রম্য রচনা

রম্য রচনা ও ব্যক্তিগত নিবন্ধ-প্রবন্ধ বা রচনা সাহিত্য এক গোত্রভুক্ত। উভয়ের মধ্যেই সাহিত্যের সাধারণ ধর্ম বিদ্যমান। উভয় জাতীয় রচনাই প্রায়শ একত্র মিলেমিশে থাকে। তবু এই দুই জাতীয় রচনা অর্থাৎ ব্যক্তিগত নিবন্ধ-প্রবন্ধ ও রম্য রচনার মধ্যে একটা সূক্ষ্ম প্রভেদ রেখা টানা যায়। রবীন্দ্রনাথ থেকেই উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, কবিসুলভ তন্ময়তার গুণে তাঁর প্রবন্ধাবলি সরসতার কোঠায় উত্তীর্ণ হয়েছে, রচনা-সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শনরূপেও পরিগণিত হয়েছে। তাঁর ‘বিচিত্র প্রবন্ধ’, ‘পঞ্চভূত' সমস্তই এই ব্যক্তিগত প্রবন্ধের পর্যায়ভুক্ত। আর তাঁর ‘জীবনস্মৃতি’, ‘ছিন্নপত্র' প্রভৃতি রচনাগুলি আত্মনিষ্ঠ রম্যরচনারই প্রকৃষ্ট নিদর্শন।


‘রম্য রচনা' কথাটির অভিধানিক অর্থ, যে রচনা রমণীয় বা সুন্দর। এই অর্থে রম্য রচনার এই সংজ্ঞা অতি ব্যাপক। কারণ সাহিত্যের ধর্মই এই যে তা রমণীয় ও সুন্দর হবে, হবে রসোত্তীর্ণ। আর এই অর্থে কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ—সকল শ্রেষ্ঠ রচনাসমূহকেই রম্য রচনা অভিধায় ভূষিত করা যেতে পারে। ‘রম্য রচনা’ কথাটির এই ব্যাপক অর্থ স্বীকার করেও, বিশেষ অর্থে রম্য রচনা বলতে আমরা এক বিশেষ রচনারীতিকেই বুঝে থাকি। বলা যেতে পারে, যে রচনায় জীবনের লঘু-চপল বিকাশগুলিকে নিয়ে উচ্চতর সারস্বত কর্মে নিয়োজিত করা হয়, সেই রচনাই রম্য রচনা। বলা যেতে পারে 'হঠাৎ আলোর ঝলকানি লেগে' ঝলমল করা চিত্তের ক্ষণপ্রকাশ। বলা যেতে পারে, এ যেন কোন অলস মধ্যাহ্নের ঘুঘু ডাকা দুপুরে বৈঠকখানায় আরামে দু পা মজলিসী মেজাজে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে বসে খোশগল্প করা। মেজাজ পরিপূর্ণ আড্ডার। কিন্তু এই আড্ডার মধ্যে সংযত ও রুচির সীমা বক্তা ও শ্রোতা সকলের কাছেই প্রত্যক্ষ। এর মধ্যে হয়তো ছ্যাবলামি আছে, তবে তা গুণপনাযুক্ত।


রম্য রচনার পরিচয়দান প্রসঙ্গে ডঃ জনসনের বহুল প্রচারিত উক্তি :... Loose sally of mind, which is an irregular undigested piece and not regular or orderly composition regular or orderly composition, প্রকৃষ্টরূপে বন্ধনযুক্ত প্রবন্ধের সঙ্গে রম্য রচনার পার্থক্য। প্রবন্ধকারের মেধা ও বুদ্ধির ছাপ ছড়িয়ে আছে প্রবন্ধে, আর রম্য রচনায় ছড়িয়ে আছে হৃদয়ের পরিচয়। উপন্যাস, গল্প এবং নাটকের সঙ্গেও রম্য রচনার পার্থক্য আছে। এই রচনাত্রয়ীর মধ্যেই একটা কাহিনির বৃত্ত আছে। এই বৃত্তকে নিয়েই কাহিনি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত রূপলাভ করে। কাহিনির যেমন একটা রীতি অনুযায়ী শুরু আছে, তেমনি রসসম্মত পরিণতি বা সমাপ্তিও আছে। কাহিনিতে একটা চরম মুহূর্ত (climax) সৃষ্টি করে তার সুসম্বন্ধ পরিণতি ঘনিয়ে তুলতে হয়। কবিতার ক্ষেত্রেও আমরা কবির যে পরিচয় পাই তা তাঁর দার্শনিক সত্তার। কবিতায় কবির হৃদয়ের পরিচয় রয়েছে, তাঁর আনন্দ রস আমাদের মুগ্ধ করে। কিন্তু সেখানেও স্রষ্টা ও ভোক্তা, দাতা ও গ্রহীতার একটা ভিন্নতা রয়েছে কবির সঙ্গে কবিতার পাঠকবর্গের।


কিন্তু রম্য রচনার ক্ষেত্রে একদিকে যেমন এর আঙ্গিকগত কোন নিয়ন্ত্রণ নেই, তা সম্পূর্ণ অন্য নিরপেক্ষভাবেই বর্ণনাত্মক–বিশ্লেষণাত্মক নয়, তেমনি রম্য রচনায় বক্তা ও শ্রোতা থাকলেও এ সম্পর্ক অভিন্নহৃদয় বন্ধুর সম্পর্ক। তিনি আমাদের দর্শন শোনাতে আসেন না, তত্ত্ব ও তথ্যের ভাবে আমাদের বিড়ম্বিত করেন না। অবশ্য এই জাতীয় রচনায় জীবন ও জগতের বৈষম্য ও অসঙ্গতি বিষয়ে বক্তার সুকঠোর কটাক্ষ যে থাকে না তা নয়। কিন্তু তত্ত্বের ভার নিয়ে তত্ত্বের দিকটি কখনই বড়ো হয়ে ওঠে না। রবীন্দ্রনাথের কথায় এ জাতীয় রচনাগুলি ‘বাজে কথা'। আর বক্তা আরাম কেদারা বা তাকিয়ায় হেলান দিয়ে অনর্গল আমাদের ‘বাজে কথা শুনিয়ে যান। এর মধ্যে ধার থাকলেও ভার নেই। প্রজ্ঞা থাকলেও দর্শন নেই। এখানে লেখক আমাদের আত্মীয় নন, গুরু নন, হিতৈষী নন—তিনি বন্ধু, শুধুমাত্র বন্ধু। রবীন্দ্রনাথের কথায়, 'অন্য খরচের চেয়ে বাজে খরচেই মানুষকে যথার্থ চেনা যায়। কারণ মানুষ ব্যয় করে বাধা নিয়ম অনুসারে, অপব্যয় করে নিজের খেয়ালে। যেমন বাজে খরচ, তেমনি বাজে কথা। বাজে কথাতেই মানুষ আপনাকে ধরা দেয়। উপদেশের কথা যে রাস্তা দিয়া চলে, মনুর আমল হইতে তাহা বাঁধা, কাজের কথা যে পথে আপনার গো-যান টানিয়া আনে সে পথ কেজো সম্প্রদায়ের পায়ে পায়ে তৃণপুষ্পশূন্য চিহ্নিত হইয়া গেছে। বাজে কথা নিজের মত করিয়াই বলিতে হয়।'


রম্য রচনার আসল রস ব্যক্তিগত রস। সেইদিক দিয়ে পত্রের সঙ্গে এর তুলনা করা যায়। পত্রের আসল রসও এই ব্যক্তিগত রস। কোন পত্র পড়লেই যেমন পত্রের অন্তরালে পত্র প্রেরকের ছবিটি প্রাপকের মনে ভেসে ওঠে, রম্য রচনার মধ্য দিয়েও লেখকের ব্যক্তি মনের ছবিটি এক লহমায় জেগে ওঠে। লেখক হৃদয়ের জারক রসে রঞ্জিত করে তার বিচিত্র বিষয় ও বিচিত্র বস্তুকে বিচিত্র দৃষ্টি নিয়ে পাঠকের সম্মুখে উপস্থিত করেন। ফরাসি সাহিত্যিক মনতেইনের মতো তিনি বলতে পারেন, ‘পাঠক, আমিই হচ্ছি আমার রচনার বিষয়বস্তু।


রম্য রচনার কোন বাঁধা-ধরা রীতি নেই। জগতের তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয় নিয়েও রমণীয় রম্য রচনা লিখিত হতে পারে। কখনও লেখা যেতে পারে আত্মচরিতের ঢঙে, কখনও-বা ভ্রমণ কাহিনির কাঠামোতে, কখনও স্কেচ রচনার ভঙ্গিতে। ব্যক্তিগত সুরই ধ্বনিত হয় রম্য রচনার সর্বাঙ্গে—তাই এর নাম দেওয়া যায় ব্যক্তিগত প্রবন্ধ।


রম্য রচনায় লেখকের যথেষ্ট স্বাধীনতা আছে। কিন্তু স্বাধীনতার অর্থ যা খুশি তাই নয়, রসিকতার অর্থ স্থূলতা নয়, ব্যক্তিগত সুর বিপজ্জনকভাবে আমিত্বের দীপ্ত অহংকারে পরিণত হওয়া নয়, এ কথাটা স্মরণযোগ্য। এক্ষেত্রে শুধু ভঙ্গি দিয়ে যেন না ভোলায় চোখ'। রম্য রচনার ক্ষেত্রে এগুলি গুণ নয়, দোষ।


আধুনিক যান্ত্রিক সভ্যতার সর্বাত্মক প্রয়াসের ফলে আমাদের জীবনে অবসর ক্রমে লোপ পাচ্ছে। চিন্তার ক্ষেত্রেও তাই। আর এই কারণেই গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ বেশিরভাগ পাঠককেই আগের মতো আকর্ষণ করতে পারে না। তাই বর্তমান মানসিকতায় এমন রচনার চাহিদা ক্রমশ দেখা দিতেছে যে রচনার আবেদন যতই গুরুগম্ভীর হোক না কেন, তার প্রকাশ হবে লঘু এবং আঙ্গিক হবে লোকায়ত। শুধু সর্বজনবোধ্য হবে না, হবে সর্বজন আকর্ষণীয়। অধিকাংশ পাঠককুলের এই চাহিদা মেটানোর ক্ষমতা রয়েছে রম্য রচনায়। তবে আধুনিক কালের এই চাহিদা মেটাতে গিয়েও আজ রম্য রচনার লেখকদের সাবধানতা অবলম্বন করা দরকার। কারণ এই জাতীয় রচনায় আতিশয্য ও পুনরুক্তি এসে যাবার আশঙ্কা ষোল আনা। রসিকতা যেখানে দীপ্তিহীন, বক্তব্য সেখানে কষ্ট কল্পিত। আমিত্বের প্রকাশ যেখানে উগ্র তখন তা আত্মম্ভরিতারই নামান্তর হয়ে ওঠে, রসজ্ঞানের ইতি ঘটে, রসিকতা অবাঞ্ছিত স্থূলত্বের কোঠায় নেমে এলে তা আঞ্চলিক গ্রাম্যতারই নামান্তর হয়ে ওঠে, রসজ্ঞানের ইতি ঘটে। এর ফলে ঠুনকো জনপ্রিয়তার আকর্ষণে ভঙ্গিসর্বস্ব, চটকদারি রচনার রম্য রচনার ভিড়ে মিশে যাবার সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে। ফলে অনধিকারী ব্যক্তির হাতে রম্য রচনার নামে অপেব্য বস্তু তৈরি হয়ে উঠতে পারে। এ সম্পর্কে বুদ্ধদেব বসুর মন্তব্যটি প্রাসঙ্গিক। তিনি বলছেন, ‘যাঁরা কবিতা প্রবন্ধ উপন্যাস কিছুই লিখতে পারেন না, এবং সত্যিকারের সাংবাদিক পর্যন্ত নন, যাঁদের না আছে তথ্য বা জ্ঞান, না উদ্ভাবন শক্তি বা কলানৈপুণ্য, সঙ্গতি রক্ষা করে কোনো বিষয়ে একদণ্ড চিন্তা করতে বা পরস্পর দুটো বাক্য রচনা করতে স্বভাব-গুণে অক্ষম, তাঁদের বিশৃঙ্খল প্রগলভতা ছাপার অক্ষরে উদ্ধৃত হয়ে উঠতে পারত না, যদি না ‘রম্য রচনা' শব্দটি সৃষ্টি হত।'


আধুনিক বাংলা সাহিত্যে উপন্যাস ও নাট্য সাহিত্যের মতো রম্য রচনাও ইউরোপীয় প্রভাবজ। ফরাসি ‘বেল্-লেতর’ (সুন্দর রচনা) শব্দটি থেকেই এসেছে রম্য রচনা কথাটি। ফরাসি দেশের সাহিত্যিক মন্‌টেইন সাহিত্যের এই ধারার পথিকৃৎ। কারও মতো ‘গ্যালিভারস ট্র্যাভেলস' খ্যাত ইংরেজি সাহিত্যিক সুইফ্টকেই রম্য রচনার গঙ্গোত্রী বলে মনে করেন। তিনিই সম্ভবত তাঁর রচনায় বেলে-লেতারস্ (Belles-letters) শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। প্রাচীনকালে বাগ্মিতা, ব্যাকরণশাস্ত্র, কাব্যকলাকেই বলা হত রম্য রচনা। পরবর্তীকালে পরিবর্তিত অর্থে কল্পনা-কুশল, শিল্পসম্মত যে-কোনো রচনার ক্ষেত্রেই রম্য রচনা শব্দটি প্রযুক্ত হত। আধুনিককালে রম্য রচনা বলতে বাংলা ভাষায় আমরা লঘু হাস্যরসাত্মক, কল্পনাময়, বর্ণনাপ্রধান এক শ্রেণির প্ৰবন্ধকে বুঝি।


ইংরেজি সাহিত্যে সুইফট-এর পর চার্লস ল্যাম্ব-এর নাম এবং তাঁর বিখ্যাত রচনা ‘দ্য সুপার অ্যানুয়েটেড ম্যান' (The Superannuated Man) স্মরণীয়। তাঁর রচনায় একই সঙ্গে রসিকতা, কারুণ্য, তারল্য ও গাম্ভীর্য বিভিন্ন ধারা নিয়ে একই সঙ্গে বিচিত্রভাবে মিশ্রিত হয়ে বয়ে চলেছে। এরপরেই নাম করা যেতে পারে ডি. কোয়েন্সীর। তাঁর ‘আফিংখোরের আত্মকাহিনী' (The Confession of An English Opium Eater) বঙ্কিমচন্দ্র এবং তাঁর ‘কমলাকান্তের দপ্তর’কেও অনুপ্রাণিত করেছিল। বিশ শতকে অন্যান্য রচনার নানা অবসরে প্রচুর রম্য রচনা লিখেছেন চেষ্টারটন, হাক্সলি, অডেন, স্পেন্ডার প্রমুখ সাহিত্যিকগণ।


বাংলা সাহিত্যে প্যারীচাঁদ মিত্রের 'আলালের ঘরের দুলাল' উপন্যাস হিসেবেই চিহ্নিত। কিন্তু একে রম্য রচনা বললেও খুব একটা অসঙ্গত হয় না। বাংলা সাহিত্যে এই রম্য রচনার প্রাথমিক উপাদান কালীপ্রসন্ন সিংহের 'হুতোম প্যাঁচার নক্সা'র মধ্যেই নিহিত দেখা যায়। এই রম্য রচনা বাংলা সাহিত্যে রম্য রচনা হিসেবে পূর্ণতা লাভ করল বঙ্কিমচন্দ্রে। বঙ্কিমের রচনা সাহিত্য ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ ও ‘লোকরহস্য' শুধু বাংলা সাহিত্যে রম্য রচনার ক্ষেত্রে অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন নয়, বিশ্ব সাহিত্যেও স্থায়ী স্থান পাবার যোগ্য। সঞ্জীবচন্দ্রের ভ্রমণ সাহিত্য ‘পালামৌ' গ্রন্থটিও রম্য রচনা হিসেবে স্মরণযোগ্য।


রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত প্রবন্ধ বা রচনা সাহিত্য ‘বিচিত্র প্রবন্ধ’, ‘পঞ্চভূত’ প্রভৃতিকে রম্য রচনা হিসেবে চিহ্নিত না করলেও রম্য রচনার অনেক গুণ এখানে বর্তমান। কিন্তু তাঁর 'জীবনস্মৃতি', 'ছিন্নপত্র' প্রভৃতি রচনাগুলি রবীন্দ্রনাথের আত্মনিষ্ঠ রম্য রচনারই প্রকৃষ্ট উদাহরণ।


রম্য রচনার ক্ষেত্রে আর একটি বিশিষ্ট নাম বীরবল। ‘মলাট সমালোচনা' হতে ‘চুটকি’ পর্যন্ত সব বিষয়েই এই অভিজাত, মজলিশী মানুষটির ছিল সহজ পদসঞ্চার। তারপর, মুজতবা আলি, বিনয় ঘোষ (কাল পেঁচা), বিমলা প্রসাদ মুখোপাধ্যায় (বিপ্রমু), বিনয় মুখোপাধ্যায় (যাযাবর), গৌরকিশোর ঘোষ (রূপদর্শী) প্রমুখ আধুনিক বাংলা সাহিত্য জগতের রথী-মহারথীগণ প্রায় সকলেই কিছু না কিছু রম্য রচনা লিখেছেন। ফলে রম্য রচনার ধারা আধুনিককালে অনেকটাই পরিপুষ্ট হয়ে উঠেছে।