“এ পূজার তাম্রশ্মশ্রুধারী ইংরেজ নামে ঋষিগণ পুরোহিত; এডাম স্মিথ পুরাণ এবং মিল তন্ত্র হইতে এ পূজার মন্ত্র পড়িতে হয়; এ উৎসবে ইংরেজি সম্বাদপত্রসকল ঢাকঢোল, বাঙ্গালা সম্বাদপত্র কাঁসিদার; শিক্ষা ইহাতে নৈবেদ্য এবং উৎসাহ ইহাতে ছাগবলি। এ পূজার ফল ইহলোক ও পরলোকে অনন্ত নরক।”—উক্তিটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো।

‘কমলাকান্তের দপ্তর'-এ ‘আমার মন' রচনাটিতে কমলাকান্তের আত্ম-উপলব্ধির যে পরিচয় ফুটে উঠেছে তা বিশদভাবে আলোচনা করো।

এই উক্তিটি বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কমলাকান্তের দপ্তর’-এর অন্তর্ভুক্ত ‘আমার মন’ নিবন্ধ থেকে উদ্ধৃত হয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্র এই রচনায় কমলাকান্তের কৌতুক-পরিহাস-তীক্ষ্ণ সমালোচনা ও উপলব্ধির মধ্য দিয়ে মানব জীবনের চরম চরিতার্থতার সত্যকে বাণীরূপ দিয়েছেন। কমলাকান্ত তার হারানো মনের সন্ধানে এই সত্য উপলব্ধি করেছে, এই সংসারে মানুষ বোধহয় শুধু মন বাঁধা দিতে, অপরকে ভালোবাসতেই আসে। সে চিরকাল নিজেরই রইল, পরের হল না, সেইজন্যই পৃথিবীতে তার সুখ নেই। যে সমস্ত লোক নিতান্ত আত্মপ্রিয়, তারাও বিয়ে করে সংসারী হয়ে, স্ত্রীপুত্রের কাছে আত্মসমর্পণ করে সুখী হয়, নচেৎ তারা কিছুতেই সুখী হত না। বস্তুত পরের জন্য আত্মবিসর্জন ছাড়া পৃথিবীতে স্থায়ী সুখের অন্য কোনো মূল্য নেই। ঐশ্বর্য, খ্যাতি প্রভৃতি ইন্দ্ৰিয়াদিলব্ধ সুখ আছে বটে। কিন্তু তা স্থায়ী নয়। ক্রমাগত অভ্যাসে এই সমস্ত বস্তু থেকে লব্ধ সুখানুভূতি হ্রাস পেতে পেতে একেবারে লোপ পায়। অন্যদিকে তারা সুখদায়ক না হলেও তাদের অভাবে গুরুতর অতৃপ্তি দেখা দেয় এবং তৃপ্তিবিহীন আকাঙ্ক্ষায় যন্ত্রণা হয়। পৃথিবীতে যে সমস্ত বিষয় কাম্যবস্তুরূপে পরিচিত, সমস্তই অতৃপ্তিকর এবং দুঃখের মূল।


পরসুখবর্ধন ছাড়া যে মানুষের স্থায়ী সুখের অন্য কোনো মূল নেই, এই কথাটি প্রাচীন, প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে ভারতবর্ষে বুদ্ধদেব সেই সত্য নানাভাবে প্রচার করে গেছেন। তারপরও শত সহস্র লোকশিক্ষক শত সহস্রবার এই শিক্ষা দিয়ে গেছেন। তবু কিছুতেই লোকে শেখে না, আত্মপ্রিয়তার মোহজাল কাটিয়ে উঠতে পারে না। তার ওপর ঊনবিংশ শতাব্দীতে ভারতবর্ষে ইংরেজি শাসন, ইংরেজি সভ্যতা ও শিক্ষার প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বাহাসম্পদের ওপর অনুরাগ এসে দেশকে উৎসন্নে দিয়েছিল। ইংরেজ জাতি বাহাসম্পদ অত্যন্ত ভালোবাসে, এটাই ইংরেজি সভ্যতার প্রধান চিহ্ন, তাঁরা এসে এদেশের বাহাসম্পদসাধনেই নিযুক্ত, ইংরেজি শিক্ষিত সম্প্রদায় তাকেই ভালোবেসে ভারতীয় সাধকদের প্রচারিত মনুষ্যত্বের সেই আদর্শ বিস্মৃত হয়েছিল। তারা বাহ্যসম্পদের আরাধনাকেই জীবনের মূল মন্ত্ররূপে গ্রহণ করেছিলেন। আমাদের দেশে বিভিন্ন দেবদেবীর যে পূজা হয়, তাতে পুরোহিতেরা পুরাণ ও তন্ত্র থেকে মন্ত্র উচ্চারণ করেন। সেই যুগে ইংরেজি-শিক্ষিত বাঙালিরা তাদের বাহ্যসম্পদের পূজায় ইংরেজদেরই পুরোহিতরূপে বরণ করেছিল, আর সেই পূজার মন্ত্র আহরণ করেছিল অ্যাডাম স্মিথ, জেম্‌স্‌ মিল, জন স্টুয়ার্ট মিল প্রভৃতির রচনা থেকে।


ইংল্যান্ডের অষ্টাদশ শতাব্দীর বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথ আধুনিক অর্থনীতি শাস্ত্রের প্রবর্তক। সমাজের প্রতিটি ব্যক্তি আর্থিক লাভের প্রেরণায় নিজ নিজ কর্মে রত, এই সূত্রটিকেই স্মিথ তাঁর অর্থনৈতিক চিন্তার কেন্দ্রস্থলে স্থাপন করেছিলেন। রাষ্ট্রের নানা বাধা-নিষেধ বিভিন্ন ব্যক্তির মধ্যে অবাধ প্রতিযোগিতার পথ অবরুদ্ধ করবে না, পুঁজি বা মূলধন বিনিয়োগকারী, শ্রমিক প্রভৃতির স্বাভাবিক শ্রমবিভাগ এবং অর্থনৈতিক আদান-প্রদানের মধ্য দিয়েই ব্যক্তিগত ও বিভিন্ন শ্রেণির স্বার্থ একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সংহত ও সমন্বিত হবে এবং দেশের অর্থনৈতিক সম্পদ বৃদ্ধি পাবে, অ্যাডাম স্মিথ বাহাসম্পদের এই তত্ত্বই প্রচার করেছিলেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর ইংল্যান্ডের দার্শনিক জেম্‌স্‌ মিল এবং তাঁর পুত্র বিখ্যাত দার্শনিক ও অর্থনীতিবিদ জন স্টুয়ার্ট মিল অষ্টাদশ শতাব্দীর বিখ্যাত ইংরেজ দার্শনিক বেস্থামের অনুসরণে ইউটিলিটেরিয়ানিজম তত্ত্বকে বা উপযোগবাদকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছিলেন। এই তত্ত্ব অনুযায়ী রাষ্ট্র বা ব্যক্তি যে কারো কোনো আচরণের ন্যায়-অন্যায়ের মানদণ্ড হল অধিকতম সংখ্যক মানুষের অধিকতম পরিমাণ সুখ উৎপাদনের উপযোগিতা; যে আচরণ মানুষের সুখ উৎপাদনে উপযোগী সে আচরণ ন্যায্য, যে আচরণ তার অনুপযোগী তা অন্যায্য। অ্যাডাম স্মিথের অর্থনৈতিক চিন্তা এবং মিলের উপযোগবাদ প্রকৃতপক্ষে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে ও ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ইংল্যান্ডে নবোদ্ভূত ধনতন্ত্রের দর্শনরূপেই দেখা দিয়েছিল। একচেটিয়া অধিকারের সমস্ত বাধানিষেধের গণ্ডি থেকে মুক্ত হয়ে দেশে অবাধ প্রতিযোগিতা ও অর্থনৈতিক লেনদেনের মুক্ত বাজারের প্রতিষ্ঠাই সকলের স্বার্থকে সমানভাবে রক্ষা করবে, বৃহত্তম সংখ্যক মানুষের বৃহত্তম পরিমাণ সুখ (the greatest good of the greatest number) বলতে তাঁর এই ব্যবস্থাকেই বুঝেছিলেন। অর্থাৎ বাহ্যসম্পদ উৎপাদন ও তার বৃদ্ধিই তাঁদের কাছে ছিল মানুষের সুখের চরম কাঠি।


ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলার ইংরেজি-শিক্ষিত সম্প্রদায় অ্যাডাম স্মিথের ওই অর্থনৈতিক চিন্তা এবং জেম্‌স মিল ও জন স্টুয়ার্ট মিলের উপযোগবাদকেই জীবনের আদর্শরূপে গ্রহণ করেছিল। সেই যুগে ইংরেজি ও বাংলা সংবাদপত্র, বক্তৃতা, বিতর্ক ভাষণে সর্বত্রই শুধু বাহ্যসম্পদের প্রশস্তি ধ্বনিত হত। ইংরেজ রাজত্বে বাণিজ্যের প্রসার, রেলওয়ে, টেলিগ্রাফ প্রভৃতির প্রতিষ্ঠা ইত্যাদিতে বাহ্যসম্পদের বিপুল সমারোহপূর্ণ তীব্র আলোকচ্ছটাময় প্রকাশে ইংরেজি শিক্ষিত বাঙালিদের চোখ ধাঁধিয়ে গিয়েছিল, তারা তাকেই সভ্যতার উৎকর্ষের এবং মানব জীবনের সার্থকতার চরম মানদগুরূপে গ্রহণ করেছিল। দেশে সর্বত্র যেভাবে বাহাসম্পদের পূজার মন্ত্র অর্থাৎ প্রশস্তি শোনা যেত, কমলাকান্ত তাকে এই উক্তিতে সার্থকভাবেই প্রকাশ করেছে : “বাহাসম্পদের পূজা কর। হর হর বম্ বম্। টাকার রাশির উপর টাকা ঢাল। টাকা ভক্তি, টাকা মুক্তি, টাকা নতি, টাকা গতি। টাকা ধর্ম, টাকা অর্থ, টাকা কাম, টাকা মোক্ষ! ওপথে যাইও না, দেশের টাকা কমিবে, ওপথে যাও, দেশের টাকা বাড়িবে। বম বম্ হর হর! টাকা বাড়াও, টাকা বাড়াও, রেলওয়ে টেলিগ্রাফ অর্থ-প্রসুতি, ও মন্দিরে প্রণাম কর!” হিন্দুদের দেবদেবীদের পূজায় যেমন পুরোহিত পূজার মন্ত্রোচ্চারণ থেকে আরম্ভ করে অন্যান্য অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন, তেমনি সেকালে ভারতবর্ষে এই বাহাসম্পদের পূজার সমস্ত অনুষ্ঠান ইংরেজরাই পরিচালনা করত, আর মন্ত্র সংগৃহীত হইয়াছিল অ্যাডাম স্মিথ ও মিলদের রচনা থেকে। পুজোয় যেমন প্রধান বাজনা হিসেবে ঢাকঢোল বাজে আর কাঁসিদার কাঁসি বাজিয়ে তাকে অনুসরণ করে, তেমন, এই পূজার প্রশস্তি বা মহিমার সাড়ম্বর প্রচারের মূল ভার গ্রহণ করেছিল ইংরেজি সংবাদপত্রগুলি, আর বাংলা সংবাদপত্রগুলি তার ধুয়ো তুলেছিল, অর্থাৎ তাকে অনুসরণ করেছিল। দেবদেবীর পূজায় ফলমূল-সন্দেশ ইত্যাদি নৈবেদ্যরূপে উৎসর্গ করা হয়, সেইরূপ বাহাসম্পদের পূজায় এদেশের ইংরেজি-শিক্ষিতরা তাদের শিক্ষা ও উৎসাহকে উৎসর্গ করেছিল। পূজায় যেমন ছাগ-বলি দেওয়া হয়, তেমনি বাহ্যসম্পদের পূজায় তারা তাদের হৃদয়কে, হৃদয়ের স্নেহ মমতা প্রীতি প্রভৃতিকে বিসর্জন দিয়েছিল; হৃদয়কে বলি না দিলে বৈষয়িকভাবে সফল হওয়া যায় না।


কিন্তু এই বাহাসম্পদের পূজার ফল কী? ইংরেজদের রেলওয়ে, টেলিগ্রাফ প্রভৃতি বাহাসম্পদের নানা আয়োজন কি মানুষের মনে সুখ বৃদ্ধি করতে পেরেছে, কারো মনের অশান্তির আগুন নিভিয়েছে, যে কৃপণ ধনতৃষ্ণায় দগ্ধ হচ্ছে, তার সেই তৃষ্ণা নিবারণ করতে সক্ষম হয়েছে? ইংরেজদের বাহ্যসম্পদের পূজার মোহান্ধ অনুকরণে পরহিতৈষণার সমস্ত ভারতীয় আদর্শ বিসর্জন দিয়ে তার আরাধনায় মত্ত হয়ে की পেয়েছিলাম? আমরা পেয়েছিলাম শুধু অশান্তি অতৃপ্তির অনির্বাণ দহন, পরস্পরের প্রতি ঈর্ষাবিদ্বেষের বিষজ্বালা, তৃপ্তিবিহীন আকাঙ্ক্ষার তাড়না, এক কথায়, জীবনব্যাপী নরকযন্ত্রণা। বাহাসম্পদ লাভের জন্য যে পাপ, অন্যায়, অনাচার করতে হয়, পরকালেও তার জন্য নরকের অন্তহীন যন্ত্রণাভোগ করতে হয়। কমলাকান্ত যথার্থই বলেছে, বাহ্যসম্পদ পূজার ফল ইহলোকে ও পরলোকে অনন্ত নরক। কমলাকান্তের প্রশ্ন মানব সভ্যতার নিকট চিরন্তন প্রশ্ন—“তোমার বাহ্যসম্পদে কয়জন অভদ্র ভদ্র হইয়াছে? কয়জন অশিষ্ট শিষ্ট হইয়াছে? কয়জন অধার্মিক ধার্মিক হইয়াছে? কয়জন অপবিত্র পবিত্র হইয়াছে? একজনও না? যদি না হইয়া থাকে, তবে তোমার এই ছাই আমরা চাহি না–আমি হুকুম দিতেছি, এই ছাই ভারতবর্ষ হইতে উঠাইয়া দাও।”