“সম্প্রতি আমার সুযোগ ঘটেছিল জাপানযাত্রার”—এই উক্তির আলোকে লেখকের জাপান যাত্রার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করো।

টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিভাগ কর্তৃক আয়োজিত ‘আধুনিক জীবনে বিজ্ঞানের স্থান' বিষয় নিয়ে একটি আলোচনাচক্র বসে। গণিতবিদ, পদার্থবিদ, জীববিদ, দার্শনিক এবং বহু বিজ্ঞানী সেখানে উপস্থিত ছিলেন। এদের মধ্যে কেউ কেউ জাপানি, কেউ ছিলেন বিদেশি। লেখক কিন্তু শ্রুতকীর্তি ভারতীয় বিজ্ঞানী হিসেবে এই আসরে যোগদান করেছিলেন এবং ভেবেছিলেন যে আলোচনা বিদেশি ভাষার মাধ্যমে হবে। কিন্তু এখানে – পৌঁছে লেখক শুনলেন জাপানে জাপানি ভাষা সর্বত্র ব্যবহার হয়। পঠনপাঠনের ক্ষেত্রে বা আলোচনা সভাতেও বিজ্ঞানীরা ইংরেজির বদলে জাপানি ভাষা ব্যবহার করেন। সুতরাং বর্তমান লেখককে তৈরি থাকতে হবে সভায় জাপানি ভাষায় আলোচনা শোনার জন্য। লেখক অবশ্য একজন দোভাষীর সাহায্য পাবেন। দোভাষীর কাজ হবে আলোচনাসভায় নানা বক্তার বক্তব্য ভাষান্তর করে দেওয়া। লেখকের পালা যখন আসবে তখন জাপানি ভাষায় তাঁর বক্তব্য সহযোগী সদস্যের কাছে উপস্থিত করা হবে। এই পদ্ধতি বেশ ফলপ্রস্। আধুনিক রাষ্ট্রে বিজ্ঞানের প্রয়োগ সম্পর্কে এক বিশেষ জটিল ও বিমূর্ত আলোচনা স্বচ্ছন্দে জাপানি ভাষায় চালানো হল। এই পদ্ধতিতে বিদেশি বৈজ্ঞানিকদের চিন্তা বেশ ভালোভাবেই ধরা গেল। আলোচনাক্রমে লেখকের বিজ্ঞান-বিষয়ক চিন্তা সম্পর্কে অনুমোদন ও প্রতিবাদমুখী ব্যাখ্যা অন্যরা নিবেদন করলেন। এইভাবে আলোচনা সভা, তর্ক-বিতর্ক জমে উঠল। এই অভিজ্ঞতা লেখক এখানে পরিবেশন করেছেন।


লেখক জাপানে ভারতীয় ছাত্রদের সঙ্গে দেখা করেছেন। লেখক যে যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে গেছেন, সেখানে পদার্থবিদ্যার আধুনিকতম দিক সম্পর্কে অধ্যাপনা হচ্ছে। সব কিছুই হচ্ছে জাপানি ভাষায়। তার পাশে জাপানি ছাত্ররা দুঃসাহসী ও অভিনব গবেষণা চালাচ্ছে স্বদেশি ভাষায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা নিজেদের মধ্যে বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা মাতৃভাষার মাধ্যমে করে চলেছেন। শিক্ষা, শিক্ষণ, অধ্যয়ন অধ্যাপনা সবাই চলছে জাপানি ভাষায়। মাতৃভাষার মাধ্যমে এইভাবে শিক্ষাকে উন্নত করার প্রচেষ্টা দেখে লেখক মুগ্ধ হয়েছেন। এই অভিজ্ঞতা লেখককে প্ররোচিত করেছে ও তাঁর মতামতকে রূপ দিয়েছে। অভিজ্ঞতার আলোকেই লেখক মাতৃভাষাকে শিক্ষার অপরিহার্য মাধ্যম হিসেবে অনুভব করেছেন এবং এই প্রবন্ধে এই অভিজ্ঞতাকে শিক্ষাচিন্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।


বিজ্ঞানীরা আলোচনায় বা রচনায় ধার করা শব্দ ব্যবহার করেন। কিন্তু তার জন্য তাঁরা কুণ্ঠিত নন। দুজন ভারতীয় বিজ্ঞানীর ইংরেজিতে লেখা একটা বইয়ের জাপানি তর্জমা হয়েছে। লেখক জানতে পারলেন যে জাপানি ভাষায় অনূদিত বইটির বেশ ভালোই বিক্রি হয়েছে। ছয়মাসে প্রায় তিন হাজারের মতো বিক্রি হয়েছে। জাপানি ভাষা জানা সাধারণ জাপানিরা এই বইটি পড়ে পারমাণবিক বিস্ফোরণের ফলাফল সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করেছে এবং এ ব্যাপারে তাঁরা নিরপেক্ষ ভারতীয় মতামতকে বেশি অনুমোদন করেন। কিন্তু এদেশে ওই বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ইংরেজিতে বইটি লিখেছেন ও অধিকাংশ লেখককে পারমাণবিক ভস্মপাত সম্পর্কে অজ্ঞ রেখেছেন। এর দ্বারা বোঝা যায় এদেশে বিজ্ঞানীরা ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করতে উৎসাহী, তাঁর মতে এদেশের মানুষ বিজ্ঞানের সুফল সম্পর্কে অবহিত হন না।


জাপানে গিয়ে এই সব অভিজ্ঞতা লেখকের চিন্তাশক্তিকে বলিষ্ঠ করে তুলতে সাহায্য করেছে। লেখকের ধারণা বিদেশি ভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান করা হলে বা বিজ্ঞানবিষয়ক আলোচনা হলে ছাত্র শিক্ষার্থী ও সাধারণ জনমানস অজ্ঞানের অন্ধকারেই থেকে যাবে। তাই তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস, মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার ব্যবস্থাই বিজ্ঞানচর্চার শ্রেষ্ঠ পথ।