“এই রূপকথার রচয়িতার কোন নামকরণ হয় নাই।”—এই উক্তিটি ব্যাখ্যা করো।

প্রাচীন সাহিত্যের সনতারিখ সঠিকভাবে জানা যায় না, কারণ তার জন্মসময় ইতিহাসের অন্ধকারে হারিয়ে যায়। মহাকাব্য বা লোকসাহিত্য এইভাবে স্রষ্টার পরিচয় হারিয়ে ইতিহাসের পথে আবির্ভূত হয়। মহাকাব্যের বিশাল দেহে অনেক নামহীন লেখক আত্মপ্রকাশ করে থাকে। লোকসাহিত্যের নানা ধাপ সম্পর্কেও এ কথা সত্য। তাদের আদিস্রষ্টার নাম ইতিহাসের অন্ধকারে হারিয়ে যায়। কালে কালে নানা রচয়িতা তাদের রচনাকে এর মধ্যে সঞ্চিত করে রাখে। তার ফলে এই জাতীয় সাহিত্যে কোন ব্যক্তি পরিচয় বা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে খুঁজে পাওয়া যায় না। এদের সৃষ্টির পশ্চাতে সমগ্র জাতি তাদের সঞ্চয়কে ধরে রাখে। এইদিক থেকে বিচার করলে এদের বলা চলে জাতীয় সাহিত্য।


‘রামায়ণ' প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন যে মহাকাব্য জাতীয় সাহিত্য, তা ব্যক্তি প্রতিভার সৃষ্টি নয়। যুগে যুগে। কালে কালে নানা কবি তাদের সাহিত্য প্রতিভাকে এক মহাকাব্যের মধ্যে সঞ্চিত করে রেখেছে। এই কারণে ‘রামায়ণ'-এর মতো মহাকাব্যকে জাতীয় সাহিত্য বলা চলে। 'রূপকথা'ও এইরকম জাতীয় সাহিত্য। রূপকথার রাজ্যের একই নিয়ম। কোথাও লেখকের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের কোন ছাপ নেই। সর্বত্রই উদার-বিশাল ভাব সক্রিয় রূপকথার আদিস্রষ্টা কে, কেউ জানে না। এ যেন জাতির অন্তরতম সত্তার নিঃশব্দ সৃষ্টি। সভ্যতার কোন আদি পর্যায়ে রূপকথার গল্পগুলি কে রচনা করেছে কেউ জানে না। কালে কালে যুগে যুগে তা প্রবাহিত হয়ে মানবমনের চিরন্তন সঞ্জয়ে তা আশ্রয় গ্রহণ করেছে। রূপকথাকে এইদিক থেকে বিচার করলে বলা চলে জাতীয় সৃষ্টি। একটা সমগ্র জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা পুরাতন সাহিত্যে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়। তাই জাতির আত্মা বৃত্তহীন পুষ্পসম ‘আপনাতে আপনি বিকাশ’ হয়ে আত্মপ্রকাশ করে। ব্যক্তিবিশেষের অপেক্ষা না করে তা বিকশিত হয় বলে সমগ্র জাতির অন্তরাত্মা তার মধ্যে ধরা পড়ে। পুরাতন সাহিত্যের অধিকাংশ, গল্প-গাথা-ছড়া-প্রবাদ রূপকথা সবই “জাতির খাস সম্পত্তি”। কত নামহীন লেখক রূপকথার এক একটি গল্পে নিজের নাম যুক্ত করে নিজেকে নিঃশেষে লীন করে রেখেছে, তার কোন তুলনা নেই। 'রামায়ণ' যেমন যুগ যুগ ধরে নানা কবির কাব্যকল্পনার দ্বারা সৃজিত হয়েছে, রূপকথাও তেমনি যুগ যুগ ধরে এই সমগ্র কল্পনারাজ্যের মধ্যে প্রয়াত হয়েছে। রূপকথার আবেদন শিশুকল্পনার জগতে। ঠাকুমার স্নেহসিপ্ত হৃদয়ে, ত্রাস-কৌতূহল কল্পিত জীবনে রুপকথার আস্বাদ পাওয়া যায়। এই রসাস্বাদ চিরন্তন। কালে কালে শিশুহৃদয় এই রসাস্বাদ লাভ করে বোমা-বেঙ্গমীর কাহিনীতে, শ্বেতবসত্তের কাহিনীতে। মধুমালা মালঞমালা-কাঞ্চনমালার কাহিনীতে রূপকথার যে জগৎ উদ্ঘাটিত হয়, তা সম্ভব অসম্ভবের সীমারেখা অতিক্রম করে দূর শূন্যে শিশু মনকে নিয়ে যায়। তেপান্তরের মাঠে রাজপুত্রের ছুটে চলে যাওয়া, রুদ্ধগৃহে স্বপ্নদীপালোকে বন্দিনী রাজকন্যার অন্তহীন ক্রন্দন সবই মানুষের হারিয়ে যাওয়া শৈশবকে জাগিয়ে তোলে। রূপকথা ও লোককথা, মানবসভ্যতার দ্বিতীয় পর্যায়ের সৃষ্টি। একজন সমালোচক লিখেছেন : “রুপকথার যথার্থ বিকাশ ঘটল আরও পরে। সৌর প্রতীকতার সীমা ছাড়িয়ে রাজপুত্র মানুষের কামনা-কল্পনা এবং বিজয়-যাত্রার প্রতিনিধি হয়ে উঠল।” রূপকথার ধারা আজও অব্যাহত। কিন্তু এই ধারা কে কীভাবে সৃষ্টি করল তার ইতিহাস অন্ধকারগর্ভে লীন। মানুষের চিরন্তন আশা-আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্নের প্রতীক রূপকথা। তাই রূপকথার আদিস্রষ্টা কে না জানলেও তার ধারায় আমরা অবগাহন করতে পারি। মানুষ যুগ যুগ ধরে এগিয়ে চলবে তার প্রাণাবেগ নিয়ে। রূপকথা-রোমান্স গতিপ্রবণতার বার্তা। রূপকথাকে বলা চলে অনাদি। কারণ যে কোন প্রাচীন লোককথার মতোই তা স্রষ্টার পরিচয়হীন। এই কারণে এই সৃষ্টিকে বলা হয়েছে জাতীয় সৃষ্টি যেখানে জাতীয় মানস রূপায়িত হয়। প্রেম, বীরত্ব, নির্যাতিত কাহিনী ছড়িয়ে পড়ল দেশে-দেশান্তরে। মানুষ এগিয়ে চলেছে সত্ত্বদ্বীপা বসুন্ধরার দিকে দিকে, এই গতির প্রাবল্যে হয়তো লোককথার আদি স্রষ্টা হারিয়ে গেছে। মানুষের আত্মবিস্তারের ইতিহাস রূপকথার মধ্যে ধরা পড়েছে। এইখানেই রূপকথার স্রষ্টাহীন আত্মবিস্তার।