"এর পর কী? শিল্পী চলবে কোন পথে?”—কোন্ প্রসঙ্গে এই উক্তি করা হয়েছে? এই উক্তির তাৎপর্য কী?

“আর তাই শিল্পের সত্য অজ্ঞানে আবিষ্কার করেও তাকে ধরে রাখতে ওরা পারল না।”- এই উক্তির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করো।

শিল্প বিষয়ের সামান্য সত্যকে প্রকাশ করে। একে বলে "universal"-এর প্রকাশ। শিল্প সৌন্দর্য সৃষ্টি করে। এই সৌন্দর্য সার্বভৌম ও বিশ্বজনীন। শিল্পসত্যকে সজ্ঞানে প্রকাশ করার মধ্যে একটা কলা থাকে। সেই কলাশক্তিকে শিল্পী সচেতন ভাবে রূপ দেয়। শিল্পের কথা এই সচেতনতাই জ্ঞান। শিশু অনেক জ্ঞানের কথা বললেও মানুষ তাকে গভীরভাবে নেয় না। কারণ শিশু অজ্ঞানের ঘোরেই সে-সব কথা বলে। এই কারণে শিল্পী সচেতনভাবেই শিল্পসৃষ্টি করেন। প্রাগৈতিহাসিক শিল্পের ব্যর্থতা প্রসঙ্গে লেখক এই উক্তি করেছেন। এদেশের প্রাগৈতিহাসিক শিল্পে পৌরাণিক জগতে স্থিতি ছিল না। পটুয়া শিল্পীরা পোশাকি ছবির ভাষা জানত না। লেখক মনে করেন এই কারণে “শিল্পের সত্য অজ্ঞানে আবিষ্কার করেও তাকে ধরে রাখতে ওরা পারল না।” সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে শিল্পে এল পোশাকি ভাষা। ঘরোয়া ভাষার সূক্ষ্ম কারিগরি নেই, বিনাসের চিহ্ন নেই, ঘোর-প্যাঁচ নেই। তাহ ঘরোয়া ভাষা আর পোশাকি ভাষার মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। সাধুভাষায় শিল্প যখন প্রাধান্য পেল, সংস্কৃত শিল্পের প্রাধান্য যখন শিল্পজগতে এল, তখন এই ঘরোয়া ভাষায় রচিত শিল্পের চেয়ে তাদের আকর্ষণ বেশি হল। কারণ চোখে ধাঁধা লাগিয়ে দিয়ে পোশাকি শিল্পের আকর্ষণ দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ল। তাই শিল্পীর দল কোমর বেঁধে শিল্পের সংস্কারকার্যে মনোযোগী হল, এর ফলে শিল্পের সত্য অপেক্ষা রূপকলাই বেশি প্রাধান্য পেল। এই ধরনের সংস্কারকর্ম শিল্পকর্মে এসে মুখ্য হয়ে উঠল বলে ঘরোয়া ভাষার সঙ্গে শিল্প আর বেঁচে রইল না। এই কারণে প্রাগৈতিহাসিক শিল্পীও শিল্পসত্যকে ধরে রাখতে পারল না। নতুন শিল্পের জোয়ারে তারা তাদের ভূমিকাকে হারিয়ে ফেলল। সচেতন শিল্পের মূল্য যখন জায়গা জুড়ে থাকে, তখন শিল্প সার্থক হয়। এই কারণে সচেতন শিল্প না থাকার জন্য প্রাগৈতিহাসিক শিল্পীরা ব্যর্থ হল। শিল্পের সত্য জানা সত্ত্বেও শিল্পীরা শিল্পসত্যকে ধরে রাখতে পারল না। সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে এইসব শিল্প হারিয়ে গেল। অনেকে মনে করেন ‘Art is unconscious', তাই শিল্পসত্যকে অনেকেই অজ্ঞাতসারে প্রকাশ করেন। কিন্তু তাকে ধরে রাখতে গেলে চাই কঠিন ভিত্তি। সেই ভিত্তিভূমি এই শিল্পীদের ছিল না।



"এর পর কী? শিল্পী চলবে কোন পথে?”—কোন্ প্রসঙ্গে এই উক্তি করা হয়েছে? এই উক্তির তাৎপর্য কী?

ইউরোপীয় শিল্পীদের সংস্কারকার্যের নেশা-প্রসঙ্গে এই উক্তি করা হয়েছে।

ইউরোপীয় শিল্পীরা সংস্কৃত শিল্পকে সৃষ্ট করে বলেছেন, এ ধরনের শিল্পের একটি বিশিষ্ট ভঙ্গি আছে। ভাষার চাকচিক্য, আড়ম্বর, পালিশ এই সব শিল্পের বৈশিষ্ট্য। শিল্পে সংস্কারকার্যের চেষ্টা শিল্পীকে নেশার মতো পেয়ে বসে। শিল্পী সেই নেশায় আক্রান্ত হয়ে তাঁর শিল্পকর্মে নানা পালিশ শুরু করেন। সমালোচকদের ভাষায়, একে বলে “মণ্ডনকলা”। এই 'মণ্ডনকলা’-র প্রেরণায় শিল্পকে নিখুঁত করতে চান শিল্পী। এই নিখুঁত করার নেশা এমনই যে ছবিতে আঁকা আঙুরকে সত্যিকারের আঙুর বলে ভুল করে পাখি পর্যন্ত ক্যানভাস ঠুকরেছে। ছবি কতখানি নিখুঁত হতে পারে, এই অবস্থার বর্ণনা তাই প্রমাণ করে। এই অবস্থাকে লেখক বর্ণনা করেছেন একটি পরিচিত উপমা দিয়ে। যোগশাস্ত্রে বিস্তৃতি দর্শনে যেমন যোগীদের নেশা ধরার কথা শোনা যায়, এও অনেকটা সেইরকম। বিভূতির টানে অনেক সময় ধর্মের ভাব হরিয়ে যায়। ধর্ম হয়ে ওঠে ‘সিদ্ধাই’-তে পূর্ণ। কিন্তু এসব ভেলকির পথে চলতে গেলে যেমন ধর্মীয় সত্য হারিয়ে যায়, তেমনি আড়ম্বরপনা ও পোশাকি ভাষার টানে শিল্পসত্যও হারিয়ে যায়। শিল্পের আসল কথা যে ভাবসৃষ্টি বা রসসৃষ্টি তা আর গুরুত্ব পায় না। তখন আঙ্গিকের দিকে মনোযোগ চলে আসে। এই মনোযোগ ক্রমে নেশার মতো পেয়ে বসে। শিল্পী ভাবে এই সংস্কার-কর্মের শেষ নেই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এর একটা সীমায় এসে পড়ে। শিল্পী সেই সীমায় এসে হাঁপিয়ে ওঠে। ভাবে এর পর কী? কতদূরই বা যেতে হবে? এই প্রশ্নের সামনে বিমূঢ় হয়ে শিল্পী আর এগোতে পারে না। সে তাকিয়ে দেখে সব পথ রুদ্ধ। লেখক একে তুলনা করেছেন দাবা খেলার সঙ্গে। দাবা খেলতে খেলতে খেলুড়ে এমন এক জায়গায় এসে পড়ে যে সুমুখে কোনো পথ নেই। সংস্কার কার্যের নেশায় মেতে ইউরোপীয় শিল্পীদের এমনই একটা অবস্থা হয়েছিল। তারা খ্রিস্টীয় বিশ্বাসও হারিয়েছিল। নতুন কোনো পুরাণে তারা আশ্রয় নেয়নি। এই নিরাশ্রয় অবস্থার ফলে ইউরোপীয় শিল্পীরা অসহায় বোধ করত। এরই ফলে শিল্পে ভাঙনের রূপ প্রত্যক্ষগোচর হয়। শিল্পীর সংস্কার প্রবণতা তাকে বার বার ভুল পথে নিয়ে যায়। অথবা যে পথ দিয়ে শিল্পীরা পথ-পরিক্রমা করে, তার পরে আর পথ নেই। পথের শেষে এসে শিল্পীদের বিমূঢ়তা ও অসহায়তা বিস্ময়করভাবে বেড়ে যায়। শিল্পসত্য ছাড়া সার্থক শিল্প হয় না-H. Caudwell বলেছেন : “A perfect poem or perfect painting would contian truth perfectly expressed"—এখানে যে বিষয় ও প্রকাশের কথা বলা হয়েছে। ইউরোপীয় শিল্পীরা শিল্পকে perfect করতে গিয়ে তা ফুটিয়ে তুলতে পারেনি।