পত্র-সাহিত্য

চিঠিপত্র লেখে মানুষ ব্যক্তিগত প্রয়োজনের তাগিদে। কিন্তু প্রয়োজন যখন মুখ্য হয়ে ওঠে, পত্র যখন তথ্যভারে ভারাক্রান্ত হয়, তখন সে চিঠি বা পত্র সাহিত্য পদবাচ্য হয়ে উঠতে পারে না, যে চিঠি লেখকের প্রয়োজনকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে, যে চিঠিতে ব্যক্তিসত্ত্বার স্পর্শ নেই, যে চিঠি রচয়িতার অন্তরের রঙে, রসে অনুরঞ্জিত, সঞ্জীবিত নয়, তার মধ্যে যতগুণই থাকুক সেগুলি পত্র, পত্র-সাহিত্য নয়। শ্রেষ্ঠ পত্র তাকে বলা যায় না।


তাই প্রয়োজনকেন্দ্রিক বৈষয়িক পত্রকে এই আলোচনা বৃত্তের বাইরে রাখলে, পত্র-সাহিত্যকে মোটামুটি দুটো ভাগে ভাগ করা যায় : (১) প্রণয়মূলক বা প্রেমপত্র, (২) অনুভূতি বা ভাবপ্রধান পত্র। পত্রে লেখক ও প্রাপক—এই দুজনকে ঘিরে সৃষ্টি হয় এক অন্তরঙ্গ সুর। আর এই দিক দিয়ে সাহিত্য হিসেবে পত্র-সাহিত্য রচনা-সাহিত্যের সঙ্গে নিকটসূত্রে সম্বন্ধযুক্ত। উভয়ের মধ্যে বিশেষ মিল এখানে যে মূলত রচনা-সাহিত্য যেমন বারোয়ারী জিনিস নয়, অনেকখানি ঘরোয়া, পত্র-সাহিত্যও তাই। বরঞ্চ পত্র-সাহিত্যে এই গুণ রচনা-সাহিত্য থেকেও বেশি থাকবার কথা, কারণ এগুলি বিশেষভাবে একটি লোকের জন্য লেখা। সে লোকটি হচ্ছে এমন একজন ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি যার সঙ্গে লেখকের অন্তরের যোগ একান্তই অকুণ্ঠিত ও অকৃত্রিম। পত্র-সাহিত্যের মূল কথাটি রবীন্দ্রনাথ নিজেই একটা পত্রে স্পষ্ট করে তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, 'দেশ থেকে বেরোবার মুখে আমার উপর ফরমাস এলো কিছু কিছু লেখা পাঠাতে হবে। কাকে পাঠাব লেখা, কে পড়বে? সর্বসাধারণ। সর্বসাধারণকে বিশেষ করে চিনিনে এইজন্য তার ফরমাস যখন লিখি তখন শক্ত করে বাঁধানো খুব একটা সাধারণ খাতা খুলে লিখতে হয়, সে-লেখার দাম খতিয়ে হিসেব কষা চলে।


কিন্তু মানুষের একটা বিশেষ খাতা আছে তার আলগা পাতা, সেটা যা-তা লেখার জন্য, সে লেখার দামের কথা কেউ ভাবেও না। লেখাটাই তার লক্ষ্য, কথাটা উপলক্ষ। সে রকম লেখাটা চিঠিতে ভালো চলে, আটপৌরে লেখা,—তার না আছে মাথায় পাগড়ি, না আছে পায়ে জুতো। পরের কাছে পরের বা নিজের কোনো দরকার নিয়ে সে যায় না, সে যায় যেখানে বিনা দরকারে গেলেও জবাবদিহি নেই, – যেখানে কেবল বকে যাওয়ার জন্যই যাওয়া-আসা। .......... চিঠি হচ্ছে লেখার অক্ষরে বকে যাওয়া। .......... বকবার জন্য অবকাশ চাই, লোক চাই। বক্তৃতার জন্য লোক চাই অনেক, বক্তার জন্য এক-আধজন। চিঠির মধ্যে থাকে আত্মীয়তার হাল্কা সুর।'


রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, 'যারা ভাল চিঠি লেখে তারা মনের জানালার ধারে বসে আলাপ করে যায়—তার কোন ভাব নেই, বেগও নেই, স্রোত আছে। ভাবহীন সহজের রসই হচ্ছে চিঠির রস।'


আঁক থেকে যে-দিন মানুষ আখর, অক্ষর বা লিপি আবিষ্কার করতে শিখেছে, সে-দিন থেকেই হয়তো পত্র এবং পত্র-সাহিত্যের জন্ম হয়েছে। রামায়ণ, মহাভারত, গ্রিক পুরাণ কথায় পত্র রচনার উল্লেখ পাওয়া যায়। নল-দময়ন্তী উপাখ্যানে হংসের পায়ে বেঁধে নলরাজাকে দময়ন্তীর পত্র পাঠানোর কথা অনেকেরই জানা কাহিনি।


গদ্য সাহিত্যের উদ্ভবমূলে দাঁড়িয়ে আছে এই পত্র বা পত্র-সাহিত্য। মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যে আমাদের দেশে রাজা ও ভূস্বামীদের লেখা পত্রে সমসাময়িক বাংলা গদ্যের প্রাথমিক রূপ ও গতিপ্রকৃতির সন্ধান পাওয়া যায় এবং বাংলা গদ্যের এই যাত্রা শুরু হয়েছিল ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ বা শ্রীরামপুর মিশনারিদের প্রচেষ্টার আগে থেকেই। ইংরেজি উপন্যাস সাহিত্যের জন্মও এই পত্র-সাহিত্য থেকেই।


কৌতূহলোদ্দীপক হলেও এটা সত্য যে ইংরেজি সাহিত্যের প্রথম উপন্যাসিক রিচার্ডসন প্রথম জীবনে একজন পত্রলেখক রূপেই হাত মস্ক করতেন। পাড়ার অশিক্ষিতা ঝি চাকরানীর দল তাঁর কাছে প্রেমপত্র লেখাতে আসত। ঐ সব ফরমায়েসি পত্র লিখতে লিখতে তাঁর মনে একটা আদর্শ পত্র রচনা পদ্ধতি লেখবার ইচ্ছা জাগল। এই আদর্শ পত্ররচনা-পদ্ধতি গ্রন্থে রিচার্ডসন পামেলা নামক এক কাল্পনিক দাসী চরিত্রের অবতারণা করলেন। এই ‘পামেলা’ ধনী মনিবের কনিষ্ঠ পুত্রের প্রেমে পড়ে কি অবস্থার মুখোমুখি হয়েছে তাই যেন তার বান্ধবীকে পত্র লিখে জানাচ্ছে। রিচার্ডসনের এই 'পামেলা' গ্রন্থটিই ইংরেজি সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস।


বিশ্ব পত্র সাহিত্যে কীটস, ওয়ালপোল, রবার্ট লিল্ড, বার্ণাড শ প্রমুখ কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। কীটসের পত্র বেশিরভাগই গভীর মননের দৃষ্টান্তবহ। কিন্তু বার্ণাড শ-এর পত্র লঘু আনন্দের বৈঠকি মেজাজ বহন করে নিয়ে আসে।


কিছুকাল আগেও বাংলা ভাষাতেও এই জাতীয় সচিত্র প্রেমপত্র-রচনা শিক্ষামূলক পুস্তকের অভাব ছিল না। ‘যাও পাখি বলো তারে, সে যেন ভুলে না মোরে' জাতীয় প্রেমপত্র রচনার নমুনা-সম্বলিত পুস্তকগুলি সেকালে খুব জনপ্রিয় ছিল।


পত্র-সাহিত্যের ক্ষেত্রে স্বামী বিবেকানন্দের পত্রাবলীর কথা সশ্রদ্ধায় স্মরণীয়। বিবেকানন্দের অধিকাংশ রচনা ইংরেজিতে লিখিত। বাংলায় লিখিত গ্রন্থ মাত্র কয়েকখানি। তাঁর চিঠিপত্র এই বাংলা রচনার সামান্য স্বাক্ষর। তিনি চিঠিপত্রে শিষ্য ও গুরুভ্রাতাদের নানা তত্ত্বোপদেশ দিতেন, আলোচনা করতেন। তত্ত্বকথা ও উপদেশের অন্তরালে সহজ, সরল ভাষায় তাঁর ব্যক্তি মনের অন্তরঙ্গ রূপটি এই পত্রাবলীকে সাহিত্যের পর্যায়ে উন্নীত করেছে। পত্রাবলী হয়ে উঠেছে পত্র-সাহিত্য। আর তাই এই পত্রাবলী পত্র-সাহিত্যের এক মূল্যবান সামগ্রী রূপে গণ্য হবার যোগ্য।


বাংলা পত্র-সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের অবদান অপরিসীম। রবীন্দ্রনাথ বিচিত্রধর্মী অসংখ্য পত্র লিখেছেন, অনেকগুলি পত্র তাঁর ভ্রমণের ডায়েরির মতো। পত্র অভিধাযুক্ত পুস্তকাকারে প্রকাশিত সেই গ্রন্থগুলি হল ‘য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র’, ‘জাভা-যাত্রীর পত্র’, ‘ভানুসিংহের পত্রাবলী’, ‘রাশিয়ার চিঠি’, ‘ছিন্নপত্র’ এবং কয়েক খণ্ডে প্রকাশিত ‘চিঠিপত্র'। রবীন্দ্রনাথের এই বিপুল পত্র-সাহিত্যের মধ্যে তাঁর সমগ্র ব্যক্তিত্বের পরিচয় অন্তর্নিহিত। রবীন্দ্রনাথের এই পত্রাবলী কখনও পরিহাসতরল, কখনও গম্ভীর দর্শনমূলক, কখনও বিষাদ ও বৈরাগ্যের কুহেলিতে সমাচ্ছন্ন, কখনও বা জীবনাবেগের সূর্যালোকে সমুজ্জ্বল।


‘ছিন্নপত্রে’র পত্রাবলীর ভেতরে কবিকে পরবর্তীকালের চিঠিগুলি অপেক্ষা বেশি পাওয়া যায়। 'ছিন্নপত্রে 'র পত্রগুলি লেখা কবির সহৃদয় ঘনিষ্ঠ বন্ধুজনদের কাছে এবং অনেকখানিই ‘একজন’কে লেখা। পত্রগুলির মধ্যে সাধারণ মানুষটির একটা অকৃত্রিম সরস পরিচয় রয়েছে। ছোটো ছোটো তুচ্ছ ক্ষুদ্র বর্ণনা ও টীকা-টিপ্পনীর মধ্য দিয়ে এই পরিচয়টি প্রকাশ পেয়েছে। দার্জিলিং থেকে একটা চিঠিতে কবি লিখেছেন, মেয়েদের এবং অন্যান্য জিনিস পত্র ladies compartment-এ তোলা গেল, কথাটা শুনতে যত সংক্ষেপ হলো কাজে ঠিক তেমনটা হয় নি। ডাকাডাকি হাঁকাহাঁকি ছুটোছুটি নিতান্ত অল্প হয় নি। – তবু ন – বলেন আমি কিছুই করিনি – অর্থাৎ একজন আস্ত মানুষ একেবারে আস্ত রকম দেখলে যে-রকমটা হয় সেই প্রকার মূর্তি ধারণ করলে ঠিক পুরুষ মানুষের উপযুক্ত হতো। কিন্তু এই দু'দিন আমি এত বাক্স খুলেছি এবং বন্ধ করেছি এবং বেঞ্চির নীচে ঠেলে শুজেছি; এবং উক্ত স্থান থেকে টেনে বের করেছি এত বাক্স এবং পুঁটলির পিছনে আমি ফিরেছি এবং এত বাক্স এবং পুঁটলি আমার পিছনে অভিশাপের মত ফিরেছে, এত হারিয়েছে এবং এত ফের পাওয়া গেছে যে, কোনো ছাব্বিশ বৎসর বয়সের ভদ্র সন্তানের অদৃষ্টে এমনটা ঘটে নি।' – এর মধ্যে যে-রবীন্দ্রনাথ কথা বলেছেন তিনি আমাদের আর পাঁচজনের মতোই অতি নিকটের জন।


তবে এই ‘একজন’কে চিঠি লেখার সঙ্কল্প নিয়ে পত্র লিখতে বসলেও তিনি শুধুমাত্র ‘একজন'কেই পত্র লিখে উঠতে পারেননি। কারণ রবীন্দ্রনাথের প্রতিভার বিকাশের কিছু পর হতেই তিনি দেশে এবং বিদেশে এমন বারোয়ারি সম্পত্তি হয়ে উঠেছিলেন যে মধ্যজীবন থেকেই তিনি যত চিঠি লিখেছেন, এবং যাকে সম্বোধন করেই লিখুন না কেন, তার শ্রোতা বাংলাদেশের হাজার হাজার মানুষ—এটা তার পক্ষে ভুলে যাওয়া বাস্তবে সম্ভব ছিল না। দ্বিতীয়ত, ‘হাল্কা কলমের লেখায় রবীন্দ্রনাথ চিঠি লিখতে বসলেও তাঁর ভাব ও ভাবনাগুলি মনের ভেতর ভিড় করে একটা গভীর খাতে বয়ে চলতে থাকত। কখনও বিষয়বস্তুতে মগ্ন, কখনও আত্মীয়তার হালকা চালে ভেসে ওঠা। —এই উভয় টানাপোড়েনে বিশ্বকবির হাতে সৃষ্ট পত্রাবলী তাঁর অন্তরঙ্গজনের এক্তিয়ার নিয়েও হয়ে উঠেছে বিশ্বলোকের সম্পত্তি।


সম্প্রতি শরৎচন্দ্রের কিছু অপ্রকাশিত পত্র প্রকাশিত হয়েছে। বরেণ্য সাহিত্যিকের কলমে লেখা এই পত্রগুলিকে সাহিত্যগুণের সঙ্গে সঙ্গে লেখক শরৎচন্দ্রের মানসিক ভাবনার ছাপ ও পত্রগুলির মূল্য বৃদ্ধি করেছে। রবীন্দ্রোত্তর যুগে কল্লোল গোষ্ঠীর লেখকদের মধ্যে অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তকে লেখা প্রেমেন্দ্র মিত্রের কতকগুলি পত্র সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।


এখানে একটা কথা স্মরণযোগ্য। পত্র-সাহিত্য সাহিত্যের একটা বিশিষ্ট অংশ নয়। তা সাহিত্যের উপজ অংশ (by product)। সাহিত্য রচনার উদ্দেশ্য নিয়ে পত্র রচিত হয় না, রচয়িতার অজ্ঞাতে রচিত পত্ৰ সাহিত্যে উত্তীর্ণ হয়। তাই একটা দেশের সাহিত্য যত উন্নত হয়, সাহিত্যিকের মননশক্তি যত শক্তিশালী ও বলিষ্ঠ হয়, সে দেশের পত্রসাহিত্যও তত সুসমৃদ্ধ হয়।