ডায়রী

দিনলিপি, দিনপঞ্জী, রোজনামচা, ডায়রী—নাম অনেক, কিন্তু বিষয় এক।

বিস্মরণের বালুতটে স্মরণের সায়র সাজিয়ে মানুষ আপন কথা, সকল অভিজ্ঞতাকে স্মরণীয় করে তুলতে চায়। আর এই প্রবণতা থেকেই মানুষ তার চলার পথে দিনযাপনের স্মরণীয় মুহূর্ত বা ঘটনাকে স্মরণ করতে চায় তার দিনচর্যার দিনলিপিতে। অবশ্য বেনোজলের মতো অনেক অপ্রয়োজনীয় সাধারণ কথাও ডায়রীর মধ্যে ভেসে আসে। আর এই প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় সব কথা নিয়েই ভরে ওঠে লেখকের ডায়রীর পাতা।


সাহিত্যের অঙ্গনে ডায়রীর কৌলীন্য খুব একটা স্বীকৃত নয়। তবু, এর প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। প্রাত্যহিক জীবনের সংস্পর্শে এসে মানুষকে নানারকম কাজ করতে হয়। তার কিছু অংশ দৈনন্দিনতার প্রয়োজনের বেড়া দিয়ে ঘেরা কেজো কাজ। আর কিছু অংশ তার ভাবনার জগৎ। সাধারণ মানুষের কাছে কেজো কাজের মূল্য রয়েছে, কিন্তু মানুষের ভাবনার জগতের হদিসের মূল্য রয়েছে, সৃজনশীল সাহিত্যিকের কাছে। ক্ষণকালের মধ্য থেকেই উপকরণ সংগ্রহ করে সাহিত্যিক তাকে চিরকালের জন্য গড়ে তোলেন।


তথ্য প্রাধান্য ডায়রীর একটা বড়ো বৈশিষ্ট্য এবং ডায়রী রচনার ক্ষেত্রে দৈনন্দিন জীবনের খুঁটিনাটি বা দৈনন্দিন জীবন-চর্চার বিবরণী নিয়ে গড়ে ওঠে ডায়েরীর আঙ্গিক। পরিবেশনের দিক দিয়েও সাংবাদিকতার রীতি কখনও প্রচ্ছন্ন কখনও প্রকাশ হয়ে ওঠে। ঘটনার বিবরণী ডায়রীর প্রধান অংশ অধিকার করে। তবু সাধারণ বিবরণীর তৃণরাজির মধ্যে মহৎ সাহিত্যের বীজ লুকিয়ে থাকে, পরবর্তীকালে তা ভাবনার মহীরুহ হয়ে দেখা দেয়।


সাহিত্যিকদের পরবর্তীকালে অনেক সাহিত্য রচনার প্রাথমিক রূপ বা ছক দেখা যায় তাদের সঞ্চিত দিনলিপির মধ্যে। এই দিনলিপি বা ডায়রী থেকেই ভাবনার বীজ নিয়ে পরবর্তীকালে অনেকের রচনা-সাহিত্য গড়ে উঠেছে। বিশেষ করে ভ্রমণ-সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে আমরা এর ব্যাপক প্রয়োগ দেখতে পাই। (রবীন্দ্রনাথের অনেকগুলি ভ্রমণ-পত্র তাঁর ভ্রমণের ডায়রীর মতো।) ভ্রমণ-সাহিত্যের পশার সাজানোর ক্ষেত্রে অনেক লেখকই প্রাথমিক মশলা হিসেবে তাঁদের ডায়রীকে ব্যবহার করেছেন এবং গ্রহণ-বর্জনের দ্বারা তাঁদের ভ্রমণ কাহিনির পূর্ণাঙ্গ রূপ দিয়েছেন।


রবীন্দ্রনাথের অনেকগুলি ভ্রমণ-পত্র তাঁর ভ্রমণের ডায়রী। কয়েকটি ভ্রমণ সংক্রান্ত গ্রন্থে তিনি ‘ডায়রী' নামটা যোগ করেছেন, যেমন, 'য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়রী’, ‘পশ্চিম-যাত্রীর ডায়রী'। এই ডায়রী কথাটাকে যুক্ত না করেও রবীন্দ্রনাথ যে-সব ভ্রমণ বৃত্তান্ত লিখেছেন, যথা 'য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র’, ‘জাপান-যাত্রী’, ‘জাভা-যাত্রীর পত্র'—সেগুলিতেও প্রায় প্রতিদিনের এবং স্থানের উল্লেখ করে ডায়রীর একটা আঙ্গিক নিয়ে এসেছেন। তবু তা দৈনন্দিন কাজের বিবরণী নিয়ে নিছক ডায়রী হয়ে ওঠেনি। স্থান এবং ঘটনাগুলি তাঁর সখের অর্গলকে মুক্ত করেছে, বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহ ও মানব চরিত্র তাঁর ভাবনালোককে উজ্জীবিত ও উদ্দীপিত করেছে, আমরা রবীন্দ্রনাথকে পেয়েছি। কবি ও সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথের বৈশিষ্ট্য তাঁর এই ডায়রীগুলির মধ্যেও বর্তমান। ডায়রী লিখতে বসে তিনি আদালতের হলফ পাঠ পূর্বক কোথাও নিছক তথ্য সরবরাহ করতে রাজী হননি। সমস্ত তথ্যগুলিকে প্রথমে নিজের মধ্যে সংহরণ করে নিয়েছেন। সে তথ্যগুলি যখন কবির ভেতরে পৌঁছে কবির ‘হৃদয়ের জারক রসে’ পরিপক্ক হয়ে কবির জীবনের তথা ব্যক্তিপুরুষেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে তখনই তিনি তা প্রকাশ করেছেন। ডায়রী লেখা সম্বন্ধে একস্থানে তিনি বলেছেন, 'কথায় কথা বেড়ে যায়। বলতে যাচ্ছিলুম ডায়রী লেখাটা আমার স্বভাব-সঙ্গত নয়। আমি তথ্য সংগ্রহ করিনে। আমার জলাশয়ের যে জলটাকে অন্যমনস্ক হয়ে উবে যেতে দিই, সেইটেই অদৃশ্য শূন্যপথে মেঘ হয়ে আকাশে জমে, নইলে আমার বর্ষণ বন্ধ।' কবি অন্যত্র বলছেন, 'চোখের পেছনে চেয়ে দেখার একটা পাকযন্ত্র আছে, সেইখানেই দেখাগুলো বেশ করে হজম হয়ে না গেলে সেটাকে নিজের করে দেখানো যায় না। তা নাই বা দেখানো গেল—এমন কথা কেউ বলতে পারেন। যেখানে যাওয়া গেছে সেখানকার মোটামুটি বিবরণ দিতে দোষ কি? দোষ না থাকতে পারে—কিন্তু আমার অভ্যাস অন্যরকম। —আমি টুকে যেতে টেকে যেতে পারিনে। না-কখনো নোট নিতে ও রিপোর্ট দিতে অনুরুদ্ধ হয়েছি, কিন্তু সে সমস্ত টুকরো কথা আমার মনের মুঠোর ফাঁক দিয়ে গলে ছড়িয়ে পড়ে যায়। প্রত্যক্ষটা একবার আমার মনের নেপথ্যে অপ্রত্যক্ষ হয়ে গিয়ে তারপরে যখন প্রকাশের মঞ্চে এসে দাঁড়ায় তখনই তাঁর সঙ্গে আমার ব্যবহার।


এই কারণেই তাঁর ‘ডায়রী’ নামাঙ্কিত এবং অ-নামাঙ্কিত প্রায় সব ভ্রমণ-কাহিনি এবং তার মধ্যেকার সমস্ত আলোচনা সাধারণ ডায়রী না হয়ে, হয়ে উঠেছে সাহিত্য। সমস্ত তথ্য বিবরণ ও আলোচনার মধ্যে তিনি কি বলছেন তাতেই আমাদের মন সম্পূর্ণভাবে নিবিষ্ট হয়ে থাকে না, কে বলছেন এবং কেমন করে বলছেন সেদিকেও আমাদের কৌতূহলের সীমা নেই। সাহিত্যে এবং অ-সাহিত্যে এখানেই প্রভেদ। সাধারণ রোজনামচার সঙ্গে সাহিত্যিকের কলমে লেখা রোজনামচার এখানেই পার্থক্য। আর এই পার্থক্যটা মৌলিক।


এই রোজনামচা বা ডায়রী লেখার প্রথা সুপ্রাচীন কাল থেকেই বহমান। আলবেরুনী প্রমুখ সুদূর অতীতের ভ্রমণকারীদের যে-সব ভ্রমণকাহিনি আমাদের হাতে এসে পৌঁছেছে তার সবই ডায়রীর আঙ্গিকে রক্ষিত। বিবেকানন্দের বিশ্ব-পরিক্রমার দলিল ‘পরিব্রাজক’ লেখা হয়েছে দিনক্ষণ উল্লেখ করে মূলত এই ডায়রীর আঙ্গিকে। কলকাতা থেকে যাত্রাপথের প্রতিদিনের হিসেবকে মিলিয়ে তিনি দূর প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য ভ্রমণের রেখাঙ্কন তৈরি করেছেন। আর এই প্রসঙ্গেই একের পর এক তাঁর দেখা প্রতিটি দেশের ভৌগোলিক, ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক পরিচয় দানের সঙ্গে সঙ্গে সেইসব দেশের মানুষের সঙ্গেও আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন, সেইসব দেশের প্রেক্ষাপটে আপন দেশ-কালের চিত্রটিও দরদিভাষায় তুলে ধরেছেন। তারই ফলে তাঁর ‘পরিব্রাজক’ নিছক প্রত্যহের রোজনামচা, ডায়েরী বা বিবরণীর স্তর থেকে গণনীয় সাহিত্যের স্তরে উন্নীত হয়েছে। ব্যক্তি মানুষটি তাঁর লেখার মধ্য দিয়ে আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। ডায়রী রচনা হয়ে উঠেছে রচনা-সাহিত্য।


বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর, বনফুল প্রমুখ খ্যাতনামা সাহিত্যিকগণও তাঁদের প্রাত্যহিক জীবনের ছোটো ও বড়ো ভাবনার সূত্রকে, তাঁদের কাছে এগিয়ে আসা মানুষদের বৈশিষ্ট্যকে তাঁদের ছোটো-বড়ো প্রাপ্তির আনন্দ ও বেদনাকে নিয়ে তাঁদের মনের রেখা-রূপকে ডায়রীর পাতায় ধরে রাখতেন। তাঁদের লেখা এই ডায়রীর কিছু কিছু প্রকাশিতও হয়েছে। এই প্রখ্যাত সাহিত্যিকদের পরবর্তীকালে রচিত উপন্যাসগুলির মধ্যে সেইসব মানুষ ও ঘটনার খসড়ারূপ আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সাহিত্যিকের কলমে রচিত এই ডায়রীর মূল্য শুধু সেখানেই নয়, পরবর্তীকালে রচিত দেবী প্রতিমার শুধু কাঠামো নির্মাণেই নয়, ভাবনার মন্ময়তায়, পরিবেশনের লাবণ্যকে নিয়ে রচিত প্রাত্যহিকের বেড়া দিয়ে ঘেরা এই ডায়রী নিজেই সাহিত্য হয়ে উঠেছে।


কাজেই আমরা দেখতে পাচ্ছি, যে গুণে প্রবন্ধ, পত্রাবলী বা ভ্রমণ-কথা সাহিত্য হয়ে ওঠে, তার কেজো কথার রেশম গুটি কেটে সাহিত্যিকের কল্পনার রামধনু রঙ মেখে প্রজাপতি হয়ে বেরিয়ে আসে, সেই গুণেই একটা দিনলিপি বা ডায়রী প্রাত্যহিকের প্রয়োজনকে ঘিরে আরম্ভ হলেও অনির্বচনীয়ের আহ্বানে সেই প্রয়োজনের গুটি থেকে অপ্রয়োজনের প্রজাপতি বেরিয়ে আসে। ডায়রী সাহিত্যের একটা অংশ হয়ে দাঁড়ায়।