“সোনার কাঠি-রুপোর কাঠি সব কিছুই তাই কৃষিসম্পদ ; এই সোনার কাঠি, রুপোর কাঠি এখনও যেহেতু ধরাছোঁয়ার বাইরে আমাদের পরিকল্পনার ব্যর্থতা সর্বত্র এক অপ্রচ্ছন্ন নৈরাশ্যের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ পাচ্ছে।”—আলোচনা করো।

“কিন্তু কৃষির ব্যাপার সম্পূর্ণ অন্যরকম"- কোন প্রসঙ্গে একথা বলা হয়েছে? 'অন্যরকম'-বলতে এখানে কী বলা হয়েছে?

সোভিয়েট রাশিয়ায় অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় যে বিনিয়োগের হার বৃদ্ধি পেয়েছে, তার গুরুত্ব বেশি পড়েছে শিল্পের ওপর। আর্থিক বিনিয়োগ যত বাড়ছে, শিল্পে তত বেশি যন্ত্রপাতি কেনা বেড়েছে। আত্মসুখ ও আনন্দ সম্ভোগের জন্য বিনিয়োগের সিংহভাগ ভোগ্যপণ্য ক্রয়ে ব্যয় করা হয়নি, তার জন্য দেশবাসী কৃচ্ছসাধন করেছে। বর্তমানের কৃচ্ছসাধনের ফলে অস্তিমে তারা অপরূপ সমৃদ্ধি পেয়েছে। এই কৃচ্ছ্রসাধনের অর্থ খাদ্য, পরিধেয় এবং বিলাসব্যসনের সামগ্রীর উৎপাদন বৃদ্ধি হয়নি। নিবৃত্তির মন্ত্র শিখে বিনিয়োগের পথ সুগম করার যাদু সোভিয়েট রাশিয়া দেখিয়েছে। শিল্পে উৎপাদন বাড়লেও কৃষিতে অমনোযোগের জন্য উৎপাদন বাড়েনি। শিল্প-উৎপাদনের প্রক্রিয়াটি সহজ সরল। কিন্তু কৃষিসমস্যা অনেক বেশি জটিল। দু-তিন হাজার কারখানার সুষ্ঠু পরিচালনা করতে পারলেই উৎপাদন বাড়বে। উৎপাদনের প্রক্রিয়া আবেগহীন ব্যাপার। মূলধন বিনিয়োগ করে বাণিজ্য-ইচ্ছুক কোনো মালিক যন্ত্রপাতি কিনে শ্রমিকদের মজুরি দিয়ে পণ্য উৎপাদন করবে এবং পণ্য বিক্রয় করে লাভের ব্যবস্থা করবেন। এই প্রক্রিয়াটি সহজ ও ঋজু। কিন্তু কৃষিক্ষেত্রের ব্যাপারটা সেরকম নয়। শিল্প উৎপাদনের প্রক্রিয়া আলোচনা করতে গিয়ে লেখক এই কথা বলেছেন।


কৃষিকর্মের ক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধি শিল্প-বিনিয়োগ অপেক্ষা জটিলতর। শিল্প-উৎপাদনের ক্ষেত্রে যন্ত্রের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। যন্ত্রের কার্যকারিতার জন্য উৎপাদন সহজ হয়ে ওঠে। উৎপাদিত শিল্পদ্রব্যের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ এই কারখানাগুলিতে তৈরি হচ্ছে। সুতরাং দু-তিন হাজার কারখানার সুষ্ঠু পরিচালনা করতে পারলেই উৎপাদনের প্রগতি অক্ষুণ্ণ থাকবে। কিন্তু কৃষির ক্ষেত্রে ব্যাপারটা সেরকম নয়। কৃষিকর্ম দেশ জুড়ে ব্যাপ্ত। পল্লিগ্রামের সংখ্যাও লক্ষ লক্ষ। একই গ্রামে হয়তো দু-তিনশো কৃষিজীবী, তারা মনের দিক থেকে সার্বভৌম, কিন্তু ইচ্ছার দিক থেকে স্বতন্ত্র। প্রত্যেকের ইচ্ছা স্বতন্ত্র। প্রত্যেককে একই চেতনার বিদ্যুৎ সংযোগে একাত্ম না করতে পারলে কৃষি-উৎপাদন বৃদ্ধি দুরাশা মাত্র। সোভিয়েট দেশ ভুল করেছিল এই কথা ভেবে যে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সবই যখন রাষ্ট্রায়ত্ত হতে চলল, তখন কৃষকের মনের স্বাতন্ত্র্যকে তারা বুঝতে চায় নি। জমিদার ছিল শোষণের প্রতীক। জমিদারদের উচ্ছেদ ঘটানোর সঙ্গে সঙ্গে দেশসুদ্ধ কৃষক রাষ্ট্রের বংশবদ হয়ে যায় না। ভূমিস্বত্ব সম্পর্কে চাষিদের মনে মোহ আছে, রাষ্ট্রের সাক্ষাৎ হস্তক্ষেপে এই মোহ ঘুচবে না। জমি সম্পর্কে চাষিদের মনে আছে দুর্বলতা। কারণ কৃষকের জমি একদিকে যেমন কৃষিজমি, অন্যদিকে তেমনি বসতির ভিটেমাটিও। এই কারণে জমি সম্পর্কে কৃষিজীবীর মনে এক ধরনের মোহ, আবেগ বা দুর্বলতা দেখা দেয়। জমি রাষ্ট্রীকৃত হয়েছে। অর্থাৎ তাতে কৃষকের অধিকারও সমপরিমাণে। কিন্তু এই যুক্তি কৃষকদের কাছে দূরাগত। চাষিরা তাই রাষ্ট্রের ডাকে সব সময় সায় দেয় না। সোভিয়েট দেশে এই সায় পাওয়ার ব্যাপারটা অস্পষ্ট হয়ে যাওয়াতে উৎপাদনও স্তিমিত হয়ে আসছে। চাষিদের মন হয়েছে অসেতুসম্ভব। তার ফলে মনের আদানপ্রদান বন্ধ হয়ে গেছে। কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যরা সর্বজ্ঞ নন, তাই কোনো গ্রামের প্রয়োজনের রূপ কী, সে সম্পর্কে তাঁরা সর্বার্থে ওয়াকিবহাল নন। এদিক থেকে দেখলে গ্রামের যা প্রয়োজন, সে তুলনায় কর্তৃপক্ষের অনুজ্ঞা তাদের কাছে যথোপযুক্ত হয় না। এই ব্যবধানও কৃষিসমস্যার এক দিক।




“সোনার কাঠি-রুপোর কাঠি সব কিছুই তাই কৃষিসম্পদ ; এই সোনার কাঠি, রুপোর কাঠি এখনও যেহেতু ধরাছোঁয়ার বাইরে আমাদের পরিকল্পনার ব্যর্থতা সর্বত্র এক অপ্রচ্ছন্ন নৈরাশ্যের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ পাচ্ছে।”—আলোচনা করো।

কৃষিসম্পদ জাতীয় জীবনের মেরুদণ্ড। কৃষি-উৎপাদন না বাড়লে কোনো দেশের উন্নতি সম্ভব নয়। রাশিয়া, চিন বা পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে আর্থিক প্রগতি সম্ভব হয়েছে কেবলমাত্র কৃষিক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সুগভীর মনোযোগ ও নজরদারির জন্য। কৃষিপণ্যে উদ্বৃত্ত প্রয়োজনীয়। সেই উদ্বৃত্তের অভাবে শিল্প শ্লথগতি হবে, বৈদেশিক মুদ্রার অনটন অব্যাহত থাকবে। কিন্তু ভারতবর্ষে সেই প্রয়োজনীয় উন্নতি সম্ভব হয়নি। দেশের শতকরা সত্তরভাগ কৃষিজীবী কৃষি থেকে জীবিকা আহরণ করেন। “সুতরাং চাষবাসের হাল না ফিরলে তাঁদের অবস্থাও ফেরবার নয়। তাঁদের অবস্থা উন্নত হলেই শিল্পেও উদ্দামগতি আসবে, তার আগে নয়।” কৃষির প্রসার না ঘটলে শিল্পদ্রব্য কেনার সংগতিও হবে না। কৃষিগত উদ্বৃত্ত থেকে দেশের আপামর জনসাধারণের খাদ্য আসবে। একই উদ্বৃত্ত মেটাবে কাঁচামালের চাহিদা।


কিন্তু কৃষিসমস্যা সমাধান করে উৎপাদন বৃদ্ধি করার প্রয়াসকে ভারতবর্ষের সরকার যথেষ্ট গুরুত্ব দেয় নি। তাই কৃষিক্ষেত্রে যা বিনিয়োগ হয়েছে, তার লভ্যাংশ গিয়ে পৌঁছেছে মহাজনদের হাতে, উচ্চবিত্ত কৃষকদের খাতে। ভূমিসংস্কার আইন হয়েছে, কিন্তু তৎসত্ত্বেও সাধারণ মজুর বা ভাগচাষিদের মনে হতাশা নেমে এসেছে। কারণ লাভের মধু সবই উচ্চবিত্ত চাষিদের অধিকারে গেছে। উৎপাদন যজ্ঞ এক মহাব্রত। সেই মহাব্রতে যুক্ত হতে গেলে শ্রমজীবী-কৃষিজীবীর মানসিক সমর্থন পেতে হবে। উচ্চবিত্ত কৃষকের সংখ্যা হয়তো সমগ্র কৃষককুলের এক-দশমাংশ। তবু তারাই লাভবান হচ্ছে। শাঁসালো মহাজন চাষিরাই সরকারি প্রসাদ ভোগ করে নিচ্ছে। রাষ্ট্র নানারকম ব্যবস্থা নিয়েছে। সেচের জল বাড়াবার জন্য, উন্নত কৃষিপ্রণালী শেখাবার জন্য, শস্যের উচিত মূল্য বজায় রাখবার জন্য, উন্নত বীজশস্য এবং উৎকৃষ্ট সার—সব কিছু আয়োজন করা সত্ত্বেও কৃষির ব্যাপ্তি হয় নি। কেন, এই প্রশ্ন যথার্থ। রাষ্ট্রের সচেতন সহযোগিতা বড়ো কম হয়নি। স্বাধীনতার পর থেকে রাষ্ট্রের দান-অনুদান কৃষিক্ষেত্রে যথেষ্ট। ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত কৃষিসম্প্রসারণে বিনিয়োগ হয়েছে বছরে অন্তত তিন হাজার কোটি টাকা। কৃষকদের ওপর করভার চাপিয়ে এই বিনিয়োগ সংগ্রহ হয়নি। তবু কৃষি ও কৃষকের উন্নতির ক্ষেত্রে ১৯৫১ সাল থেকে যথোচিত নয়। উৎপাদন বিশেষভাবে বাড়েনি, উৎপাদন ১৯৫২ সালের তুলনায় শতকরা তিরিশ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান হারের ফলে কৃষকের সংখ্যাও বেড়েছে। তার ফলে কৃষকের গড় উৎপাদনের সূচক আসলে হ্রাসপ্রাপ্ত হয়েছে। উৎপাদন সম্ভব হয়েছে আবাদি জমির পরিমাণ বাড়িয়ে, কৃষিপ্রণালীর উৎকর্ষ এতে সাহায্য করেনি। স্বাধীনতার পর আমাদের খাদ্যশস্যের ঘাটতি ছিল সম্পূর্ণ চাহিদার শতকরা পাঁচ ভাগ পরিমাণ। তার মধ্যে অনেক অধ্যবসায় আলোচনা-আন্দোলন ঘটে গেছে। তবু ঘাটতির আনুপাতিক অঙ্ক একই আছে। ফলে বিদেশ থেকে প্রতি বছর খাদ্যশস্য আমদানি করতে হয়। উৎপাদনে স্বনির্ভর হতে শেখেনি ভারতবর্ষ। কিন্তু শঙ্কার কথা, দুর্ভাবনার কথা এই যে, পরদেশিদের মহানুভবতার স্রোতে একদিন হয়তো ভাঁটা পড়বে। তখন দেশের আর্থিক প্রগতি কেবল ক্ষুণ্ণ হবে না, অস্তিত্বও বিপন্ন হতে পারে। যে কৃষিকে লেখক সোনার কাঠি-রুপোর কাঠি বলেছেন, পরিকল্পনার ব্যর্থতা এক অপ্রচ্ছন্ন নৈরাশ্য সৃষ্টি করেছে।


এই নৈরাশ্যের পশ্চাতে আছে আমাদের গ্রামসমাজের কাঠামোগত ত্রুটি। শ্রেণি-বৈষম্যে চিহ্নিত গ্রামসমাজে মহাজন-উচ্চচাষি, মধ্যচাষি এবং ভাগচাষিরা নানা শ্রেণিতে বিভক্ত। একে লেখক বলেছেন “একটা মস্ত ফাঁকি”। তার ফলে যে সব সাহায্য বিলোনো হচ্ছে, তা অর্ধপথে লক্ষভ্রষ্ট হচ্ছে। বর্ণভেদের অনাচার গ্রাম সমাজকে দুষিত করেছে। নানাভাবে বিত্তবানই সমৃদ্ধতর হচ্ছে। কারণ কৃষিপ্রসারের উদ্দেশ্যে অর্থানুকূল্যে যা হয়, তা বিত্তবানদের হাতে গিয়েই পড়বে। কৃষিক্ষেত্রে উদ্বৃত্ত ঘোষণা সত্ত্বেও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ধনবণ্টনের অসাম্যই প্রাধান্য পেয়েছে। এইভাবে কৃষিসম্পদের মহার্ঘত্ব স্বীকার করে নিয়েও কৃষকের মনে যে নৈরাশ্য তা দিয়ে নতুন ভুবন গড়ে তোলা যাবে না। “উৎপাদন উচ্চকিত বিপ্লব” আনতে গেলে এই মনস্তাত্ত্বিক দিকও অনুধাবনের যোগ্য।