“আমাদের দেশে সম্প্রতি মহান স্বামী বিবেকানন্দের জন্মশতবার্ষিকী উৎসব উদযাপিত হয়ে গেল। তিনি মোক্ষেরও উপরে স্থান দিয়েছিলেন দুর্গত মানুষের সেবায়।”—কোন প্রসঙ্গে এই উক্তি করা হয়েছে? এই উক্তির তাৎপর্য বিচার করো।

“আমাদের দেশে সম্প্রতি মহান স্বামী বিবেকানন্দের জন্মশতবার্ষিকী উৎসব উদযাপিত হয়ে গেল। তিনি মোক্ষেরও উপরে স্থান দিয়েছিলেন দুর্গত মানুষের সেবায়।”- কোন প্রসঙ্গে এই উক্তি করা হয়েছে? এই উক্তির তাৎপর্য বিচার করো।


ভারতীয় ভাবাদর্শ সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে লেখক এই ডক্তি করেছেন। ভারতীয় ভাববাদী দর্শনের আধিপত্য কায়েম ছিল যুগযুগান্ত ধরে। এই সময়কার চিন্তাবিদ্রা জীবনের গুরুত্ব স্বীকার করতে অবহেলা করতেন। সনাতন ধর্মের মূল বাণী ব্যক্তিগত মোক্ষলাভ। আচার্য বসুর মতে ব্যক্তিগত মোক্ষলাভের ওপর গুরুত্ব বেশি দেওয়া সমীচীন নয়। কারণ এই ধরনের চিন্তাধারা মানুষকে স্বার্থপর, লোভী ও জড় করে তোলে। এই ধারণাটি বোঝাবার জন্য লেখক স্বামীজির কর্মবাদ ও জীবে সেবার আদর্শকে তুলে ধরেছেন। স্বামীজি ভারতীয় সনাতন ধর্মে একজন স্তম্ভস্বরূপ। কিন্তু তিনিও এই ব্যক্তিগত মোক্ষলাভের চেয়ে দুর্গত মানুষের সেবাকে অধিকতর গুরুত্ব দিয়েছেন। এই আলোচনা প্রসঙ্গে লেখক এই উক্তি করেছেন।


ভারতীয় সনাতন আদর্শকে বলা হয় ভাববাদী দর্শন। ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা—শংকরাচার্যের এই বাণীর ভিত্তিতে ভারতীয় দর্শন ও ধর্মের নানা শাখা গড়ে উঠেছে। যুগ যুগ ধরে মানুষের এই দর্শনের ওপর একটা মোহান্ধতা গড়ে উঠেছে। শাশ্বত সত্যের ধ্যান ও মননের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হত যে দর্শনে তার মূল কথা ছিল ব্যক্তিগত মোক্ষ বা মুক্তির সাধনা। এই দুঃখচক্রময় পৃথিবীতে অনেক মানুষ দুঃখের হাত থেকে মুক্তির জন্য লোকালয় ছেড়ে অরণ্যে গিয়ে তপস্যা করে। পেছনে যারা পড়ে থাকে, তারা দুর্ভোগের যন্ত্রণার মধ্যে ডুবে থাকে। দুঃখ-দারিদ্র্য ও অনুন্নত জীবনযাত্রায় তারা কষ্ট পায়। জীবনের গুরুত্ব অবহেলিত হলে দেশ ও সমাজ এইভাবেই অবনতির পথে চলে যায়। তাই লেখক তাঁর বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োগে মানুষের জীবনযাত্রার উন্নতির কথা চিন্তা করেছেন। এ-পৃথিবী নশ্বর, সংসার পান্থশালা, এই উপলব্ধি মানুষকে ইহবিমুখ বা কর্ম-বিমুখ করে তোলে। জীবনে কর্মবাদের গুরুত্ব স্বীকৃত না হলে জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করা যায় না। ভারতবাসীর জীবনে যে মান উন্নত হয়নি, নিজেদের মধ্যে হিংসা-বিতর্ক ও অভ্যন্তরীণ বিবাদ-বিসংবাদ ডেকে আনে বিদেশি হানাদারদের। এইভাবে দেশ ও জাতি বিচ্ছিন্ন ও শতদীর্ণ হয়ে যায়। বিদেশি হানাদাররা এসে ভারতবর্ষে প্রতিষ্ঠা করে শতাব্দী জোড়া দাসত্ব। এইভাবে জাগতিক ব্যাপারে আধিপত্য হারিয়ে ভারতবাসী বর্বরদের হাতে পরাস্ত ও পর্যুদস্ত হয়ে গেল। দেশের বৈষয়িক সমৃদ্ধির জন্য যারা চেষ্টা করল না, তারা গুহায় গিয়ে ব্রহ্মসাধনা করল। পারলৌকিকতার সঙ্গে পার্থিব দায়িত্ব পালনের সুসংগতি এই সমস্যার সমাধানের একমাত্র পথ। স্বামীজির জীবন দর্শনের মূল কথা কর্মবাদ। “জীবে প্রেম করে যেই জন/সেই জন সেবিছে ঈশ্বর”—এই বাণী জীবসেবার মন্ত্রকে দিকে দিকে ছড়িয়ে দিয়েছে। স্বামীজির জন্মশতবার্ষিক উৎসবে দেশবাসী স্বামীজিকে শ্রদ্ধা ও ভক্তি জানিয়েছেন। ভারতবর্ষের সনাতন ধর্মের ইতিহাসে স্বামীজির কর্মসাধনা ও জীবনসাধনা দেশবাসীকে নতুন পথ দেখিয়েছে। দেশের ঐতিহ্যের সঙ্গে স্বামীজির জীবনদর্শন কতখানি গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক, তা অবর্ণনীয়।



“অতএব ভারতীয় সভ্যতার অবনতির কারণ সম্বন্ধে একাধিক ব্যাখ্যার অবকাশ আছে।”— আলোচনা করো।

ভারতবর্ষ মহান দেশ। এই মহান দেশের মহান ঐতিহ্য যুগ যুগ ধরে ভারতবাসীকে অনুপ্রাণিত করেছে। দেশবিদেশের মানুষ ভারতীয় অধ্যাত্মচিন্তার অধিকার অর্জনের জন্য ব্যাকুল হয়ে ভারতবর্ষের দ্বারপ্রান্তে এসেছে। ভারতবর্ষ সনাতন ধর্মের দেশ। বেদ-বেদান্ত উপনিষদের বাণীর মধ্যে জীবনের নশ্বরতা ও দুঃখ দুর্দৈবময় অবস্থার চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। উপনিষদ-বেদান্ত-গীতার মধ্যে যে শাশ্বত-সত্যের বাণী পরিস্ফুট হয়েছে তা দেশবাসীকে ইহ-বিমুখ করে তুলেছে। ব্রয় সত্য জগৎ মিথ্যার বাণী মানুষকে মোহময় সংসার থেকে, সুখদুঃখ জর্জরিত সংসার থেকে দুরে সরিয়ে রেখেছে। ভারতবাসীর পিতৃপুরুষ যে দর্শনের অধিকারী ছিলেন, তা এই পরাদর্শন। এই পরাদর্শনের মধ্যে মানুষের শ্রেয়জ্ঞান পরিস্ফুট হত। এই শ্রেয়জ্ঞান ছিল মানুষের শ্রেষ্ঠ সম্পদ কিন্তু এই সম্পদ নিয়ে মানুষের জীবনপথে কোনো উন্নতি হয় না। বৈষয়িক উন্নতি হয় না, জাতির অভ্যন্তরীণ সুরক্ষা বিঘ্নিত হয়। এই কারণে লেখক ভারতীয় সভ্যতার অবনতি সম্বন্ধে পর্যালোচনা করতে গিয়ে সনাতন চিন্তাকে অন্যতম কারণ হিসেবে মনে করেছেন।


গণতান্ত্রিক দেশে ইতিহাসের শিক্ষা সম্বন্ধে মত প্রকাশের স্বাধীনতা প্রত্যেকেরই থাকে। ইতিহাসের ধারায় দেখা যায় যে যুগে যুগে কোনো দেশের বাণী নানাভাবে গৃহীত, সমাদৃত ও বর্জিত হয়। ইতিহাসের ধারা তার অনিবার্য গতিতে প্রবাহিত হয়। এই স্রোতোধারায় সব কিছুই ভেসে যায়, আসে নতুন নতুন চিন্তা আদর্শ ও বাণী। যা কিছু পুরাতন তা জীর্ণ হয়ে যায়। তার মধ্যে থেকে উঠে আসে নতুনের বাণী। ইতিহাসের এই পাঠ ও ব্যাখ্যার স্বাধীনতা প্রত্যেকটি মানুষেরই থাকে। যে ভারতীয় সভ্যতা একসময় মহান বলে স্বীকৃত হয়েছে, সেই ভারতীয় সভ্যতা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে পশ্চাৎপদ হয়ে আছে। দেশে দারিদ্র্য, দুঃখ ও শিক্ষাহীনতা ভারতবাসীর জীবনযাত্রার মানকে নিম্নাভিমুখী করে রেখেছে। জীবনের গুণগত মানের অবনতিকে লেখক সভ্যতার অবনতি বলেছেন। এই অবনতির পশ্চাতে আছে ভারতীয় সনাতন ধর্মের অনুরক্তি ও অনুসৃতি। নালন্দা ও তক্ষশিলার মত শিক্ষাকেন্দ্রগুলিতে ধারাবাহিকতার পারলৌকিকতার পোষকতা করা হত। পারলৌকিকতায় বিশ্বাস এদেশের সংস্কৃতির মেরুদণ্ড। শাশ্বত সত্যের অতন্ত্র মনন, চিন্তন ও নিদিধ্যাসনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া ছিল ভারতীয় সনাতন আদর্শের কেন্দ্রবিন্দু। লেখক মনে করেন এই চর্চার ফলে ব্যক্তি মানুষের মুক্তি হয়তো সম্ভব, কিন্তু সমষ্টিগত মানুষের মুক্তি আসা অসম্ভব। ব্যক্তিবিশেষ আত্মজ্ঞান লাভের ইচ্ছা যদি প্রাধান্য পায় এবং কোনো দেশের দর্শন ও সংস্কৃতি যদি একে মূল্য দেয়, তাতে সেদেশের উন্নতি সুদূরপরাহত। ভারতীয় সভ্যতার বাস্তবক্ষেত্রে অবনতি সম্পর্কে হয়তো অনেক কারণ থাকতে পারে, কিন্তু এক্ষেত্রে লেখকের পর্যালোচনায় এই বিশেষ সত্যটি ধরা পড়েছে যে ভারতীয় সভ্যতা ইহমুখী নয়।