ধরে কমলাকান্তকে ডাকলেন, আফিমের নেশার ঘোরে সে তাকিয়ে দেখে নসীরামকে চিনতে পারল না, তার মনে হল, একটা বৃহৎ পতঙ্গ বালিশে ঠেসান দিয়ে তামাক টানছে, চোঁ বোঁ করে কি যেন বলছে? তখনই কমলাকান্তের মনে হল, মানুষ মাত্রেই পতঙ্গ।


বঙ্কিমচন্দ্র ‘কমলাকান্তের দপ্তর'-এর অন্তর্ভুক্ত ‘পতঙ্গ’ রচনায় এই রূপক-কল্পনার মধ্য দিয়ে মানুষের আকাঙ্ক্ষা সম্পর্কে এক গভীর সত্যকে প্রকাশ করেছেন। প্রতিটি মানুষেরই এক একটি বাসনা-বহ্নি আছে, সকলেই তাতে পুড়ে মরতে চায়, মনে করে, সেই বাসনা-বহ্নিতে তাদের পুড়ে মরার অধিকার আছে। এই সংসারে আকাঙ্ক্ষার জিনিস অনেক, জ্ঞান-বহ্নি, ধন-বহ্নি, রূপ-বহ্নি, ধর্ম-বহ্নি, ইন্দ্রিয়-বহ্নি, সংসার বহ্নিময়। অন্যদিকে, এই মানব সংসার কাচময়, সেজের মতোই তার চারদিকে মানুষের ভয়-ভীতি, দ্বিধা-সংশয়, নিজের জীবন ও আত্মীয়স্বজনের প্রতি মায়া মমতার পিছুটান প্রভৃতির আবরণ, তাতে বাধা পেয়ে আমরা আমাদের বাসনা-বহ্নিতে পুড়ে মরতে পারি না। আলো দেখে, অর্থাৎ কাম্যবস্তুর আকর্ষণে মুগ্ধ হই, মুগ্ধ হয়ে তাতে ঝাঁপ দিতে চাই, কিন্তু সেইসব বাধায় পারি না, ফিরে পতঙ্গের মতোই বোঁ করে চলে যাই, আবার ফিরে এসে তার চারদিকে ঘুরে বেড়াই। সেই কাচ অর্থাৎ নানা বাধার আবরণ না থাকলে সংসার এতদিন পুড়ে যেত।


চৈতন্যদেব এই আবরণ ভেদ করে ধর্ম মানস-প্রত্যক্ষে দেখেছিলেন বলেই এই সংসার ত্যাগ করেছিলেন। যদি সকল ধর্মবিদই তাঁর মতো সেভাবে ধর্মকে দেখতে পেত, তবে ক'জন বাঁচত। অনেকেই জ্ঞানের প্রতি আকৃষ্ট হয়, কিন্তু তারা জ্ঞান-বহ্নির আবরণ-কাচে, অর্থাৎ সেইসব বাধার জন্য তাতে আত্মাহুতি দিতে পারে না। কিন্তু সক্রেটিস ও গ্যালিলিও জ্ঞানের তীব্র তৃষ্ণায় কোনো বাধাকেই গ্রাহ্য করেননি, তার জন্য নিজেদের প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। রূপ, ঐশ্বর্য, মান প্রভৃতির আকাঙ্ক্ষা-রূপ-বহ্নিতে বহু মানুষই আত্মাহুতি দেয়। বাসনাকামানার এই বহ্নিদাহ যাতে বর্ণিত হয় তাকেই আমরা কাব্য বলি। 'মহাভারত' জ্ঞান-বহ্নিতে দুর্যোধন, ‘প্যারাডাইস লস্টে’ জ্ঞান-বহ্নিতে আদম ও ইভ, ‘অ্যান্টনি অ্যান্ড ক্লিওপেট্রা'য় ভোগ-বহ্নিতে অ্যান্টনি ও ক্লিওপেট্রা, ‘রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট' নাটকে রূপ-বহ্নিতে রোমিও ও জুলিয়েট এবং 'ওথেলো' নাটকে ঈর্ষা-বহ্নিতে ওথেলোর পুড়ে মারার বর্ণনা পাই। সেন্ট পল ধর্ম-বহ্নির অদ্বিতীয় কবি, গীতগোবিন্দ ও বিদ্যাসুন্দরে ইন্দ্রিয়-বহ্নির প্রজ্বলিত রূপ দেখি, রামায়ণে পাই স্নেহ-বহ্নিতে সীতার দাহ।


কিন্তু বহ্নি অর্থাৎ আমাদের কাম্যবস্তুর স্বরূপ কী আমরা জানি না। এই আলো তার বাসনার বস্তু, জাপ্রতের ধ্যান, নিদ্রার স্বপ্ন, জীবনের আশা, মরণের আশ্রয়—সে শুধু এইটুকুই জানে। আলোর স্বরূপ পতঙ্গ জানতে পারবে না, জানতে চায়ও না, যেদিন জানবে সেই দিনই তার আলোর জন্য তৃষ্ণার সুখ চলে যাবে; কাম্য বস্তুর স্বরূপ জানলে কার সুখ থাকে। ঈশ্বর কী, ধর্ম কী, জ্ঞান বা স্নেহ কী, আমরা কিছুই জানি না। দর্শন, বিজ্ঞান, ধর্মপুস্তক, কাব্যগ্রন্থ ইত্যাদি সবকিছুই আমাদের কাম্যবস্তুর স্বরূপ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছে। আমরা আমাদের কাম্যবস্তুর স্বরূপ জানি না, তবু সেই অলৌকিক ও অজ্ঞাত বস্তুকে পতঙ্গের মতোই ব্যাকুলভাবে প্রদক্ষিণ করি। আমরা পতঙ্গ ছাড়া আর কী। বঙ্কিমচন্দ্র এইভাবেই আলোর উদ্দেশে পতঙ্গের ভাষণের রূপক কল্পনায় মানুষের আকাঙ্ক্ষা সম্পর্কিত এক গভীর ভাবসত্যকে প্রকাশ করেছেন।