“প্রবন্ধের সমস্ত আঙ্গিক-বিন্যাস এখানে ছিন্ন হইয়া ইহা এক মুক্ত মানবাত্মার এক সববন্ধনাতীত মানস অনুভূতির লীলাবিহারক্ষেত্রে পরিণত হইয়াছে।”—'কমলাকান্তের দপ্তর'-এর পাঠ্য প্রবন্ধগুলির অবলম্বনে এই মন্তব্যটির যৌক্তিকতা বিচার করো।

“ইহাদের আঙ্গিক গঠনে-নীতি প্রেরণার মত স্বেচ্ছাচারী এক নিগূঢ় ভাবসঙ্গতি আত্মপ্রকাশ করিয়াছে।”- ‘কমলাকান্তের দপ্তর'-এর পাঠ্য প্রবন্ধগুলি বিশ্লেষণ করে এই উক্তিটির যৌক্তিকতা নির্ণয় করো।


বঙ্কিমচন্দ্র প্রবন্ধ ও উপন্যাস রচনা করে সম্পূর্ণরূপে তৃপ্ত হতে পারেননি, কারণ প্রবন্ধের বিষয়বস্তুকে যুক্তিগ্রাহ্যরূপে উপস্থাপিত করার দায়িত্বের জন্য লেখকের ব্যক্তিগত আবেগ অনুভূতি প্রকাশের সুযোগ বিশেষত থাকে না, উপন্যাসে পাত্র-পাত্রীদের জীবনের সমস্যা, সুখ-দুঃখ ও হৃদয় দ্বন্দ্ব চিত্রণের অন্তরালে ঔপন্যাসিককে আত্মগোপন করতে হয়। সেইজন্যই ‘বঙ্গদর্শনে'র প্রধান লেখকরূপে বঙ্কিমচন্দ্রকে অ্যাডিসন, স্টীল, ডিকুইন্সি প্রভৃতি লেখকদের রচনার আদর্শ গদ্য রচনার এমন একটি আঙ্গিক উদ্ভাবন করতে হয়েছিল যার মাধ্যমে তিনি তাঁর ব্যক্তিগত ভাবনাচিন্তা আবেগ-অনুভূতিকে স্বচ্ছন্দে, স্বতস্ফূর্তভাবে প্রকাশ করতে পারেন। তাঁর শিল্পী ও ব্যক্তি সত্তার আত্মপ্রকাশের সেই নিগূঢ় প্রয়োজন পূরণের জন্যই তাঁকে তাঁর সেই সত্তার প্রতীক কমলাকান্তের মতো বিচিত্র চরিত্রের উদ্ভাবন করতে হয়েছিল।


কমলাকান্ত অর্ধোন্মাদ, সমাজ-সংসারে থেকেও তার সমস্ত বন্ধনমুক্ত এবং আফিঙের নেশাখোর। সেইজন্যই সে মোহমুক্ত জীবনদৃষ্টির অধিকারী, তার প্রজ্ঞাদৃষ্টি সমস্ত ক্ষুদ্র, সংকীর্ণতা ও মিথ্যাচারের আবরণ ভেদ করে সত্যের জ্যোতির্ময় রূপ প্রদর্শন করতে পেরেছে। বঙ্কিমচন্দ্র কমলাকান্তের আফিমের নেশাঘটিত আপাত উদ্ভট, বিচিত্র কল্পনা, মনন, আবেগ-অনুভূতির তরঙ্গে উচ্ছ্বাস প্রভৃতির মধ্য দিয়ে তাঁর জীবন দর্শন, ব্যক্তি-হৃদয়ের আবেগ উৎকণ্ঠাকে প্রকাশ করেছেন। এই রচনায় হাস্যরস, তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গবিদ্রুপ, প্রবন্ধের মননশীলতার গাম্ভীর্য ও বিশ্লেষণ, গীতিকবিতার মন্ময়তা প্রভৃতির সমবায়ে তিনি তাঁর জীবনের ভাবনাকে এক বিচিত্র বর্ণোজ্জ্বল রূপ দান করেছেন। আমরা হাস্যরসের উচ্ছলতা থেকে মননশীলতার গাম্ভীর্যে—সেই গাম্ভীর্য হৃদয়ানুভূতির গীতিকবিতা সুলভ আবেগঘন প্রকাশে পৌঁছে যাই, কোথাও ছন্দপতনের বিশৃঙ্খলা, বৈষম্য বা অসংগতি অনুভব করি না। কমলাকান্তের দপ্তরের প্রতিটি রচনায়ই বহু সুরতাললয়-সমন্বিত ঐকতান সংগীতের ছন্দ সুষমা অনুভব করি।


‘কমলাকান্তের দপ্তর’-এর প্রবন্ধগুলি পরীক্ষা করলেই দেখা যায়, তাদের মধ্যে কোনো নির্দিষ্ট বিষয়বস্তুর ধারাবাহিক, সুসংলগ্ন আলোচনা ও বিশ্লেষণ নেই। প্রবন্ধের বৈশিষ্ট্য তার নামকরণেই দ্যোতিত, যে রচনায় আমরা কোনো ‘প্রকৃষ্ট বন্ধনে' গ্রথিত কোনো চিন্তা বা বক্তব্য বিষয়ের প্রারম্ভ, সূচনা থেকে উপসংহার পর্যন্ত তথ্য ও যুক্তিবিন্যাসের অচ্ছেদ্য শৃঙ্খল লক্ষ্য করি, তাকেই আমরা প্রবন্ধ বলি। কমলাকান্তের দপ্তরের কোনো রচনায়ই প্রবন্ধের এই গঠন বৈশিষ্ট্য অনুসৃত হয়নি। শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর আঙ্গিক-বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে যথার্থই বলেছেন : “গোধূলি সন্ধ্যায় একখণ্ড ক্ষুদ্রতর মেঘ যেমন দেখিতে দেখিতে সমস্ত আকাশ পরিব্যাপ্ত করে, ইহার চারিদিকে যেমন বর্ণালীমায়া অদৃশ্য চিত্রকরের সমাবেশ-সুষমার এবং স্বপ্নলোকের সুসম্বদ্ধ চিত্ররূপে প্রতিভাত হয়, কমলাকান্তের প্রবন্ধগুলির মধ্যেও তেমনি ভাবোচ্ছ্বাসের একটি বিন্দু মনোলোকে ঘন হইয়া উঠে, নানা বর্ণের সংমিশ্রণে নানা সুরের সমবায়ে একটি অপরূপ সত্তা গ্রহণ করে এক অন্তঃসঙ্গতি ও প্রাণলীলার স্পন্দনে একটি চিরন্তন অধ্যাত্ম সত্যরূপে অন্তরে প্রতিষ্ঠিত হয়। মনের একটি আকুতি, বেদনার একটি স্পন্দন, কল্পনার একটি উচ্ছ্বাস, জীবনানুভূতির একটি তরঙ্গলীলা বঙ্কিমের ভাবলোকে একটি সুষ্ঠু অবয়বে সংহত হয়, একটি অলক্ষ্য যোগসূত্রের টানে নানা সমধর্মী চিন্তাভাবনাকে আকর্ষণ করিয়া নিজের অঙ্গীভূত করে ও পরিশেষে একটি নানাতন্ত্রী সমন্বিত সুরসঙ্গতিতে (harmony) পরিণত হইয়া অন্তর গভীরে একটি অপরূপ সংগীতের অনুরণন তুলিতে থাকে।”


‘কমলাকান্তের দপ্তর’-এর ‘পতঙ্গ' রচনাটির সূচনায় কমলাকান্ত বলেছে, নসীরামবাবুর বৈঠকখানায় সেজ জ্বলছে, তার পাশে সে মোসায়েবি ধরনে বসে আছে, বাবু দলাদলির গল্প বলছেন, সে আফিম চড়িয়ে ঝিমোচ্ছে, দলাদলিতে চটে গিয়ে মাত্রা চড়িয়ে ফেলেছে। সেই সম্পর্কে সে এই নৈয়ায়িক ব্যাখ্যা দিয়েছে, এই অখিল ব্রহ্মাণ্ডের অনাদি ক্রিয়াপরম্পরার একটি ফল হিসেবেই কমলাকান্তকে ঊনবিংশ শতাব্দীতে জন্মগ্রহণ করে আজ রাত্রিতে নসীরামবাবুর বৈঠকখানায় বসে মাত্রা বেশি করে ফেলবে, সুতরাং তার অন্যথা করার সাধ্য তার নেই। নিজের আফিমের মাত্রা বৃদ্ধি নিয়ে এই কৌতুক পরিহাসের পরই কমলাকান্ত তার আফিমের নেশার প্রসাদে আলোর উদ্দেশে পতঙ্গের এই ভাষণ শুনতে পেয়েছে। তারা পতঙ্গজাতি, পূর্বাপর আলোয় পুড়ে মরে আসছে, সেই অধিকার তাদের জন্মগত, কিন্তু এখন আলো সেজের মধ্যে প্রবেশ করার জন্য তারা পুড়ে মরতে পারছে না। এই আলো কী সে জানে না, শুধু জানে যে সে তার কামনার বস্তু, জাগ্রতের ধ্যান, নিদ্রার স্বপ্ন, জীবনের আশা ও মরণের আশ্রয়। তাকে সে কোনোদিন জানতে পারবে না, জানতে চায়ও না, যে দিন জানবে সেইদিনই তার সুখ যাবে, কাম্যবস্তুর স্বরূপ জানলে কার সুখ থাকে। পতঙ্গ চলে যায়, নসীরামবাবু কমলাকান্ত বলে ডাকলে তাকিয়ে দেখতেই কমলাকান্তের মনে হল, একটা বৃহৎ পতঙ্গ বালিশে ঠেসান দিয়ে তামাক টানছে এবং চোঁ বোঁ করে কি যেন বলছে। এই বিচিত্র ও উদ্ভট কল্পনার পরই কমলাকান্ত এই তত্ত্বভাবনা প্রকাশ করে—মানুষ মানেই পতঙ্গ, – ধর্ম, মান, জ্ঞান, রূপ, ইন্দ্রিয় প্রভৃতি এক একটি বাসনা-বহ্নিতে পুড়ে মরতে চায়, কিন্তু সেজের কাচের মতো সংসারের নানা বাধার আবরণে ঠেকে গিয়ে পারে না। আমরা বহ্নি তথা ধর্ম, ঈশ্বর, জ্ঞান, স্নেহ প্রভৃতি কি জানি না। বিজ্ঞান দর্শন, ধর্মশাস্ত্র ও কাব্য তার ব্যাখ্যা দিতে পারেনি। তবু সেই অলৌকিক, অপরিজ্ঞাত পদার্থকে কেন্দ্র করে আমরা ঘুরে বেড়াই, আমরা পতঙ্গ ছাড়া আর কি? এই সমস্ত প্রসঙ্গ এবং হাস্যরস থেকে মননশীলতায় ও বিশ্লেষণের যে পরিবর্তন ঘটেছে, তাদের অসংলগ্ন ও বিচ্ছিন্ন মনে হয় না, কমলাকান্তের কল্পনা ও মননের সূত্রে সমস্তই ঐক্যবদ্ধ হয়ে এক অখণ্ড ভাবানুভূতিতে আমার হৃদয়কে স্পন্দিত করে তোলে!


‘আমার মন’ প্রবন্ধে তার মন কোথায় হারিয়ে গেছে, কে তাকে চুরি করেছে, সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে কমলাকান্ত পুরাণাশ্রয়ী বিচিত্র রূপক-কল্পনায় তার ঔদরিকতা নিয়ে কৌতুকরস সৃষ্টি করেছে “মানি, পাকের ঘরে আমার মন পড়িয়া থাকিত। যেখানে পোলাও, কাবাব, কোফতার সুগন্ধ, সেখানে ডেকচী সমারূঢ়া অন্নপূর্ণার ফুটফুট-বুটবুট-টকবকো ধ্বনি, সেইখানে আমার মন পড়িয়া থাকিত।” কিন্তু পাকশালাতেও সে তার মন খুঁজে পেল না। তখন বন্ধুর পরামর্শমতো প্রসন্ন গোয়ালিনীর কাছে কমলাকান্ত তার হারানো মনের সন্ধান নিতে গেল। প্রসন্নর সঙ্গে কমলাকান্তের গব্যরসাত্মক প্রণয়ের বিবরণ এবং তার প্রতি তার অনুরাগের এই কারণ নির্দেশ আমাদের মনে বিপুল হাস্যাবেগ জাগিয়ে তোলে : প্রথমত, প্রসন্ন যে দুধ দেয় তা নির্জল ও দামে সস্তা; দ্বিতীয়ত, সে কখনো-কখনো তাকে ক্ষীর, সর, ননী ইত্যাদি বিনামূল্যে দিয়ে যায়; তৃতীয়ত, কমলাকান্ত একদিন তার দপ্তরের কয়েকটি প্রবন্ধ প্রসন্নকে পড়ে শুনিয়েছিল, সে বসে শুনেছিল। এত সব গুণে কোন লেখক বশীভূত না হয়ে পারে। প্রসন্নর গুণের কথা সে আর বেশি কি বলবে, সে তার অনুরোধে আফিম পর্যন্ত ধরেছিল।


কিন্তু প্রসন্নর কাছেও নিজের হারানো মনের সন্ধান না পাওয়ায় কমলাকান্ত পথে বেরিয়ে আসে, কলসী কাঁখে পথচারিণী এক যুবতীকে দেখতে পায়, তার রূপলাবণ্যের তরঙ্গকে উচ্ছ্বলিত হতে দেখে ভাবে, সে-ই তার মন চুরি করেছে। কমলাকান্তকে তার পিছু নিতে দেখে তরুণীটি ঈষৎ রুষ্ট হয়ে তার কারণ জানতে চায়। কমলাকান্ত বলে, সে তার মন চুরি করেছে। যুবতী কটূক্তি করে গালি দিল, বলল, সে চুরি করেনি, তার ভগিনী তাকে যাচাই করতে দিয়েছিল, সে দর কষে ফেরত দিয়েছে। কমলাকান্তের এই বিড়ম্বনাও কৌতুকাবহ। কমলাকান্তের মাধ্যমে হাস্যরসের এই আয়োজনে কোনো ধরনের ইন্দ্রিয়সুখই যে মানুষের মনের ধ্রুব আশ্রয় নয়, সেই ইংগিত দিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র পরবর্তী অংশে মননদীপ্ত আলোচনা ও বিশ্লেষণের পটভূমি গড়ে তুলেছেন। এই অংশে পরোপকারই যে মানুষের স্থায়ী সুখের একমাত্র উপায়, গভীর অন্তর্দৃষ্টির সঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্র বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন। তারপরেই আমরা পাই কমলাকান্তের এই উক্তি : “আমি মরিয়া ছাই হইব, আমার নাম পর্যন্ত লুপ্ত হইবে, কিন্তু আমি মুক্তকণ্ঠে বলিতেছি, একদিন মনুষ্য মাত্রে আমার এই কথা বুঝিবে যে, মনুষ্যের স্থায়ী সুখের অন্য মূল নাই।” এখানে আমরা মানব হিতৈষণার দর্শনকে ব্যক্তিগত উপলব্ধির আবেগময় কণ্ঠস্বরে প্রাণবন্ত সত্য হয়ে উঠতে দেখি। পরবর্তী অংশে আমরা পাই ইংরেজদের রেলওয়ে, টেলিগ্রাফ প্রভৃতি স্থাপনের মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষের বৈষয়িক সমৃদ্ধির আয়োজনে মহোমুগ্ধ ইংরেজি শিক্ষিত বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের প্রতি এই বিরূপ ও ধিক্কার : “টাকা বাড়াও, টাকা বাড়াও, রেলওয়ে টেলিগ্রাফ অর্থ-প্রসূতি, ও মন্দিরে প্রণাম কর। যাতে টাকা বাড়ে, এমন কর; শূন্য হইতে টাকা বৃষ্টি হইতে থাকুক। টাকার ঝনঝনিতে ভারতবর্ষ পুরিয়া যাউক। মন। মন আবার কি?” প্রথম অংশের হাস্যপরিহাস, দ্বিতীয় অংশের মননশীলতা ও আবেগ এবং তৃতীয় অংশের তীক্ষ্ণ বিদ্রূপ...... এ সমস্তই কমলাকান্তের মাধ্যমে এক অন্তলীন ঐক্যসূত্রে গ্রথিত হয়ে বঙ্কিমচন্দ্রের মানব প্রীতির ভাবনাকে এক অপূর্ব হৃদয়গ্রাহী রূপ দান করেছে।


‘বড়বাজার’ প্রবন্ধটির সূচনায়ও কমলাকান্ত নিজেকে নিয়ে কৌতুক পরিহাস করেছে। প্রসন্ন গোয়ালিনী তাকে এতদিন দুধ, দই, ক্ষীর, সর, ননী দিয়ে আসছিল। আহারকালে কমলাকান্ত মনে করত, প্রসন্ন এই দানের বিনিময়ে পরকালে সদ্‌গতির কামনায় অত্যন্ত পুণ্য সঞ্চয় করছে। সে ভোজনশেষে প্রতিদিন প্রসন্নর পরকালে অক্ষয় স্বর্গ এবং ইহকালে মৌতাত বৃদ্ধির জন্য দেবতার কাছে প্রার্থনা করত। কমলাকান্তের এই আত্মপ্রসাদ অত্যন্ত কৌতুকাবহ সন্দেহ নেই। প্রসন্ন এই সমস্ত দুগ্ধজাত দ্রব্যের জন্য মূল্য চাওয়ায় কমলাকান্ত বিস্ময়ে, ক্ষোভে ও বেদনায় অত্যন্ত বিচলিত হয়। তার সেই প্রতিক্রিয়ার বিবরণেও আমরা হাসি সংবরণ করতে পারি না প্রথম দিন প্রসন্ন যখন মূল্য চাইল কমলাকান্ত হেসে উড়িয়ে দিল, দ্বিতীয় দিনে বিস্মিত হল, তৃতীয় দিন, গালি দিল। প্রসন্ন দুধ দেওয়া বন্ধ করে দিল। তাতে সে গভীরভাবে বিচলিত হল 'কি ভয়ানক। এতদিনে জানিলাম, মনুষ্যজাতি নিতান্ত স্বার্থপর; এতদিনে জানিয়াছি যে, সে সকল আশা ভরসা সযত্নে হৃদয়ক্ষেত্রে রোপন করিয়া বিশ্বাস জলে পুষ্ট করা সকলই বৃথা।.....হায়। মনুষ্যজাতির কি হইবে! হায়, অর্থলুব্ধ গোয়ালা জাতিকে কে নিস্তার করিবে! হায়। প্রসন্ন নামে গোয়ালার কবে গোরু চুরি যাবে।” অতঃপর মনের দুঃখে কমলাকান্ত আফিম চড়ায়, তার প্রসাদে এই পৃথিবীকে একটি বৃহৎ বাজাররূপে দেখতে পায় সেখানে রূপ, বিদ্যা, সাহিত্য, যশ প্রভৃতি সব কিছুরই কেনা-বেচা চলছে। কমলাকান্তের কল্পনার এই বাজারের দৃশ্যগুলি আমাদের সামাজিক জীবনের তীক্ষ্ণ বিদ্রুপাত্মক বিশ্লেষণ, প্রথম অংশের পরিহাস থেকে এই অংশে আমরা সহজেই পৌঁছে যাই। কমলাকান্তের মনন-কল্পনাও জীবনের গভীরতম সত্য সন্ধানের আকুলতার সূত্রে প্রসঙ্গ ও প্রকাশভঙ্গির পরিবর্তন সহজেই সাধিত হয়।


ড: শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় যথার্থই বলেছেন, ‘কমলাকান্তের দপ্তর-এ’ বঙ্কিমের সমস্ত মনন এসেছে কমলাকান্তের আধ-পাগলা, জীবন রহস্যের তির্যক পথ বেয়ে, যুক্তিধর্মী আলোচনার সকলের চলা রাজপথ দিয়ে নয়। ‘বিড়াল’ প্রবন্ধে পাণ্ডিত্যপূর্ণ তথ্যনিষ্ঠ যুক্তি সমাবেশ ও বিশ্লেষণের দ্বারা সমাজতন্ত্রবাদ প্রতিষ্ঠিত করা হয়নি, এটি নিতান্ত অপ্রত্যাশিতভাবে এক খেয়ালী কল্পনার এলোমেলো বাতাসে উড়ে এসে পড়েছে। কিন্তু আসার পর আমাদের সন্দেহাতীতভাবে উপলব্ধি করতে হয়, কোনো সমাজবিজ্ঞানী বা অর্থনীতিবিদ তাকে আমাদের অন্তরে এত গভীরভাবে প্রোণিত করে দিতে পারতেন না। কোথায় চারপাইয়ে উপবিষ্ট, নৈশ আহারের জন্য প্রতীক্ষমান নিজেকে ওয়াটার্ন যুদ্ধজয়ী নেপোলিয়নরূপে এবং ওয়েলিংটনের মার্জারত্ব প্রাপ্তির কল্পনায় আত্মপ্রসাদস্ফীত, বিভোর কমলাকান্ত একদিকে দুধের মালিক প্রসন্ন ও অন্যদিকে তার জন্য রক্ষিত দুগ্ধপানকারী মার্জার, আর কোথায় সমাজতন্ত্র সম্পর্কিত আলোচনা ও বঞ্চিত দরিদ্রের ধনীর কাছ থেকে‌ চৌর্যবৃত্তির সাহায্যে ক্ষুধা দূর করার অধিকারের উচ্চকণ্ঠ ঘোষণা। প্রারম্ভ ও পরিণতির মধ্যে এই অভাবনীয় অসংগতি বঙ্কিমচন্দ্রের কল্পনা শক্তির সাহায্যেই সমাধান লাভ করেছে, কমলাকান্তের আফিমের প্রসাদলব্ধ কল্পনায় বিড়ালকে সমাজতন্ত্রের প্রবক্তা এবং কমলাকান্তকে ধনতন্ত্রের প্রতিনিধিতে রূপান্তরিত হতে দেখে আমরা বিন্দুমাত্র অসংগতিবোধে পীড়িত হই না।


বঙ্কিমচন্দ্রের দেশাত্মবোধ 'আমার দুর্গোৎসব' প্রবন্ধে গীতিকবিতার আবেগময় রূপে প্রকাশিত হয়েছে। সপ্তমী পূজার দিন কে তাকে এত আফিম চড়াতে বলল, কেন সে আফিম খেল, কেন প্রতিমা দেখতে গেল, বা কখনও দেখবে না তা কেন দেখল, এ কুহক কে দেখাল—এই প্রস্তাবনার পরই কমলাকান্ত তার আফিমের নেশাঘটিত কল্পনার এই দৃশ্যকে দেখতে পেয়েছে : দিগন্ত ব্যাপ্ত করে কালের স্রোত, প্রবল বেগে ছুটে চলেছে, সে ভেলায় চড়ে ভেসে যাচ্ছে; অনন্ত, অকুল, অন্ধকারে বাত্যা-বিক্ষুব্ধ তরঙ্গ সঙ্কুল সেই স্রোতে মধ্যে মধ্যে উজ্জ্বল নক্ষত্রগুলি একবার উদিত হচ্ছে, নিভছে, আবার উঠছে–“আমি নিতান্ত একা একা বলিয়া ভয় করিতে লাগিল—নিতান্ত একা মাতৃহীন— মা! মা! করিয়া ডাকিতেছি। আমি এই কাল-সমুদ্রে মাতৃ-সন্ধানে আসিয়াছি। কোথা মা! কই আমার মা? কোথায় কমলাকান্ত প্রসুতি বঙ্গভূমি!” পরাধীন জীবনের তীব্র বেদনায় কমলাকান্তের এই উক্তিতে তার স্রষ্টার দেশজননীর সন্ধান হাহাকারের মতোই ধ্বনিত হয়েছে, ব্যক্তিগত অনুভূতির সেই আবেগঘন প্রকাশে এই উক্তি গীতিকবিতাধর্মী হয়ে উঠেছে, আমাদের হৃদয়ের প্রতিটি তন্ত্রীতে তার সূত্র অনুরণিত হয়। কমলাকান্ত দেখতে পেয়েছে, সেই তরঙ্গ সংকুল জলরাশির ওপর দূরপ্রান্তে সুবর্ণমণ্ডিতা, সপ্তমীর শারদীয় প্রতিমা, তার জননী, জন্মভূমি এখন কালগর্ভে নিহিতা। দেশজননীর এই ঐশ্বর্য সমুজ্জ্বল মূর্তির ধ্যান-কল্পনা যে কমলাকান্তের স্রষ্টার পরাধীনতার যন্ত্রণা-মথিত সত্তার মর্মমূল থেকে উৎসারিত আমরা কমলাকান্তের এই উক্তিতে অনুভব করি “এ মূর্তি এখন দেখিব না— আজি দেখিব না, কিন্তু একদিন দেখিব— দিগ্‌ভুজা, নানা প্রহরণপ্রহারিণী, শত্রুমর্দিনী বীরেন্দ্রপৃষ্ঠবিহারিণী–দক্ষিণে লক্ষ্মী ভাগ্যরূপিণী, বামে বিদ্যাজ্ঞানমূর্তিময়ী, সঙ্গে বলরূপী কার্তিকেয়, কার্যসিদ্ধিরূপী গণেশ, আমি সেই কালস্রোতমধ্যে দেখিলাম, এই সুবর্ণময়ী বঙ্গপ্রতিমা”—ব্যক্তি হৃদয়ের তীব্র আবেগে দুর্গা প্রতিমার চিত্রকল্পে এবং কাটাকাটা বাক্য ও বাক্যাংশের ছন্দস্পন্দনে এই অংশটিতে বঙ্কিমের দেশাত্মবোধের প্রকাশ যে গীতিকবিতার বৈশিষ্ট্যে মণ্ডিত হয়েছে, আমরা অনুভব না করে পারি না।