“রুপকথার সৌন্দর্যসম্ভার তাহারই জন্যে, যে পৃথিবীর সংকীর্ণ আয়তনের মাঝে নিজ আশা ও কল্পনাকে সীমাবদ্ধ করে নাই।”—উদ্ধৃতিটি তথ্য সহযোগে আলোচনা করো।

মানুষ সংকীর্ণ দৈনন্দিন জীবনের গ্লানিভরা দিন কাটাতে কাটাতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। শুধু দিনযাপনের, ‘শুধু প্রাণধারণের গ্লানি নিয়ে কাটে তার অহোরাত্র। জীবন হয়ে ওঠে ক্লান্তিকর, সংকীর্ণ সীমার বাইরে যাবার জন্য মন বলে, “আমি চঞ্চল হে/আমি সুদূরের পিয়াসী"। অন্তরাত্মার এই ক্রন্দন সাড়া পায় রূপকথার জগতে। রূপকথার মায়াবী জগৎ, রহস্যময় জগৎ মানুষকে আকর্ষণ করে। মানুষ এই কল্পনার রহস্যে ঘেরা জগতে ছুটে যায়, পৃথিবীর সংকীর্ণ সীমা থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে মানুষ ছুটে চলে কল্পনার জগতে। যেখানে অসম্ভবের জগতে সে সাড়া দেয়, অভাবনীয় কল্পনার জগতে যা কিছু অবিশ্বাস্য তাকে সন্ধান করে ফেরে। মানুষের মনে যে কুহেলিকাময় প্রদেশ আছে, যে অস্পষ্ট অনুভূতি সুপ্ত থাকে, তা রূপকথার জগতে এসে মুক্তি পায়। এই কারণে শিশু বয়স্ক নির্বিশেষে সকলের মন সাড়া দেয় রূপকথার জগতে। ঠাকুমার কোলে শুয়ে শুয়ে স্তিমিত প্রদীপ আলোয় শিশুর অন্তরের কৌতূহলের শেষ থাকে না। বয়স্ক মানুষের দৈনন্দিনতায় অতৃপ্ত মন সুদূরের পিয়াসী হয়ে ওঠে। এই চাঞ্চল্য রূপকথার জগতের দিকে মানুষকে টেনে নিয়ে যায়। মনে হয়, প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ যাদের কাছে কল্পনার রাজ্যের দুয়ার স্তব্ধ, যারা সামান্য প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে, সংসারের অর্থনৈতিক সংগ্রাম বা বাস্তবতা যাদের দৃষ্টিকে সীমিত করে তারা হয়তো এই উঠতি কল্পনার জগতে সাড়া দিতে পারে না। অথবা সংকীর্ণতা থেকে মুক্তির জন্য ফিরে যায় তেপান্তরের মাঠে। সেখানে কল্পনার অশ্ব ছুটিয়ে বন্দিনী রাজকন্যাকে উদ্ধারের জন্য রাজপুত্রের ভূমিকা নিয়ে ছুটে চলে। বন্দিনী রাজকন্যাকে দেখে অন্তঃপুরবাসিনী প্রেয়সীরূপে, তার স্বর্ণ-পালঙ্কে হয়তো মায়াবী চাঁদের আলো এসে পড়েছে। সেই চিরপ্রেয়সীর উদ্দেশ্যে রাজপুত্রের অভিযাত্রা প্রেমের চিরন্তন রোমান্সে। বর্তমানের বণিকধর্মী বিবাহে এ রোমান্স নেই, সংকীর্ণ জীবনযাত্রায় এই রোমান্স লুপ্তপ্রায়, সংকীর্ণ জগতের সংকীর্ণ দৃষ্টি দিয়ে পাতালপুরের নাগকন্যাকে পাওয়া যায় না। কাঞ্চনমালা-মালওমালার জগতেও যাওয়া যায় না। নানা অসম্ভব ঘটনার বাতাবরণে ঢাকা বলেই রূপকথার রোমান্স বিলাস তার সর্বপ্রকার সৌন্দর্যভাণ্ডারকে মানুষের কাছে উন্মুক্ত করে দেয়। মানবমনের চিরন্তন ঐক্যের ফলেই রূপকথার আবেদনে সহজেই মানুষ জেগে ওঠে। যে রাজপুত্র শ্বেতহংসের ডানায় চেপে সূর্যকন্যার পাণিপ্রার্থনায় সূর্যের কাছে অনুমতি প্রার্থনায় ছুটে সৌরলোকে অনেক সমুদ্র পেরিয়ে। এইসব অসম্ভব ঘটনার মধ্যে যে আহ্বান আছে, সেই আহ্বান-মানবমনের শাশ্বত ঐক্যকে জাগ্রত করে তোলে। কখনও কখনও মনে চলে, পাহাড়ের অনেক অনেক ওপরে যেখানে কেবল রাশি রাশি তুষার, সেখানে থাকে তুষার রাজ্যের রাজা। মানুষের মন এই অসম্ভব রাজ্যে ঘুরে বেড়ায়। কারণ তার মনেই লুকিয়ে আছে কুহেলিকার প্রদেশ। একজন পণ্ডিত সমালোচক বলেছেন, “রূপকথার এই সমস্ত গল্প মানুষের জয় এবং জয়েচ্ছার সংকেত বহন করে আনে। তাকে যে কোন উপায়ে আত্মরক্ষারই উপদেশ দেয় না-দুর্লভ্যের অভিযানে নির্ভয়ে বেরিয়ে পড়বার জন্য অনুপ্রাণিতও করে।”—এইসব গতিশীলতা মানুষের কল্পনাকে জাগায়। এই কল্পনার উন্মেষের ফলে মানুষ বাস্তব পৃথিবী থেকে অনেক দূরে চলে যায়।


রূপকথার সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে গিয়ে ড. শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন: “রূপকথা নামটির চারিধারে একটি রহস্যঘন মাধুর্য, একটি ঐন্দ্রজালিক মায়াঘোর বেষ্টন করিয়া আছে। নামটি আমাদের হৃদয়ের গোপন কক্ষে গিয়া আঘাত করে ও সেখানকার সুপ্ত নামহীন বাসনাগুলির মধ্যে একটা সাড়া জাগাইয়া দেয়।” সংকীর্ণ চিত্ত সংসারী মানুষের কাছে রূপকথা কল্পনারাজ্যের দ্বার খুলে দেয়। সংসারানভিজ্ঞ মনের স্বচ্ছন্দ ভ্রমণের উপযুক্ত ক্ষেত্র রচনা করে। “রূপকথার সৌন্দর্যসম্ভার তাহার জন্য যে পৃথিবীর সংকীর্ণ আয়তনের মাঝে নিজ আশা ও কল্পনাকে সীমাবদ্ধ করে নাই।” শিশু মনের গোপন কোণে ঘন অন্ধকার জমাট বেঁধে থাকে। সেই অন্ধকার থেকে মুক্তির জন্য রূপকথার কল্পলোকে শিশু আনন্দ পায়। “প্রত্যেকেই তাহার প্রাত্যহিক, নীরস, যন্ত্রবদ্ধ কাজের অবসরে এই কল্পলোকে, এই কল্পনার দুর্গে ক্ষণিক আশ্রয় গ্রহণ করে; এখানে বসিয়াই সে আকাশকুসুম চয়ন করে ও শূন্যে প্রাসাদ-নির্মাণের উপকরণ সংগ্রহ করে।”


রূপকথার সৌন্দর্য কল্পনায়। কল্পনা জগৎ সৃষ্টি করে সৌন্দর্য। এই সৌন্দর্য কখন প্রবাল রাজ্যে, কখনও তুষাররাজ্যে। ড্রাগনের বিষাক্ত নিশ্বাস, মায়ারুপিনী সর্পের ছলনা ও চক্রান্ত, ডাইনির মন্ত্রতন্ত্র, নাগকন্যার চক্রান্ত, দৈত্যদানব ও জিনের প্রতিবন্ধকতা সবই শিশুমনকে টানে, অসম্ভব হলেও বয়স্ক মনকে লুব্ধ করে। আর তার মধ্যে দিয়েই রূপকথার ধারা বয়ে চলে। প্রাজ্ঞ সমালোচক বলেছেন, “রূপকথার ধারা অবশ্য আজও বয়ে চলেছে, কিন্তু এখন তার স্থান শিশুজগতে। তবু এই সমস্ত শিশুপাঠ্য কাহিনীর অন্তরালে মানুষের চিরন্তন আশা-আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্নের গভীর তত্ত্বটি সন্নিহিত।”