কমলাকান্তের দপ্তর-এ’ বঙ্কিমচন্দ্র একাধারে স্বদেশপ্রেমিক, সমাজতান্ত্রিক দার্শনিক ও কবি'। তোমার পাঠ্য প্রবন্ধাবলির আলোকে এই মন্তব্যটির যাথার্থ্য বিচার করো।

ঊনবিংশ শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ মনীষী ও সাহিত্য স্রষ্টা বঙ্কিমচন্দ্রকে নিছক সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও ঔপন্যাসিকরূপে বিচার বিশ্লেষণ করলে আমরা যে গুরুতর ভুল করব তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বস্তুত তিনি যুগনায়ক, ঊনবিংশ শতাব্দীর নবজাগরণের শেষ পর্বে স্বদেশ ভাবনা, সামাজিক-সাংস্কৃতিক চিন্তা ও আন্দোলন প্রভৃতির রূপরচয়িতা, জাতির পথপ্রদর্শক। বাংলার তথা সমগ্র ভারতবর্ষের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ভাবাদর্শ বঙ্কিমই প্রথম নির্মাণ করে যান। বঙ্কিমচন্দ্রের মধ্যে স্বদেশ প্রেমিকের জন্মভূমির জন্য গভীর মমতা ও বেদনাপূর্ণ আকুলতা, সমাজতাত্ত্বিকদের সমাজ বিশ্লেষণের দূরদৃষ্টি ও তার সমস্যা অনুধাবনের ও সমাধানের পথ নির্দেশের মনন শক্তি দার্শনিকের অন্তর্দৃষ্টি গভীর তত্ত্বভাবনা এবং কবির কল্পনা ও আবেগ অনুভূতি সমন্বিত হয়েছিল বলেই তাঁর পক্ষে এই জাতীয় ভূমিকা পালন করা সম্ভব হয়েছিল। তাঁর কোনো রচনায় সমাজতাত্ত্বিক, কোনোটিতে দার্শনিক, কোথায়ও বা কবির পরিচয় মেলে, হয়ত দু-একটি রচনায় দুটি বা তিনটি ভূমিকার সমন্বয়ও দুর্লক্ষ্য নয়। বঙ্কিমের কোনো রচনার ওপরে উল্লিখিত সমস্ত ভূমিকারই সমাবেশ বা সমন্বয় ঘটেছে, এই প্রশ্নের উত্তরে যে রচনার নাম আমাদের সন্দেহের কোনো অবকাশ না রেখে উল্লেখ করতে হবে, সেটি তার অনলস ও অবিস্মরণীয় সৃষ্টি কমলাকান্তের দপ্তর।


বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর কমলাকান্তের দপ্তরের বক্তা বা কথক কমলাকান্তকে নিজের হৃদয় মনের পরিপূর্ণ প্রতিচ্ছবি রূপেই নির্মাণ করেছেন, তার অনন্যসাধারণ বৈশিষ্ট্যের সূত্রেই নিজের স্বদেশপ্রেমিক, সমাজতাত্ত্বিক, দার্শনিক ও কবি এইসব বিভিন্ন সত্তাকে অবাধে প্রকাশ করার সুযোগ পেয়েছেন। কমলাকান্ত অর্ধোন্মাদ, সমাজ সংসারে থেকেও তার সমস্ত বন্ধন থেকে মুক্ত এবং আফিমের নেশাখোর। সেইজন্যই সে মোহমুক্ত জীবনদৃষ্টির অধিকারী, তার প্রজ্ঞাদৃষ্টি সমস্ত ক্ষুদ্রতা, সংকীর্ণতা ও মিথ্যাচারের আবরণ ভেদ করে সত্যের জ্যোতির্ময় রূপ প্রদর্শন করতে পেরেছে। বঙ্কিমচন্দ্র কমলাকান্তের আফিমের নেশাঘটিত আপাত উদ্ভট, বিচিত্র কল্পনা মনন, আবেগ-অনুভূতির তরঙ্গোচ্ছ্বাস প্রভৃতির মধ্য দিয়ে তাঁর জীবনদর্শন, স্বদেশপ্রীতি, ব্যক্তি হৃদয়ের আবেগ উৎকণ্ঠা ইত্যাদিকে প্রকাশ করেছেন। একই রচনায় হাস্যরস, তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গবিদ্রূপ, প্রবন্ধের বা দার্শনিকের মননশীলতার গাম্ভীর্য ও বিশ্লেষণ, গীতিকবিতার মন্ময়তা প্রভৃতির সমবায়ে তিনি তাঁর জীবন-ভাবনাকে এক বিচিত্র বর্ণোজ্জ্বলরূপে রূপ দান করেছেন।


বঙ্কিমচন্দ্রের স্বদেশ প্রেমিকের রূপটি উদ্ভাসিত হয়েছে কমলাকান্তের দপ্তরের অন্তর্ভুক্ত ‘আমার দুর্গোৎসব’ রচনাটিতে, এখানে তাঁর দেশাত্মবোধ গীতিকবিতার আবেগস্পন্দনে ও সুরময়তায় প্রকাশিত হয়েছে। সপ্তমী পূজার দিন সে কেন এত আফিম চড়াতে বলল, কেন সে আফিম খেল, কেন প্রতিমা দেখতে গেল, যা কখনও দেখবে না তা কেন দেখল, এ কুহক কে দেখাল, এই প্রস্তাবনার পরই কমলাকান্ত তার আফিমের নেশাঘটিত কল্পনায় যে দৃশ্য দেখতে পেয়েছে তার বর্ণনা দিয়েছে : দিগন্ত ব্যাপ্ত করে কালের স্রোত প্রবলবেগে ছুটে চলেছে, সে ভেলায় চড়ে ভেসে যাচ্ছে; অনস্ত অকুল, অন্ধকারে বাত্যা-বিক্ষুব্ধ তরঙ্গ-সংকুল সেই স্রোত, মধ্যে মধ্যে উজ্জ্বল নক্ষত্রগুলি একবার উদিত হচ্ছে, নিভছে, আবার উঠছে—‘আমি নিতান্ত একা-একা বলিয়া ভয় করিতে লাগিল—নিতান্ত একা—মাতৃহীন— মা! মা! করিয়া ডাকিতেছি? আমি এই কালসমুদ্রে মাতৃ-সন্ধানে আসিয়াছি। কোথা মা। কই আমার মা? কোথায় কমলাকান্ত প্রসুতি বঙ্গভূমি?’ পরাধীন জীবনের তীব্র বেদনায় কমলাকান্তের এই উক্তিতে তার স্রষ্টার দেশজননীর সন্ধান হাহাকারের মতোই ধ্বনিত হয়েছে, ব্যক্তিগত অনুভূতির সেই আবেগঘন প্রকাশে এই উক্তি গীতিকবিতাধর্মী হয়ে উঠেছে, আমাদের হৃদয়ের প্রতিটি তন্ত্রীতে তার সুর অনুরণিত হয়। কমলাকান্ত দেখতে পেয়েছে, সেই তরঙ্গ-সংকুল জলরাশির ওপর দূরপ্রান্তে সুবর্ণমণ্ডিতা সপ্তমীর শারদীয়া প্রতিমা, তার জননী, জন্মভূমি এখন কালগর্ভে নিহিতা। দেশজননীর এই ঐশ্বর্য সমুজ্জ্বল মূর্তির ধ্যান কল্পনা যে কমলাকান্তের স্রষ্টার পরাধীনতার যন্ত্রণা-মথিত সত্তার গভীরতম স্তর থেকে উৎসারিত আমরা কমলাকান্তের এই উক্তিতে অনুভব করি। ‘এ মূর্তি এখন দেখিব না—আজি দেখিব না, কিন্তু একদিন দেখিব—দিগ্‌ভুজা, নানা প্রহরেণপ্রহারিণী, শত্রুমদিনী বীরেন্দ্র পৃষ্ঠবিহারিণী—দক্ষিণে লক্ষ্মী, ভাগ্যরূপিণী, বামে বিদ্যাবিজ্ঞানমূর্তিময়ী সঙ্গে বলরূপী কার্তিকেয়, কার্য্যসিদ্ধিরূপী গণেশ, আমি সেই কালস্রোতমধ্যে দেখিলাম, এই সুবর্ণময়ী বঙ্গপ্রতিমা—ব্যক্তি হৃদয়ের তীব্র আবেগে, দুর্গা প্রতিমার চিত্রকল্পে এবং বাক্য ও বাক্যাংশের ছন্দস্পন্দনে এই অংশটিতে স্বদেশপ্রেমিক বঙ্কিমের দেশাত্মবোধের প্রকাশ যে গীতিকবিতার বৈশিষ্ট্যে মণ্ডিত হয়েছে, আমাদের লক্ষ্য করতেই হয়।


সমাজতাত্ত্বিক বঙ্কিমের পরিচয় মেলে ‘আমার মন’ ও ‘বিড়াল' রচনাটিতে। কমলাকান্তের বিচিত্র কল্পনা, ব্যঙ্গবিদ্রূপ ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে তার স্রষ্টা ইংরেজি শিক্ষার প্রভাবে এদেশের বুদ্ধিজীবীদের বৈষয়িক সমৃদ্ধিকেই জীবনের মূলমন্ত্র রূপে গ্রহণের মনুষ্যত্বহীনতাকে উদ্ঘাটন করেছেন: পরসুখবর্ধন ছাড়া মানুষের স্থায়ী সুখের আর কোন ভিত্তি নেই। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে বুদ্ধদেব এই কথা কতভাবে বলে গেছেন, তারপরেও বহু লোকশিক্ষক বহুবার এই শিক্ষা দিয়েছেন তবু মানুষ আত্মকেন্দ্রিকতার মায়ামোহ থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারে না। তার ওপর আবার আমাদের দেশ ইংরেজ শাসনাধীন হবার পর ইংরেজি শাসন, ইংরেজি সভ্যতা, ইংরেজি শিক্ষার সঙ্গে বাহ্যসম্পদের প্রতি অনুরাগ এসে এদেশকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বাহাসম্পদ ইংরেজ জাতির বড় প্রিয়, এটাই ইংরেজি সভ্যতার প্রধান লক্ষণ; বাণিজ্য বৃদ্ধিতে, রেলওয়ে, টেলিগ্রাফ প্রভৃতির স্থাপনে ইংরেজদের ভারতবর্ষের বাহাসম্পদ বৃদ্ধির পরিচয় জাজ্বল্যমান। এদেশের ইংরেজ শিক্ষিত সম্প্রদায় তাতেই আকৃষ্ট হয়ে বাহাসম্পদকে ভালবেসেছে, তার আরাধনায় দেশের প্রাচীন আদর্শগুলোকে বিসর্জন দিয়েছে। কিন্তু কমলাকান্তের উক্তির মাধ্যমে সমাজতাত্ত্বিক বঙ্কিমচন্দ্র এই প্রশ্ন তাদের সামনে উপস্থাপিত করেছেন এই রেলওয়ে টেলিগ্রাফে মানুষের কতটুকু সুখ বাড়বে, এই বাহ্যসম্পদ কি তার মনের শূন্যতা দূর করতে পারে, কারো মনের অশান্তির আগুন নির্বাপিত করতে পারবে? ইংরেজি বাঙলা সংবাদপত্র, সাময়িকপত্র, বক্তৃতা, বিতর্ক—সবকিছুতেই এই বাহ্যসম্পদের প্রশস্তি শোনা যায়। বাহ্যসম্পদের পূজার আহ্বান প্রতিনিয়ত উচ্চারিত হচ্ছে, এ পূজার ভাষশ্মশ্রুধারী ইংরেজ নামে ঋষিগণ পুরোহিত, অ্যাডাম স্মিথ এবং মিল-তন্ত্র থেকে এ পূজার মন্ত্র পড়তে হয়, অর্থাৎ অ্যাডাম স্মিথ-জেম্স মিল-জন স্টুয়ার্ট মিলের উপযোগবাদে বৈষয়িক সমৃদ্ধিকেই সমাজ ও ব্যক্তি জীবনের মূল্য নিরূপণের মানদণ্ডরূপে নির্দেশিত হয়েছিল, ইংরেজি শিক্ষিত বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা অন্ধ মোহে তাকেই মানব জীবনের আদর্শরূপে গ্রহণ করেছিল; এই উৎসবে ইংরেজি সংবাদপত্রগুলি ঢাক ঢোল, বাংলা সংবাদপত্র কাসিদার, শিক্ষা ও উৎসাহ নৈবেদ্য এবং হৃদয় ছাগবলি। এই বৈষয়িক সম্পদে ক'জন অভদ্র ভদ্র হয়েছে, ক'জন অশিষ্ট শিষ্ট, ক'জন অধার্মিক ধার্মিক, ক'জন অপবিত্র পবিত্র হয়েছে, পূজারীরা কি এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে? তারা বলবে, এই উদর পূর্ণ তথা তার ক্ষুধা প্রতিদিন দূর করা চাই, যাতে সকলেরই উদর ভাল করে পূর্ণ হয়, তারা তার জন্য সচেষ্ট। কিন্তু সেই কাজে তারা এত ব্যস্ত যে অন্য সব কথা ভুলে গেছে। মনের সুখ বৃদ্ধি তার থেকে স্বতন্ত্র, মানুষে মানুষে প্রীতি বৃদ্ধির কথা ভাবতে হবে।


‘কমলাকান্তের দপ্তর’-এ সমাজতাত্ত্বিক বঙ্কিমের পুর্ণাঙ্গ পরিচয় মেলে 'বিড়াল' প্রবন্ধটিতে। ধনী ও দরিদ্রের নিদারুণ অর্থনৈতিক বৈষম্য, দরিদ্রদের শোচনীয় দারিদ্র্য, অনাহার, ক্ষুধার জ্বালায় চৌর্যবৃত্তির মতো অপরাধ ইত্যাদির বিনিময়ে ধনী শ্রেণির ঐশ্বর্য ও ভোগবিলাস সমাজ ব্যবস্থার সর্বাপেক্ষা গুরুতর ত্রুটি, ভয়ংকর অভিশাপ। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকেই ফরাসি বিপ্লবের রুশো প্রমুখ চিন্তানায়কেরা এই বিষয়ে চিন্তাভাবনা করে আসছিলেন। ধনীদের দ্বারা দরিদ্রদের শোষণ ও বঞ্চনার ওপর নির্ভরশীল ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার বিকল্প হিসাবে সেই শোষণ মুক্ত সাম্যের ওপর স্থাপিত সমাজব্যবস্থার পরিকল্পনাকে তুলে ধরেছিলেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলার নবজাগরণে সর্বশ্রেষ্ঠ চিন্তানায়ক বঙ্কিমচন্দ্র সেই সমাজতন্ত্রের সমাজতাত্ত্বিক চিন্তাধারার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। 'বিড়াল' প্রবন্ধে তিনি সর্বহারা দরিদ্র সমাজের প্রবক্তারূপে বিড়ালের বক্তব্যে সমাজতন্ত্রের যৌক্তিকতা এবং তার খণ্ডনে ধনতন্ত্রের প্রতিনিধি হিসেবে কমলাকান্তের ধনতন্ত্রের সপক্ষে যুক্তি প্রদর্শনকে উপস্থাপিত করেছেন কাল্পনিক বিতর্কের রঙ্গব্যঙ্গ কৌতুক রসসিক্ত মনোজ্ঞ ভঙ্গিতে। এই বিতর্কে বঙ্কিম দুটি বিপরীত সমাজব্যবস্থার মধ্যে সমাজতন্ত্রের শ্রেষ্ঠত্বের ইঙ্গিত দিয়েছেন।


বিড়াল শোষিত, সর্বহারা, দরিদ্র সমাজের প্রবক্তারূপে বক্তব্য উপস্থাপিত করেছে এই সংসারের ক্ষীর, সর, দুগ্ধ, দধি, মৎস্য, মাংস ইত্যাদি সবই কমলাকান্তরা অর্থাৎ ধনীরা খাবে, আর, তারা বিড়ালেরা অর্থাৎ দরিদ্ররা কিছু পাবে না কেন, কোন্ যুক্তিতে তারা এই সমস্ত খাদ্যবস্তু থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকবে, ধনী ও দরিদ্র শুধু এই শ্রেণীগত পার্থক্যের জন্যই। কিন্তু ধনীদের মত দরিদ্ররাও ত মানুষ, প্রকৃত প্রভেদ সত্যই কিছু আছে কি? ধনীদের যেমন ক্ষুধা তৃষ্ণা আছে, তেমনি দরিদ্রদেরও আছে। কোনও দরিদ্রই সাধ করে চোর হয় না। খেতে পেলে কে চোর হয়। সমাজের উঁচুতলার যেসব মানুষ সাধু সেজে বসে আছেন এবং চোরের নামে শিউরে ওঠেন তাঁদের অনেকেই চোর অপেক্ষাও অধার্মিক, চুরি করার প্রয়োজন নেই বলেই তাঁরা চুরি করেন না। কিন্তু প্রয়োজনাতীত ধন থাকা সত্ত্বেও তাঁরা যে চোরের দিকে মুখ তুলে চেয়ে দেখেন না, তার জন্যই চোর চুরি করে। অধর্ম চোরের নয়, চোর যে চুরি করতে বাধ্য হয় সেই অধর্ম কৃপণ ধনীর। চোর দোষী, কিন্তু কৃপণ ধনী তার থেকে শতগুণে দোষী। চোরের দণ্ড হয়, কিন্তু চুরির মূলে যে কৃপণ ধনী তার দণ্ড হয় না কেন? দরিদ্রদের আহার সংগ্রহের দণ্ড আছে, ধনীর কৃপণতার দণ্ড নেই কি কারণে? ধনীর দোষেই কি দরিদ্র চোরে পরিণত হয় না। পঁচিশ জন দরিদ্রকে বঞ্চিত করে একজন তাদের আহার্য সংগ্রহ করবে কেন, যদি করল তবে সে তাঁর আহারের পর যেটুকু অবশিষ্ট থাকে, তা দরিদ্রকে কেন দেবে না? যদি না দেয় তবে দরিদ্র অবশ্য তার থেকে চুরি করবে, কারণ না খেতে পেয়ে মরবার জন্য এই পৃথিবীতে কেউ জন্মগ্রহণ করেনি।


বিড়ালের এই বক্তব্য খণ্ডন করার জন্য ধনতন্ত্রের প্রতিনিধিরূপে তার সমর্থনে কমলাকান্ত সেই সনাতন যুক্তি উপস্থাপিত করেছে। এই কথাগুলো অত্যন্ত সোশিয়ালিস্টিক, সমাজ বিশৃঙ্খলার মূল। যদি যার যত ক্ষমতা সে তত ধন সঞ্চয় করতে না পারে, অথবা সঞ্চয়ের পর চোরের জ্বালায় ভোগ না করতে পারে, তবে কেউ আর ধন সঞ্চয়ে যত্নবান হবে না, তাতে সমাজের ধন বৃদ্ধি হবে না। আর সামাজিক ধন বৃদ্ধি ছাড়া সমাজের উন্নতি সম্ভব নয়। ধনতন্ত্রের সমর্থনে কমলাকান্তের এই যুক্তি বা বক্তব্যের প্রতিবাদে বিড়াল বলেছে, সে যদি খেতেই না পেল তবে সমাজের উন্নতি নিয়ে কি করবে। এই পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষের খেয়ে পরে বেঁচে থাকার অধিকার আছে, এই অধিকার জন্মগত। কিন্তু মুষ্টিমেয় ধনী শ্রেণি তাদের শোষণ করে, তাদের মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়ে মুনাফার পাহাড় গড়ে তোলে। ধনতন্ত্রের প্রবক্তারা ভেবে দেখেন না, ধনীদের সমৃদ্ধি ও সমাজের উন্নতি অসংখ্য দরিদ্র, নিরন্ন মানুষদের কাছে অর্থহীন, নিষ্ঠুর পরিহাস। ক্ষুধার জ্বালা কী ভয়ংকর, অসহনীয় ভুক্তভোগী ছাড়া আর কেউ বোঝে না। সমাজতন্ত্রের প্রবক্তা বিড়ালের উক্তির মাধ্যমে বঙ্কিমচন্দ্র যথার্থই বলেছেন সমাজের ধন বৃদ্ধির অর্থ ধনীর ধন বৃদ্ধি, ধনীর ধন বৃদ্ধি না হলে দরিদ্রের কী ক্ষতি; সে যদি খেতেই না পেল, যা বেঁচে থাকার ন্যূনতম শর্ত ও অধিকার, তবে সমাজের উন্নতি নিয়ে সে কী করবে। ক্ষুধার জ্বালায় যে মানুষ ছটফট করছে, দু'চোখে অন্ধকার দেখছে, যার কর্ণদ্বয় রুদ্ধ হয়ে আসছে, তার কাছে এই সামাজিক উন্নতির তো কোনো অর্থই নেই। সে যদি খেতেই না পেল তবে সমাজের উন্নতি নিয়ে কী করবে, বিড়ালের এই উক্তির কোনো সদুত্তর দিতে না পেরে ধনতন্ত্রের প্রতিনিধি কমলাকান্ত অবশেষে বলেছে : ‘সমাজের উন্নতিতে দরিদ্রের প্রয়োজন না থাকিলে থাকিতে পারে, কিন্তু ধনীদিগের বিশেষ প্রয়োজন, অতএব চোরের দণ্ড বিধান কর্তব্য। ধনতন্ত্রের সপক্ষে এই অক্ষম অসাড় যুক্তি লক্ষ্য করেই বঙ্কিমচন্দ্রের বিড়াল রচনাটির মূল বক্তব্য বিষয়ে যে সমাজতন্ত্রের সমর্থন, সে বিষয়ে আমাদের মনে সন্দেহের কোনো অবকাশ থাকে না।


দার্শনিক বঙ্কিমচন্দ্রের পরিচয় পাই ‘একা-কে গায় ঐ’ ও ‘আমার মন' প্রবন্ধ দুটিতে। কমলাকান্তের চিন্তাভাবনা, আবেগ-অনুভূতি ও সত্যোপলব্ধির চিত্তের মধ্য দিয়ে তিনি তাঁর সাহিত্যকর্মের অন্যতম মূল ভিত্তি জীবনদর্শনকে প্রকাশ করেছেন। একজন পথিক জ্যোৎস্নাপ্লাবিত রাত্রির সৌন্দর্য দর্শনে নিজের অসহস্পন্দনের মনের সুখমাধুর্য বসন্তের মধুধামে তার মধুর কন্ঠের গানে ছড়িয়ে দিয়ে যাবার সময় বহুকাল বিস্মৃত সুখ স্বপ্নের স্মৃতির মতো ওই মধুর সংগীত কমলাকান্ত শুনতে পায়। তার সমস্ত হৃদয় আলোড়িত হয়ে ওঠে। প্রকৃতির জগতের মতো রাজপথেও বালক-বালিকা, যুবক-যুবতী, প্রৌঢ়া-বৃদ্ধ শুভ্র চাঁদের আলোকে স্নানে আনন্দমগ্ন, নিরানন্দ শুধু কমলাকান্ত, তাই ওই সংগীতে তার হৃদয়তন্ত্রী বেজে ওঠে। যৌবনে পৃথিবী যখন সুন্দরী ছিল, তখন কমলাকান্ত প্রকৃতির সমস্ত রূপে সৌন্দর্য ও সংগীতের আস্বাদ পেত প্রতিটি মানুষের মুখে সরলতা দেখত; তখন সংগীত শুনে আনন্দ হত। পৃথিবী, সংসার, মানবচরিত্র এখনও তাই আছে কিন্তু কমলাকান্তের সেই যৌবনকালের হৃদয় আর নেই। আজ এই সংগীত শুনে যৌবনের যে অবস্থায় সে সুখে সে সেই আনন্দ অনুভব করে, তা তার মনে পড়ে। মুহুর্তের জন্য সে তাকায় তার যৌবন ও সেই আনন্দ ফিরে পায়। সেই ক্ষণিক ভ্রান্তিতেই এই সংগীত তার এত ভালো লাগে। সেই প্রফুল্লতা, সেই সুখ আর কেন নেই। এই প্রশ্ন কমলাকান্তের হৃদয় মনকে আলোড়িত করে। সে এই সত্য উপলব্ধি করে যৌবনের অপরিমিত আশায় মানুষের হৃদয় মন বিস্ফারিত হয়ে থাকে বলে তার কানে এই সংসারের সমস্ত সম্বন্ধ আনন্দ ও সুখময়, বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের সব দিক অনুপম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে উদ্ভাসিত—সংসারের সেই সংগীত ধ্বনিত হতে থাকে। তার হৃদয়কে আনন্দোচ্ছল করে রাখে। বয়স হবার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ক্ষতির তুলনায় অনেক বেশি সুখকর জিনিস সঞ্চয় করলেও সেই আনন্দ তার মন থেকে বিদায় নেয়। পৃথিবী আর তার কাছে তেমন সুন্দরী বলে প্রতিভাত হয় না, কারণ সে আশা হারিয়ে ফেলে। সেই সুখ বা আনন্দ স্থায়ী নয়। মানব প্রীতিই মানুষের স্থায়ী সুখ, তার জীবনের মূল সত্য। সেই প্রকৃত সুখদায়ক প্রীতিবাক্যকে অন্য সুখের জন্যে মানুষকে কাতর করে না।


মানবজীবনের চরম সার্থকতা সম্পর্কে বঙ্কিমচন্দ্রের এই দার্শনিক চিন্তা বা তত্ত্বভাবনা ‘আমার মন' প্রবন্ধেও প্রকাশিত হয়েছে তার নিজস্ব রূপে, বৈশিষ্ট্যে। কমলাকান্তের এই সত্যোপলব্ধিতে আমরা তারই পরিচয় পাই। সে একদিন অনুভব করে, তার মন কোথায় হারিয়ে গেছে, সেই সূত্রে নিজের হারানো মনের সন্ধান করতে থাকে। ভোজন প্রিয় কমলাকান্ত একজন বন্ধুর পরামর্শমতো পাকশালায় পোলাও, কাবাব, কোপ্তা, ইলিশ মাছের ঝোল, মাংসের কোরমা, লুচি, সন্দেশ ইত্যাদি সুখাদ্য বস্তুতে তার হারানো মনের সন্ধান করে ব্যর্থ হয়। যে তাকে বিনামূল্যে দুধ এবং সাথে সাথে ক্ষীর, সর, ননী দেয়, তার রচনাপাঠ শোনে, তার অনুরোধে আফিম পর্যন্ত ধরে সেই প্রসন্ন গোয়ালিনীর কাছেও কমলাকান্ত তার হারানো মনকে খুঁজে পায় না। প্রতি পদক্ষেপে রূপলাবণ্যের তরঙ্গ উচ্ছ্বসিত কলসী কাঁখে এক যুবতীকে পথে দেখতে পেয়ে সে তার মন চুরি করেছে, একথা তাকে বলার পর তার কটূক্তিতে জর্জরিত হয়ে কমলাকান্ত তরুণী নারীর কাছে নিজের হারানো মন সন্ধানের ধৃষ্টতার উচিত শিক্ষালাভ করে। এইসব বিড়ম্বনার পর কমলাকান্ত উপলব্ধি করে, সে কখনও কিছুতে তার মনকে বাঁধতে পারেনি, সেইজন্য কিছুতেই তার মন নেই। এই সংসারে মানুষেরা কী করতে আসে তা সে ঠিক বলতে পারে না, কিন্তু তার মনে হয়, তারা শুধু মন বাধা দিতেই আসে। কমলাকান্ত চিরকাল নিজেরই রইল, পরের হল না। সেইজন্যই পৃথিবীতে তার সুখ নেই। যারা স্বভাবগতভাবে আত্মপ্রিয়, তারাও বিয়ে করে সংসারী হয়ে স্ত্রী পুত্রের কাছে আত্মসমর্পণ করে সুখী হয়। কমলাকান্ত অনেক অনুসন্ধানে দেখেছে, পরের জন্য আত্মবিসর্জন ছাড়া পৃথিবীতে স্থায়ী সুখের অন্য কোনো মূল বা ভিত্তি নেই। অর্থ খ্যাতি ইত্যাদি ইন্দ্ৰিয়াদিলব্ধ সুখ স্থায়ী হয় না। এগুলি প্রথমবারে যে পরিমাণে সুখদায়ক হয়, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বারে সেই সুখের পরিমাণ ক্রমাগত হ্রাস পায়, অভ্যাসে সুখ আর থাকে না। সুখ না থাকুক, তাদের অভাবে গুরুতর অতৃপ্তি দেখা দেয় এবং তৃপ্তিহীন আকাঙ্ক্ষায় যন্ত্রণা বৃদ্ধি হয়। পৃথিবীর যে সমস্ত বস্তু কাম্য বলে আবহমানকাল পরিচিত, তারা সবই অতৃপ্তিকর ও দুঃখের উৎস। কিন্তু পরসুখবর্ধন ছাড়া মানুষের স্থায়ী সুখের অন্য কোনো ভিত্তি নেই।


বঙ্কিমচন্দ্রের কবিসত্তার পরিচয় মেলে ‘একা–কে গায় ঐ’ ও ‘আমার দুর্গোৎসব' এই দুটি রচনায়। ‘কমলাকান্তের দপ্তরে’র বিচিত্র ও অনন্য সাধারণ আঙ্গিকের মূলে যে বঙ্কিমের কবি কল্পনাই ক্রিয়াশীল ছিল, ড: শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর এই বিশ্লেষণে সুন্দরভাবে প্রদর্শন করেছেন। 'গোধূলি সন্ধ্যার একখণ্ড ক্ষুদ্র মেঘ যেমন দেখিতে দেখিতে সমস্ত আকাশ পরিব্যাপ্ত হয়, ইহার চারিদিকে যেমন বর্ণালীমায়া অদৃশ্য চিত্রকরের সমাবেশ-সুষমার এবং স্বপ্নলোকের সুসম্বন্ধ চিত্ররূপে প্রতিভাত হয়, কমলাকান্তের প্রবন্ধগুলির মধ্যেও তেমনি ভাবোচ্ছ্বাসের একটি বিন্দু মনোলোকে ঘন হইয়া উঠে, নানা বর্ণের সংমিশ্রণে নানা সুরের সমবায়ে একটি অপরূপ সত্তা গ্রহণ করে ও অন্তঃসঙ্গতি ও প্রাণলীলার স্পন্দনে একটি চিরন্তন অধ্যাত্ম সত্যরূপে অন্তরে প্রতিষ্ঠিত হয়। মনের একটি আকৃতি, বেদনার একটি স্পন্দন, কল্পনার একটু উচ্ছ্বাস, জীবনানুভূতির একটি তরঙ্গলীলা বঙ্কিমের ভাবলোকে একটি সুষ্ঠু, সুগঠিত অবয়বে সংহত হয়, একটি অলক্ষ্য যোগসূত্রের টানে নানা সমধর্মী চিন্তাভাবনাকে আকর্ষণ করিয়া নিজের অঙ্গীভূত করে ও পরিশেষে একটি তন্ত্রী সমন্বিত স্বরসঙ্গতিতে (harmony) পরিণত হইয়া অন্তর-গভীরে একটি অপরূপ সঙ্গীতের অনুরণন তুলিতে থাকে। ‘একা-র' এই ভূমিকা-অংশে বঙ্কিমচন্দ্রের কবিকল্পনা অনুপম চিত্রসৌন্দর্যে গীতিকবিতার সুরছন্দে অভিব্যক্ত হয়েছে— জ্যোৎস্নাপ্লাবিত রাত্রিতে নিজের মনের আনন্দে একজন পথচারীর গান শুনে কমলাকান্তের মনের এই প্রতিক্রিয়ার বর্ণনায় : ‘স্বতঃ তাহার কণ্ঠ মধুর মধুর কণ্ঠে, এই মধুমাসে, আপনার মনের সুখের মাধুর্য বিকীর্ণ করিতে করিতে যাইতেছে। তবে বহুতন্ত্রী বিশিষ্ট খাদ্যের তন্ত্রীতে অঙ্গুলী স্পর্শের ন্যায়, ঐ গীতিধ্বনি আমার হৃদয়কে আলোড়িত করিল কেন? কেন, কে বলিবে? রাত্রি জ্যোৎস্নাময়ী—নদী সৈকতে কৌমুদী হাসিতেছে। অর্ধাবৃতা সুন্দরীর নীল বসনের ন্যায় শীর্ণ-শরীরা নীল-সলিলা তরঙ্গিণী সৈকত বেষ্টিত করিয়া চলিয়াছেন; রাজপথে কেবল আনন্দ—বালক, বালিকা, যুবক, যুবতী, প্রৌঢ়া, বৃদ্ধা বিমল চন্দ্রকিরণে স্নাত হইয়া আনন্দ করিতেছে। আমিই কেবল নিরানন্দ—তাই ঐ সঙ্গীতে আমার হৃদয় যন্ত্র বাজিয়া উঠিল। কমলাকান্তের একাকীত্বের বেদনাগীতি কবিতার চিত্র সৌন্দর্যে ও সুরময়তায় প্রকাশিত হয়ে মানব প্রীতির মহাসংগীতই যে মানুষের হৃদয়ের একমাত্র আশ্রয় স্থল সেই সত্যোপলব্ধির উপযুক্ত পটভূমি রচনা করেছে। আমার দুর্গোৎসব’-এ কমলাকান্তের বেদনা সন্তপ্ত হৃদয়ে দেশ জননীর এই রূপ-ধ্যান গীতিকবিতার আবেগোচ্ছ্বাসিত সুরে প্রকাশিত হয়েছে, 'সহসা স্বর্গীয় বাদ্যে কর্ণরক্ত পরিপূর্ণ হইল—দিমগুলে প্রভাতারুনোদয়বৎ লোহিতসম্বল আলোক বিকীর্ণ হইল—স্নিগ্ধ মন্দ পবন বহিল—সেই তরঙ্গসঙ্কুল জলরাশির উপরে দূরপ্রান্তে দেখিলাম—সুবর্ণমণ্ডিতা, এই সপ্তমীর শারদীয়া প্রতিমা। জলে হাসিতেছে, ভাসিতেছে, আলোক বিকীর্ণ করিতেছে। এই কি মা? হাঁ, এই মা। চিনিলাম, এই আমার জননী জন্মভূমি-এই মৃন্ময়ী-মৃত্তিকারূপিণী-অনম্ভরত্ন-ভূষিতা-এক্ষণে কালগর্ভে নিহিতা।


‘কমলাকান্তের দপ্তর’-এ বঙ্কিমচন্দ্র একাধারে স্বদেশপ্রেমিক, সমাজতাত্ত্বিক, দার্শনিক ও কবি-পাঠ্য প্রবন্ধগুলির এই পরীক্ষায় এই মন্তব্যের যাথার্থ্য আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।