বঙ্কিমচন্দ্রের কমলাকান্তের দপ্তরের ‘পতঙ্গ’ প্রবন্ধের ডাববস্তু সংক্ষেপে বিবৃত করে প্রবন্ধটির রচনা বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনা করো।

আগুন দেখিলেই পতঙ্গ তার রূপে মুগ্ধ ও আকৃষ্ট হয়ে তাতে আত্মাহুতি দেয়। যুগ যুগ ধরেই পতঙ্গ তেলের আলো, বাতির আলো বা কাঠের আলোয় আকৃষ্ট হয়ে তাতে প্রাণবিসর্জন করে আসছে, প্রতিটি পতঙ্গের মধ্যেই সেই পতঙ্গ-জাতির অগ্নিশিখায় আত্মবিসর্জনের প্রবণতা মজ্জাগত। তারা প্রতিদিন ফুলের মধু পান করে, সমগ্র পৃথিবীর আনন্দদায়ক সূর্যকিরণে বিচরণ করে, কিন্তু তাতে তারা তৃপ্ত হয় না। পতঙ্গেরা অনুভব করে, ফুলের সেই একই গন্ধ, মধুর সেই একই ধরনের মিষ্টতা, সূর্যের দীপ্তিও একই রকম। তাদের কাছে এই জগৎ অসার, পুরনো ও বৈচিত্র্যহীনরূপে প্রতিভাত হয়। অগ্নিশিখা রূপময়, সে যেমন পোড়াতে এসেছে, তেমনি পতঙ্গও পুড়ে মরতে এসেছে। সেজবাতির কাচের ভেতরে যখন সেই অগ্নিশিখা বন্দী হয়, তখনই পতঙ্গ সেই আলোয় ঝাঁপ দিয়ে আত্মাহুতি দিতে পারে না। অগ্নিশিখা পৃথিবী ধ্বংস করতে সক্ষম, জগতে সে অপ্রতিরোধ্য, তার গতির কারণ। এই অগ্নিশিখার স্বরূপ পতঙ্গ জানে না, শুধু এইটুকুই জানে যে সে তার বাসনার বস্তু, জাগ্রতের ধ্যান, নিদ্রার স্বপ্ন, জীবনের আশা ও মৃত্যুর আশ্রয়। তার স্বরূপ পতঙ্গ যেদিন জানিতে পারবে সেইদিনই তার সুখ চলে যাবে, কারণ আকাঙ্ক্ষিত বস্তুর স্বরূপ জানলে কেউ আর সুখ অনুভব করে না।


পতঙ্গের মতো মানুষও বিভিন্ন কামনার আগুনে পুড়ে মরতে চায়। জ্ঞান, ঐশ্বর্য, মান, রূপ, ধর্ম, ইন্দ্রিয়—চারদিকেই তাদের আগ্নেয় আকর্ষণ। মানব-সংসার বহ্নিময় আবার সেজের আলোর কাচের মতো তাতে একটা আবরণ আছে, সেই আবরণ বা বাধার জন্য অনেকে কাম্য বস্তুর প্রতি আকর্ষণ বোধ করেও তাতে পুড়ে মরতে পারে না। সেই আবরণ না থাকলে এতদিনে সংসার পুড়ে মরত। যদি সমস্ত ধর্মবিৎ চৈতন্যদেবের মতো ধর্ম মানসে প্রত্যক্ষ দেখতে পেত, তবে কজন বাঁচত। বেশিরভাগ লোকই জ্ঞান বহ্নির আবরণ-কাচে ঠেকে রক্ষা পায় কিন্তু সক্রেটিস ও গ্যালিলিও তাতে পুড়ে মরলেন। রূপ, ধন, মান প্রভৃতির আগুনে অর্থাৎ কামনায় প্রতিদিন পতঙ্গের মতো অজস্র লোক পুড়ে মরে। কামনার বহ্নিদাহ যাতে বর্ণিত হয়, তাকেই আমরা কাব্য বলি। মান-বহ্নিতে পতঙ্গরূপ দুর্যোধন পুড়ে মরল, জগতে অতুলনীয় কাব্যগ্রন্থ মহাভারত সৃজিত হল, প্যারাডাইস লস্ট জ্ঞান-বহ্নিজাত দাহের কাব্য, ধর্ম-বহ্নির অদ্বিতীয় কবি সেন্ট পল। অ্যান্টনি ও ক্লিওপেট্রা ভোগ-বহ্নির, রোমিও ও জুলিয়েট্ রূপ-বহ্নির এবং ওথেলো ঈগো বহ্নির পতঙ্গরূপেই পুড়ে মরেছে। গীতগোবিন্দ ও বিদ্যাসুন্দরে ইন্দ্রিয়-বহ্নিকে জ্বলতে দেখি, স্নেহ-বহ্নিতে সীতারূপ পতঙ্গের দাহের জন্যই রামায়ণের সৃষ্টি : বহ্নি তথা ঈশ্বর, ধর্ম, জ্ঞান, স্নেহ ইত্যাদি কি আমরা জানি না, তবু সেই অলৌকিক ও অপরিজ্ঞাত পদার্থের জন্য অগ্নিশিখার রূপমুগ্ধ পতঙ্গের মতো তাদের চারিদিকে ঘুরে মরি।


বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কমলাকান্তের দপ্তরে’র ‘পতঙ্গ' রচনা সাহিত্যের উদাহরণ। এই জাতীয় রচনায় সাধারণ বিষয়বস্তুপ্রধান প্রবন্ধের একটি নির্দিষ্ট বিষয়কে কেন্দ্র করে তথ্য ও যুক্তির সুশৃঙ্খল বিন্যাসে বক্তব্য বিষয়কে প্রতিষ্ঠিত করার দিকে লেখকের কোনো লক্ষ্য থাকে না, লেখকের চিন্তা-ভাবনা আবেগ-অনুভূতি কখনও কৌতুক-পরিহাসে, কখনও মননশীলতার গাম্ভীর্যে, কখনও বা গীতিকবিতার আবেগস্পন্দনে রূপায়িত হয়; সেইসব বিভিন্ন প্রসঙ্গ ও প্রকাশভঙ্গির মধ্যে আমরা এক নিগূঢ় অন্তঃছন্দের সংগতি লাভ করি। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কমলাকান্তের দপ্তর’-এর সমস্ত চিন্তা, তত্ত্ব ও আবেগ-অনুভূতি উপস্থাপিত হয়েছে অর্ধোন্মাদ নেশাখোর ও ভবঘুরে কমলাকান্তের চিন্তা-অনুভূতির বিচিত্র তরঙ্গলীলায়। তার জীবনবীক্ষার ঐক্যসূত্রেই ‘কমলাকান্তের দপ্তর'-এর অন্যান্য রচনার মতো ‘পতঙ্গে'ও বিভিন্ন প্রসঙ্গ ও প্রকাশভঙ্গিকে সমন্বিত হতে দেখি।


কমলাকান্ত জমিদার নসীরাম বাবুর পার্শ্বচররূপে তাঁর আশ্রয় পেয়েছে, ‘পতঙ্গে'র সূচনায় নসীরাম বাবুর বৈঠকখানার সান্ধ্য আসরের এই বর্ণনা পাই : “বাবুর বৈঠকখানায় সেজ জ্বলিতেছে—পাশে আমি, মোসায়েবি ধরনে বসিয়া আছি। বাবু দলাদলির গল্প করিতেছেন,—আমি আফিম চড়াইয়া ঝিমাইতেছি। দলাদলিতে চটিয়া মাত্রা বেশী করিয়া ফেলিয়াছি। বিধিলিপি। এই অখিল ব্রহ্মাণ্ডের অনাদি ক্রিয়াপরম্পরার একটি ফল এই যে, ঊনবিংশ শতাব্দীতে কমলাকান্ত চক্রবর্তী জন্মগ্রহণ করিয়া অদ্য রাত্রে নসীরাম বাবুর বৈঠকখানায় বসিয়া মাত্রা বেশী করিয়া ফেলিবেন। সুতরাং আমার সাধ্য কি যে, তাহার অন্যথা করি।” কমলাকান্তের নিজের আফিমের মাত্রা চড়াবার এই নৈয়ায়িক ব্যাখ্যা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত কৌতুকাবহ। এই কৌতুকরসসিক্ত উপক্রমণিকার পরই পাই আফিমের প্রসাদে দিব্যকর্ণ প্রাপ্ত হয়ে কমলাকান্তের বাতির চারপাশে বোঁ-ও-চৌও শব্দ করে ঘুরে বেড়ানো একটি পতঙ্গের আলোর উদ্দেশে ভাষণ শ্রবণ। পতঙ্গ বলেছে, অগ্নির রূপে মুগ্ধ হয়ে তাতে আত্মবিসর্জনই তার স্বধর্ম ও অধিকার। কিন্তু এই আলো বা অগ্নিশিখা কাচের আবরণে থাকার জন্য সে তাতে আত্মাহুতি দিতে পারছে না। অতীতে পেতলের পিলসুজের ওপর মাটির প্রদীপে আলো শোভা পেত, তারা স্বচ্ছন্দে পুড়ে মরত। তারা পতঙ্গজাতি, জ্বলন্ত রূপশিখায় গা ঢেলে দেবার জন্যই তাদের জন্ম। এই অগ্নিশিখার স্বরূপ পতঙ্গের অজানা : “তুমি কি? তা আমি জানি না আমি জানি না—কেবল জানি যে, তুমি আমার বাসনার বস্তু—আমার জাগ্রতের ধ্যান-নিদ্রার স্বপ্ন—জীবনের আশা-মরণের আশ্রয়। তোমাকে কখন জানিতে পারিব না—জানিতে চাহিও না—যে দিন জানিব, সেই দিন আমার সুখ যাইবে। কাম্য বস্তুর স্বরূপ জানিলে কাহার সুখ থাকে?" পতঙ্গের এই উক্তিটি মননশীলতার গাম্ভীর্যে মানুষের অস্তবিহীন বাসনা সম্পর্কে তত্ত্বভাবনা প্রকাশিত হয়েছে।


শেষ অংশে আফিমের প্রসাদেই কমলাকান্ত উপলব্ধি করেছে, মানুষমাত্রেই পতঙ্গ, এক এক জন এক এক ধরনের বাসনার বহ্নিদহনে পুড়ে মরতে চায়, মরে কেউ কাচে ঠেকে ফিরে আসে। পৃথিবীর বিখ্যাত কাব্যনাটকগুলি সেইসব দাহেরই প্রকাশ। দর্শন, বিজ্ঞানে ও ধর্মপুস্তকে এই বহ্নির স্বরূপ মানুষের সামনে উন্মোচিত হয়নি: “ঈশ্বর কি, ধর্ম্ম কি, জ্ঞান কি, স্নেহ কি? তাহা কি, কিছু জানিনা। তবু সেই অলৌকিক, অপরিজ্ঞাত পদার্থ বেড়িয়া বেড়িয়া ফিরি। আমরা পতঙ্গ না ত কি?” এখানে আমরা দার্শনিক প্রজ্ঞার উদ্ভাসই লক্ষ্য করি। কমলাকান্তের মনন ও কল্পনার ঐক্যসূত্রে বিধৃত হয়েছে বলেই আমরা রচনাটির এই সমস্ত স্তর বা পটপরিবর্তনের মধ্যে কোনো অসংগতি বা ছন্দপতনের বিশৃঙ্খলায় পীড়িত হই না, তাদের মধ্যে এক গভীর ঐক্যের ছন্দোময় সুষমার প্রকাশে মুগ্ধ ও আকৃষ্ট হই। এটাই পতঙ্গের প্রকাশভঙ্গির বৈশিষ্ট্য।