প্রবন্ধ-সাহিত্য : রচনা-সাহিত্য : নিবন্ধ

শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় নিবন্ধমূলক রচনাকে দুটি ভাগে ভাগ করেছেন। একটি তত্ত্বাশ্রয়ী প্রবন্ধ-নিবন্ধ-সন্দর্ভ। অর্থাৎ যে গদ্যরচনায় যুক্তির বিশেষ বন্ধন আছে তার মধ্যে তত্ত্ব ও তথ্য নিজ গুণেই প্রাধান্য লাভ করে। আর অপরটি হল রসাশ্রয়ী গদ্যরচনা, যা নিবন্ধ হলেও প্রবন্ধ নয়। এই জাতীয় গদ্য রচনায় লেখকের ব্যক্তিসত্ত্বার প্রাধান্য। এখানে তিনি রসস্রষ্টা, রূপদক্ষ এবং কল্পনাপ্রবণ।


এই দ্বিতীয় ধারার রচনাকে প্রথম ধারা থেকে পৃথক করে দেখাতে গিয়ে সাহিত্য গুণাস্রোত এই রচনাসমূহকে রচনা-সাহিত্য, প্রবন্ধ-সাহিত্য বা নিবন্ধরূপে বিশেষিত করা হয়েছে। সাধারণভাবে প্রবন্ধ ও নিবন্ধ প্রায় সমার্থক হলেও, বিশেষরূপে প্রবন্ধ, সাহিত্য বা রচনা-সাহিত্যকেই আধুনিককালে ‘নিবন্ধ’ অভিধায় অধ্যাপক অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, অধ্যাপক শশিভূষণ দাশগুপ্ত প্রভৃতি অভিহিত করার পক্ষপাতী। আরও সঠিকভাবে বললে বলা যেতে পারে ব্যক্তিগত নিবন্ধ। ইংরেজিতে বলা যেতে পারে formal, subjective, personal essay, literary essay, intimate essay বা essay literature। আর এর বিষয়। বল্মীক থেকে বাল্মীকি— যে-কোনো বিষয় হতে পারে। এর গুরুত্ব বিষয় গৌরবে নয় বলার গৌরবে। এই জাতীয় রচনায় কি বলছি তা বড়ো নয়, বড়ো হচ্ছে কেমন করে বলছি।


প্রথাসিদ্ধ প্রবন্ধের দৃঢ়সন্নিবিষ্ট কঠিন নাগপাশ মোচন করে এই নিবন্ধ বা রচনা-সাহিত্য সাহিত্যের অলৌকিক সৌন্দর্যমালায় বিভূষিত হয়। প্রবন্ধের বস্তুতন্ময় (objective) রূপ পরিবর্তিত হয়ে রচনাতে ভাব-তন্ময় (subjective) রূপটি বড়ো হয়ে ওঠে। প্রবন্ধে বক্তব্য উপস্থাপনে বা বিষয়- ব্যাখ্যায় লেখক ফর্মাল সম্পর্ক না রেখে পাঠকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে চান। এই জাতীয় প্রবন্ধে বিষয় গৌরব থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু যে-কোনো বিষয়কে নিয়েই তাতে সকল মনের মাধুরী মিশিয়ে কিছুটা খেয়ালীপনার সঙ্গে, কিছুটা আরামপ্রদ শৈথিল্যের সঙ্গে এই জাতীয় প্রবন্ধের মধ্যে লেখকের ঘটে ‘আত্মপ্রকাশ'। বিষয় এখানে উপায়, লক্ষ্য হল লেখক চরিত্র। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কমলাকান্তের দপ্তর' বা 'লোকরহস্যে' আমরা বঙ্কিমচন্দ্রের ব্যক্তিমনের সঙ্গেই ঘনিষ্ঠ হই। রবীন্দ্রনাথের ‘বিচিত্র প্রবন্ধ’ লেখক মনের বিচিত্র ডালিকেই মেলে ধরেছে। এখানে লেখক যেন আপন মনে নিজেকে সম্বোধন করে বলে যান, পাঠক যেন আড়ি পেতে শুনে থাকেন।


বস্তু বা তথ্যনির্ভর প্রবন্ধের তুলনায় এই জাতীয় ভাবনির্ভর প্রবন্ধের মধ্যেই রয়েছে রচনার যথার্থ সাহিত্যগুণ। তাই এই জাতীয় বিশেষ লেখাকেই অধ্যাপক শশিভূষণ দাশগুপ্ত 'রচনা সাহিত্য' নামে অভিহিত করেছেন। তাঁর কথায়, 'রচনা-সাহিত্যের ভিতরে আমরা সাধারণত ভাল বলি সেইগুলিকে যেখানে কোন লেখা তত্ত্ব, তথ্য এবং যুক্তিতর্কের নিখুঁত সমাবেশে একেবারে জমজমাট হইয়া উঠিয়াছে। তত্ত্ব, তথ্য এবং যুক্তি তর্কের নিপুণ সমাবেশে একটা লেখা অতি মূল্যবান হইয়া উঠিতে পারে সন্দেহ নাই; কিন্তু সেই মূল্যের সহিত সাহিত্যের মূল্যের একটা আশমান-জমিন তফাত থাকিতে পারে।' অধ্যাপক দাশগুপ্তের মতে যথার্থ সাহিত্য-মূল্যে অন্বিত রচনাই হচ্ছে রচনা-সাহিত্য, এ ভিন্ন অন্যান্য রচনা তা হয়তো উৎকৃষ্ট রচনা, কিন্তু রচনা-সাহিত্য নয়।


সাহিত্যের স্বরূপ-লক্ষণ যে রচনার মধ্যে রয়েছে তাকেই রচনা-সাহিত্য বলা যায়। সাহিত্যের বই স্বরূপ-লক্ষণ বা স্বরূপ-ধর্ম সম্বন্ধে বলতে গিয়ে অধ্যাপক দাশগুপ্ত প্রাচীন আলঙ্কারিকদের অভিমতের উল্লেখ করে বলেছেন, ধ্বনিই হচ্ছে কাব্যের বা সাহিত্যের আত্মা। —এই ধ্বনির স্বরূপ কি? সে আমাদের বক্তব্যকে সর্বদাই অতিক্রম করিয়া যাইতে চায়। আমরা যাহা কিছু বলি—যাহা কিছু লিখি, তাহার মুখ্যার্থকে ধ্বনি শুধু অতিক্রম করিয়াই যায় না, আমাদের বক্তব্যকে সে গৌণ করিয়া দিয়া প্রধান করিয়া তোলে একটা অকথিত মাধুর্য এবং মহিমাকে। একটু নিবিষ্ট মনে চিন্তা করিলেই দেখিতে পাইব, আমাদের যাহা কিছু সাহিত্য-সৃষ্টি তাহার স্বরূপ ধর্মই এই যে, সে আমাদের বাচ্যার্থকে সর্ব অতিক্রম করিয়া নয়া গিয়াছে অনেক দূরে— অনেক গভীরে। আমাদের সমস্ত বলার ভিতরে বলাগুলি যেন কখন কোথায় পিছনে পড়িয়া রহিয়াছে—তাহার ভিতর দিয়া আভাসে-ইঙ্গিতে ফুটিয়া উঠিয়াছে কত না-বলা কথা। না-বলা যে কথাটা ধ্বনিত হইয়া মুখ্য হইয়া দাঁড়ায়, তাহাই সাহিত্যের লক্ষ্য, বলা কথাগুলি যেন উপলক্ষ্য মাত্র।'


একটু গভীর ও ব্যাপক অর্থে এই ধ্বনিই সত্যকারের রচনা সাহিত্যের প্রাণবস্তু। এই ধ্বনির স্বরূপ পরিচয়ের কথায় আলঙ্কারিকেরা এরই নাম দিয়েছেন রস। রসধ্বনিই হল যথার্থ ধ্বনি এবং এই রসধ্বনিই সাহিত্যের আত্মা। রচনাকে তাই যথার্থ সাহিত্য হতে হলে অর্থাৎ রচনা-সাহিত্য হতে হলে তার ভিতরে চাই এই রসধ্বনি।


নাটক, গল্প, কবিতা, উপন্যাস প্রভৃতির সঙ্গে এক গোত্রভুক্ত যথার্থ রচনা-সাহিত্যের এখানেই মিল, আর ‘দুর্দান্ত পাণ্ডিত্যপূর্ণ দুঃসাধ্য সিদ্ধান্ত' সমন্বিত প্রবন্ধের সঙ্গে এখানেই অমিল। কারণ লেখার সাধারণ ধর্ম যে সাহিত্য গুণ তা তত্ত্ব ও তথ্যপূর্ণ প্রবন্ধে নেই। সাধারণ প্রবন্ধে লেখক যেখানে থামেন, পাঠকও তার চলার সেখানেই ইতি টানেন, আর সাহিত্যে বা ব্যক্তিগত প্রবন্ধে বা রচনা সাহিত্যে বা নিবন্ধ-সাহিত্যে লেখকের থামার পরেও পাঠকের রাধা-মনের অভিসার শেষ হয় না। মানস-সুরধুনী পারে হরি-তীর্থাভিমুখে তার চলা হয় অবারিত।


বাংলা গদ্য রচনার যাত্রাপথে রামমোহন ও বিদ্যাসাগরের রচনায় তাত্ত্বিক আলোচনার মধ্যেও কোথাও কোথাও ব্যক্তিগত উপলব্ধির স্পর্শ ঘটেছে। এখানে রামমোহনের ‘পাদরি ও শিষ্য সম্পদ’ এবং বিদ্যাসাগরের ‘প্রভাবতী সম্ভাষণে’র স্থানে স্থানে এই ব্যক্তিগত উপলব্ধির চকিত স্পর্শ পাওয়া যাবে। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আত্ম-জীবনী’ প্রমুখ রচনার মধ্যেও তাঁর ব্যক্তিগত উপলব্ধির স্পর্শ পাঠক মন মাঝে মাঝেই লাভ করে লেখককে আপন করে নিতে পারে। হৃদয়ের সঙ্গে হৃদয়ের যোগ গড়ে ওঠে। বিষয় নিষ্ঠার সঙ্গে আত্মনিষ্ঠতা এবং একটা সহজ পরিহাস কুশলতার গুণে রাজনারায়ণ বসুর ‘সেকাল ও একাল' গ্রন্থটি উল্লেখযোগ্য। বাঙালির খোলামেলা মজলিসি মনটি বাইরের পোশাক ত্যাগ করে ঘরোয়া পোশাকে নিজে হাজির হয়েছে ‘হুতোম প্যাঁচার নক্শা'য়। রচনাকার হুতোম অর্থাৎ কালীপ্রসন্ন সিংহ। বিদ্রুপাত্মক রচনা হিসেবে কালীপ্রসন্নের ছোটো ছোটো নক্‌শাগুলির মধ্যে বেশ কয়েকটি সার্থক। তাঁর ‘হুজুক' শিরোনামের অন্তর্গত ‘মহাপুরুষ’ এবং ‘মরুফেরা’ শীর্ষক রচনা দুটি এবং ‘বুজরুকি' শিরোনামের অন্তর্গত 'ভূতনাবানো’ রচনাটির উল্লেখ এই প্রসঙ্গে করা যায়। পরিমিত আয়তনের এই রচনাগুলির মধ্যে একটা উপদেশাত্মক উদ্দেশ্য থাকলেও রচনার যে রসব্যঞ্জনা তা এখানে রয়েছে।


উপন্যাস ছাড়াও বঙ্কিমচন্দ্র নানান জাতীয় গদ্য রচনা লিখেছেন। বঙ্কিমচন্দ্রের পূর্ববর্তী আরও অনেক লেখক গদ্য-চর্চা করেছেন, তা আমরা দেখেছি। কিন্তু বঙ্কিম পূর্ববর্তী বাংলা রচনা-সাহিত্য এবং বঙ্কিমচন্দ্রের রচনা-সাহিত্যের মধ্যে একটা প্রধান পার্থক্য হচ্ছে যে বঙ্কিম পূর্ববর্তী রচনাসমূহ একটা বিশেষ উদ্দেশ্যমূলক তবে সেই বিশেষ উদ্দেশ্যকে নিয়ে রচনাও বহুস্থানে সাহিত্য হয়ে উঠেছে। প্রধানত সাহিত্য সৃষ্টির জন্যই রচনা বাংলা সাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্রেই প্রথম দেখা মেলে। অবশ্য বঙ্কিমচন্দ্রের রচনাই রচনা সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত নয়। লঘু ও গুরু বিষয়ে বঙ্কিমচন্দ্রের যে স্বল্পায়তন প্রবন্ধগুলি রয়েছে তার মধ্যে কয়েকটিকে যথার্থ রচনা-সাহিত্যের লক্ষণাক্রান্ত বলে চিহ্নিত করা যেতে পারে। যথা, 'অনুকরণ', 'ভালবাসার অত্যাচার', 'সঙ্গীত', 'বাহুবল ও বাক্যবল' প্রভৃতি। রচনাগুলিতে জ্ঞান অপেক্ষা মনের পরিচয়ই বেশি করে প্রকাশ পেয়েছে। তাঁর বিশুদ্ধ রচনা সাহিত্যের উদাহরণরূপে ‘কমলাকান্তের দপ্তর' এবং 'লোক-রহস্যে'র কিছু কিছু অংশকে চিহ্নিত করা যেতে পারে। বঙ্কিমচন্দ্রের মধ্যে একটি কবিপ্রবণ, একটি চিন্তাশীল দার্শনিক সত্তা, একটি অকপট স্বদেশভক্ত মন, একটি শুভ্রোজ্জ্বল হাস্যরসিকতা আর একটি অপরাধ-অসহিষ্ণু বীর্যশালী শাসক সত্তা—সব একত্রিত হয়ে একটা সমগ্র সত্তায় যে জেগে উঠেছিল, তারই সামগ্রিক পরিচয় ‘কমলাকান্তের দপ্তর'। বঙ্কিমচন্দ্রের মধ্যে যে একটা লিরিক-ধর্মী কবিপ্রাণ ছিল, তার চমৎকার প্রকাশ ঘটেছে ‘বসন্তের কোকিল’কে উপলক্ষ করে, এ যেন গদ্যভাষায় এক অপূর্ব কবিতা।


বঙ্কিম সমসাময়িক ‘বঙ্গদর্শনে'র লেখকগণের মধ্যে চন্দ্রনাথ বসুর ব্যক্তিগত ঢঙে রচিত ছোটো ছোটো নিবন্ধগুলির রস এখনও উপভোগ্য। এর মধ্যে ‘ফুলের ভাষা' রচনাটিকে সবিশেষ রূপে উল্লেখ করা যায়। রচনাটি গদ্যলিরিক। চন্দ্রশেখর মুখোপাধ্যায় রচিত ‘উদ্ভ্রান্ত প্রেমে'র কথাও একেবারে ভুলে যাওয়া উচিত নয়। জাতি বিচারে গ্রন্থটি লিরিকধর্মী গদ্যকাব্য। হুতোমের পর কলকাতার চলিত গদ্যে যাঁরা মনের দ্রুত প্রকাশ করে গেছেন, তাদের মধ্যে প্রধান হচ্ছেন স্বামী বিবেকানন্দ এবং প্রমথ চৌধুরী।


উনিশ শতকে বাংলা রচনা সাহিত্যের যে যাত্রা শুরু হয়েছিল বঙ্কিমচন্দ্রের হাত পেরিয়ে রবীন্দ্রনাথে এসে তা পরিপূর্ণতা লাভ করল। বিচিত্রগামী রবীন্দ্রপ্রতিভা প্রবন্ধ-নিবন্ধের পসার সৃষ্টিতেও ছিলেন অনলস। আসলে সাহিত্য রবীন্দ্রনাথের কাছে কোনো ‘সাধ্য’ বস্তু নয়, ‘সিদ্ধ’ বস্তু। তাঁর ‘ভাষাতত্ত্ব' সম্পর্কিত আলোচনায় তত্ত্বের কঠিন উপলখণ্ডের মধ্যে অসাধারণ রুক্ষতার ফল্গুধারা আলোচ্য বিষয়কে কঠিনতার পাশ থেকে মুক্ত করেছে। রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ-নিবন্ধ সমূহের মধ্যে শুধু বিষয়বস্তুর মহিমা নয়, প্রকাশভঙ্গি মহিমার আকর্ষণও কম নয়। আর এইটেই সাহিত্যের অংশ। তাই তাঁর প্রবন্ধ-নিবন্ধের শ্রেণিভাগ করতে গিয়ে গহনের মধ্যে পথহারা হবার সম্ভাবনা। যাইহোক, তাঁর ‘পঞ্চভূত’ মূলত রচনা-সাহিত্য। রচনাকৌশল অভিনব। 'বিচিত্র প্রবন্ধ এবং ‘শান্তি নিকেতনে' প্রকাশিত ‘নদী ও কূল’, ‘আত্মবোধ' প্রভৃতি কয়েকটি লেখাকে আমরা খাঁটি সাহিত্যিক রচনা হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি। রচনা-সাহিত্যের অন্তর্গত এইসব রচনাতে আমরা বিশেষ করে দেখতে পাই লেখক কি বলেছেন সেই চিন্তাতেই আমাদের মন একান্ত আবিষ্ট হয়ে ওঠে না–কেমন করে বলেছেন তাঁর কৌতূহল সামান্য নয়।


রবীন্দ্রনাথ ব্যতীত ঠাকুর পরিবারের মধ্যে বিশুদ্ধ রচনা-সাহিত্যের প্রতিভা নিয়ে এসেছিলেন বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর। বলেন্দ্রনাথের ভাব মূলত ভাবাশ্রয়ী হয়ে গদ্য রচনার রূপ গ্রহণ করেছে। তাঁর রোমান্টিক কবি মন নিয়ে লেখা ‘কনারক’, ‘খণ্ডগিরি’, ‘বারাণসী’ বা প্রকৃতিকে কেন্দ্র করে ‘শরৎ বসন্ত' প্রভৃতি প্রায় সব রচনা-সাহিত্য হয়ে ওঠার লক্ষণ বর্তমান। প্রবন্ধ যে গুণে নিবন্ধ বা রচনা-সাহিত্য হয়ে ওঠে অবনীন্দ্রনাথের লেখায় সে গুণ ছিল। বাগীশ্বরী শিল্প-প্রবন্ধাবলির অনেক প্রবন্ধই তার স্বাক্ষর। বীরবল রচনাকার হিসেবে মনটেইনপন্থী। ইউরোপীয় সাহিত্যে বিশুদ্ধ রচনারূপে যে রচনাগুলিকে স্বীকার করা হয়, বীরবলের রচনাগুলি অনেকটা তার সমজাতীয়। 'বীরবলের হালখাতা'য় প্রকাশিত রচনাগুলির মধ্যে এই রচনাধর্ম স্পষ্টরূপে প্রকাশিত। বীরবলের রচনা মূখ্যত এই খেয়ালখুশিতে ‘বাজে কথার ফুলের চাষ।


বর্তমানকালে লেখকগণের মধ্যে ‘অ্যাকাডেমিক’ বিষয়-বিন্যাসরীতির বাহুল্য রম্যরচনার চর্চাকে বা ‘বাজে কথার ফুলের চাষ’ চর্চাকে অনেকখানি ঢাকা দিয়ে দিয়েছে। নামী লেখকগণও প্রবন্ধের ক্ষেত্রে বিষয়াতিরিক্ত স্বাদ ফুটিয়ে তোলবার দিকে তেমন প্রবণতা দেখান না। ফলে ব্যক্তিত্বধর্মী, personal essay বা সৃষ্টিধর্মী নিবন্ধের লেখক অনেক কমে গেছে। তবু একালের বুদ্ধদেব বসু, সুবোধ ঘোষের সাহিত্য ও অন্যান্য বিষয়ক আলোচনায় বিচিত্র কৌতূহলী মানসিকতা ও ব্যক্তিত্বের স্বাদ পাওয়া যায়। এ ভিন্ন অন্নদাশঙ্কর রায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সৈয়দ মুজতবা আলী, পরিমল রায়, বিপ্রমু (বিমলাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়), যাযাবর, শংকর, তপন মোহন চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ বেশ কিছু লেখকের রচনায় এই ব্যক্তিগত, ব্যক্তিত্বময় রচনার আস্বাদ পাওয়া যায়।