গোপাল হালদারের অনুসরণে 'আধুনিক সাহিত্য' প্রবন্ধটির বিষয়বস্তু বর্ণনা করো।

সাহিত্য মানুষের মানস-ক্রিয়া বলেই তার মুখ্য মূল্য মনের কাছে, তবে যুক্তির নিকটও গৌণভাবে কিছু মূল্য আছে। এইজন্যই দেশ-কাল-পাত্রের পরিপ্রেক্ষিতে এর মূল্য নির্ধারিত হয়। ফলত এর কোন নির্ভরযোগ্য নির্দিষ্ট মানদণ্ড কখনও গড়ে উঠতে পারেনি। সাহিত্যের মানদণ্ড বড় বেশি পরিবর্তনশীল। তাছাড়া ব্যবহারিক বিচারে সাহিত্যের মূল্যও বাজার দরের মতো ওঠা-নামা করে। বিচারক্ষেত্রে ব্যক্তি-মনের গুণাগুণের ছাপ পড়ে বলেই সাহিত্য-বিচারে কোন চরম বিচার নেই, যা আছে তা আপেক্ষিক মূল্যনির্ধারণ।


আলোচনার দৃষ্টিক্ষেত্র: কালে কালে মানুষের জীবন-দর্শনের পরিবর্তন ঘটে বলেই সাহিত্যের আদর্শ ও পরিবর্তিত হয়। যেমন ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সাহিত্যে একচ্ছত্র অধিকার ছিল ‘রসের বিচার' তথা 'আর্টের হিসাব'। এর পর থেকে অনেকেই 'ঐতিহাসিক বিচারে'র পক্ষপাতি হয়ে ওঠেন। আবার 'ঐতিহাসিক বিচার' বলতে কেউ বোঝেন ‘কালানুক্রমিকতা’, কেউ বোঝেন ‘বাস্তবতা’। এই হিসেবে আমরা সাহিত্যকে ‘জীবনের বাণী'-রূপেই গ্রহণ করি। এ শুধু জীবনের মুকুর নয়, জীবনও এ থেকে অনেক রসদ আহরণ করতে পারে। তাই সাহিত্যকে আমরা 'জীবনদর্শন'-রূপেই একালে দেখতে চাই। 'আধুনিক সাহিত্য’ তাই একালের জীবনদর্শন। কিন্তু ‘আধুনিক’ বা ‘এ-কাল’ বলতে কোন্ কালকে বোঝায়? কী তার জন্মলক্ষণ?


জন্মচিহ্ন : মধ্যযুগের সাহিত্যে সে যুগের চিহ্ন এবং আধুনিক যুগের সাহিত্যে একালের চিহ্ন থাকবেই। স্বল্পপূর্বকালের কবি ভারতচন্দ্রের রচনায় যতই লিপি কুশলতা থাক, তা যে কোন আধুনিক কবির নয় কিংবা নজরুলের কবিতা যে মধুসুদন রবীন্দ্রনাথের আবির্ভাবের আগে কিছুতেই লেখা হতে পারতো না, তা আমরা হাতে নিলেই বুঝতে পারি। আবার কর্ণ ও কুম্ভীর সাক্ষাৎকারের বিবরণ মহাভারতেও আছে, রবীন্দ্রনাথের ‘কর্ণ-কুন্তী-সংবাদে'ও রয়েছে : বিষয় একই, অথচ আমরা বুঝতে পারি, রবীন্দ্রনাথ ছাড়া কেউ 'কর্ণ-কুন্তী-সংবাদ' লিখতে পারতেন না। তার কারণ, প্রকৃত লেখায় ফুটে ওঠে ‘যুগধর্ম' তথা 'পরিবেশ-ধর্ম', যাতে লেখকের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ধরা পড়ে।


বিষয়বস্তু ও রূপ : 'পরিবেশ-ধর্ম", যাতে থাকে পারিপার্শ্বিকের ছাপ, তার দুটি দিক—একটি ‘বিষয়বস্তু বা content, অপরটি ‘প্রকাশ' অর্থাৎ ‘রূপায়ণ তথা form এ দুটির যথাযোগ্য সুসঙ্গত মিলনেই গড়ে ওঠে সাহিত্য রূপ অখণ্ড সৃষ্টি। একটা মোটা হিসেবে বলা যায়, দেহ ও মনের যথাযথ সংযোগে যেমন গড়ে ওঠে পরিপূর্ণ মানুষ। হেতু ও মনকে যেমন বিচ্ছিন্ন করা যায় না, বিষয়বস্তু ও প্রকাশ-কলারও তেমনি দ্বৈত অস্তিত্ব অস্বাভাবিক। 'শকুন্তলা'র কথাবস্তু মহাভারতে ও কালিদাসে প্রায় এক, কিন্তু ভাব-বস্তুতে পৃথক। অনেক সময় কথাবস্তু পৃথক হলেও ভাব-বস্তু এক হতে পারে। এই ভাব-বস্তুই আইডিয়া, বাণী বা message। সৃষ্টিতে এটি রূপায়িত হলেও তা সত্য হয়ে ওঠে। অতএব প্রকাশ বা রূপায়ণের মধ্য দিয়েই প্রকাশ ঘটে সত্যের।


কেউ কেউ আবার রূপকলা বা প্রকাশ-কলাকেই সৃষ্টির আসল রহস্য মনে করে সাহিত্যকে শুধু 'আর্ট' জ্ঞান করেন; রূপকলার বিশ্লেষণে রীতি বা স্টাইল, আঙ্গিক বা টেকনিক, অলঙ্কার ইত্যাদি নানা দিক্ রয়েছে। সংস্কৃত সাহিত্যশাস্ত্রীরা 'রসশাস্ত্রে'র আলোচনায় ভাববস্তুকে যেমন বিশ্লেষণ করেছেন, অলঙ্কারশাস্ত্র নিয়েও তেমনি যথেষ্ট বাড়াবাড়ি করেছেন। এতে সাহিত্যের সত্য খণ্ড খণ্ড হয়ে যায়; সাহিত্যের সত্যমূল্য ধরা পড়ে না। দেহের বিশ্লেষণে যেমন দেহের গঠন ধরা পড়লেই প্রাণের সন্ধান পাওয়া যায় না, মনকেও জানতে হয়। দেহ-মনের বিচিত্র লীলাতেই জীবন, সাহিত্যও তেমনি অর্থ অলঙ্কারময়।


পরিবর্তিত মূল্যবোধ : কালে কালে সাহিত্যের বিষয়বস্তু ও রূপ দুইই পরিবর্তিত হয়। সভ্যতা আর জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রসারের সঙ্গে যেমন সাহিত্যের বিষয়গত পরিধি অনেকখানি বেড়ে গেছে, তেমনি তাদের প্রকাশের জন্যও নানা রীতি-পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে। মানুষের দুঃখবেদনার কাহিনী নিয়ে সেকালেও সাহিত্য রচিত হয়েছে, যেমন পদ্যে মঙ্গলকাব্য, আবার একালেও হচ্ছে—কিন্তু গদ্যে এবং উপন্যাস-গল্পনাটক জাতীয় সাহিত্য, কাজেই দেখা যায়, ভাববস্তু একই থাকা সত্ত্বেও কথাবস্তুতে যেমন বিরাট পরিবর্তন সাধিত হয়েছে, তেমন পরিবর্তন দেখা দিয়েছে প্রকাশ-রীতিতেও।


মানুষের মূল্য : তবে কালে কালে যে কথাবস্তুর অন্তর্নিহিত ভাববস্তুও বদল হয়েছে ও হচ্ছে তা অস্বীকার করবার উপায় নেই। শূদ্রের বেদপাঠে দেশে দুর্ভিক্ষ হয়েছে– এই বিশ্বাসে রামচন্দ্র শম্বুকের শিরচ্ছেদ করেছিলেন, এটি সেকালের, এমনকি আমাদের প্রপিতামহদের আমলেও সুবিচারের চমৎকার প্রমাণ-রূপে গ্রহণ করা হত, কিন্তু একালে আমরা এটিকে মূঢ়তাপ্রসূত চরম অবিচার বলেই মনে করি। হরিজনদের প্রতি অবজ্ঞাকেই গান্ধীজী বিহার ভূমিকম্পের কারণ বলে ঘোষণা করলেও আমরা তা মেনে নিইনি অর্থাৎ একালে আমরা মানুষের মর্যাদা স্বীকার করে নিয়েছি—অবশ্য এটি পূর্ণ মর্যাদা নয়, কারণ মানুষে-মানুষে ভেদটা এখন যথেষ্ট রয়ে গেছে। তবু, মানুষ মানুষই, এটি আজ স্বীকৃত সত্য। এদিক দিয়ে আমাদের পূর্বপুরুষদের পুরানো মূল্যবোধ থেকে অনেকটা সরে এসেছি। একালের সাহিত্যে দেব-দেবী এবং ধর্মের স্থান একেবারে গৌণ হয়েছে, সাহিত্যে মানুষই মুখ্যস্থান নিয়েছে—এটি একটি মৌলিক পরিবর্তন।


অতএব আধুনিক সাহিত্য বলতে বোঝায় মানুষের সাহিত্য—এটিই বড় কথা। মানবসত্য নিয়েই আধুনিক সাহিত্য।


ব্যক্তিত্বের মূল্য : রামচন্দ্র প্রজানুরঞ্জনের জন্য সীতাকে বিসর্জন দিয়েছিলেন; যজ্ঞের জন্য 'স্বর্ণসীতা’ নির্মাণ করেননি। পিতা দশরথের সাড়ে সাতশত মহিষী থাকলেও রামচন্দ্র কিন্তু দ্বিতীয় পত্নী গ্রহণ করেননি। এই একনিষ্ঠ প্রেম অতিশয় প্রশংসনীয়। হয়তো তাঁর দৃষ্টিতে রাজকর্তব্যের তথা প্রজানুরঞ্জনের আদর্শ মহত্তর বিবেচিত হয়েছিল বলেই তিনি ব্যক্তি-প্রেম জলাগুলি দিয়েছিলেন। একালের জীবনে এবং সাহিত্যে কিন্তু ব্যক্তিত্বের দাবি অপর অনেক কিছুকেই ছাপিয়ে যায়। এই যুগ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের যুগ, তাই ডিউক অব্ উইন্ডসর মনোমতো পাত্রীকে বিবাহ করবার প্রয়োজনে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সিংহাসনের অধিকার যখন ত্যাগ করেন, তখন বিশ্ববাসী ধন্য ধন্য করেছিল। একালের সাহিত্যেও এই ব্যক্তিভাবের প্রাধান্য। তবে এই বিংশ শতাব্দীতে 'সমাজ-সচেতনতার প্রয়োজনে ব্যক্তিত্বের দাবিকে কিছুটা সীমাবদ্ধ করে নিতে হচ্ছে, কারণ প্রত্যেকে আমরা পরের তরে'—এই সত্যটিকে অস্বীকার করা যায় না। কাজেই ব্যক্তির অন্তরের দাবিকে সব ক্ষেত্রে এক তরফা ডিক্রি দেওয়া যায় না, কিন্তু ব্যক্তির মর্যাদা, ব্যক্তি স্বরূপের দাবি যে বড় সত্য, এটা মেনে নেওয়া হয়েছে। তাই একালের সাহিত্যে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যও ব্যক্তিগত প্রেমভালোবাসা যে সেকালের তুলনায় অনেক বেশি প্রাধান্য পেয়েছে, তাতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।


বিপ্লবী নিয়তির স্বীকৃতি : মানুষের মূল্য ব্যক্তিত্বের মূল্য ছাড়াও একালের সাহিত্যে আরও কিছু নতুন মূল্যবোধের সমকোণ পদচারণা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। প্রাচীন সাহিত্যে মানুষ ভাগ্যের দাস ছিল ক্রমে মানুষের নিজের প্রতি আস্থা আসতে আরম্ভ করে কিন্তু নিয়তি-নির্ভরতা একেবারে ছাড়তে পারেনি। তবু মানুষ বুঝতে শিখেছে, সে নিষ্ক্রিয় নয়, সে-ও একটা সক্রিয় শক্তি; তবে বিশ্বরহস্য এখনও অজ্ঞাত বলে নিজের প্রতি পূর্ণ আস্থা আসেনি। এতকাল মানুষ জানতো, ভাগ্যই তাদের নিয়ন্ত্রিত করে, এখন দেখতে পাচ্ছে, সে নিজেও ভাগ্যকে অনেকটা নিয়ন্ত্রিত করতে পারে। প্রকৃতির নিয়ম ক্রমশ আয়ত্তে এনে, সে ইচ্ছামতো মানবপ্রকৃতিকেও পরিবর্তিত করতে পারে—একেই বলা হচ্ছে 'বিপ্লবী নিয়তি'—মানুষের আধুনিকতম আবিষ্কার। মানুষ বুঝতে শিখেছে, সে সৃষ্টির অধিকারী, কাজেই সে নতুন জীবন, নতুন যুগ সৃষ্টি করে যেতে পারে।


পূর্বে মানুষ নিজের মহিমা উপলব্ধি করতে পারলেও, বিংশ শতকের পূর্বে কখনও মানুষ নিজেকে স্রষ্টারূপে, বিপ্লবী শক্তির বাহক-রূপে ভাবতে সাহস পায়নি। জগৎ ও জীবন-সম্বন্ধে প্রথম বিস্ময়বোধ দেখা দিল রেনেসাঁস যুগে, তারপর ফরাসী বিপ্লবের শেষে এল স্বপ্নযুগ ও স্বপ্নভঙ্গের যুগ, এরপর ইংরেজ কবিদের রচনায় দেখা গেল আশাবাদ ও উনিশ শতকে শিল্পচিত্তবানের বিজয়োৎসব : বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় পাদে দেখা দিয়েছে বিপ্লবী শক্তির স্বীকৃতি।


মানবতাবাদ : এই মূল্যবোধ থেকেই সাহিত্যে আধুনিকতার স্বীকৃতি। অন্তত তিনটি দিক থেকে মানুষের মূল্যবোধে নতুনত্ব লক্ষ্য করা যায় মানুষের মর্যাদাবোধ, ব্যক্তি-সত্তার মুক্তি এবং মানুষের মূল্যবোধে বিপ্লবী নিয়তিতে বিশ্বাস। অবশ্য এ ছাড়াও নতুন সমাজসত্তা, বিশ্বমানবতাবাদ, জাতীয় আত্মাবাদ প্রভৃতি নতুন বক্তব্যও সাহিত্যে পাওয়া যায়, তবে এগুলি আসলে ঐ মূল সুরেরই বাদী-প্রতিবাদী সুর। তবে সাহিত্যের প্রধান কথা যেটি আসলে অতি পুরাতন কথা—মানবতাবাদ।


প্রাচীন মানবতাবোধ : মনে হতে পারে, মানবতাবাদ তো প্রাচীন কথা—প্রাচীন গ্রীক সাহিত্যে ও শিল্পে, প্রাচীন লাতিন সাহিত্য ও রেনেসাঁস যুগের ইতালীয় লেখকদের রচনায়, ইংরেজ লেখক মার্লো ও শেক্‌স্পীয়রে, এমনকি পূর্ব দেশে চীনের শিল্প ও সাহিত্যেও পার্থিব, সামাজিক ও পারিবারিক সুরে এই মানবতাবাদের আভাস পাওয়া যায়। আমাদের অবতার রামচন্দ্রকেও আমরা পারিবারিক মানুষরূপে পেয়েছি, দেবতা শ্রীকৃষ্ণও মানবীয় সম্পর্ক নিয়েই আমাদের কল্পনায় ধরা দিয়েছেন। এমনকি প্রাচীন বাঙালি কবি চণ্ডীদাস যে আশ্চর্য বাণী উচ্চারণ করেছিলেন—

"শুনহে মানুষ ভাই,

সবার উপরে মানুষ সত্য

তাহার উপরে নাই।'


এমনকি বিশ্বসাহিত্যের কোথাও, একালেও শোনা যায়নি। অতএব প্রশ্ন হতে পারে মানবতাবাদ একালেরই বিশেষ বাণী হবে কেন? এর উত্তর হল, এটি আধুনিক, এর বাণী এবং রূপ-রচনার জন্য। একালে যদি কেউ পাঁচালি বা মঙ্গলকাব্য রচনা করেন, তা যেমন আধুনিক হবে না, তেমনি শতাধিক বৎসর পূর্বে রচিত হলেও হেমচন্দ্রের 'বেঁচে থাক মুখুজ্জের পো...একটি চালে/করলে বাজিমাৎ' অবশ্যই আধুনিক। কারণ এটি ভাবে ভাষায় অখণ্ড, এর ভাববস্তু ও কথাবস্তু জীবন্ত, এর ছন্দ বাঙলা কথার জীবনছন্দ। এটি এর বাণী এবং রূপ-রচনার জন্যই আধুনিক অথচ তাঁর প্রসিদ্ধতম ‘বৃত্রসংহার কাব্য' কিংবা 'ভারতভিক্ষা' কাব্য তত আধুনিক নয়। এদের তুলনায় 'মহিলা কাব্য' এবং 'সারদামঙ্গল' বেশি আধুনিক। আবার তারও আগে মাইকেলই কাব্যের বিষয়বস্তু এবং রূপায়ণে বিপ্লব সৃষ্টি করেন।


মানুষের চরিত্র এবং ঘটনা নিয়ে একালে সৃষ্ট হল নভেল বা উপন্যাস। বঙ্কিম থেকে আমাদের সাহিত্যেও উপন্যাস এল। প্রাচীনকালে মুকুন্দরাম ছন্দে রচনা করেছিলেন কথাসাহিত্য—চণ্ডীমঙ্গল; তাতেও আছে মানবিক বৈশিষ্ট্য, যেমন ছিল প্রাচীন গ্রীক ও লাতিন সাহিত্যে। এদের যতটুকু মানবীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ, ততটুকু আধুনিকই বটে।


সহজ মানুষ ও মানবতাবাদ : সাহিত্যে মানুষী চেতনার প্রকাশ ঘটে প্রথম, যখন সে নিজেকে প্রকৃতি থেকে পৃথক বলে বুঝতে পেরেছে। কিন্তু তৎসত্ত্বেও প্রাচীন কালে মানুষ নিজের মর্যাদা বুঝতে পারেনি সে একটা অলৌকিক শক্তির ক্রীড়নক বলেই জেনেছে। তাই মানুষের নামেও প্রচারিত হয়েছে দেবতা আর ধর্মেরই মাহাত্ম্য। শ্রীরামচন্দ্র, শ্রীকৃষ্ণ তার দৃষ্টান্ত, মঙ্গলকাব্যের মানুষও দেবতার কৃপানির্ভর।


মধ্যযুগের সাধকদের মধ্যে একটা অস্ফুট মানবতাবাদের সূক্ষ্মতর প্রকাশ লক্ষ্য করা গেছে। তাই সহজিয়া চণ্ডীদাসের সবার উপর সত্য যে মানুষ, সেও সমাজ-সম্পর্কের অতীত সত্তা, বস্তুত আধ্যাত্মিক মানুষ। কিন্তু আধুনিক সাহিত্যের মানুষ আধিভৌতিক মানুষ, সে তার ধর্মসম্পর্কবর্জিত সামাজিক জীবনে স্থিত। আমরা চণ্ডীদাসের আধ্যাত্মিক সত্তারূপী মানুষকে একালের অনুভূতি দিয়ে ব্যাখ্যা করেই এত বড় করে দেখেছি, শতাব্দীকাল পূর্বেও বাঙালির দৃষ্টিতে মানুষ এত সত্য ছিল না।


গ্রীক মানবতাবাদ : প্রাচীনকালের অস্পষ্ট মানবতাবোধই প্রাচীন গ্রীক সাহিত্যে প্রথম মানবতাবাদে পরিস্ফুট হল। সমকালের গ্রীক রাষ্ট্র ব্যবস্থা, সামাজিক জীবন ও অর্থনীতিক ভাবনা-চিন্তা অনেকটা প্রাগ্রসর ও বাস্তবমুখী ছিল বলেই প্রাচীন সভ্যতা ও সাহিত্য ছিল অনেকটাই মানবতাবাদী, প্রায় আধুনিক কালের অনুরূপই নয়, অনুরূপও বটে। তারপর দীর্ঘকাল য়ুরোপ ছিল তমসাচ্ছন্ন। এরপর আবার গ্রীক চিন্তাজগতের পুনরাবিষ্কারের মধ্য দিয়ে ঘটলো য়ুরোপীয় রেনেসাঁস। এই সময় ধনিক-বণিক যুগের যে বনিয়াদ স্থাপিত হল তার ভিত্তি ছিল সুদৃঢ়, কারণ বিজ্ঞানের আবিষ্কার যথেষ্ট সহায়তা দান করেছে। এই রেনেসাঁস যুগ থেকেই সুস্থ মর্ত্যজীবনের দৃষ্টিতেও সমাজবোধ স্থান পেয়েছিল; কিন্তু বিজ্ঞানের আবিষ্কার বেশিদূর অগ্রসর না হওয়াতে চীনের ঐতিহ্য অনড় রয়ে গেল, মানুষের মূল্য ব্যক্তিত্ব ও গণতন্ত্রের স্ফুরণ হল না, সে এক নৈর্ব্যক্তিকতার যুগ।


প্রাচীন মানবতাবোধের ঐতিহাসিক পরিণতিতেই আধুনিক মানবিকতাবাদের সৃষ্টি হলেও এতদুভয়ের পার্থক্যটা কিন্তু পরিমাণগত নয়, গুণগত। মানুষের অধিকারের মধ্য দিয়ে আধ্যাত্মিকতার দিন শেষ হয়ে এল। ইংলন্ডে ও আমেরিকায় ব্যক্তি-স্বাধীনতার আভাস পাওয়া গেলেও ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে ফরাসী বিপ্লবের সময় ‘ব্যক্তিসত্তার দাবি’ স্বীকারের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের দাবিও প্রতিষ্ঠিত হল, সমাজে মানবতাবাদ, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য এবার প্রয়োজন দেখা দিল শোষণতন্ত্র-অবসানের। ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে সোভিয়েত বিপ্লবের মধ্য দিয়ে এই বাণীকে সার্থক করে তুলে মানুষ সৃষ্টিধর্মী বিপ্লবীশক্তির অধিকারী রূপে আপনাকে প্রতিষ্ঠিত করলো।


আধুনিক বাংলা সাহিত্য : সব দেশে ইতিহাস সমানভাবে বিকাশ লাভ করেনি বলেই, মানবতার বাণী আমাদের সাহিত্যে ততটা স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি। এমনকি সোভিয়েত দেশের মানুষ বিপ্লবী নিয়তিবিষয়ে সচেতন হয়ে উঠলেও য়ুরোপ-আমেরিকার মানুষের চেতনা এখনও আমাদের মতোই দ্বিধাগ্রস্ত। তবে আমাদের অবস্থাটা জটিলতর। কারণ এখানে সামন্ততান্ত্রিক পরিবেশ যেমন ধনিকতন্ত্রী আশা-আকাঙ্ক্ষা একদিকে আমাদের দোলা দিচ্ছে, অন্যদিকে তেমনি সমাজতন্ত্রী চিন্তার ফলে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের স্বপ্নও আমাদের আকুল করে তোলে। এই অস্বাভাবিক কারণে আমাদের দেশে যখন আধুনিকতার সুর এল তখন তা অসাধারণ তীব্র বেগে প্রাচীন সাহিত্যের সুরকে ছাপিয়ে গেল। মধুসূদন-বঙ্কিমই আমাদের সাহিত্যে প্রথম আধুনিকতা নিয়ে এলেন। আমাদের চেতনায় আমরা ফরাসী বিপ্লবের 'মানবিক অধিকার'-বোধের তাৎপর্য স্বীকার করে নিলেও রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক কারণে তাকে জীবনের অঙ্গীভূত করে নিতে পারিনি। য়ুরোপে রেনেসাঁস যুগ থেকে আরম্ভ করে চারশ বছরে সাহিত্যে আধুনিকতার দিকে যতখানি এগিয়েছে, মাত্র আশি বছরে আমরা সেখানে এসে দাঁড়িয়েছি, তালহারা হলেও আমাদের অবিশ্বাস্য বেগবতী এই অগ্রগতি যে বিস্ময়াবহ, তা অনস্বীকার্য। আবার মানুষের স্বীকৃতি যে আমাদের সাহিত্যে এখনও অবারিত নয়, এ কথাও স্বীকার করতেই হয়।


আমাদের সাহিত্যে, বিপ্লবী নিয়তি’ এখনও বাণীরূপ লাভ করতে না পারলেও ভরসার কথা এই ইংরেজ-আদি অতি স্থির জাতির তুলনায় আমাদের বিপ্লবী ব্যাকুলতা অনেক বেশি তীব্র, ফলে আমরাই হয়তো অগ্রগামী হতে পারি।

অতএব আমরা দেখতে পাচ্ছি, তিনটি স্তরের মধ্য দিয়ে সাহিত্যে আধুনিকতা অভিব্যক্তি লাভ করেছে। প্রথম, য়ুরোপীয় রেনেসাঁসে মানব মহিমাবোধের জাগরণ, দ্বিতীয়, ফরাসী বিপ্লবে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা এবং তৃতীয়, সোভিয়েত বিপ্লবে মানুষের বিপ্লবী যাত্রার সূচনা।