রবীন্দ্রনাথের কাব্য-প্রতিভার বৈশিষ্ট্য এবং তাঁর উত্তরসাধকদের একটা সামগ্রিক অথচ সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।

(বুদ্ধদেব বসুর অনুসরণে) বুদ্ধদেব বসু-রচিত 'রবীন্দ্রনাথ ও উত্তর-সাধক' প্রবন্ধের বিষয় সংক্ষেপে আলোচনা করো।


(১) সাধারণভাবে বলা যায় যে, কবিমাত্রই স্বভাবকবি, কারণ সহজাত শক্তি ছাড়া কাব্য রচনা সম্ভবপর নয়। কিন্তু 'স্বভাবকবি' বলতে সাধারণত এমন কবিকেই বোঝায়, যিনি হৃদয়ের প্রেরণাতেই কাব্য রচনা করেন, বুদ্ধির সঙ্গে তার কোন যোগ থাকে না; ফলত যে আবেগের উত্তাপ কাব্যমাত্রেই প্রত্যাশিত, সেই আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করবার শক্তি এই স্বভাব-কবিদের মধ্যে থাকে না, কখনও ব্যক্তিগত কারণে, কখনও বা ঐতিহাসিক কারণে। গোবিন্দদাস এইরূপ একজন স্বভাব কবি, যাঁর রচনায় সংযমের অভাব ছিল। তিনি রবীন্দ্র-সমকালে বর্তমান থেকেও যেন রবীন্দ্রনাথের অস্তিত্বই অনুভব করেননি। অবশ্য রাবীন্দ্রিক দীক্ষা পেলেও হয়তো ভিন্ন ফল হত না, কারণ রবীন্দ্র প্রভাবের প্রথম পর্বে, সত্যেন্দ্রনাথ থেকে নজরুল ইসলাম পর্যন্ত অনেক কবিই রবীন্দ্র প্রভাবাধীন হবার ফলেও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন।


রবীন্দ্র-প্রতিভার মধ্যাহ্নে যেসব তরুণ কবি তাঁর সান্নিধ্যে এসেছেন, তাঁরা রবি-চুম্বকে যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন, কারণ না হয়ে উপায় ছিল না। পূর্ববর্তী বাংলা সাহিত্যে দাশু রায়ের চাতুর্যময় বাগভঙ্গি, রামপ্রসাদের ভক্তিবাদ, ঈশ্বর গুপ্তের বাস্তবতা, এমনকি মধুসূদনের তূর্যধ্বনির পর রবীন্দ্রনাথের আবির্ভাবে বিচলিত, বিস্মিত ও অভিভূত হওয়া যত সহজ ছিল, তাঁকে সহ্য করা কিংবা গ্রহণ করা তত সহজ ছিল না, কারণ তা' ছিল সকলের সাধ্যের বাইরে। তার ফলে রবীন্দ্র-কাব্যে উত্তর-সাধক প্রতিরোধহীনভাবে আত্মবিলোপ ঘটিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথকে সাধারণের পক্ষে গ্রহণ করা যে অসম্ভব ছিল, তার প্রমাণ পাওয়া যায়, তাঁর খ্যাতি ও রচনা-বৈচিত্র্যের তুলনায় পাঠক সংখ্যার স্বল্পতা থেকে। পক্ষান্তরে রবীন্দ্রনাথের তরলিত সংস্করণের স্বাদ গ্রহণ করেছে পাঠকরা শরৎচন্দ্র আর সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের লেখা পড়ে।


বিশ শতকের প্রথম দুই দশকে যতীন্দ্রমোহন, করুণানিধান, কিরণধন প্রভৃতি কবি, এমনকি সত্যেন্দ্রনাথও—অর্থাৎ যাঁরা রবীন্দ্র-মণ্ডলের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন, তাঁদের রচনা এতই সমতলরকম সদৃশ যে একের রচনা থেকে অপরের রচনাকে পৃথক করা সম্ভব নয়, ব্যতিক্রম, একমাত্র সত্যেন্দ্রনাথ–এও তাঁর ছন্দের দাক্ষিণ্যে। অথচ এঁদের শক্তির দীনতা ছিল না, বিচ্ছিন্নভাবে ভালো কবিতাও তাঁরা লিখেছেন, কিন্তু তাঁরা এক ‘অনতিক্রম্য, অসহ্য দেশের অধিবাসী, কিংবা পরবাসী' হয়ে রইলেন। রবীন্দ্রনাথকে অনুকরণ করা ছাড়া তাঁদের গত্যন্তর ছিল না এবং সেটি ছিল এক অসাধ্য কর্ম। রবীন্দ্রনাথের মোহিনী মায়ায় আটকে পড়ে তাঁকে ঘিরেই আবর্তিত হতে লাগলেন, তাঁর সঙ্গে আর চলতে পারলেন না। তাঁদের এই আত্মাহুতি পরবর্তীদের সতর্ক করে দিয়েছে—এইটেই লাভ।


(২) রবীন্দ্রনাথের মতো মহাকবিকে পাবার জন্য আমাদের কিছু মূল্য দিতে হয়েছে। সেটি এইঃ অতঃপর কবিতা-লেখার কাজটি বেশ কঠিন হয়ে গেল। এরপর এমন কিছু কাজ বেছে নেওয়া উচিত ছিল, তা যত ক্ষুদ্রই হোক—যা’ রবীন্দ্রনাথ করেননি। কিন্তু এইখানেই ভুল করলেন সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ও তাঁর সম্প্রদায়। তাঁরা রবীন্দ্র-কাব্যের আপাত-সরলতায় বিভ্রান্ত হয়ে কবিতা রচনার কাজটিকে অত্যন্ত সহজ ভেবে বসলেন এবং এইখানেই তাঁরা প্রতারিত হলেন। এমনকি, তাঁরা রবীন্দ্র-ভাবনার পরিমণ্ডলের বাইরে এক পা বেরুনোটাকেও দৃষ্য করে তার মধ্যেই চক্রবৎ পরিভ্রমণ করতে লাগলেন। রবীন্দ্রনাথ ‘এই বাংলাদেশের প্রকৃতির মধ্যে চোখ মেলে, দু'চোখ ভরে যা তিনি দেখেছেন তাই-ই তিনি লিখেছেন, আবহমান ইতিহাস লুঠ করেননি, পারাপার করেননি বৈতরণী অলকানন্দা। এইজন্যই তাঁর অনুকরণ যেমন দুঃসাধ্য, তার প্রলোভনও তেমনি দুর্দম।'—আর এই প্রলোভনের ফাঁদে পা দিয়েই ডুবেছেন সত্যেন্দ্রনাথরা।


রবীন্দ্রকাব্যের আপাত-সারল্যের জন্যই ক্ষুদ্রতর কবিরা এভাবে কাব্য রচনায় উৎসাহিত হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ‘ছেলেমানুষি'কে কাব্যের উপাদান হিসেবে উত্তম মনে করতেন। এই ‘ছেলেমানুষি'র অর্থ হল—ভিতর থেকে আপনি হয়ে-ওঠা। কিংবা কাব্যের রূপায়ণে ছেলেমানুষিকে সযত্নে পরিহার করেছেন, তাঁর অনুকারীরা এখানেই ভুল করলেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবিতার, বিশেষত গানে, মুহূর্তের বৃত্তের উপর ফুটে ওঠা পলাতক এক-একটি রঙিন বেদনাকে এমনভাবে তাঁর গানে আর কাব্যে ধরে রেখেছেন যে, তাঁর রচনাকে আর বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়। সমালোচনায় এর রহস্যটুকু ধরা যায় না। কিন্তু এ-তো অপরের দ্বারা আর সম্ভব নয়।


রবীন্দ্রনাথের এ জাতীয় কবিতা জীবনের সম্পদ, কিন্তু এর অনুকরণ করতে গেলেই বিপদ অনিবার্য হয়ে ওঠে। সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতায় এর নিদর্শন পাওয়া যাবে। রবীন্দ্র সমসাময়িকদের মধ্যে তিনিই শ্রেষ্ঠ, তাঁর বিশিষ্টতাও কাব্যপাঠেই ধরা পড়ে। তিনিও রবীন্দ্রনাথের মতোই উপাদান গ্রহণ করেছেন, রবীন্দ্রনাথেরই সাজ-সরঞ্জাম ব্যবহার করে কাব্য রচনা করেছেন, কিন্তু সত্যেন্দ্রনাথের কবিতায় রবীন্দ্রনাথের মতো আবেগের চাপ, বিশ্বাসের উত্তাপ কিংবা প্রবলতার স্পর্শমাত্রও পাওয়া যায় না। বস্তুত সত্যেন্দ্রনাথের অনুভূতিটাই কৃত্রিম বলে মনে হয়। রবীন্দ্রকাব্যকে ভেজাল করে নিয়ে কবি সত্যেন্দ্রনাথ সাধারণ পাঠকের মনস্তৃষ্টি সাধন করেছিলেন। ফলে তিনি রবীন্দ্রনাথের একটা প্রতিমূর্তি হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন এবং পাঠকদের শুধু কর্ণের দাবিই মেটাতে পেরেছিলেন, কারণ তাঁর কাব্য ছিল ছন্দোঘটিত ব্যায়াম। এমনকি এক সময় সত্যেন্দ্রনাথের প্রভাব রবীন্দ্রনাথকেও ছাড়িয়ে যায়, যার ফলে এক জাতীয় সুশ্রাব্য অন্তঃসারশূন্য লেখায় মাসিকপত্রগুলি বোঝাই হয়ে গিয়েছিল; অবশ্য কালের সম্মাজনী তাদের ঝেটিয়ে বিদায় করেছে।


(৩) রবীন্দ্র প্রভাবের মধ্যযুগে সেই সর্বগ্রাসিতার মধ্যেও গদ্যে প্রমথ চৌধুরি এবং অবনীন্দ্রনাথ আপনাদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে পারলেও পদ্যে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ও অপর কবিরা তাতে নিমজ্জিত হয়ে গিয়ে সেই ধাক্কা সামাল দিলেন; যার ফলে পরবর্তী কবিদের পক্ষে অভিঘাতটা আর তেমন প্রবল রইলো না। তবু, নজরুল ইসলামের 'বিদ্রোহী' কবিতার আবির্ভাব না ঘটা পর্যন্ত রবীন্দ্র সম্মোহন বজায় ছিলই। নজরুলই প্রথম এই মোহন-মায়াজাল কেটে বেরিয়ে আসতে পারলেন।


নজরুলও রবীন্দ্রনাথকে অনুকরণ করেছেন। অসংযমাদি দোষ তাঁর রচনায়ও রয়েছে, তবু ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের জোরেই রবীন্দ্রোত্তর যুগে তিনিই বাংলার প্রথম মৌলিক কবি। নজরুলের পটভূমির ভিন্নতাই তাঁর এই স্বাতন্ত্র্যে সহায়তা করেছে। তাঁর পক্ষে যেগুলি সামাজিক অসুবিধার কারণ ছিল, সেগুলিই তাঁর সুবিধের হাতিয়ার হয়ে। উঠলো। কোনপ্রকার সাহিত্যিক প্রস্তুতি ব্যতিরেকেই তিনি আপন স্বভাবের জোরে রবীন্দ্রনাথের মুঠি থেকে পালাতে পারলেন। তাঁর কবিতায় উত্তেজনার তুলনায় পুষ্টি ছিল কম: নতুনভাবে আকাঙ্ক্ষার জাগরণ তিনি ঘটিয়েছিলেন, তবে নজরুলের প্রত্যক্ষ প্রভাব ছিল স্বল্পস্থায়ী। তবে তিনি যে আকাঙ্ক্ষাটা জাগিয়েছিলেন, তারই ফলে সত্যেন্দ্রনাথের মৌতাত কাটিয়ে আবির্ভাব হয়েছিলেন পেশীগত শক্তি নিয়ে মোহিতলাল, একটি অগভীর ভিন্নধর্মিতা নিয়ে যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত এবং তারপরই বাংলা সাহিত্যের মোড় ফেরার ঘণ্টা ধ্বনিত হ'লো 'কল্লোল গোষ্ঠী'র আবির্ভাবে।


(৪) নজরুলের মনে যে অতৃপ্তি ছিল, তা প্রকাশ পেয়েছে রাজনৈতিক সামাজিক বিদ্রোহে; কিন্তু তাঁরই অজ্ঞাতে সেই অতৃপ্তি সংক্রামিত হয়ে সৃষ্টি করেছে 'কল্লোল যুগে’র সাহিত্যিক বিদ্রোহ। রবীন্দ্র-সাহিত্যে যে সমস্ত বিষয় বা ভাবের অভাব লক্ষিত হয়েছে, তা নিয়ে অভিযোগ ধ্বনিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে। রবীন্দ্রনাথকে সত্য করে পাবার জন্য, তাঁকে সহ্য করার জন্য প্রয়োজন ছিল এই প্রতিরোধের। এ নিয়ে যাঁরা আন্দোলন করেছিলেন, তাঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন রবীন্দ্র-সাহিত্যে সুয়াত। নিজের কথাটা নিজের মতো করে বলা'র তাগিদেই তাঁরা স্বতন্ত্র পথের সন্ধানী হয়েছিলেন। 'শেষের কবিতা'য় রবীন্দ্রনাথের একটি ব্যঞ্ছনা-গর্ভ উপমাকে এক পরম সত্যের ইঙ্গিত-রূপে গ্রহণ করে কল্লোল যুগের কবিদের মনোভাব ব্যাখ্যা করা যায়। ফজলি আমের কাল ফুরুলে আরও ভালো আমের সন্ধান না করে কালের ফসল আতার সন্ধানী হলেন তাঁরা। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের পর তার চেয়েও ভালো কবিতার জন্য ব্যর্থ চেষ্টায় নিযুক্ত না হয়ে তাঁরা এমন পথে এগুলেন, যে পথে রবীন্দ্রনাথ পা ফেলেননি।


এই যুগে কবিদের রচনায় কিছু আবর্জনাও হয়তো জমেছে কিন্তু ক্রমশ স্থিতিশীলতা দেখা যেতে লাগলো। সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ‘পরিচয়’ এবং বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকার বুকে তার চিহ্ন ফুটে উঠতে লাগলো। প্রেমেন্দ্র মিত্রের হৃদ্যস্বাদু কবিতার পর ‘বাংলা কবিতায় দেখা দিল সংহতি, বুদ্ধিঘটিত ঘনতা, বিষয় এবং শব্দ-চয়নে ব্রাত্যধর্ম, গদ্যপদ্যের মিলন-সাধনের সংকেত।' কালের প্রভাবেই এই সমস্ত ঘটতে লাগলো। নানা বৈচিত্র্যে বাংলা কাব্যের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ হয়ে উঠতে লাগলো—জীবনানন্দ, সুধীন্দ্র দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী—প্রত্যেকেই বিষয়ে-মেজাজে রূপে-রীতিতে ভিন্নমুখী', স্বতন্ত্র, কিন্তু একই আন্দোলনের অন্তর্ভুক্ত। এঁদের কেউ বা রবীন্দ্রনাথকে পাশ কাটিয়ে গেছেন, কেউবা তাঁকে আত্মস্থ করে তাঁর মুখোমুখি দাঁড়িয়েছেন। তাঁরা রবীন্দ্রনাথের মোহন রূপে না ভুলে তাঁকে কাজে লাগাতে শিখলেন। এমনকি, কেউ কেউ রবীন্দ্রকবিতার পঙ্ক্তি শুদ্ধ সচেতনভাবেই আপন কাব্যে প্রয়োগ করলেন। তাঁরা এই মৌল সত্যটি পুনরুদ্ধার করলেন যে, গুরুর হাত থেকে সত্য-শিব-সুন্দরকে পাওয়া যায় না, তাকে জীবন দিয়ে সন্ধান করতে হয়।


নজরুল থেকে সুভাষ মুখোপাধ্যায় পর্যন্ত—এই কুড়ি বৎসরে বাংলা কবিতার রবীন্দ্রাশ্রিত নাবালক দশা কাটলো। তারপর যারা এলেন, তাদের কেউ কেউ আবার কল্লোলীয় কবিদের আবর্তে পড়ে পাক খেতে লাগলেন; নতুন কবিদের অনেকেই টেক্‌নিক্‌ নিয়েই বেশি মাথা ঘামায়—এটা দুর্লক্ষণ। আগেকার সব কৌশল এখন সমান উপযোগী নয়। কলাসিদ্ধির প্রাধান্য না কমিয়েও বলা যায় কবিতা লেখা মানে স্বর-ব্যানের চাতুরী দেখানো নয়। এখানে বক্তব্যটিই বড়ো, তবে তার প্রকাশও স্বচ্ছন্দ হওয়া প্রয়োজন। এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের কথাও স্মরণ করা প্রয়োজন। তিনি আমাদের রক্তে-মাংসে মিশে রয়েছেন। এখন, যখন আর সম্মোহন আশঙ্কা নেই, তখন তাঁর উপযোগিতা ও ব্যবহার্যতা বিস্তৃততর হয়ে আগামী বাংলা সাহিত্যে প্রকাশ পাবে–এরূপ আশা করা যায়।