“ঐতিহাসিক কারণে ও ব্যক্তিগত দুর্ভাগ্যে ঈশ্বর গুপ্ত এই রীতির সার্থকতা ও সীমাবদ্ধতা একাধারে দুয়েরই দৃষ্টান্ত।”—আলোচনা করো।

বঙ্কিমচন্দ্র ঈশ্বর গুপ্ত প্রসঙ্গে লিখেছেন, “মধুসূদন, হেমচন্দ্ৰ, নবীনচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ শিক্ষিত বাঙালির কবি, ঈশ্বর গুপ্ত বাংলার কবি। এখন আর খাঁটি বাঙালি কবি জন্মে না। জন্মবার যো নাই, জন্মিয়া কাজ নাই।”—এই উক্তিকে “ঐতিহাসিক জ্ঞানে সমৃদ্ধ” বলেছেন লেখক। কারণ এই উক্তির মধ্যে বাংলার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটটি স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়েছে। শিক্ষিত-সম্প্রদায়ের সাহিত্য-সংস্কৃতিকে সমাজবিজ্ঞানীরা বলেছেন ‘elite' সংস্কৃতি আর দেশজ সাহিত্য-সংস্কৃতির ধারাকে তাঁরা বলেছেন, 'Folk'-সংস্কৃতি। ব্রিটিশ আমল থেকেই এই ‘এলিট’-সংস্কৃতির প্রকাশ এ দেশের আধুনিকতার যাত্রাপথ শুরু। J. B. Bottommore তাঁর বিখ্যাত 'Modern Elites in India' প্রবন্ধে লিখেছেন : “The modernization of Indian society was begun under British rule largely by the activities of an elite of colonial administrators who established an effective administrative of judicial system or the whole country, introduced higher education and formed modern banking and commerce, as well as some modern industry" | প্রাক্-ব্রিটিশ পর্বে বাঙালি যখন ‘খাঁটি বাঙালি' ছিল তখন আধুনিকতার এই রূপ ছিল না। এই কারণে ঈশ্বর গুপ্ত দেশজ কাব্যধারার বাহক হয়ে ব্রিটিশ-পূর্ব দেশজ-সংস্কৃতির ধারাকে বহন করে চলেছেন। এই কারণে লেখক বলেছেন, “দেশজ রীতি বা কনভেনশনেই তাঁর কবিত্বের শক্তি।”—ঈশ্বর গুপ্তের কাব্যপ্রতিভার উৎস সম্পর্কে লেখক এই কথা বলেছেন। 'এই রীতি’ বলতে লেখক ‘দেশজ রীতি'-কে বুঝিয়েছেন।


ঈশ্বর গুপ্ত যুগসন্ধির কবি। ঈশ্বর গুপ্ত সামাজিক দোটানার শিক্ষার ও ঐতিহ্যের আপাতবিরোধের কবি, সেই বিরোধে তিনি ঐতিহ্যের চেনা পক্ষই নিয়েছিলেন। ঈশ্বর গুপ্ত ঐতিহ্যানুগ কবি, কিন্তু নবযুগের কবিদের আর একটি দিকই এক্ষেত্রে স্মরণীয়। এই দিককে লেখক বলেছেন “রোমান্টিক স্বপ্নের অভীপ্সার আস্বাদ”। বিষ্ণু দে লিখেছেন, “সে-রীতির লৌকিক স্বভাব এবং রোমান্টিক জ্ঞানগরিমার সমন্বয় তাঁর আয়ত্তে ছিল না। তার কারণ যে শুধু তাঁর কবিপ্রতিভার সামান্যতা নয়, তার প্রমাণ পাই মাইকেল, হেমচন্দ্র একাধিক নামকরা কবিকীর্তিতে।” “রোমাণ্টিক জ্ঞানগরিমা” বলতে লেখক যা বুঝেছেন তা তাঁর ইন্দ্রিয়সংবেদনশীল সংরাগ, অতীন্দ্রিয় অভিলাষ ও সৌন্দর্য প্রিয়তা। রোমান্টিক কল্পনার প্রভুত্ব রোমান্টিক সাহিত্যে ও শিল্পে প্রাধান্য পায়। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের "প্রাকৃত মনোবৃত্তি"-র সাহিত্যে এই রোমান্টিক জ্ঞানগরিমার প্রকাশ দেখা যায় না। কিন্তু হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতাবলী পাঠ করলে বোঝা যায় যে কবিতাশক্তিতে হেমচন্দ্র ঈশ্বর গুপ্তের সমতুল্য। কিন্তু হেমচন্দ্রের মধ্যে যে রোমান্টিক লক্ষণ আছে, সে লক্ষণ ঈশ্বর গুপ্তের কাব্যে নেই। গুপ্ত কবির কাব্যে সাময়িক ঘটনার প্রেরণা বেশি, তৎকালীন সমাজ-সমস্যা বা সংস্কার-চিন্তা গুপ্তকবিকে উত্তেজিত করত। গুপ্ত-কবি এই কারণে বস্তুনিষ্ঠ বা সমাজসচেতন কবিতাই বেশি লিখেছেন। হেমচন্দ্র গুপ্ত কবির রীতিতে সাময়িক ঘটনা নিয়ে কবিতা লেখেন। উনিশ শতকের সাহিত্যধারা দ্বিধারা। এই দ্বিধারার একটি শিক্ষিত বা শিষ্টজনোচিত ধারা, অন্যটি দেশজ ধারা। এই দুই ধারা সকলের কবিস্বভাবে মেলেনি। এইখানেই তাঁদের ব্যর্থতা। এই ধারা-সমন্বয়ের অভাবে হেমচন্দ্র গুপ্ত কবির মতোই সীমাবদ্ধ। ঈশ্বরচন্দ্রের সীমাবদ্ধতার ক্ষেত্র এইখানে। পারিবারিক দুর্ভাগ্য, কৈশোরে বিমাতার অনাদর, লাঞ্ছনা-গঞ্জনা তাঁকে গৃহত্যাগী করেছিল। যে নব্যতন্ত্রের কলকাতায় তিনি এসে উপস্থিত হয়েছিলেন, তাকে তিনি সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ করতে পারেননি। এই বিরোধ তাঁকে পীড়িত করেছিল। বিষ্ণু দে তাঁর এই প্রবন্ধে ঈশ্বর গুপ্তের জীবন ও পটভূমির বিরোধের কথা বলেছেন। বিষ্ণু দের মতে, এই বিরোধ সমন্বিত রূপ নিয়েছিল মাইকেল মধুসূদনের কাব্যে ও নাট্যে। 'মেঘনাদবধ’ উদ্দাম রোমান্টিক কল্পনার কাব্য। রোমান্টিক বিদ্রোহ তাঁর ‘রাবণ’ চরিত্রাঙ্কনে, কিন্তু ‘ব্রজাঙ্গনা' তাঁর “প্রাকৃত মনোবৃত্তি”-র ফলে “সমাজবেদ্য" হয়ে উঠেছে। এই দিক থেকে সার্থকতম উদাহরণ। “বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ” বা “একেই কি বলে সভ্যতা” এই দুই প্রহসনে পরিস্ফুট হয়েছে, “প্রাকৃত শুভবুদ্ধির সামাজিক দৃষ্টি, যে বস্তুনির্ভর দেশজ রীতির সুস্থ মনোবিন্যাস এখানে প্রতিফলিত তা তাঁর মিল্টন-হোমার-বায়রন-আদর্শায়িত কাব্যে নেই বলেই লেখক মনে করেন। এই দেশজ কাব্যবিন্যাস ঈশ্বর গুপ্তের কাব্যে পাওয়া যায়। ঈশ্বর গুপ্ত যখন লেখেন—

‘বিবিজ্ঞান চ'লে যখন লবেজান ক'রে। 

শাড়ীপরা এলোচুল আমাদের মেম

বেলাক নেটিভ লেডি শেষ শেম শেষ।'


‘পৌষপার্বণ’, ‘আনারস’, ‘ছাগল' তাঁর কবিতার বিষয়বস্তু। এই সব বস্তুসচেতন কবিতায় তাঁর প্রাকৃত মনের পরিচয় পাওয়া যায়। এই ভাষা বাগর্থ বা কবিভণিতি দেশজ রীতির কাব্যধারায় উৎকট। এখানে 'রোমান্টিক জ্ঞানগরিমা’ বা ‘শিষ্ট সাহিত্যের’ শিল্পরূপ ও অন্তরায়। এই কারণে বিন্নু দে বলেছেন, “আমরা কবিত্ব বলতে যা বুঝি, রোমান্টিক কাব্যের সে সংজ্ঞা গুপ্তকাব্যে প্রযোজ্য না হলেও তাঁর নিজস্ব মর্যাদা আছে।” এই দিক থেকে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের কাব্যপ্রতিভার সীমাবদ্ধতা ও সার্থকতা বিচার করতে হবে। কালীপ্রসন্ন সিংহের 'হুতোম প্যাঁচার নক্সা’, টেকচাঁদ ঠাকুরের ‘আলালের ঘরের দুলাল'—এই দেশজধারার আর এক দিক যা ঈশ্বর গুপ্তের উত্তরসূরী। লেখক তাই বলেছেন—“এই শুভবুদ্ধি, এই রীতি টেকচাঁদকে, কালীপ্রসন্নকে লুব্ধ করেছিল, দীনবন্ধু মিত্র এই মননের উৎসেই পান তাঁর অসামান্য শেক্সপীঅরীয় মানবিকতা”। “শেক্সপীঅরীয় মানবিকতা' কথাটি হয়তো অলঙ্কার হিসেবে লেখক যুক্ত করেছেন, ‘নীলদর্পণ'-এর মানবিকতাকে শেক্সপীরীয় স্তরে সম্পৃক্ত কিনা, এ কথা বলা তর্কসাপেক্ষ। কিন্তু ঈশ্বর গুপ্তের ‘প্রাকৃত মনোবৃত্তির' ধারা মধুসুদন, দীনবন্ধুর নাট্যে রয়ে গেছে, তাই লেখক বলেছেন “বাক্যবিন্যাসের দেশজ রীতি আজও আমরা ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের মধ্যে খুঁজতে পারি, যেমন পারি বস্তুনির্ভর সাধারণ সুস্থ বুদ্ধির সরসতা।" বুদ্ধিনির্ভর বস্তুনিষ্ঠ সরল ভাষণ ঈশ্বরগুপ্তের বাক্যকে সরস করে তুলেছে।