'এই পত্রসাহিত্যের সর্বাপেক্ষা অভিনব বার্তা হইল জীবনের লঘু, খুঁটিনাটি, হাস্যোদ্দীপক দিকগুলির প্রতি রবীন্দ্রনাথের সরস অভিনিবেশ। –‘ছিন্নপত্র' অবলম্বনে উক্তিটির যৌক্তিকতা আলোচনা করো।

‘ছিন্নপত্র’ মূলত রবীন্দ্রনাথের বিচিত্র অনুভবের আত্মউন্মোচন। ১৮৮৭ থেকে ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়পর্বে স্নেহের ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবীকে লিখিত রবীন্দ্রনাথের পত্রাবলিই ‘ছিন্নপত্রাবলী'। এই আট বৎসরের মধ্যে অধিকাংশ সময়টাই রবীন্দ্রনাথের কেটেছে শিলাইদহ-সাজাদপুর-পতিসর বা ওড়িশার জমিদারি পরিদর্শন ও পরিচালনার কর্মব্যস্ততায়, পদ্মা-গড়াই-আত্রেই যমুনার বুকে বোট বা স্টিমার যাত্রায়। প্রকৃতির মুক্ত সৌন্দর্যমূর্তি রবীন্দ্রনাথের ইন্দ্রিয়-মনকে মায়াঞ্জন পরিয়েছে। পদ্মা তীরের জনপদবাসীদের আপাত শান্ত জীবনযাত্রা, তাদের ছোটো ছোটো দুঃখ-সুখ, অভাব-অভিযোগ, সরলতা-নিষ্ঠুরতা রবীন্দ্রনাথের কাহিনি কল্পনাকে উদ্দীপ্ত করেছে। পদ্মার নির্জন চরের জ্যোৎস্না, ডাহুক-ডাকা দ্বিপ্রহর, পদ্মার গ্রীষ্ম-শীত-বর্ষা, দিগন্তের শ্যামল রেখা, আকাশের অনন্ত বিস্তৃতি, নদীর অবিশ্রান্ত স্রোতধারা রবীন্দ্রনাথের দার্শনিক মনটিকে বারে বারে জাগ্রত করে দিয়েছে। তৎকালীন প্রতিটি মুহূর্তের অনুভবটিকে লঘু এবং গম্ভীর, কৌতুককর এবং দার্শনিকোচিত প্রত্যেক অভিজ্ঞতাকে রবীন্দ্রনাথ প্রকাশ করতে চেয়েছেন তাঁর চিঠিপত্রের মধ্য দিয়ে— ‘‘কত দিন কত মুহূর্তকে আমি ধরে রাখবার চেষ্টা করেছি........ যেটাকে আমি বাইরের থেকে সঞ্চয় করে এনেছি, যেটা এক একটা দুর্লভ সৌন্দর্য, দুর্মূল্য সম্ভোগের সামগ্রী, যেগুলো আমার জীবনের অসামান্য উপার্জন—যা হয়তো আমি ছাড়া আর কেউ দেখে নি, যা কেবল আমার সেই চিঠির পাতার মধ্যে রয়েছে....."


কিন্তু পত্রসাহিত্যের মূল প্রাণশক্তি নিহিত থাকে প্রাকৃত জীবনের উত্তাপে, উষ্ণ ব্যক্তিজীবনের অকপট প্রকাশে, প্রাত্যহিক চলমান মুহূর্তগুলির তুচ্ছাতিতুচ্ছ ছবি ও ঘটনার সজীব চিত্রায়ণে। কবিসুলভ ভাবোৎকর্ষ এবং দার্শনিক সুলভ সুউচ্চ মননের মধ্যে মাহাত্ম্য আছে সন্দেহ নেই, কিন্তু চিঠিপত্রের মধ্যে প্রত্যাশিত সহজ মানুষটিকেই, যিনি জীবনের লঘু, পুঙ্খানুপুঙ্খ বিষয়গুলিতেও সদা আগ্রহী, তরলিত কৌতুকে দীপ্তিমান, সহজ আনন্দে সহজেই আন্দোলিত। চিঠিপত্র আসলে যেহেতু অপর এক ব্যক্তির সাহচর্যের অপেক্ষা করে, পত্র প্রেরকের সঙ্গে পত্রপ্রাপকও যেখানে সমভাবে গুরুত্বপূর্ণ, সেহেতু দার্শনিকোচিত ভাবগাম্ভীর্যের পরিবর্তে সহজ সাধারণ মানুষটির প্রকাশই কাঙ্ক্ষিত। 'ছিন্নপত্র'-তে রবীন্দ্রনাথ যদিও লিখেছেন–“ওর মধ্যে যা কিছু আমার ব্যক্তিগত জীবনসংক্রান্ত সেটা তেমন বহুমূল্য নয়"—তবু আমাদের বিবেচনায় ‘ছিন্নপত্র’র ওই ব্যক্তিগত, খুঁটিনাটি, কৌতুকোজ্জ্বল বিষয়গুলির রস-সম্ভোগের বর্ণনাগুলিই পত্রসাহিত্য হিসাবে এই পত্রগুচ্ছের মূল্য ও গুরুত্ব বৃদ্ধি করেছে।


শিলাইদহ বা সাজাদপুরে বসবাসকালে প্রকৃতি ও মানুষের যে বিচিত্র লীলা তিনি দেখেছেন, তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা আছে ‘ছিন্নপত্র’তে। সাজাদপুরের অনতিদূরে কোনো এক ছিপছিপে নদীর দৃশ্য আঁকতে গিয়ে তিনি লিখেছেন— “চারিদিকে জেলেদের বাঁশ পোঁতা—জেলেদের জাল থেকে মাছ ছোঁ মেরে নেবার জন্যে চিল উড়ছে, পাঁকের উপরে নিরীহ বক দাঁড়িয়ে আছে নানা রকমের জলচর পাখি জলে শ্যাওলা ভাসছে, মাঝে মাঝে পাঁকের মধ্যে অযত্নসম্ভূত ধানের গাছ, স্থির জলের উপর ঝাঁকে ঝাঁকে মশা উড়ছে।”


আবার পতিসরের এক গ্রীষ্মের মধ্যাহ্ন বর্ণনাতেও পাবো প্রকৃতির এমন অনুপুঙ্খ চিত্র— “তপ্ত বাতাস ধুলোবালি খড়কুটো উড়িয়ে নিয়ে হুহু শব্দ করে ছুটেছে; প্রায়ই হঠাৎ এক এক জায়গায় একটা আজগবি ঘূর্ণিবাতাস দাঁড়িয়ে উঠে শুকনো পাতা এবং ধুলোর ওড়না ঘুরিয়ে ঘুরতে ঘুরতে নেচে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে …."


‘ছিন্নপত্র’র প্রকৃতিদৃশ্যগুলি সত্যিই যেন ভবিষ্যৎ-চিত্রশিল্পী রবীন্দ্রনাথের ভাষায় আঁকা বর্ণনাধর্মী ছবি। নদীবিধৌত বঙ্গপল্লির প্রকৃতির বুকে নানা ঋতুময়, সূর্যাস্ত সূর্যোদয়, নিদাঘ-দুপুর বা ঝিল্লিকম্পিত রাত্রি, মায়াময়ী সন্ধ্যা বা প্রলয়ংকরী ঝড়ের তাণ্ডব আশ্চর্য চিত্ররূপে ‘ছিন্নপত্র’-তে অঙ্কিত।


শুধু অন্য নিরপেক্ষ প্রকৃতি নয়, প্রকৃতি সংলগ্ন মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার চিত্রও ‘ছিন্নপত্র’-তে উপস্থিত। যদিও সেই প্রকৃতির অসীম বিস্তারে মানুষও মানুষের জীবনকে বড়োই ক্ষুদ্র অকিঞ্চিৎকর বলে রবীন্দ্রনাথের মনে হয়েছে, তথাপি মানব জীবন বর্ণনায় তাঁর নিবিড় সূক্ষ্ম দৃষ্টি ব্যাহত হয়নি। ছোটো ছোটো কলকাকলিপূর্ণ গ্রাম, বেদেদের অস্থায়ী উপনিবেশ, হাটুরে মানুষের আসা-যাওয়া, ছোটো ছেলেদের জলক্রীড়া, মাঝি-মাল্লাদের জল-জীবন, পল্লি বধূদের ঘাটে সমাগম, মেয়েলি গল্পালাপ—ইত্যাদি কিছুই রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি। এমনকি তাদের অননুকরণীয় বাগভঙ্গিটিও অসাধারণ কুশলতায় কখনো কখনো তুলে এনেছেন রবীন্দ্রনাথ— “বোধ হয় একজন কে কোথায় যাচ্ছে এবং তাকে বিদায় দিতে সবাই এসেছে। অনেকগুলি কচি ছেলে, অনেকগুলি ঘোমটা এবং অনেকগুলি পাকাচুল একত্র হয়েছে। ... একজন মেয়ে ডাঙায় দাঁড়িয়ে রৌদ্রে চুল এলিয়ে দশাঙ্গুলি-দ্বারা জটা ছাড়াচ্ছে এবং নৌকোর আর একটি রমণীর সঙ্গে উচ্চৈঃস্বরে ঘরকন্নার আলাপ হচ্ছে। শোনা গেল তার একটিমাত্র ‘মায়্যা', অন্য ‘ছাওয়াল নাই’ – কিন্তু সে মেয়েটির বুদ্ধিসুদ্ধি নেই…”


এমন চলমান চিত্র আরও আছে – “গুটিকতক খোড়ো ঘর, কতকগুলি চাল-শূন্য মাটির দেয়াল, দুটো-একটা খড়ের স্তূপ, কুলগাছ আমগাছ বটগাছ এবং বাঁশের ঝাড়, গোটা তিনেক ছাগল চরছে, গোটা কতক উলঙ্গ ছেলে মেয়ে; নদী পর্যন্ত একটি গড়ানে কাঁচা ঘাট, সেখানে কেউ কাপড় কাচছে, কেউ নাইছে, কেউ বাসন মাজছে।”


প্রকৃতি ও মানুষের এক বিস্তৃত চিত্রপট যেন ‘ছিন্নপত্রাবলী’, সামান্য তুচ্ছ ছবিও সেখানে অসামান্য মহত্ত্বে উদ্ভাসিত। শুধু পুঙ্খানুপুঙ্খ প্রকৃতি বা মানবজীবনের চিত্রই নয়, জীবনের নানা লঘু কৌতুককর বর্ণনাও অসামান্য গুরুত্বসহ বিবৃত হয়েছে এই চিঠিগুলিতে। ইন্দিরা দেবীকে লেখা প্রথম চিঠিটিতেই আছে দার্জিলিং যাত্রার সেই কৌতুককর ছবি— “আমার ঠিক বাক্স phobia হয়েছে, বাক্স দেখলে আমার দাঁতে দাঁত লাগে। যখন চারিদিকে চেয়ে দেখি বাক্স, কেবলই বাক্স, ছোটো বড়ো মাঝারি হাল্কা এবং ভারী, কাঠের এবং টিনের এবং পশুচর্মের এবং কাপড়ের—নীচে একটা উপরে একটা পাশে একটা পিছনে একটা—তখন আমার ডাকাডাকি হাঁকাহাঁকি এবং ছুটোছুটি করবার স্বাভাবিক শক্তি একেবারে চলে যায় "


এছাড়া ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবকে সাজাদপুরের কুঠিবাড়িতে আমন্ত্রণ, ঘর পরিষ্কারের কৌতুককর চিত্র আছে ১২ সংখ্যক চিঠিতে, কালীগ্রামের কাছারিতে বিদ্যালয়ের ছোটো ছেলেদের বিশুদ্ধ ভাষায় আবেদনের ছবি ১৭ সংখ্যক চিঠিতে, পাণ্ডুয়ার জমিদারি দেখতে পালকি যাত্রার হাস্যকর ছবি (৩৩) ইত্যাদি অজস্র কৌতুকমুখর লঘু মুহূর্ত বা কথোপকথনকেও রবীন্দ্রনাথ অনায়াসে মেলে ধরেছেন তাঁর চিঠির মধ্যে। সে কৌতুক অন্যকে নিয়েও যেমন, তেমনই নিজেকে নিয়েও। বিসদৃশ এক পরিস্থিতিতে, স্বভাবের বিপরীত কোনো কর্মব্যস্ততায় নিজের করুণ অবস্থাটিকে প্রকাশ করতে গিয়ে এক নির্মল কৌতুকরস পরিবেশন করেছেন রবীন্দ্রনাথ, যা ‘ছিন্নপত্র কৈ আরও সজীব ও প্রাণবন্ত করে তুলেছে।


এই Humour বা নির্মল কৌতুকের পথ ধরেই ‘ছিন্নপত্র’তে এসেছে রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিজীবন ও ব্যক্তি অনুভূতির নানা প্রসঙ্গ। 'ছিন্নপত্র'র ৭ সংখ্যক পত্রে বন্ধু শ্রীশচন্দ্র মজুমদারকে লিখেছেন বাতের যন্ত্রণার প্রসঙ্গ— “কিন্তু কোমর ভেঙে গেলেই মানুষ একেবারে কাৎ, তার আর উত্থানশক্তি থাকে না। তখন প্রেমের আহ্বান স্বদেশের আহ্বান, সমস্ত পৃথিবীর আহ্বান এলেও সে কোমরে টার্পিন তেল মালিশ করবে।”


এসেছে বোলপুরের ঝড়ে মর্মান্তিক দুর্ভোগের ছবি, সঙ্গে মন্তব্য— “ঝড়ের সময় কারো মধুর মুখ মনে রাখা অসম্ভব— কী করলে চোখে কাঁকর ঢুকবে না সেই চিন্তাই সর্বাপেক্ষা প্রবল হয়ে ওঠে।”


সেই সঙ্গে আছে অতিথিপরায়ণতার দায়ে অস্থিরপ্রাণ কবির ছবি, হাস্যকর পরিস্থিতিতে গাম্ভীর্য রক্ষাকারী জমিদারের ছবি, আত্মীয়দের হারিয়ে যাওয়া নিয়ে কৌতুকমিশ্রিত উদবিগ্ন মুখের ছবি; এমনকি খেয়ালি মনের উদ্ভট স্বপ্নবর্ণনাও তুচ্ছ বলে ‘ছিন্নপত্র’তে পরিত্যাজ্য হয়নি।


এই সমস্ত আপাত তুচ্ছ ঘটনা, দৃশ্য, বাক্যালাপ, অভিজ্ঞতার পুঙ্খানুপুঙ্খ ছবি, লঘু কৌতুককর বিষয়ের উপস্থাপন, ব্যক্তিজীবনের খুঁটিনাটি সরস বর্ণনার কারণেই ‘ছিন্নপত্র’ শুধু রবীন্দ্র-রচনা ধারাতেই নয়, বাংলা সাহিত্য ধারায় এমনকি বিশ্ব-পত্রসাহিত্যের প্রেক্ষিতেই অভিনবত্ব ও অনন্যতা লাভ করেছে।