“রূপকথা কতকগুলি অসম্ভব বাহ্যঘটনার ছদ্মবেশ পরিয়া আমাদের মনের সহিত ইহার প্রকৃত ঐক্যের কথা গোপন রাখিতে চেষ্টা করে।" -আলোচনা করো।

রূপকথার মধ্যে কল্পনারাজ্যের নানা অসম্ভব ঘটনা, নানা রূপ, নানা রূপক আত্মপ্রকাশ করে। সাত সমুদ্র তের নদী পার হয়ে নির্জন রাক্ষসপুরীতে রাজকন্যা প্রবাল পালঙ্কে নিদ্রাতুরা। এই রাজকন্যাই আমাদের গোপনচারিনী প্রেয়সী। রূপকথার রাজপুত্র নানা বাধাবিঘ্নের মধ্য দিয়ে এই প্রেয়সীকে উদ্ধার করে আনতে যায়। রাজপুত্রের এই অভিযানের বর্ণনায় নানা অসম্ভবচিত্র চিত্রিত হয়ে পাঠকমনকে দোলায়িত করে। রূপকথার মধ্যে অলীক, অসম্ভব ও অবাস্তব জগতের রূপায়ণ আছে। ড্রাগনের আগুন ঝরা বিষাক্ত নিঃশ্বাস, ডাইনীর মন্ত্র-তন্ত্র, সর্পের উদ্যত ফণা সব কিছু অগ্রাহ্য করে রাজপুত্র ছুটে চলে তার মদমত্ত অভিযানে। পালঙ্কশায়িতা রাজকন্যা উদ্ধারের আশায়। কখনও নাগপাশে জড়িয়ে থাকে রাজকন্যা। রাজপুত্র দৈব খড়গ দিয়ে বা অজগরের মাথার মণি দিয়ে সুন্দরী প্রেয়সীকে মুক্ত করে আনবে। এইসব বাহাঘটনা অসম্ভবের ছদ্মবেশে আবির্ভূত হয়। এইভাবেই তা মানবমনকে দোলায়িত করে দূর শূন্যে, যেখানে বাস্তবমন নিয়ে মানুষ পৌঁছতে পারে না। কাঞ্চনমালা মালঞমালার কাহিনী বা শ্বেতবসত্তের কাহিনীতে এইভাবে কল্পনার অত্যাশ্চর্য স্পর্শ মানবজীবনের গোপন সত্তার সঙ্গে যুক্ত হয়ে আত্মপ্রকাশ করে বলেই রূপকথার এইসব রূপক এতখানি সার্থক।


রূপকথাকে যতখানি অসম্ভব ও অলীক ভাবের আলোকে আমরা দেখি না কেন, আসলে তা মানবমনের গভীরতম প্রান্তে এক যোগসূত্র রচনা করেছে বলেই তা আমাদের কাছে এতখানি জনপ্রিয়। রূপকথার অসম্ভব বাহাঘটনা আসলে ছদ্মবেশ। এই ছদ্মবেশ সরিয়ে নিলে যে ভাবলোক উদ্ঘাটিত হয়, তা মানবমনের সঙ্গে যুক্ত ভাব। এই যোগসূত্রটি না থাকলে রূপকথা আমাদের কাছে এতখানি জনপ্রিয় হত না। মানবমনের সূক্ষ্ম অনুভূতি, সূক্ষ্ম ভাব ও ভাবনা আমাদের হৃদয়ে অস্পষ্ট আবেগ জাগিয়ে তোলে। কখনও কখনও জাগ্রত হয় আপাত-অসম্ভব ভাবকল্পনা, অল্প-আকাঙ্ক্ষার আদর্শগত রূপ। এ-সবই মানবমনের নিকট ভাবনা, মানবজীবনের আত্মীয়। এই ভাব-ভাবনা অস্ফুট আকারে নিহিত থাকে, তাই লেখক মনে করেন অস্ফুটতা হলেও এরা সব সত্য ও বাস্তব। স্ফুটতাই বাস্তবতার একমাত্র মাপকাঠি নয়।


রূপকথার অসম্ভব ঘটনার সঙ্গে মানবমনের নিবিড় যোগ আছে। বাস্তব জগতে যে শক্তি মানুষকে অনুপ্রাণিত করে, যে আদর্শের সন্ধান করে মানুষ, সেই আদর্শের রূপায়ণ রূপকথার অসম্ভব ঘটনারাজির মধ্যে। রূপকথার রাজ্যে মানবমনের আদিম সনাতন নীতির প্রতিপত্তি। মানুষ পরিপূর্ণ সুখের সন্ধান করে। মানুষ দুঃখ থেকে মুক্তির চেষ্টা করে, মানুষের সৌন্দর্য পিপাসার পূর্ণ পরিতৃপ্তি, আশাতীত শক্তিসম্পদ লাভ, পাপপুণ্যের জয় পরাজয়। এসব মানুষের চিরন্তন কাহিনী, চিরপুরাতন কাহিনী। পৃথিবীর চিরপরিচিত মূর্তিগুলি অতিরঞ্জনে রঞ্জিত হয়ে, কল্পনার দ্বারা রূপান্তরিত হয়ে রূপকথার রাজ্যের অলিতে গলিতে ঘুরে বেড়ায়। রাজপুত্রের রাজকন্যা উদ্ধারের পথে যে-সব বাধাবিঘ্ন রাজপুত্রের পথরোধ করে দাঁড়ায়, তারা আসলে পার্থিব বাধার অতিরঞ্জিত রূপ। বেঙ্গমা-বেঙ্গমী আসলে অনুকূল দৈবের একটা রূপ। তা না হলে রাক্ষস-খোক্ষসের মৃত্যুরহস্য সে শিখিয়ে দিতে পারে না। এই বেঙ্গমা-বেঙ্গমীর অযাচিত সাহায্য এই পৃথিবীর নিষ্ঠুর হৃদয়হীনতার কলঙ্ক স্খালন করে। রূপকথার গল্পে পাতালপুরীর যে ছবি আঁকা হয়েছে, সেখানে নাগকন্যার প্রাসাদ-প্রাঙ্গণে আমরা চিরপরিচিত পৃথিবীর স্পর্শ লাভ করি। পাতালপুরীর নিকট অন্ধকারে মর্ত্যপৃথিবীর সূর্যালোকের স্পর্শ পাওয়া যায়। রূপকথার রাজপুত্রের জয়যাত্রা আসলে মানবমনের জয়যাত্রা। রূপকথার গল্পে "মানুষের জয় এবং জয়েচ্ছার সংকেত বহন করে। তাকে যে কোন উপায়ে আত্মরক্ষাই উপদেশ দেয় না, দুর্লভ্যের অভিযানে নির্ভয়ে বেরিয়ে পড়বার জন্য অনুপ্রাণিত করে।” এই দিক থেকে বিচার করলে দেখা যায়, মানবমনের সঙ্গে রুপকথার অন্তরঙ্গ যোগাযোগ সভ্যতার প্রথম পর্যায় থেকে। কারণ "রুপকথার পরিপুষ্টি ঘটল মানবেতিহাসের দ্বিতীয় পর্যায়ে। এই সময় মানুষ সমাজবদ্ধ হয়েছে, শহর গড়ে তুলেছে, সভ্যতার মধ্যে পদক্ষেপ করছে। এ আর তার আত্মরক্ষার যুগ নয়, এ হল তার আত্মবিস্তারের পর্যায়।” রূপকথার এই আত্মপ্রসারধর্ম মানবমনের ঐক্যের সঙ্গে যুক্ত। মানবমনের এই যোগসূত্র আছে বলেই রূপকথা মানবহৃদয়কে এতখানি আন্দোলিত করে। অসম্ভবকে মানুষের কাছে সত্য করে তুলে ধরে।


রূপকথার মধ্যে যে অসম্ভবের বাতাবরণ আছে, তা ছিন্ন করে মানুষকে তার মর্ম-ঐক্যের সঙ্গে একাত্ম করে তোলে। মানবমনে ও মানবজীবনের সঙ্গে যোগাযোগ না থাকলে রূপকথার আবেদন এতখানি বিশ্বজয়ী হতে পারত না। রূপকথার আবেদন কেবল শিশুমহলে নয়, বয়স্ক মানুষের আসরেও তার আবেদন। পৃথিবীর যা কিছু পুরাতন ও প্রাচীন অভিজ্ঞতা বয়স্ক মানুষের হৃদয়ে তা সঞ্জিত থাকে। এই কারণে রূপকথার আবেদন বয়স্ক মানুষকেও দোলায়িত করে। মানবমনের আদিম সনাতন ধারার সঙ্গে রূপকথার যোগাযোগ আছে বলেই রূপকথা এতখানি জনপ্রিয়।