বঙ্কিমচন্দ্রের কমলাকান্তের দপ্তরের ‘একা’ রচনাটির ডারবস্তু সংক্ষেপে বিবৃত করে তার রচনাবৈশিষ্ট্য উদাহরণ সহযোগে বিবৃত করো।

একজন পথিক জ্যোৎস্নাপ্লাবিত রাত্রির সৌন্দর্যদর্শনে নিজের আনন্দোচ্ছল মনের সুখমাধুর্য বসন্তের মধুমাসে তার মধুরকণ্ঠে গানে ছড়িয়ে দিয়ে যাবার সময় বহুকালবিস্মৃত সুখস্বপ্নের স্মৃতির মতো ঐ মধুর সংগীত কমলাকান্ত শুনতে পায়, তার সমস্ত হৃদয় আলোড়িত হয়ে ওঠে। নদীতীরে চাঁদের আলোর হাসি, শীর্ণকায়া নীলসলিলা নদী প্রবাহিত, রাজপথে বালক-বালিকা, যুবক-যুবতী, প্রৌঢ়া-বৃদ্ধা শুভ্র চাঁদের আলোয় স্নাত হয়ে আনন্দে মগ্ন; নিরানন্দ শুধু কমলাকান্ত, তাই ওই সংগীতে তার হৃদয়তন্ত্রী বেজে উঠল। এই জনবহুল নগরে আনন্দময় অনন্ত জনস্রোতে সে একা বলেই ওই সংগীতে তার শরীর শিহরিত হয়ে ওঠে। কেউ যেন একা না থাকে, যদি অন্য কেউ কোনো মানুষের প্রেমের অংশীদার না হয়, তবে তার মানবজন্ম নিষ্ফল : ফুল নিজের জন্য ফোটে না। পরের জন্য মানুষকে তার হৃদয় কুসুম প্রস্ফুটিত করতে হবে। কমলাকান্ত তার পাঠকদের উদ্দেশে এই মত উচ্চারণ করে।


কিন্তু একবার মাত্র ওই সংগীত শুনেই তার কেন এত মধুর লাগল কমলাকান্ত তা বলেনি। অনেকদিন আনন্দ থেকে উৎসারিত সংগীত সে শোনেনি, আনন্দ অনুভব করেনি। যৌবনে পৃথিবী যখন সুন্দরী ছিল, তখন কমলাকান্ত প্রকৃতির সমস্ত রূপে সৌন্দর্য ও সংগীতের আস্বাদ পেত, প্রতিটি মানুষের মুখে সরলতা দেখত। তখন সংগীত শুনে আনন্দ হত। পৃথিবী, সংসার, মানবচরিত্র এখনও তাই আছে, কিন্তু তার সেই হৃদয় আর নেই। আজ এই সংগীত শুনে যৌবনের যে অবস্থায় যে সুখে কমলাকান্ত সেই আনন্দ অনুভব করল, তা তার মনে পড়ল, মুহুর্তের জন্য সে আবার তার যৌবন ও সেই আনন্দ ফিরে পেল। সেই ক্ষণিক ভ্রান্তিতেই এই সংগীত তার এত মধুর লাগল। তখন চিত্তের যে প্রফুল্লতার জন্য তার সংগীত ভালো লাগত, এখন তার অভাবেই তা ভালো লাগে না। কমলাকান্ত তার মনের গহনে আত্মগোপন করে কখন সেই বিগত যৌবনসুখ চিন্তা করছিল, সেই সময়ই এই পূর্বস্মৃতিবাহী সংগীত সে শুনতে পায়, তাই সেটি তার এত মধুর বলে বোধ হল।


সেই প্রফুল্লতা, সেই সুখ আর কেন নাই, এই প্রশ্ন কমলাকান্তের মনকে আলোড়িত করে তোলে। সংসারে ক্ষতি অপেক্ষা অর্জন বেশি, আমরা জীবনের পথ যতই অতিবাহিত করি, ততই সুখকর সামগ্রী সঞ্চয় করে চলি। কিন্তু বয়স হবার পর যে আনন্দ হ্রাস পায়, পৃথিবী আর তেমনি সুন্দরী দেখায় না, আগে যা প্রকৃতির সৌন্দর্যের ঐশ্বর্যসম্ভার বলে মনে হয়, এখন তাকে যে বালুকাময় মরুভূমি বলে বোধ হয়, তার কারণ, মানুষ পরিণত বয়সে আশারূপ রঙিন কাচ হারিয়ে বসে। যৌবনে সুখের অর্জনের পরিমাণ যৎসামান্য, কিন্তু তার আশা অপরিমিত। আর মানুষের পরিণত বয়সে অর্জিত সুখ অনেক, কিন্তু সেই ব্রহ্মাগুব্যাপী আশা তার মন থেকে তিরোহিত হয়। তাকে অভিজ্ঞতার মধ্যেই এই কঠিন সত্যের সম্মুখীন হতে হয় যে, এই সংসারচক্রে যখন সে মনে করে সে অগ্রসরমান, তখন প্রকৃতপক্ষে সে শুধু আবর্তনশীল, এই সংসার-অরণ্যে পথ নেই, তার অন্ধকার নক্ষত্রবিহীন, কুসুমেও কীট আছে, মানব হৃদয় আত্মাদরে পরিপূর্ণ, কাচও হীরকের মতো উজ্জ্বল, অর্থাৎ মিথ্যাও সত্যের বেশে সকলের চোখ অন্ধকার রাখে। কমলাকান্তের চিত্ত আর এক ধরনের সংগীত শোনার জন্য ব্যাকুল। নানা বাদ্যধ্বনি সংযোগে, বহুকণ্ঠপ্রসূত পূর্বশ্রুত সেই সংগীত সে আর শুনবে না; সে গায়ক, সে বয়স, সে আশা আর নেই। কিন্তু তার পরিবর্তে সে যা শুনছে তা অধিকতর প্রীতিকর। প্রীতি সংসারে সর্বব্যাপী, ঈশ্বরই প্রীতি, প্রীতিই তার কানে এখনকার সংসার-সংগীত। অনন্তকাল সেই মহাসংগীতে মানব হৃদয়তন্ত্রী বাজতে থাকুক। মানব জাতির ওপর যদি কমলাকান্তের প্রীতি থাকে, তবে সে আর অন্য সুখ চায় না।


বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কমলাকাস্তের দপ্তরের অন্তর্ভুক্ত রচনাগুলি যে বিষয়বস্তু প্রধান, যুক্তিতথ্যনির্ভর বিশ্লেষণমূলক সাধারণ প্রবন্ধ নয়, যার আবেদন শুধু পাঠকদের বুদ্ধি ও চিন্তাশক্তির কাছে। তাদের গোত্র ভিন্ন; “একা (কে গায় ঐ)” রচনাটি পরীক্ষা করে দেখলে সেই সত্য আমাদের কাছে নতুনভাবে প্রতিভাত হয়। এই রচনাগুলি বিভিন্ন রাগরাগিণীর সমবায়ে রচিত ঐকতান সংগীতের মতো মনন, কল্পনা, গভীর হৃদয়ানুভূতি, তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণ প্রভৃতির সমবায়ে গীতিকবিতার মতোই সৃজনমূলক ব্যক্তিগত রচনার (Personal Essay) অনুপম ঐশ্বর্যে আমাদের কাছে ধরা দেয়। এই প্রসঙ্গে ড: শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় যথার্থই বলেছেন: ‘মনের একটি আকুতি বেদনার একটি স্পন্দন, কল্পনার একটু উচ্ছ্বাস, জীবনানুভূতির একটি তরঙ্গলীলা বঙ্কিমের ভাবলোকে একটি সুষ্ঠু, সুগঠিত অবয়বে সংহত হয়। একটি অলক্ষ্য যোগসূত্রের টানে নানা সমধর্মী চিন্তা-ভাবনাকে আকর্ষণ করিয়া নিজের অঙ্গীভূত করে ও পরিশেষে একটি নানাতন্ত্রী সমন্বিত সুরসঙ্গতিতে পরিণত হইয়া অন্তর গভীরে একটি অপরূপ সংগীতের অনুরণন তুলিতে থাকে। বঙ্কিমের রচনায় প্রসঙ্গ পরিবর্তন সাধিত হয় কোন বহিরঙ্গমূলক যুক্তি পারম্পর্যের দ্বারা নহে, এক নিগুঢ় সহানুভূতির অনুসরণে, উহার অন্তর্নিহিত প্রাণলীলার স্বতঃস্ফূর্ত আত্মসম্প্রসারণে।


যৌবনের অপরিমিত আশায় মানুষের হৃদয় মন বিস্ফারিত হয়ে থাকে বলে তার কানে এই সংসারের সমস্ত সম্বন্ধ আনন্দ ও সুখময়, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবদিক অনুপম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে উদ্ভাসিত—সংসারের সেই সংগীত ধ্বনিত হতে থাকে, তার হৃদয়কে আনন্দোচ্ছল করে রাখে। বয়স হবার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ ক্ষতির তুলনায় অনেক বেশি সুখকর জিনিস সঞ্চয় করলেও সেই আনন্দ তার মন থেকে বিদায় নেয়, পৃথিবী আর তার কাছে তেমন সুন্দরী বলে প্রতিভাত হয় না, কারণ, সে আশা হারিয়ে ফেলে। সেই সুখ বা আনন্দ স্থায়ী নয়। মানব প্রীতিই মানুষের স্থায়ী সুখ, তার জীবনের মূল সত্য, সেই প্রকৃত সুখদায়ক প্রীতি থাকলে অন্য সুখের জন্য তাকে কাতর হতে হয় না—এটা শুধু 'একা' রচনারই মূল বিষয়বস্তু নয়, বঙ্কিমচন্দ্রের মূল জীবনদর্শন, বিভিন্ন রচনায় তাকে তিনি প্রকাশ করেছেন বিভিন্ন রূপে : সেই প্রকাশভঙ্গির অভিনবত্ব 'একা'র ঐ বিষয় বা জীবনভাবনাকে যে কিভাবে শিল্পরসবস্তুতে পরিণত করেছে রচনাটির আঙ্গিক বিশ্লেষণ করলে আমাদের কাছে স্পষ্ট হবে।


ড: শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিশ্লেষণ অনুসরণ করে আমরা বলতে পারি, কমলাকান্তের দপ্তরের অন্যান্য রচনার মতো 'একা'-য়ও বঙ্কিমচন্দ্রের সমস্ত মনন ও কল্পনা এসেছে আফিমের নেশাখোর, আধাপাগল কিন্তু প্রকৃত সত্যদ্রষ্টা কমলাকান্তের জীবনরহস্যের মধ্যে নিমজ্জিত বিশেষ মনোভঙ্গীর তির্যক, বিচিত্র পথ চেয়ে, যুক্তিধর্মী গতানুগতিক সকলের পদচিহ্নিত রাজপথে নয়। রচনাটির সূচনায়ই আমরা দেখি, জ্যোৎস্নাপ্লাবিত রাত্রিতে আনন্দোচ্ছল মনে একজন পথিক যখন আপন মনে গান গেয়ে যাচ্ছিল, তখন সেই মধুর সংগীত বহুকালবিস্মৃত সুখস্বপ্নের স্মৃতির মতো কমলাকান্তের কানে প্রবেশ করে, তার মনকে মাধুর্যের আস্বাদ দেয়, সেই সঙ্গে এই প্রশ্ন তার মনকে আলোড়িত করে তোলে, এই সংগীত তার এত মধুর লাগল কেন? প্রথমে সে তার উত্তর খুঁজে পায়নি—যেন, ‘কে বলিবে?' তার পরেই আমরা পাই জ্যোৎস্নাপ্লাবিত রাত্রি, নদী ও রাজপথে উৎফুল্ল জনতার এই চিত্র : “রাত্রি জ্যোৎস্নাময়ী—নদী-সৈকতে কৌমুদী হাসিতেছে। অর্ধাবৃতা সুন্দরীর নীল বসনের ন্যায় শীর্ণ-শরীরা নীল-সলিলা তরঙ্গিনী, সৈকত বেষ্টিত করিয়া চলিয়াছেন; রাজপথ, কেবল আনন্দ—বালক, বালিকা, যুবক, যুবতী, প্রৌঢ়া, বৃদ্ধা, বিমল চন্দ্র কিরণে স্নাত হইয়া আনন্দ করিতেছে।” প্রকৃতির এই সৌন্দর্য এবং তার প্রভাবসঞ্জাত আনন্দের পটভূমিতে কমলাকান্ত তার নিরানন্দ অবস্থার জন্যই যে ঐ সংগীতে তার হৃদয়যন্ত্র বেজে উঠল সেই বেদনাময় উপলব্ধিকে প্রকাশ করে “আমিই কেবল নিরানন্দ তাই ঐ সংগীতে আমার হৃদয়যন্ত্র বাজিয়া উঠিল।”


অতঃপর কমলাকান্ত আর এক ধাপ এগিয়ে তার এই নিরানন্দ অবস্থার কারণ নির্দেশ করে বলে: “আমি একা—তাই এই সংগীতে আমার শরীর কণ্টকিত হইল। এই বহুজনাকীর্ণ নগরী মধ্যে এই আনন্দময়, অনন্ত জনস্রোতমধ্যে, আমি একা।” সেই বেদনায় আর্ত হয়েই কমলাকান্ত একাকীত্বের অভিশাপ সম্পর্কে সকলকে সচেতন করে দেয় : “কেহ একা থাকিও না। যদি অন্য কেহ তোমার প্রণয়ভাগী না হইল, তবে তোমার মনুষ্যজন্ম বৃথা।” সে তার শ্রোতা বা পাঠকদের জীবনের সার্থকতার সত্য সম্বন্ধে সচেতন করে দেয় “পুষ্প আপনার জন্য ফুটে না। পরের জন্য তোমার হৃদয় কুসুমকে প্রস্ফুটিত করিও।” গল্প-উপন্যাসের মতো পটভূমি চিত্রণে এবং গীতিচরিতাসুলভ কল্পনার বর্ণবৈভবে ও আবেগম্পন্দনে কমলাকান্ত দ্বীপের মতো বিচ্ছিন্ন জীবন নয়, মহাদেশের মতো বহুজনের মধ্যে ব্যাপ্ত ও সম্মিলিত জীবনেই যে মানুষ যথার্থভাবে সার্থক হতে পারে, সেই সত্যের ইঙ্গিত দিয়ে তার মূল বক্তব্য বা প্রতিপাদ্যের জন্য পাঠকদের মনকে উন্মুখ ও প্রস্তুত করে তোলে। এই ভূমিকার পর আবার সে একবার মাত্র শ্রুত ঐ সংগীত তার কেন এত মধুর লাগল—সেই প্রশ্নে ফিরে গিয়ে তার উত্তর দেয় তার যৌবনে পৃথিবী সুন্দরী বলে প্রতিভাত হত, প্রতি পুষ্পেই সে সুগন্ধ পেত, প্রতি পত্রমর্মরে মধুর শব্দ শুনত, প্রতি মানুষের মুখেই সরলতা উদ্ভাসিত হতে দেখত, সেই সময় তার আনন্দ ছিল, তখন সংগীত শুনে আনন্দ হত। পথচারীর সংগীত শুনে কমলাকান্ত তার যৌবন ও সেই সময়ের আনন্দ অনুভবের ক্ষমতা ফিরে পায়, তাই তা এত মধুর লাগে। যৌবনে যে প্রফুল্লতার জন্য তার সংগীত ভালো লাগত তা এখন নেই বলেই প্রৌঢ়ত্বে উপনীত কমলাকান্তের সংগীত ভালো লাগে না। সে মনের ভেতরে মন লুকিয়ে সেই বিগত যৌবন সুখ চিন্তায় রত ছিল সেই সময় সেই পূর্বস্মৃতিসূচক সংগীত তার কানে প্রবেশ করে, তাই তা তার কাছে এত মধুর মনে হয়।


“সে প্রফুল্লতা, সে সুখ, আর নাই কেন?” “একা'র শেষ অনুচ্ছেদে এসে কমলাকান্ত আর একটি প্রশ্ন তোলে, তার উত্তর দিতে গিয়ে বলে, জীবনের পথে মানুষ যতই অতিবাহন করে ততই সুখকর সামগ্রী সঞ্চয় করে চলে, কিন্তু বয়সে যে আনন্দ হ্রাস পায়, পৃথিবীকে আর তেমন সুন্দরী দেখা যায় না। তার কারণ, মানুষ তখন আশারূপ রঙ্গিন কাঁচ হারিয়ে ফেলে, চারদিকে আলোর পরিবর্তে অন্ধকার দিগুলিই তার চোখে পড়তে থাকে। কিন্তু তার পরিবর্তে আর এক সংগীতে তার কান ভরে উঠছে, তা অধিকতর প্রীতিকর : “প্রীতি সংসারে সর্বব্যাপিনী—ঈশ্বরই প্রীতি। প্রীতিই আমার কর্ণে এক্ষণকার সংসার সংগীত। অনন্তকাল সেই মহাসংগীতের সহিত মনুষ্য-হৃদয়-তন্ত্রী বাজিতে থাকুক। মনুষ্যজাতির উপর যদি আমার প্রীতি থাকে তবে আমি অন্য সুখ চাই না।” শেষ অংশে কমলাকান্তের মানবপ্রীতিই যে মানবজীবনের একমাত্র স্থায়ী সুখের উৎস—সেই প্রত্যয় কল্পনা ও আবেগের বিচিত্র তরঙ্গলীলার পর উচ্চারিত হয়েছে মননশীলতার গাম্ভীর্য এবং গভীর আবেগের অপূর্ব সমন্বয়ে। লেখকের ব্যক্তিসত্তার প্রতিভূ কমলাকাস্তের মনন ও হৃদয়ানুভূতির আধারে এই সমস্ত বিভিন্ন ধরনের প্রকাশভঙ্গি বিধৃত হয়েছে বলেই কোথাও কোন ছন্দপতন ঘটেনি, সবই ঐকতান সংগীতের মতো এক অপূর্ব সুরসঙ্গতিতে সমন্বিত হয়ে বঙ্কিমচন্দ্রের জীবন-ভাবনাকে প্রাণবন্ত 'সত্যের জ্যোতির্ময় রূপদান করেছে।