“ইতিহাসের তিনটি বড় রকমের সমুখানের মধ্য দিয়ে আধুনিকতার এই ক্রমবিকাশকেও আমরা চিহ্নিত করতে পারি।”—বিশ্বের ইতিহাসে আধুনিকতার আলোচনা প্রসঙ্গে উক্তিটি বিশদ করো।

'আধুনিকতা’ কোনো কালগত ব্যাপার নয়, এটি একপ্রকার মানসক্রিয়া। যে-কোন দেশে, যে-কোন কালেই আধুনিকতার উদ্ভব ঘটতে পারতো—অবশ্যই এটি পারিপার্শ্বিক অবস্থার আনুকূল্য সাপেক্ষ। বাস্তবে দেখা যায়, যে কালকে আমরা ঐতিহাসিকভাবে 'প্রাচীনকাল' নামে উল্লেখ করে থাকি, পৃথিবীর কোন কোন দেশে সেকালেও আধুনিকতার স্ফুরণ দেখা দিয়েছিল। আবার কালগতভাবে যাকে আমরা বলি 'আধুনিক যুগ’ একালেও কিন্তু পৃথিবীর বহু দেশেই এখনও যথার্থ আধুনিকতা পরিপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারেনি।


মানুষ যখন থেকে নিজেকে প্রকৃতি থেকে স্বতন্ত্ররূপে ভাবতে শিখলো, তখন থেকেই তার সৃষ্টিতে মানব-চেতনা লক্ষ্য করা যায়। মানুষ নিজের সম্বন্ধে সচেতন হয়েছে, কিন্তু তখনও পরিপূর্ণ আত্মবিশ্বাস আসেনি বলেই মানুষকে পুরো মর্যাদা দিতে পারেনি। বিজ্ঞান-বুদ্ধি অনায়ত্ত ছিল বলেই বহু প্রাকৃতিক ঘটনার কার্যকারণ সম্পর্ক মানুষ বুঝে উঠতে পারেনি, ফলে সমস্ত প্রাকৃতিক ঘটনার পিছনেই একটা অলৌকিক শক্তির লীলা অনুভব করতো, এমনকি নিজেকেও দেবতার বা ভাগ্যের ক্রীড়নক বলে ভাবতো। তাই আমাদের সমগ্র প্রাচীন যুগের সাহিত্যে দেবতার ও ধর্মের মাহাত্ম্যই বিশেষভাবে প্রকাশ পেয়েছে। তবু মানুষ যে মানুষের মহিমা-বিষয়ে ক্রমশ সচেতন হয়ে উঠেছিল তার প্রমাণ পাই শ্রীরামচন্দ্র, শ্রীকৃষ্ণ প্রভৃতি মানুষী কল্পনার মধ্য দিয়ে। মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্যেও মানুষের কাহিনী বিবৃত হয়েছে, কিন্তু সে মানুষও ভাগ্যতাড়িত, দেবতার কৃপাভিক্ষু। এইভাবেই আমাদের দেশের প্রাচীন সাহিত্যে আমরা মানবিক চেতনার অর্ধস্ফুট স্ফুরণটুকুই শুধুই দেখতে পাই।


মধ্যযুগের সাধকদের মধ্যে কিন্তু আমরা মানবিকতার প্রকাশ লক্ষ্য করি অপেক্ষাকৃত স্ফুটতরভাবে। তাঁরা অনেকেই মানুষের সুখদুঃখের সঙ্গে নিজেদের জড়িয়ে নিয়ে তাদের আত্মোন্নতির পথে অগ্রসর হতে সাহায্য করেছেন। এমনকি চণ্ডীদাস এ কথাও বলেনঃ

“শুনহে মানুষ ভাই,

সবার উপরে মানুষ সত্য 

তাহার উপরে নাই।”


পৃথিবীর কোন্ দেশে কখনও, এমনকি আধুনিক কালেও মানবিক মাহাত্ম্যের এমন সমুন্নত ঘোষণা শোনা যায়নি। কিন্তু সমকালের প্রেক্ষাপটে এর তাৎপর্য ব্যাখ্যা করলে আমরা বুঝতে পারি, চণ্ডীদাস যে মানুষের কথা। বলেছেন, সেই মানুষ সমাজ-সম্পর্কের অতীত একটা সত্তামাত্র, সে মানুষ ‘আধ্যাত্মিক মানুষ’, সুখদুঃখ-সমন্বিত সবলোকের মানুষ নয়। কিন্তু একালের মানবতা এই আধ্যাত্মিক মানবতা নয়।


সমকালে আমাদের দেশের তুলনায় প্রাচীন গ্রীসদেশে এবং চীনদেশে মানুষের মর্যাদা অনেক বেশি স্বীকৃতি পেয়েছিল। তাৎকালিক গ্রীসের সামাজিক ও রাষ্ট্রিক পরিবেশ এবং জীবনযাত্রার মান অনেক উন্নত ছিল। প্রাচীন গ্রীক সভ্যতার বনিয়াদ অনেকটা আধুনিক সভ্যতারই অনুরূপ এবং ক্ষুদ্র সংস্করণ ছিল, ফলত তথাকার মানবতাবোধ অনেকটা স্পষ্টরূপ লাভ করে। প্রাচীন চীনদেশেও কনফুসিয়াস-এর যুগ থেকেই সুস্থ ঐহিক দৃষ্টিতে সমাজবোধ স্থান পেয়েছিল। কিন্তু পরে আর মানুষের মূল্য, ব্যক্তিত্ব আর গণতন্ত্র অধিক দূর অগ্রসর হতে পারেনি। ফলে মধ্যযুগ রয়ে গেল অন্ধকারাচ্ছন্ন। মধ্যযুগের গ্রীস দেশের অবস্থাও একই রূপ। সমগ্র য়ুরোপেও আর আধুনিকতার কোন পদধ্বনি শোনা গেল না।


ইউরোপে মধ্যযুগের অভিম ঘন্টাধ্বনি শোনা গেল ইতালিতে চতুর্দশ শতকে রেনেসাঁসের আবির্ভাবে। প্রাচীন গ্রীক সাহিত্যের পুনরালোচনায় ইতালিতে এই মানবতামুখী নবজাগরণ দেখা দেয় এবং পরবর্তী দুই শতাব্দীকালে শিল্পে-সাহিত্যে জীবনচর্যায় মানবিকতাবোধের পূর্ণ বিকাশ সাধিত হয়। এরই ফলে পরবর্তী শতাব্দীগুলিতে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এর প্রতিফলন ঘটে, মার্লো-শেক্‌স্পীয়রের মধ্য দিয়ে আমরা সেই আধুনিক জীবনবোধের পরিচয় পাই। এই কারণেই রেনেসাঁসকে আধুনিক কালের প্রথম সোপান বলে মেনে নেওয়া হয়। জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাধনায় মানুষ ক্রমশ আত্মনির্ভর হয়ে উঠতে লাগলো। বস্তুত প্রাচীনকালের মানবতাবোধের ঐতিহাসিক পরিণতিরূপেই ‘আধ্যাত্মিক মানুষ' রেনেসাঁসের যুগে এসে ‘আধিভৌতিক মানুষে রুপান্তরিত হলো। প্রাচীন যুগের মানবতাবাদের সঙ্গে আধুনিক যুগের প্রথম পর্বের অর্থাৎ রেনেসাঁস যুগের মানবতাবাদের পার্থক্য কেবল পরিমাণগত নয়, বরং বহুলাংশে গুণগত। দেবতা-ধর্মের স্থান গ্রহণ করলো এবার মানুষ। এই পরিদৃশ্যমান ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ এবং মানব-জীবনই মানুষের ভাবনায়, চিন্তায়, শিল্পে, সাহিত্যে প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়ালো। জগৎ আর জীবনের দিকে তাকিয়ে তাই কবি বলে ওঠেন :

How beautious mankind is ! 

O brave new world:

That has such people in it!"


রেনেসাঁসের সর্বতোমুখী বিকাশ ঘটে প্রথম ইতালিতে। পেত্রার্ক, বোকাচিও, তাসো প্রভৃতি সাহিত্যের মাধ্যমে এবং লিওনার্দো-দা-ভিত্তি, মিকায়েল এঞ্ঝোলো, রাফায়েল প্রভৃতি চিত্রকলা, ভাস্কর্য ও স্থাপত্যে মানব-ব্যক্তিত্বের বহুমুখী বিকাশের স্বতঃস্ফূর্ত প্রমাণ রেখেছেন। ক্রমে এই রেনেসাঁসের প্রভাব ইউরোপ খণ্ডেও ছড়িয়ে পড়ে। এলিজাবেথীয় যুগে ইংরেজি সাহিত্যেও যুগান্তর সৃষ্টি হয়। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, এই বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে, তারই ফলে ধর্মনিরপেক্ষ বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গিরও প্রবর্তনে সহায়তা হয়।


এই রেনেসাঁস মানবিক আন্দোলনে যে গতি সৃষ্টি করলো, তা থেকেই এল আধুনিকতার দ্বিতীয় পর্ব—ফরাসী বিপ্লবে যার সূত্রপাত এর প্রত্যক্ষ পটভূমিকা-রূপে সপ্তদশ শতকের বিজ্ঞান-দর্শন, নবোদিত অর্থশাস্ত্র এবং ইংলন্ডে ও আমেরিকায় বিদ্রোহ অবশ্য যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছে। তৎসহ ফ্রান্সে দিদেরো, ভলতেয়ার, রুশো প্রভৃতির রচনায় ব্যক্তি-স্বাধীনতা যে ব্যক্ত হয়েছে তা' সমকালীন ফরাসী জন-মানসে যে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছিল, তাতে কোন সন্দেহ নেই। এই ফরাসী বিপ্লবের মাধ্যমেই ‘সাম্য, মৈত্রী ও মুক্তি’-র যে নীতি স্বীকৃতি পেল, তার মধ্য দিয়েই ‘মানুষের অধিকার' প্রতিষ্ঠিত হল। আধুনিকতার প্রথম পর্বে ইউরোপীয় রেনেসাঁসের মধ্য দিয়ে মানুষের মহিমা-বোধের উদ্বোধনের পর, দ্বিতীয় পর্বে ফরাসী বিপ্লবের মধ্য দিয়ে 'মানুষের অধিকার' প্রতিষ্ঠিত হল। এরই সঙ্গে এল ব্যক্তি-স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের স্বীকৃতি। মানুষের অবচেতন মনে পোষিত বহুকালের আকাঙ্ক্ষা মুক্তির পথ খুঁজে পেল, বহুদিনের স্বপ্ন সফল হবার পথে খানিকটা এগুলো। কিন্তু যে কোনো কারণেই হোক, সেই স্বপ্ন ভঙ্গ হতেও বেশি দেরি হল না। তবে ফরাসীবিপ্লবের ফলে ইউরোপময় যে ভাব-বিপ্লব দেখা দিয়েছিল, তা সদ্যই ফলপ্রসূ হল ইংরেজিসাহিত্যে। ব্রাউনিং-আদি রোম্যান্টিক আশাবাদের মধ্য দিয়ে, ওদিকে হুইম্যানের রচনার মধ্য দিয়েও তার প্রতিফলন ঘটলো। তারপর একসময় সংশয়, হতাশা এবং বিষণ্ণতা যেন মানুষের ভবিষ্যৎকে গ্রাস করতে উদ্যত হল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সেই আশঙ্কাই বাস্তবে পরিণত হল।


এই প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে রুশ দেশে সংঘটিত 'রুশবিপ্লবে'র মধ্য দিয়ে আধুনিকতার তৃতীয় পর্যায় শুরু হল। পূর্ববর্তী পর্বে ব্যক্তি-স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্রের দাবি স্বীকৃত হলেও তার পরিপূর্ণতার জন্য প্রয়োজন ছিল শোষণতন্ত্রের অবসানের। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ায় বিপ্লবের ফলে তারই পথ খুলে গেছে। মানুষ যে বিপ্লবী শক্তির অধিকারী, মানুষ যে সৃষ্টিধর্মী, নিজের প্রচেষ্টাতেই যে সে আপন ভাগ্য গড়ে ও নিয়ন্ত্রণ করে নিতে পারে, সোভিয়েত বিপ্লবে মানুষের আর্থিক ও যথার্থ আধ্যাত্মিক বিকাশের মধ্য দিয়ে এই নতুনতর সত্য উদ্ঘাটিত হতে পারে—এই সম্ভাবনাই দেখা দিয়েছে। তবে ব্যক্তি-সত্তার বিকাশ যদি হয় একান্তভাবে ব্যক্তিকেন্দ্রিক, তবে সামূহিক অগ্রগতি থমকে দাঁড়ানোর আকাঙ্ক্ষা থাকে বলেই এর সঙ্গে সমাজ-চেতনাও যুক্ত হয়েছে। আবার বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে জাতীয় সমাজবোধেই ক্রমে বিশ্বমানবতাবাদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তাই বলা চলে—“ইউরোপীয় রিনাইসেন্সে উদ্বোধন ঘটেছে মানুষের মহিমাবোধের, ফরাসী বিপ্লবে ঘটেছে 'মানুষের অধিকারের' ব্যক্তিগত ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠা, আর সোভিয়েত বিপ্লবে ঘটেছে মানুষের বিপ্লবী যাত্রার সূচনা।”—এই তিনটি বড় রকমের সমুখানের মধ্যে দিয়ে আধুনিকতার এই ক্রমবিকাশকে চিহ্নিত করা যায়।