“আমাদের বঙ্গদেশের সামাজিক অবস্থা ও বিচারের কি এক সম্পূর্ণ ছবি এই রূপকথার মধ্যে প্রতিফলিত হইয়াছে।”—উদ্ধৃত উক্তিটি তথ্য সহযোগে মন্তব্যটির বিশ্লেষণ করো।

রূপকথায় কল্পনা রাজ্যের ছবিই ফুটে ওঠে। রূপকথায় মানুষের হৃদয়ের রহস্য ঘেরা মাধুর্যঘন চিত্রই মানুষকে আকর্ষণ করে। রূপকথা মানুষের অস্পষ্ট অনুভূতির স্পন্দনকে জাগিয়ে তোলে। এই সূক্ষ্ম, রহস্যময় মায়াজগৎ যেন বাস্তবের ধূলিমলিন জগৎ থেকে সুদুর। এই কারণে রূপকথাকে অনেকেই বাস্তব-বিচ্যুত অলীক ও অভাবনীয় ব্যাপার বলে মনে করেন। রূপকথা সম্পর্কে এইটেই প্রধান অভিযোগ। কিন্তু সূক্ষ্ম বিশ্লেষণে দেখা যায় যে রূপকথায় সামাজিক ও গার্হস্থ্য জীবনের চিত্রও পরিস্ফুট হয়। রূপকথার বিষয়বস্তু রাজা-রাজড়ার কথা। তবু এর মধ্যে সাধারণ লোকের জীবন চিত্রের সংকেত পাওয়া যায়। এই চিত্রের মধ্যে অবজ্ঞার চিহ্নমাত্র নেই। রাজপুত্র কখনও কখনও বিপদগ্রস্ত হয়ে দরিদ্রের কুটীরে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয় ও শেষে আশ্রয়দাতার গৃহে বাৎসল্যের টানে পালিত হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য শেষ হলে, সৌভাগ্যসূর্য উদিত হলে তখন তার ছায়া থেকে বঞ্চিত হয়নি আশ্রয়দাতা। সমাজের সঙ্গে লেখক অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত হয়ে গিয়েছেন, যে তার নিজ ব্যক্তিগত জীবন বলে কিছু নেই। রূপকথার রাজ্যের স্বপ্ন ও রহস্য ঘেরা জগৎ থেকে এই বাস্তব জীবনচিত্র বিস্ময় উদ্রেক করে। এই জন্যই লেখক মন্তব্য করেন যে, রূপকথায় প্রতিফলিত হয়েছে পারিবারিক ও সামাজিক ব্যবস্থা। “বাঙালি সমাজের পরিবারের ও সমাজের নিখুঁত ছবি রূপকথার মধ্যে প্রতিফলিত হইয়াছে।” এই উক্তির সমর্থনে বলা যায়, বাংলাদেশের পরিবারের বহুবিবাহ, সপত্নী-বিরোধ, সপত্নী পুত্রের প্রতি বিমাতার অত্যাচার, রূপসী প্রণয়িনীর মোহ ও পরিশেষে সেই মোহভঙ্গ, শঠতা ও বিশ্বাসঘাতকতা এ-সবই পারিবারিক জীবনের জ্বলন্ত সমস্যা। এই সব সমস্যা সামাজিক বৈষম্য ও পশ্চাৎপদ মানসিকতা থেকে উদ্ভূত। পুত্রের প্রতি বিমাতার অত্যাচার যেমন পারিবারিক শাস্তিকে বিঘ্নিত করে, রূপসী প্রণয়িনীর মোহ ও মোহভঙ্গ যেমন পারিবারিক ও সামাজিক সমস্যাকে মূর্ত করে তোলে, ভাইয়ে ভাইয়ে দ্বন্দ্ব, স্বামী-স্ত্রীতে অবিশ্বাস এইসব ঘটনা রূপকথার রহস্যময় কল্পনার উদ্দাম যাত্রার অন্তরালে জীবন্ত হয়ে ওঠে বাস্তবতার দাবীতে। এইভাবে দেখা যায়, মালঞমালা, কাঞ্চনমালার গল্পে বা শ্বেতবসন্তের কাহিনীতে সামাজিক ও পারিবারিক চিত্র নানা দিক থেকে উৎসারিত হয়। রাজবধূ কাঞ্চনমালা ও ‘কাকন-দাসী’ কাঁকনমালার গল্পে মানুষের শঠতার কথা মনে পড়ে। যেমন স্মরণীয় হয়ে ওঠে সাপ ও রাজকন্যার গল্পে আর এক প্রবঞ্চনার ছবি। সাপ রাজকন্যার কোমরবন্ধটি খুলে অবিকল রাজকন্যার রূপ ধারণ করে কাকার বাড়ীতে এসে পরম সুখে আদরযত্ন উপভোগ করে। শেষে রাজকন্যার জাদুর ঝাঁপির সহায়তায় এই ভুলের নিষ্পত্তি হয়, শয়তান সাপ প্রাণ হারায়। এইভাবে অলৌকিক ঘটনার বাতাবরণে প্রাণীজগতের শঠতা, হিংস্রতা ও স্বার্থানুতাকে রূপকথার গল্পে খুঁজে পাওয়া যায়। মানুষের ত্রুটি-বিচ্যুতি, মানুষের মনের নিম্নবৃত্তি সবই ভাগ্যবিপর্যয়ের কারণ হয়ে ওঠে। আবার অলৌকিক কোন ঘটনায় বা প্রসাদে নিষ্পত্তিও হয়। রূপকথার রহস্যময় মায়াবরণ ভেদ করে বাস্তব জীবনের যে জ্বলন্ত সমস্যা উঁকি দেয়, তা রূপকথার বাস্তবধর্মিতাকে প্রমাণ করে।


রূপকথার মধ্যে আছে অসম্পূর্ণতা থেকে সম্পূর্ণতার সন্ধান। সামাজিক সমস্যা ও বৈষম্যকে এই আদর্শসন্ধান সমাধানের মধ্যে পর্যবসিত করে। বাস্তব জীবনে যার অভাব সমস্ত জীবনপ্রবাহে একটা অনির্বচনীয় মাধুর্য সঞ্চার করে। রাজপুত্র শ্বেতবসন্তের কাহিনীতে বক্তীর অশ্রুব্যাকুল কণ্ঠে যে বেদনা ফুটে ওঠে, সেই বেদনা কেবল শিশুকে করুণরসে বিহ্বল করে না, বয়স্ক মানুষকেও করুণার্দ্র করে তোলে। এই গল্পে হয়তো রামায়ণের ছায়া আছে, কিন্তু এই গল্পের এক নিজস্ব মাধুর্য আছে। রূপকথার গল্পে রহস্য ও মায়া যখন মানুষকে কল্পনারাজ্যের অধিবাসী তেমনি বাস্তবজীবনে ত্রুটি-বিচ্যুতি, পতন-অভ্যুদয়, জয়-পরাজয় সামর্থ্যে সচেতন করে তোলে। রূপকথার গল্পে মানুষের সামাজিক বৈষম্য শেষে জয়যাত্রার কাহিনী বর্ণিত আছে। মানুষের ভাগ্যবিধাতা হবার কাহিনীও শেষপর্যন্ত এই গল্পগুলিতে রূপ পায়। এইসব তথ্য বিশ্লেষণ করলে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হয় যে মানুষের জীবনের ভুলত্রুটি-বিচ্যুতির কাহিনী যেমন বাস্তব, তেপান্তরের মাঠের কল্পনার যাত্রাও তেমনি সত্য। রূপকথার বিরুদ্ধে যারা অলীকতা ও অভাবনীয়তার অভিযোগ করেন, তারা যে যথার্থ সত্যসন্ধানী নন, এ কথা অনস্বীকার্য। রূপকথার বর্ণনা মাধুর্য বা বর্ণনা বাহুল্যের আড়ালে, রূপকের অন্তরালে পারিবারিক জীবনের বা সমাজের নিখুঁত ছবি আমাদের আকৃষ্ট করে। রূপকথার মধ্যে যে মাটির ছোঁয়া আছে, তা যে কেবলমাত্র আকাশকুসুম নয়, এই বিশ্লেষণ থেকে তা বোঝা যায়। মানুষের বাস্তবতার প্রয়োজন বড় তীব্র। তাই রূপকথার কল্পজগতেও মানুষকে বাস্তবতার অনুসন্ধান করতে হয়। লেখক এই দিক থেকে সার্থকভাবে বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে রূপকথার মায়াবরণ কেবল মানবমনকে আমাদের দিকে ছুটিয়ে চলে না, তার যোগসূত্র আছে “মাটির কাছাকাছি”। এই কারণে সামাজিক ও পারিবারিক সমস্যা, মানুষের দুষ্প্রবৃত্তি ও চক্রান্ত সবই রূপকথার গল্পে প্রতিভাত হয়েছে।